দুআর কারিশমা
বন্ধুরা! আমরা যখন অসুস্থ হই আল্লাহই আমাদের শেফা দান করেন। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর কওমকে যখন মূর্তিপূজার অসারতা বুঝাচ্ছিলেন; তাদেরকে বলছিলেন- দেখ, তোমাদের হাতেই মাটি দ্বারা তৈরি এ মূর্তিগুলোর কাছে তোমরা প্রার্থনা কর; তারা তো তোমাদের প্রার্থনা শুনতে পায় না। শুনবেও বা কীভাবে; ওরা তো তোমাদের হাতের তৈরি মাটির বস্তু, যেমন তোমরা মাটি দিয়ে হাড়ি-পাতিল ইত্যাদি বানাও। হাড়ি-পাতিল যেমন জড়বস্তু, কোনো কিছু শুনতে পায় না, এগুলোও তেমন। সুতরাং প্রার্থনা ঐ রবের কাছে করতে হবে, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাদের রিযিক দেন। যিনি আমাদের সব দুআ শোনেন ও আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন-
وَإِذا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ.
এবং যখন আমি অসুস্থ হই তখন তিনিই আমাকে শেফা দান করেন-সুস্থ করেন। [সূরা শুআরা (২৬) : ৮০]
আমরা মুসলিম। ইবরাহীম আলাইহিস সালামও মুসলিম ছিলেন। তিনিই মুসলিম জাতির পিতা। তিনিই এ জাতির নাম রেখেছেন মুসলিম। ফলে আমরাও তাঁর মত বলি- ‘এবং যখন আমি অসুস্থ হই তখন তিনিই (আল্লাহই) আমাকে শেফা দান করেন-সুস্থ করেন।’ ফলে আমরা অসুস্থ হলে আল্লাহ্র কাছেই সুস্থতা চাই। আর আল্লাহ আমাদের সুস্থতা দান করেন। আজ আমি তোমাদের এমনই একটি কাহিনী শোনাব; আল্লাহ্র কাছে মন থেকে দুআ করলে আল্লাহ কীভাবে কবুল করেন এবং কত কঠিন রোগ থেকেও তিনি আমাদের সুস্থ করে দেন। চলো শোনা যাক সেই কাহিনী-
ছোট্ট শিশু আমাতুল্লাহ। দেখতে খুবই সুন্দর। ফুটফুটে। নাদুসনুদুস। বাড়ি সৌদি আরবের দাম্মামে। দাম্মামের অনেক বড় এক ধনী শায়েখের একমাত্র মেয়ে সে। আমাতুল্লাহ্র চার বছর পূর্ণ হয়েছে। ধীরে ধীরে সে বড় হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে ঘরের সবাই খুশি থাকার কথা। কিন্তু না, কারও মুখে হাসি নেই। কোনো আনন্দ নেই। ঘরে কোনো কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ নেই। সবকিছু থমথমে। সবার চেহারায় মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। বিষণ্ন সবাই। কারণ একটাই- আমাতুল্লাহ আজ চার বছর পরেও হাঁটতে পারে না। এমনকি বসতেও পারে না। কথাও বলতে পারে না। অথচ এ বয়সে তার খেলাধুলা করার কথা। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখার কথা। কিন্তু আমাতুল্লাহ শান্ত-নিথর, তাকে বিছানায়ই শুয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ।
ধনী শায়েখ মেয়েকে দেশ-বিদেশের অনেক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছেন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটেছেন। কোনো কাজ হয়নি। আমাতুল্লাহ হাঁটা তো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত কোমর সোজা করে বসতে পারে না। শায়েখ হতাশ হয়ে পড়লেন। মন ভেঙে গেছে তার। কী করবেন ভেবে পান না। প্রিয় আদরের নয়নমণির এমন নীরবতা সইতে পারেন না। মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছেন তিনি। নীরবে অশ্রু ঝরিয়েছেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। হঠাৎ একদিন তার মনে পড়ে পবিত্র কুরআনের একটি বাক্য। বাক্য নয়, যেন আলোর রেখা- ‘লা তাক্বনাতূ মির রাহমাতিল্লাহ’-ওহে বান্দা! আল্লাহ্র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না!
শায়েখ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, দুনিয়ার কারও কাছে গিয়ে কিছু হয়নি, তাই তাঁর কাছেই যাবেন, যাঁর কাছে গেলে সবকিছু হবে। যিনি কাউকে হতাশ করেন না। কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। শায়েখ পরিবারের কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মোবাইল বন্ধ করে দিলেন। দাম্মাম থেকে সোজা চলে এলেন মাক্কাতুল মুকাররামায়। মহান রাব্বুল আলামীনের ঘর বায়তুল্লাহ্য়। কাবার চত্বরে, মহামহিমের দরবারে।
ভাঙা মন নিয়ে উমরাহ করলেন। বিগলিত হৃদয়ে তাওয়াফ করলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে সায়ী করলেন। মাকামে ইবরাহীমে এসে দুই রাকাত নামায পড়লেন এবং দু’হাত তুললেন। হৃদয়ের সব আবেগ, অনুভূতি এবং মিনতি আজ কোত্থেকে যেন হাজির হল। চোখ বেয়ে আজ যেন অশ্রুর ফোয়ারা বইছে। শায়েখ অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। বলতে শুরু করলেন, ‘ওগো আমার আল্লাহ! ওগো রাব্বুল আলামীন! আপনার দেয়া নিআমত আমার মেয়েকে নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছি। হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরেছি। মাবুদ গো, সবাই ব্যর্থ হয়েছে। যারা সুস্থতার মালিক না, অসুস্থতার মালিক না, তাদের কাছ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি; তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। হে আল্লাহ! আপনিই তো সুস্থতার মালিক। আপনিই অসুস্থতার মালিক। আপনি বান্দাকে সুস্থ করতে পারেন। আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আপনি আমার মেয়েকে সুস্থ করে দিন। তাকে হাঁটার শক্তি দিন। এক অসহায় পিতার ফরিয়াদ কবুল করুন হে আল্লাহ...!’
আমাতুল্লাহ্র বাবা এভাবে তিন দিন পড়ে থাকলেন কাবার চত্বরে। কাবা শরীফের গিলাফ ধরে, হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে, যমযমের পারে, মাতাফে, সাফা-মারওয়ায় আরোহণ করে অনেক কাঁদলেন। অনেক দুআ করলেন। এত কান্না শায়েখ কখনও করেননি। এত অশ্রু কখনও তাঁর চোখ থেকে ঝরেনি। অবশেষে তাঁর ব্যথিত হৃদয় শান্ত হল। চোখের অশ্রু মনের ব্যথা ধুয়ে দিল। হৃদয়ে প্রশান্তির পরশ অনুভব করলেন। তিনি জানেন না- আমাতুল্লাহ কেমন আছে। এ কয়দিন বাড়িতে যোগাযোগ নেই। দুনিয়ার কারও সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। একমাত্র যোগাযোগ রাব্বুল আলামীনের সাথে।
তিন দিন পর দাম্মামে ফিরে আসেন শায়েখ। মনে আশা-নিরাশার ঝড় বইছে। ঘরে গিয়ে মামণীকে কী অবস্থায় দেখবেন! সে কি এখনও আগের মতো নিথর হয়ে শুয়ে আছে, নাকি আল্লাহ তার চোখের পানির লাজ রেখেছেন! তাঁর দুআয় সাড়া দিয়েছেন! গভীর রাত। ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন শায়েখ। ঘরের সবাই ঘুমিয়ে আছে এখন। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেলে চাপ দিলেন। বুক ধড়ফড় করছে। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে দরজা খুলল। শায়খ কাউকে দেখলেন না। হঠাৎ দরজার পিছন থেকে শিশু কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল- ‘ইয়া আবাতী!’ আব্বাজান! মুহূর্তের জন্য শায়েখ থমকে গেলেন। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। আরে, এ যে আমাতুল্লাহ! সে-ই পিতাকে হেঁটে এসে দরজা খুলে দিয়েছে! ঘরের সবাই তখনও ঘুমোচ্ছে। শায়খ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমাতুল্লাহকে কোলে তুলে নিলেন। অনেকক্ষণ বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। তাঁর দ্’ুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরছে। এ অশ্রু কষ্টের নয়, আনন্দের। কিছু হারাবার নয়, ফিরে পাওয়ার। সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন শায়েখ। কৃতজ্ঞতার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। মহান রাব্বুল আলামীন তার ডাকে এভাবে সাড়া দেবেন, তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। বান্দার দুআ আল্লাহ এভাবে কবুল করেন! বান্দার ডাকে আল্লাহ এভাবে সাড়া দেন! বান্দাকে এভাবে মায়া করেন! ফা-লাকাল হাম্দু কুল্লুহু ইয়া আরহামার রাহিমীন!
এ ঘটনার কিছুদিন পর দাম্মামের ওই শায়েখ নিজের জীবনের এ সুন্দর সত্য গল্পটি দাম্মামের মাদীনাতুয যাহরানে অবস্থিত ‘মসজিদে আমেনা বিনতে আবদুর রহমান আসসাঈদ’-এর বাংলাদেশী ইমাম মাওলানা সা‘দুল্লাহ সিদ্দীকীর কাছে খুলে বলেন। আমি এই ইমাম সাহেবের কাছেই গল্পটি শুনেছি।