বাইতুল্লাহর ছায়ায় (৬)
Mawlana Abu Taher Mesbah
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হেজাযের আকাশে ঈদের চাঁদ দেখার কথা ছিলো জীবনের প্রথম সফরে। হয়নি আমারই নির্বুদ্ধিতার কারণে। সেই চাঁদ এবার দেখা হলো। ঈদের চাঁদ এত সুন্দর হয়! কিসের সঙ্গে হতে পারে এ সৌন্দর্যের তুলনা! লায়লার, কিংবা হূরানে জান্নাতের ঠোঁটের হাসি !
ঈদের চাঁদ দেখে কারো চোখে পানি আসে না, আমার চোখে পানি এলো। জানি না, কী ছিলো সেই চোখের পানির রহস্য! আনন্দের আতিশয্য, না মনের গোপন কোন কষ্ট! আল্লাহকে শুধু বললাম, হে আল্লাহ! মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান কেউ কাছে নেই। এটা আমার জীবনের প্রথম নিঃসঙ্গ ঈদ। হে আল্লাহ, যার কেউ নেই তার তুমি আছো। আজ ঈদের আনন্দের দিনে হে আল্লাহ, তুমিই আমার দয়ালু মেযবান, আমি তোমার গোনাহগার মেহমান!
হারাম শরীফে ঈদের জামা‘আত হয় খুব সকালে। ফজরের পর মুছল্লীরা বসেই থাকে; ঈদের জামা‘আত পড়ে তবে বের হয়। সেদিন ঈদের জামা‘আতে আমার মন যে কেমন করেছিলো! কেউ নেই, তবু যেন সব আছে! নিঃসঙ্গতার মধ্যেও কার যেন সঙ্গ আছে! আমার জন্য কোথাও যেন কিছু আয়োজন আছে! তাহলে কত ভাগ্যবান আমি!
নিজেকে ভাগ্যবান তুমিও ভাবতে পারো। কারণ আমরা প্রত্যেকে আল্লাহর জন্য, আর আল্লাহ আমাদের প্রত্যেকের জন্য! যার অনুভব যত গভীর আল্লাহ তার তত আপনার!
আমি তখন মাতাফে, সামনে আল্লাহর ঘর, উপরে নীল আসমান। অশরীরী কারা যেন ঝালর দুলিয়ে বাতাস করে! ঝিরঝির বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে যায়!
ইমামুল হারামের কণ্ঠে একটু পর পর ধ্বনিত হয়, আর লক্ষ কণ্ঠে তা হয় প্রতিধ্বনিত, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
ঈদের তাকবীর কত শুনেছি, কত পড়েছি! কিন্তু আজকের তাকবীর যেন জান্নাতের সুর-সঙ্গীত!
জামা‘আত শুরু হলো; মসজিদুল হারামে আমার জীবনের প্রথম ঈদের জামা‘আত! আহা কী শান্তি! কী প্রশান্তি! আজ হারামে ঈদের জামা‘আতে অতিরিক্ত তাকবীরগুলো যেন অন্যরকম অনুভূতি এনে দিলো। প্রতিটি তাকবীরের সঙ্গে আমার ভিতর থেকে যেন কে বলে ওঠে, আমি হাযির! আমি হাযির!
এবং আমার হাযিরি যেন কবুল হলো! এখানে ঈদের কোলাকুলি নেই, কিন্তু আসমান থেকে যারা নেমে এসেছে তাদের সঙ্গে যেন কোলাকুলি হলো!
জীবনে বহু ঈদে খতীবের মুখে শুনেছি, ইয়া মালাইকাতী, মা জাযাউ আবীদিন...! কিন্তু আজ যেন শুনলাম নতুন ভাব ও অনুভবের সঙ্গে। নিজেকে এমন করে মজুরি পাওয়া শ্রমিক আগে তো আর কখনো ভাবা হয়নি! আজ আমার কী হলো, সবকিছু মনে হয় শুধু আমার জন্য!
জামা‘আতের পর মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে হারাম থেকে বের হলাম। হাঁ মুক্তির আনন্দে! কারণ আল্লাহ তো ফিরেশতাদের সাক্ষী করে বলেছেন, আমি আমার রোযাদার বান্দাদের মাফ করে দিলাম! আকাশের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, আমার ঈদের দস্তরখান কোথায় সাজিয়েছো হে আল্লাহ! সামনে হাতের ডানে দেখি, ‘মাত‘আমুল-মাদীনাহ’! কেন জানি মনে হলো, আমার করীম মেযবান এখানেই সাজিয়েছেন আমার দস্তরখান! সেখানেই প্রবেশ করলাম।
যারা খাবার পরিবেশন করলো তারা যে আচরণ করলো, আমার কাছে তা ছিলো গৌণ। কারণ তারা তো হলো গায়বকে আড়াল করার পর্দা। আমি তো আজ ঈদের দিনে আল্লাহর ঘরে বেড়াতে আসা মেহমান! সুতরাং আমার খাবার তো পরিবেশন করছে ... নাহ, কলমের সংযম এখনো বোধহয় শেখা হলো না! তুমি মাফ করো হে আল্লাহ!
***
‘সব দুঃখের শেষ আছে এবং সব আনন্দের আছে অবসান।’ এ সত্য আবার সত্য হলো আমার জীবনে। আল্লাহর ঘর থেকে বিদায় গ্রহণের দিন এসে গেলো। ঈদের দু’দিন পর বিষণ্ন হৃদয়ে বিদায় তাওয়াফ করলাম এবং অশ্রুসিক্ত চোখে আল্লাহর ঘরকে ‘আলবিদা’ জানালাম। আল্লাহর ঘর থেকে বিদায় গ্রহণের বেদনাবিধুর মুহূর্ত আমার জীবনে আরো এসেছে, কিন্তু আজকের বিদায় যেন অন্য কিছু; এমন কিছু যা শুধু হৃদয়ের নিভৃতে অনুভব করা যায়, শব্দের অবয়বে প্রকাশ করা যায় না! শুধু এইটুকু বলা যায়, আল্লাহর ঘর যেন বিদায় দিলো না!
কিন' বাইরের মজবূরি কখনো ভিতরের আকুতি শোনে না। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। মজবূরি আমাকে নিয়ে এলো জেদ্দায়, যদিও বিমান আমাদের আগামীকাল।
সন্ধ্যায় লোহিত সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে বিষণ্ন সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখলাম! এ যেন আমার হৃদয়াকাশের সূর্যাস্তের প্রতিচ্ছবি! আমারই মনের কষ্টগুলো যেন ছড়িয়ে পড়লো দিগন্তের লাল আভায়, যার প্রতিফলন ঘটেছে লোহিত সাগরের জলে!
বিরহের কষ্ট আছে, তাই বলে এত কষ্ট! বিচ্ছেদে বেদনা আছে, তাই বলে এমন বেদনা! রাত ভোর হলো শুভ্র-সুন্দর শয্যায় শুধু ছটফট করে। চোখ দু’টো লেগে আসে, আর কে যেন কাছে আসে, একটি বিষণ্ন অনুযোগ ভেসে আসে, ‘এ ভুল কেন করলে?!’
ভোর হলো, আযান হলো, ফজর হলো, আমার অস্থিরতা দূর হলো না। কিসের অস্থিরতা তাও বুঝতে পারি না। মহিউদ্দীন জালাল- আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন- কী বুঝলেন জানি না, বললেন, চলুন, আজ আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে আপনার দ্বিতীয় সফর হোক। বিমানবন্দরে যেতে হবে চারটায়, আমরা ইনশাআল্লাহ সময়মত পৌঁছে যাবো।
কী বলে যে তার প্রতি অন্তরের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো! শুধু বললাম, জাযাকাল্লাহ! আমরা ভেবেছিলাম, মেযবান ঘুমিয়ে আছেন; না, তিনি জেগে ছিলেন, উঠে বসে বললেন, আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে কেন! চলুন আমার গাড়ীতে!
অনেক চেষ্টা করেও তাকে নিরস্ত করা গেলো না, সুতরাং কষ্ট দিতেই হলো। কষ্ট পেয়ে কেউ যদি আনন্দ পায়, তাকে কষ্ট না দিয়ে উপায় কী!
নতুন ইহরামে, নতুন আনন্দে নতুন সফর শুরু হলো। ঝড়ের গতিতে গাড়ী ছুটে চললো আবার মক্কার পথে। মিসফালায় হারামের খুব কাছে তখন যে সবুজ পোলটি ছিলো, সেখানে গাড়ী থামলো। সবকিছু আমার কাছে তখন স্বপ্নের মত! স্বপ্নের মতই ছিলো কালকের বিদায় নেয়া, স্বপ্নের মতই হলো আজকের ফিরে আসা! মাঝখানে বিচ্ছেদ-বেদনায় দগ্ধ একটি রাত! যা কিছু হয় আমার আল্লাহর হুকুমেই হয়। হারাম শরীফে প্রবেশ করলাম। আবার দুরু দুরু বুকে নতুন আনন্দে, আবেগের নতুন তরঙ্গে উদ্বেলিত হয়ে অবনত দৃষ্টি উত্তোলন করে আল্লাহর ঘর অবলোকন করলাম! চোখের তারায় আল্লাহর ঘরের নতুন ছবি ধারণ করলাম।
এ জন্যই কী কাল মনে হয়েছিলো, আমি বিদায় নিলাম, কিন্তু আল্লাহর ঘর যেন বিদায় দিলো না! গায়বের রহস্যলীলা গায়বের মালিক শুধু জানেন। আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ এবং ছাফা-মারওয়ার সাঈর মাধ্যমে আবার নতুন ওমরা হলো; নতুন তৃষ্ণার নতুন আকুতি নিয়ে আবার যামযাম পান করা হলো। যা কল্পনায়ও ছিলো না তা-ই আল্লাহ মেহেরবান দান করলেন। দাতা যখন দান করেন এভাবেই দান করেন। তবু বান্দা শোকর আদায়ে কার্পণ্য করে!
মোটকথা, এই সফরের শুরু থেকে শেষ, আমার জন্য ছিলো অন্যরকম অনুভব-অনুভূতি এবং অন্যরকম তৃপ্তি ও প্রাপ্তি। মক্কা শরীফে বাইতুল্লাহর তাওয়াফে এবং মদীনা শরীফে রাওযাতুন্-নবীর যিয়ারাতে শুধু শান্তি, আর শান্তি! রিয়াযুল জান্নায় এবং মুলতাযামে শুধু প্রশান্তি, আর প্রশান্তি! ইফতারের খেজুরে এবং যামযামের পানিতে শুধু তৃপ্তি, আর তৃপ্তি! সবকিছুতে যেন প্রাপ্তি, আর প্রাপ্তি!
বিশেষ করে ইফতারের আগে এবং সেহরীর সময় হারামের আকাশ থেকে যেন ঝিরঝির করে ঝরতো অন্যরকম কিছু আশ্বাস ও সান্ত্বনা! অদৃশ্যলোক থেকে যেন ভেসে আসতো, ‘চাও বান্দা! যা ইচ্ছা চাও। যা চাইবে তার চেয়ে বেশী পাবে; এত বেশী যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।’
আমার আল্লাহর আশ্বাসবাণী সত্য ছিলো। সত্যই তো হবে! দু’হাত পেতে যা কিছু চেয়েছি, আল্লাহ তা দান করেছেন। চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশী দান করেছেন।
ঐ সফরে মুলতাযামে আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ! তোমার ডাকে প্রতিবার আমি একা আসি এবং একা একা সব নেয়ামত ভোগ করি। তাতে আমার যে কষ্ট হয় হে আল্লাহ!
তুমি তাওফীক দাও, আগামীবার স্ত্রী-সন্তান সবাইকে নিয়ে যেন তোমার ঘরে আসতে পারি! একসঙ্গে যেন তোমার ঘর যিয়ারাত করতে পারি। একসঙ্গে যেন তোমার হাবীবের রওযায় হাযির হতে পারি।’
যখনই এ দু‘আ করেছি, একটি আশ্বাস ও সান্ত্বনার শীতল পরশ অনুভব করেছি এবং আমার বিশ্বাস হয়েছে, আল্লাহর তাঁর গোনাহগার বান্দার দু‘আ কবুল করেছেন।
কোন যাহেরী আসবাব ও উপায়-উপকরণ তো আমার ছিলো না, তবু হৃদয়ের গভীরে বিশ্বাস ছিলো, ইনশাআল্লাহ, আগামীবার অবশ্যই আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর ঘরে আনবেন। কীভাবে, জানি না; শুধু জানি, তাঁর কুদরতের ভাণ্ডারে কোন কিছুর অভাব নেই। তিনি শুধু ‘কুন’ বলেন, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায়, আর আল্লাহর কুদরতের কারিশমা দেখে বান্দা শুধু সিজদায় লুটিয়ে পড়ে।
সফর থেকে মেয়েদের জন্য কালো ও সবুজ উড়না এনেছিলাম, আর ছেলের জন্য ‘ছোট্ট’ ইহরাম। আল্লাহর রহমতের ভরসায় আমি তাদের বলেছিলাম, আগামীবার ইনশা‘আল্লাহ তোমরাও যাবে আল্লাহর ঘরে। আমি মুলতাযামে তোমাদের জন্য দু’আ করেছি, আর আমার বিশ্বাস, বান্দার দু‘আ তিনি কবুল করেছেন।
‘খোদা তোমায় ডাকতে জানি না’- এ যে কত বড় সত্য উচ্চারণ তা হয়ত আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। কবি তো বলেছেন, ‘ডাকার মত ডাকলে খোদা কেমনে শোনে না’, কিন্ত হাকীকত এই যে, আল্লাহর দয়া ও রহমত ডাকার মত ডাকেরও অপেক্ষা করে না। শুধু ডাকলেই হলো, ‘ইয়া রাব্ব!’ অমনি দয়ালু মাওলার জওয়াব আসে, ‘লাব্বাইকা ইয়া আবদী!’ কিন্তু আমরা তো ডাকতেও ভুলে যাই। এমনকি ডাকতে না পারার অনুতাপ ও লজ্জাটুকুও থাকে না আমাদের অন্তরে, থাকে শুধু শেকায়াত ও অনুযোগ।
আল্লাহ তাঁর গোনাহগার বান্দার লাজ রক্ষা করেছিলেন; বরং বলা ভালো আল্লাহ তাঁর রহমতের লাজ রক্ষা করেছিলেন। পাঁচবছর পর তিনি আমাদের সবাইকে নিয়েছিলেন তাঁর ঘরে।
কীভাবে? অনেক দ্বিধা-সংশয়ের পর এখন মনে হচ্ছে, ‘তাহদীছে নেয়ামত’-এর আসমানি তা‘লীমের উপর আমল করে আল্লাহর গায়বী মদদের বয়ান যদি তুলে ধরি ইনশাআল্লাহ কল্যাণকরই হবে। হে আল্লাহ! সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে তুমি হিফাযাত করো, আমীন।
***
আল্লাহর ঘর থেকে ফিরে আসার পর দু’বছর পার হলো। আমি বসে আছি আমার বিশ্বাস এবং আসমান থেকে পাওয়া আশ্বাস সম্বল করে; তবে দুনিয়া তো দারুল আসবাব। বান্দাকে আসবাব তালাশ করতেই হয়। সেটাই শরীয়াতের বিধান। কিন্তু আমার অবস্থা হলো, যতই চেষ্টা করি, কোন উপায় দেখি না। অথচ ঘরে স্ত্রী-সন্তানেরা খুশিতে আত্মহারা, তারা আল্লাহর ঘরে যাবে, আল্লাহর ঘর দেখবে; সোনার মদীনায় যাবে, নবীর রাওযা যিয়ারাত করবে!
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ আল্লাহর এক বান্দার সঙ্গে পরিচয় হলো এবং ধীরে ধীরে অন্তরঙ্গতা হলো। আমরা পরস্পর দ্বীনী ভাই হলাম। দ্বীনী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক যে কত পবিত্র ও সুন্দর হতে পারে তার জীবন- নমুনা হলেন আমার প্রিয় নাজমুল করীম ভাই ও আনওয়ার ভাই। আল্লাহ তাদেরকে এবং আমার প্রত্যেক দ্বীনী ভাইকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।
ভাই নাজমুল কারীমই হলেন সেই ভালো মানুষটি যাকে পর্দা করে নেমে এসেছিলো আল্লাহ তা‘আলার গায়বী মদদ।
পাঁচবছর পার হতে তখনো কয়েক মাস বাকি। আমার ভিতরে তখন অন্যরকম এক ব্যাকুলতা ও অসি'রতা। এবার তো আমি নিজেই শুধু স্বপ্ন দেখিনি, আরো কিছু হৃদয়কে স্বপ্ন দেখিয়েছি এবং আল্লাহর রহমতের ভরসা দিয়েছি! কিন্তু উপায়!
একটি করে দিন যায়, আর ভিতরের ব্যাকুলতা ও অসি'রতা বাড়ে, বাড়তেই থাকে। তবে আশা ও আশ্বাসের আলোকরেখা হৃদয়কে তখনো আলোকিত করে রেখেছে।
একদিন স্বপ্নে দেখি, না, ঠিক বলা হয়নি। আমি স্বপ্ন দেখিনি, আমার মাওলা আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, নাজমুল কারীম ভাই সপরিবারে আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হয়েছেন। আমার অন্তরে আবেগের এমন ঢেউ জাগলো যে, জারজার হয়ে কাঁদলাম। মনে হলো, নাজমুল কারীম ভাই আমার ভিতরের আবেগ বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, চিন্তা করবেন না, আপনাকে আমি চিকিৎসার জন্য মাদরাজ পাঠাবো।
তাতে আমার কান্না যেন আরো উথলে উঠলো। বললাম, এটাই বুঝি ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ইনছাফ! আপনি যাবেন আল্লাহর ঘরে, আমাকে পাঠাবেন মাদরাজ!
তখন তিনি বললেন, ঠিক আছে, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে আল্লাহর ঘরে।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম এবং শোকর আদায় করে বললাম, এটাই না হলো ভাইয়ের মত কথা! পকেটে হাত দিয়ে দেখি, পাঁচ হাজার টাকা; সেটা তার হাতে দিয়ে বললাম, এই নিন রাহাখরচ। ইনশাআল্লাহ আরো দেবো।
কী পবিত্র ও মধুর স্বপ্ন! মুমিনের স্বপ্ন, হোক সে গোনাহগার, হাদীছ শরীফে তার বড় মরতবা বয়ান করা হয়েছে। জাগরণের স্বপ্ন পূর্ণ করার জন্য মুমিনকে এভাবে আল্লাহ ঘুমের স্বপ্ন দেখান। স্বপ্নের মাধ্যমে তাকে ‘স্বপ্নপূরণের’ রাস্তা বাতলে দেন।
এ স্বপ্ন দেখার পরদিন বা‘দ মাগরিব বলা নেই, কওয়া নেই নাজমুল কারীম ও আনওয়ার ভাই এসে হাজির। তখন মনে হলো, এ নিশ্চয় আমার মাওলার ইশারা। আমি দ্বিধা-সংকোচ না করে স্বপ্নের কথা তাকে বললাম, আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, ‘আলহামদু লিল্লাহ! আমরা তো আগেই নিয়ত করেছি, আগামী রামাযানে আল্লাহর ঘরে যাওয়ার, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে।’
গতকাল কেঁদেছিলাম স্বপ্নে, আজ কান্না এলো জাগ্রত অবস্থায়। দয়াময় কতভাবেই না বান্দার সঙ্গে দয়ার আচরণ করেন!
‘আলহামদু লিল্লাহ! জাযাকাল্লাহ’ বলে আমি সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত দিলাম। তিন হাজার টাকা ছিলো। তিনি কিছুতেই নেবেন না। আমি জোর করে তার হাতে দিয়ে বললাম, স্বপ্নে যা দেখেছি তাই পালন করছি এবং স্বপ্নে যেহেতু বলেছি, ইনশাআল্লাহ আরো দেবো সেহেতু যখন যা পারি দিতে থাকবো। আপনি তা কবুল করলে ইনশাআল্লাহ উভয়েরই কল্যাণ হবে।
বান্দার দিল তো! দুর্বলতা এসে গেলো। ইয়া আল্লাহ, এ কী হলো! তুমি দেখি শুধু আমার ইনতিযাম করছো! আমি না মিনতি জানালাম, সবার জন্য ‘ডাক’ পাঠাতে! আমি না ফরিয়াদ করলাম সবাইকে লাব্বাইক বলার তাওফীক দিতে!
আমি তো তোমার রহমতের উপর ভরসা করে তোমার বান্দা-বান্দীকে খোশখবর দিয়ে দিয়েছি। এখন কী হবে! কেমন হবে! তুমি কি হে আল্লাহ, বান্দার লাজ রক্ষা করবে না!
আবার নিজেই মনকে বুঝ দিয়ে বলি, অস্থির হও কেন? তুমি শুধু তোমার বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকো। দাতা যখন আশ্বাস দিয়েছেন, দান অবশ্যই করবেন। কীভাবে, তা তো তোমার চিন্তার বিষয় নয়!
রামাযান প্রায় এসে গেলো, আমার অস্থিরতা তখন চূড়ান্তে উপনীত হলো। আর যেন সহ্য হয় না। আর কবে হে আল্লাহ!
একদিন নাজমুল কারীম ভাই আমার পাসপোর্ট চেয়ে নিলেন। তখন আম্মা-আব্বাকে জানালাম আল্লাহর ঘরে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা। তাঁরা খুশী হলেন এবং দু‘আ দিলেন।
স্ত্রী যখন জানলেন, আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যা কখনো আমি ভোলবো না। কী ছিলো তার চোখের তারায়! বিস্ময়! বিষণ্নতা! বেদনার ছায়া! কিংবা অন্য কিছু! আমি কিছুটা কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললাম, আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখো, নিশ্চয় তিনি আমাদের সবার ব্যবস্তা করবেন। কীভাবে, জানি না, তবে অবশ্যই করবেন।
তিনদিন পর নাজমুল কারীম ভাইয়ের ফোন। কোন ভূমিকা ছাড়াই বললেন, ভাই, আপনি যাবেন, তো ভাবীকে নেবেন না! ভাবীকেও নিয়ে চলুন।
আমি আসমানের দিকে তাকাই, আর বলি, আলহামদু লিল্লাহ!
কয়েক দিন পর তিনি বললেন, মুহম্মদ তো খুব ছোট। ওকে কার কাছে রেখে যাবেন? ওকেও নিয়ে চলুন।
আমি আবার আসমানের দিকে তাকাই, আর বলি, আলহামদু লিল্লাহ!
সেদিন সারাদিন আশ্চর্য এক ভাবতন্ময়তার মধ্যে ছিলাম। চারপাশে কত মানুষ, অথচ আমি যেন এক নির্জন অরণ্যে বিচরণ করছি। আল্লাহর সঙ্গ ছাড়া আর সব সঙ্গ যেন আমি বর্জন করতে পেরেছি। সারা অন্তর দিয়ে আল্লাহর দয়া ও করুণার স্বাদ অনুভব করছি, আর বলছি, হে আল্লাহ! তোমার ‘বান্দানেওয়াযির’ আন্দায আমার বড় ভালো লাগছে। আমি এর শেষটুকু দেখতে চাই হে আল্লাহ! তাওফীক দাও হে আল্লাহ, আমি যেন তোমার হতে পারি এবং তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারি।
সময় বয়ে যায়। আমি নিজে থেকে কিছু বলি না, শুধু প্রতীক্ষার প্রহর গুনি আল্লাহর শানে করমের চূড়ান্ত প্রকাশের। আমার তখন স্থির বিশ্বাস, যিনি এতটুকু দেখিয়েছেন তিনি বাকিটুকুও দেখাবেন। অসি'র প্রতীক্ষা শুধু, কীভাবে দেখাবেন তা জানার জন্য।
আল্লাহর রহমত নেমে এলো একই পথে, একই ভাবে। নাজমুল কারীম ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়। কারণ আমার পরিপার্শ্ব তখন এতটাই কষ্টদায়ক ছিলো যে, নির্জনতার সন্ধানে প্রতিদিন সকালে আমি চলে যেতাম তার মনিপুরী পাড়ার বাড়ীতে। একটি কামরায় একেবারে নিরিবিলি পরিবেশে লিখতাম, আর সন্ধ্যায় ফিরে আসতাম। একদিন তিনি বললেন, ভাই, সাফফানাকে আর একা রেখে যাবেন কেন! ওকেও নিয়ে চলুন।
বান্দা তখন আর কী বলতে পারে শোকর আলহামদু লিল্লাহ ছাড়া!
অন্তরের অন্তস্তল থেকে নাজমুল কারীম ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। কারণ আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। আল্লাহ যাকে অছীলা করে নেয়ামত দান করেন তার শোকর আদায় করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই শোকর আদায় করা।
তবে নাজমুল কারীম ভাইকে বললাম, আপনার সবকথা আমি খুশিমনে এবং কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করেছি, আপনি আমার একটি কথা রক্ষা করুন; সফরের সমস্ত রাহাখরচ করয হিসাবে থাকবে, আমি ধীরে ধীরে তা আদায় করবো। অনেক কষ্টে তাকে এ শর্তে রাজি করাতে পারলাম, যদিও পরে তিনি শর্তটি পুরোপুরি রক্ষা করেননি।
যাই হোক, আল্লাহর রহমতে একে একে সবার ইন্তিযাম হলো। বাকি থাকলো শুধু বড় মেয়ে লোবায়না, তার সম্পর্কে নাজমুল কারীম ভাই কিছু বললেন না। আসলে তিনি তো বলার কেউ নন; যা কিছু হয় তা তো গায়বের আড়াল থেকে হয়, আর গায়বের রহস্য তো জানেন শুধু গায়বের মালিক। একে একে মা, ভাই ও বোনের ব্যবস্থা হলো, আর সে দিল থেকে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে গেলো। তার মুখমণ্ডলের উদ্ভাস ছিলো অমলিন। বাইতুল্লাহর সফরে তার নাম যে এলো না, সে জন্য তার মুখমণ্ডলে কোন মেঘের ছায়া দেখা গেলো না। ভাই-বোনের আনন্দ যেন তারই আনন্দ! তাদের সৌভাগ্য যেন তারই সৌভাগ্য! ‘বড় বোন মায়ের সমান’ এ সত্য আমার সামনে সেদিন নতুন করে উদ্ভাসিত হলো। সারা অন্তর দিয়ে আমি তার সৌভাগ্য কামনা করলাম, আর প্রতিজ্ঞা করলাম, যেভাবেই হোক বড় মেয়েকে আমি সঙ্গে নেবো।
পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত জমা দেয়ার সময় তাকে বললাম, ‘আম্মু! তুমিও চলো। আমি তো তোমার জন্যও দু‘আ করে এসেছি। ইনশাআল্লাহ তোমারও ইন্তিযাম হয়ে যাবে।’
ওর বাচ্চার বয়স তখন দেড় বছর। আমি বললাম, ‘তোমার আম্মু সঙ্গে আছেন, বাচ্চা নিয়ে তোমার কোন কষ্ট হবে না।’
ভেবেছিলাম, মেয়ে আমার খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাবে, কিন্তু না, সে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘তোমরা যাও, ইনশাআল্লাহ আমি পরে যাবো।
আমি তো অবাক! বলে কী মেয়ে! আমি যত করে বলি, সে নত মুখে, শান্ত স্বরে একই কথা বলে, ইনশাআল্লাহ আমি পরে যাবো।
আমি ভাবলাম, ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছে না, কিন্তু ওর মা বললো, ‘হয়ত ওর ইচ্ছা, যখন যাবে, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে যাবে।’
আচ্ছা! আমার মেয়ে তাহলে এমন করেও ভাবতে পারে! এটা তো অনেক বড় কথা! আল্লাহর ঘরের সৌভাগ্য অর্জনের সময়ও যে স্ত্রী স্বামীর কথা ভাবে এবং স্বামীর জন্য ইন্তিযার করে সে তো আসলেই বড় লক্ষ্মী স্ত্রী! অথচ আমার চারপাশে এমন কত দেখি, বারবার আল্লাহর ঘরে যায়, একবারও ভাবে না, এবার অন্তত স্ত্রীকে সঙ্গে নেয়ার চেষ্টা করি।
সেদিন যেন মেয়েকে আমি নতুন করে চিনলাম এবং তার লাজনম্র মুখে নতুন কিছু যেন দেখতে পেলাম। এত দিন দেখেছি আমার মেয়েকে, আজ যেন দেখতে পেলাম একজন ভাগ্যবান মানুষের স্ত্রীকে।
মেয়েরা এমনই হয়। এরা শুধু দিয়েই যায়, কন্যা হয়ে বাবাকে, বোন হয়ে ভাইকে, স্ত্রী হয়ে স্বামীকে এবং মা হয়ে সন্তানকে। আমরা শুধু তাদের দান গ্রহণ করি, প্রতিদানের কথা চিন্তা করি না, সামান্য কৃতজ্ঞতার কথাও ভাবি না।
মনে পড়ছে মাওলানা তাক্বী ওছমানী ছাহেবের স্ত্রীর একটি সাক্ষাৎকার। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘স্বামী যে আপনাকে সময় দিতে পারেন না, এজন্য তাঁর প্রতি কি আপনার কোন অনুযোগ আছে?
তাঁর উত্তর ছিলো, না কোন অনুযোগ নেই। কারণ তাঁকে আমি বলেছিলাম, ‘আপনি যখনই আল্লাহর ঘরে যাবেন, আমাকে নিয়ে যাবেন, তারপর আপনার ছুটি’। তো তিনি আমার কথা রেখেছেন, আমিও তাঁকে ছুটি দিয়ে রেখেছি।’
সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেছেন, তা আসলে অনেক স্ত্রীরই মনের কথা এবং মনের ব্যথা।
একটি ঘটনা, যখন আমাদের দেশের বাড়ী ছিলো তখনকার। এক অত্যাচারী স্বামী শেষ বয়সে হজ্বের ইরাদা করলো। তার মনে হলো, স্ত্রীর উপর তো বহু যুলুম করেছি, মাফ চেয়ে নেই। স্ত্রীকে সে বললো, ‘তোরে অনেক জ্বালাইছি, মাফ কইরা দিছ্।’
হয়ত এখন সময়ের কিছুটা বদল হয়েছে, কিন্তু একসময় এমনই ছিলো, স্বামীর মুখের এইটুকু কথায় স্ত্রী সারা জীবনের সবকিছু ভুলে যেতো। ঐ লোকটির স্ত্রী বললো, ‘সব মাফ, তয় একটা শর্ত, আমারে আফনের লগে নিবেন।’
কিছুক্ষণ চিন্তা করে স্বামী বললো, ‘আচ্ছা, আগামীবার নেমু।’ সচ্ছল অবস্থা ছিলো, তবু সেই আগামীবার আসেনি আর। তবে জীবনের শেষ দিকে ছেলে তার মাকে হজ্বে নিয়েছিলো।
যাই হোক, মেয়েকে আমি আর কিছু বললাম না, শুধু মনে মনে তার এ পবিত্র অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কামনা করলাম, আল্লাহ যেন তার নেক ইচ্ছা পূর্ণ করেন, স্বামীর সঙ্গে যেন আল্লাহর ঘরের যিয়ারাতে সে যেতে পারে।
আমার বিশ্বাস ছিলো, আল্লাহ তাঁর বান্দীর এ মহৎ অনুভূতির লাজ অবশ্যই রক্ষা করবেন এবং তিনি তা করেছেন।
নাজমুল কারীম ভাই তো এ খবর জানতেন না, পরের বছর তিনি নিজের থেকেই বললেন, লোবায়না ও তার স্বামীকে হজ্বের জন্য তৈয়ার হতে বলুন।
সুবহানাল্লাহ! যিন্দেগির মানযিলে মানযিলে কুদরতের কত কারিশমা দেখি; দয়াময়ের কত দয়া ও মায়া দেখি, তবু কেন আমাদের বিশ্বাস ও ভরসার বুনিয়াদ এত নড়বড়ে!
মেয়েকে যখন এ খোশখবর জানালাম তখন তার খুশির কান্না এবং আনন্দের অশ্রু দেখে আমার বুঝতে বাকি ছিলো না যে, কীভাবে কেটেছে তার এই দীর্ঘ সময়ের দিন-রাতগুলো! ভাবের ও ভাবনার কত ঢেউ ছিলো, তরঙ্গ ছিলো তার মনে! কাকুতি ও মিনতি ছিলো, কত আহাজারি ও রোনাযারি ছিলো আল্লাহর কাছে নির্জনে তার মুনাজাতে!
হয়ত এসব কথা এখানে বলার মত ছিলো না, তবু বলা হয়ে গেলো। তবে যে নিয়তে বলা হলো, আল্লাহ যেন তা কবুল করেন, আমীন।
রামাযানের সম্ভবত চার তারিখে একমাসের জন্য আমরা আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হলাম।
আটজনের কাফেলা; নাজমুল কারীম ভাই, তার স্ত্রী, তাদের একমাত্র ছেলে তানবীর, আনোয়ার ভাই, নাজমুল কারীম ভাইয়ের বোন ও ভগ্নিপতি এবং আমরা চারজন।
পরামর্শক্রমে নাজমুল কারীম ভাইয়ের ভগ্নিপতি সারওয়ার সাহেব কাফেলার আমীর নির্বাচিত হলেন। তিনি ছিলেন সবার বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বহুবার আল্লাহর ঘর যিয়ারাত করেছেন।
পুরো সফরে তিনি আমীরের হক উত্তমরূপে আদায় করেছেন। সম্ভবত তারই পরামর্শে প্রচুর চাল-ডাল ও চিড়া-মুড়ি নেয়া হয়েছিলো। আমার জন্য এটা ছিলো সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। পুরো সফরে যেমন ছিলো ‘রান্না-বান্না’ তেমনি ছিলো খানা-পিনা, তেমনি ছিলো আরামের ঘর ও ফোমের বিছানা। মোটকথা, সফরের কষ্ট বলে যা কিছু আছে, কোন দিক থেকে তা একটু উঁকি দেবে, সে সুযোগ ছিলো না। সফরের কষ্ট যেমন ছবরের বিষয়, তেমনি সফরের আরামও শোকরের বিষয়। সুতরাং শোকর আলহামদু লিল্লাহ! তারপর নাজমুল কারীম ভাইকে ‘জাযাকাল্লাহ’!
আল্লাহর ঘরের এ সফর যেমন আরামের ও আনন্দের হয়েছিলো তেমনি বড় শান্তি ও প্রশান্তির এবং অশেষ কল্যাণ ও বরকতের হয়েছিলো। আমরা যেন আল্লাহর দানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলাম। তিনটি পরিবারের নারী-পুরুষ একসঙ্গে দীর্ঘ একমাস আল্লাহর ঘরের সফরে ছিলাম। একবারের জন্যও সামান্য কোন মনোমালিন্যের কারণ ঘটেনি আমাদের মধ্যে, বরং আশ্চর্য রকম মিল-মুহব্বত ও সৌহার্দ্য ছিলো সবার মাঝে। বাইতুল্লাহর সফরে এটা সত্যি আল্লাহ তা‘আলার এক বিরাট নেয়ামত।
শোকর আদায় করার অর্থ, বান্দা যেন একথা বিশ্বাস করে যে, যা কিছু সে পেয়েছে তা শুধু আল্লাহর করুণার দান, তার যোগ্যতার অবদান নয়। ব্যস, অন্তরে এই বিশ্বাসটুকু যত্নের সঙ্গে লালন করো, আল্লাহ ধরে নেবেন যে, বান্দা তার নেয়ামতের শোকর আদায় করেছে। শোকর আদায় করাকেও বান্দার জন্য আল্লাহ তা‘আলা কত সহজ করে দিয়েছেন। তাই হে প্রিয় পাঠক, জীবনে আল্লাহ যত নেয়ামত দান করেছেন, এসো আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করি।
বিমান যখন আকাশে উড়লো, আবেগে, আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি এসে গেলো। স্ত্রী-সন্তানদের উদ্ভাসিত মুখের দিকে তাকাই আর আল্লাহর শোকর আদায় করি। সহায়-সম্বলহীন এক বান্দা স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আল্লাহর ঘর যিয়ারত করবে তা তো কল্পনা করাও সম্ভব ছিলো না! কিন্তু আল্লাহ যখন দয়া করেন, সব অসম্ভব তখন সম্ভব হয়ে যায়। তোমার শোকর হে আল্লাহ! তোমার শোকর!
এখানে মনে পড়ছে মীরাঠের সেই মুসলিম ভাইকে, যার সঙ্গে এই সফরে বাইতুল্লাহর চত্বরে দেখা হয়েছিলো। পরে হয়ত ভুলে যাবো, তাই এখনই বলে রাখি তার কথা।
সেদিন তার ঘটনা শুনে অন্তরের এ বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছিলো যে, তুমি যে হও, যেমনই হও; ধনী বা নির্ধন, সাধারণ বা অসাধারণ, যদি দিল দিয়ে আল্লাহকে ডাকো এবং আল্লাহর কাছে হাত পাতো, অবশ্যই তিনি তোমার ডাক শোনবেন এবং অঞ্জলিভরে তোমাকে দান করবেন। চাই শুধু বিশ্বাসের ডাক এবং ডাকের বিশ্বাস, আর চাই ব্যাকুল প্রতীক্ষা এবং প্রতীক্ষার ব্যাকুলতা।
একদিন তাওয়াফের পর ওয়াজিব দু’রাকাত আদায় করে মুনাজাত করছি। হঠাৎ পাশ থেকে কে একজন বলে উঠলেন, ‘হাজী ছাহাব, যেরা ইস ফাকীর কে লিয়ে ভী দু‘আ কার না।’
অস্বীকার করবো না, মুনাজাতে ব্যাঘাত ঘটায় কিঞ্চিৎ বিরক্তি এসেছিলো, যদিও তা মুহূর্তের জন্য। কারণ সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, হয়ত মুনাজাতের কবুলিয়াতের জন্যই আল্লাহ তাঁর বান্দাকে পাঠিয়েছেন। আমি দু‘আ করলাম, হে আল্লাহ! জানি না, তোমার বান্দার মনে কী আশা, কী বাসনা, কী দুঃখ, কী বেদনা। তুমি হে আল্লাহ! তার সমস্ত আশা পূর্ণ করো এবং তার সমস্ত দুঃখ দূর করো। হে আল্লাহ! অদেখা, অচেনা এক মুসলিম ভাইয়ের জন্য দু‘আ করেছি, এ উছিলায় তুমি আমার যিন্দেগির সমস্ত দু‘আ কবুল করে নাও।
মুনাজাতের পর ঐ মুসলিম ভাই মুছাফাহার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। ইখলাছ ও মুহাব্বাতের মুছাফাহা হৃদয়ের গভীরে কেমন প্রশান্তির তরঙ্গপ্রবাহ সৃষ্টি করে, অনেক বারের মত এবারও তা অনুভব করলাম।
কিছু মানুষ থাকে অবলোকনে তারা খুব সাধারণ, কিন্তু তাদের মুখে অবয়বে কিছু একটা থাকে অসাধারণ। সেটাকে বলতে পারো সরলতার দীপ্তি ও প্রভা, কিংবা অন্তরঙ্গতার সজীব স্নিগ্ধতা। হয়ত এটাকেই বলা হয়েছে ‘মুখের অবয়বে হৃদয়ের পবিত্রতার প্রলেপ’! প্রথম দেখাতেই তারা আপন হয়ে যায় এবং হৃদয়ে তাদের ছবি চিরকালের জন্য আঁকা হয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে জীবনের বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে আল্লাহর ঘরের সফরে।
হিন্দুস্থানের মীরাঠ অঞ্চলের এই মুসলিম ভাইটি ছিলেন সেই রকমের অসাধারণ একজন সাধারণ মানুষ। হাসি হাসি মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, নূর যেন ঝলমল করে। মনে হলো গোনাহ কাকে বলে তিনি জানেন না এবং জানেন না, মানুষকে কীভাবে কষ্ট দিতে হয়।
এই প্রথম দেখা, কিন্তু মনে হলো, কত দিনের যেন চেনা! হয়ত আমার প্রতিও তার অন্তরে আপনত্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিলো। বাইতুল্লাহর সামনে বসে আমাকে তিনি অনেক কথা বললেন। সাধারণ মানুষের সাদামাটা সাধারণ কথা, কিন্তু আমার জন্য তাতে ছিলো অসাধারণ কিছু শিক্ষা।
তার বাবা ছিলেন স্টেশনের কুলি, তবে মা-বাবা দু’জনই ছিলেন নামায-রোযায়, সততা ও সত্যতায় এবং মানুষের প্রতি আন্তরিকতায় বস্তিতে সবার প্রিয়জন।
বাবা সূরা-ক্বেরাত সামান্য জানতেন, মা কিছুই জানতেন না। কীভাবে জানবেন! জীবনে কখনো না মকতব দেখেছেন, না স্কুল! গরীবের ঘর, তাও আবার মেয়েছেলে, তার জন্য তো সব দুয়ার বন্ধ! তবে বাবার ঘরে কোরআন শরীফ ছিলো। সেই কোরআন বুকে নিয়ে মা অঝোরে কাঁদতেন, আর আনমনে কী যেন বলতেন।
জোয়ান হওয়ার পর বাবাকে আরামে রেখে জীবিকার দায়িত্বটা তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং স্টেশনে কুলিগিরি শুরু করলেন।
জোয়ান বেটা, যত সামান্যই হোক, যখন কামাই শুরু করে মায়ের মনে আহ্লাদ জাগে ‘গুড়য়া সি বাহূ’ (পুতুলের মত বউ) ঘরে আনার। তো মা তার আহ্লাদ পুরা করলেন। আল্লাহর কী কুদরত, এর কিছু দিন পর মা-বাবা একসঙ্গে বিছানায় পড়ে গেলেন। প্রায় চার বছর তারা ছোট্ট ‘বাচ্চা-বাচ্চি’র মত বিছানায় ছিলেন। মিয়া-বিবি ‘দিল-জান সে’ বুড়া-বুড়ির খেদমত করলেন, আর তারা ‘বেটা-বাহূ’ উভয়ের প্রতি ‘খোশ’ হলেন।
কোরআন বুকে রেখে কালিমা পড়ে পড়ে মা ইন্তিকাল করলেন, মনে হলো খুব আরামে তার ইন্তিকাল হলো। আর ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় বুড়া মিয়াঁ বললেন, ‘বেটা, তেরী মাঁ কী জুদায়ী বরদাশত নেহী হোতী। জলদী মুঝে তেরী মাঁ কে পাস পোঁহচা দে।
সেদিনই তিনি ‘মাঁ কে পাস’ পৌঁছে গেলেন। ইন্তিকালের সময় বাবার মুখ থেকে ছেলের জন্য দু‘আ বের হলো, ‘বেটা, খোদা তুঝে পচ্ছিম কো লে যায়ে।’
স্টেশনে একদিন তিনি মীরাঠের এক মশহূর ‘শেঠ’-এর সামান মাথায় নিলেন। কী কারণে যেন শেঠ তাকে পছন্দ করলেন এবং সঙ্গে নিয়ে এলেন। সেই থেকে এখনো ‘খাদেমরূপে’ শেঠ-এর সঙ্গে আছেন।
তিন বছর আগে শেঠ হজ্ব করতে এলেন এবং খেদমতের জন্য তাকেও সঙ্গে আনলেন। তার নিজের ভাষায়-
‘হজ্বের সময় শেঠ আচানক বীমার পড়ে গেলেন, আর আমি ‘জী জান সে’ তার তীমাদারি করলাম, পেশাব-পায়খানা ভী ছাফ করলাম। কেন করবো না, তিনি তো আমার বড় মেহেরবান মনিব! আল্লাহ তো তারই উছিলায় ‘পিতাজী’র দু‘আ কবুল করেছেন।
আরাফার ময়দানে খুব রোনাযারি করে আল্লাহ মিয়াঁর কাছে একটা জিনিস চাইলাম। আমার তো হজ্ব হলো, মালিকের ঘর দেখা হলো, বিবি-বাচ্চা সবাইকে নিয়ে আবার যেন মালিকের ঘরে আসা হয়, আবার যেন হজ্ব নছীব হয়।
ভাই ছাহাব, সাচ মানো, ইয়াকীন কে সাথ আল্লাহ মিয়াঁ সে জো ভী মাঙ্গো, মিল যাতা হায়।
এদিকে আমার রোনাযারি খতম হলো, ওদিকে শেঠ ছাহাব ডেকে বললেন, মিয়াঁ, তুমি আমার বহুত খেদমত করেছো, এই পাক ময়দানে আমিও নিয়ত করলাম, তোমাকে যরূর এই খেদমতের বদলা দেবো। আয়েন্দা সাল বিবি-বাচ্চাসহ তোমাকে হজ্বে পাঠাবো। ‘বিলকুল রামাযান সে হজ্ব তক জী ভার কার মযা লূট না’।
আমার খুশির তখন কোন ‘ঠিকানা’ ছিলো না। গোনাহগারের ফরিয়াদ এত জলদী আল্লাহ মিয়াঁ কবুল করে নিলেন! কত মেহেরবান তিনি!
হজ্বের পর দেশে ফিরে এলাম এবং বিবি-বাচ্চাকে খোশখবর শুনিয়ে দিলাম। তারাও বহুত খোশ হলো।
রামাযান নযদীক হলো, আমি বে-কারার হলাম, মাগার শেঠ ছাহাব কিছু বলেন না! তাজ্জব কী বাত! শেঠ কি তাহলে ভুলে গেলেন আরাফার ময়দানের ওয়াদা!
রামাযান গেলো, হজ্বের ‘মাহীনা’ এসে গেলো। মাগার শেঠ চুপচাপ। তখন ভাবলাম, যরূর আল্লাহ মিয়াঁর দরবারে কোন গোস্তাখি হয়েছে। তাই নিজেও রোনাযারি শুরু করলাম; বিবি-বাচ্চাকেও বললাম, খুব রোনাযারি করতে থাকো।
নিজে আগে বেড়ে শেঠকে তার ওয়াদার কথা মনে করিয়ে দিলাম না। কারণ সব তো আল্লাহ মিয়াঁর হাতে। সেখান থেকে ‘বোলাওয়া’ না হলে তো ‘কিসী সেঠ সে কুছ নেহী বননে কা’।
এভাবেই দিন যায়, মাস যায়, আমার বে-কারারি ও রোনাযারি বাড়তে থাকে।
রামাযান যখন খুব নযদীক হলো, দিলের বে-কারারি তখন এত বেড়ে গেলো যে, সিজদায় পড়ে চোখের পানিতে যমিন ভিজিয়ে বললাম, ‘আয় আল্লাহ, জান লেনা হায় তো লে লে, মাগার হাম-সব কো তেরে ঘর তো পোঁহচা দে!’
আর দেরী হলো না, আল্লাহ মিয়াঁর রহমতের দরিয়ায় জোশ পয়দা হয়ে গেলো। সেদিনই শেঠ ছাহাব আচানক ডাক দিয়ে বললেন, ‘মিয়াঁ, মাওলা কে নাম পর তৈয়ারি শুরু কর দো’
এই হলো আমার মীরাঠী ভাইয়ের শাওকে দীদারে বাইতুল্লাহর ‘কাহানী’। রামাযানের ছয়-সাত দিন আগে বিবি-বাচ্চা নিয়ে তিনি আল্লাহর ঘরে এসেছেন; আল্লাহ চাহে তো হজ্ব করে দেশে যাবেন।
তার একটি কথা আমার এত ভালো লেগেছে যে, এখনো সেই ভালো লাগার স্বাদ অনুভব করি। তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ মিয়াঁ লায়া যরূর, মাগার লানে সে পহেলে রোলায়া বহুত। বন্দে কা রোনা উনহেঁ পছন্দ জো হায়!
(আল্লাহ মিয়াঁ এনেছেন ঠিক, তবে তার আগে কাঁদিয়েছেন অনেক, বান্দার কান্না তার পছন্দ যে!)
ঐ যে একদিন সামান্য সময়ের জন্য আল্লাহর ঐ পেয়ারা বান্দার সঙ্গে দেখা হলো, তারপর তাকে আর দেখিনি। এখনো তার কথা মনে হলে ঈমান তাজা হয় এবং দিলের মধ্যে ইয়াকীনের ‘ঠান্ডক’ পয়দা হয়। যেখানেই তিনি থাকুন আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন, আমীন। (চলবে ইনশাআল্লাহ)