Rabiul Akhir 1441   ||   December 2019

সরেজমিন : ফিরে দেখা ১ ডিসেম্বর, কী ঘটেছিল সেদিন

মাসউদুয যামান শহীদ

[এ লেখাটির প্রধান উদ্দেশ্য ইতিহাস সংরক্ষণে অংশগ্রহণ। কারণ ইতিহাসের যথাযথ সংরক্ষণ- এটি প্রতিটি প্রজন্মের উপর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হক। আরেকটি উদ্দেশ্য হল, এতাআতী ভাইদের হেদায়েত কামনা। হয়ত এটা পড়ে তাদের কারো বোধ জাগবে, অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে এবং সঠিক রাস্তায় ফিরে আসবে। হেদায়েত আল্লাহর হাতে, তিনিই তাওফীক দেওয়ার মালিক। আর যাদের মজলুমিয়াতের কিছুটা বিবরণ এই লেখায় উঠে এসেছে তাদের জন্য এটা ইহসান ও ইহতিসাবের সিফাত যিন্দা করার যরীআ হতে পারে। আল্লাহ তাদেরকে নিজের হেফাযতে রাখুন। এমন কথা ও কাজ থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন, যা মজলুমিয়াতের ফায়দা ও বরকত নষ্ট করে দেয় বা কমিয়ে দেয়। আশা করি, তারা পূর্বের মতো وَ لْیَعْفُوْا وَ لْیَصْفَحُوْا  اَلَا تُحِبُّوْنَ اَنْ یَّغْفِرَ اللهُ لَكُمْ  (তারা যেন ওদেরকে ক্ষমা করে এবং ওদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিন? -সূরা নূর (২৪) : ২২) -এর উপর আমল জারি রাখবেন। -তত্ত্বাবধায়ক]

 

১ ডিসেম্বর ২০১৮। মনে পড়ে যায় টঙ্গীর ইজতিমা ময়দানের সেই লোমহর্ষক কাহিনী, সেই দুঃসহ দুপুর। নিরীহ নিরস্ত্র উলামা-তালাবা ও দ্বীনদার মানুষের উপর একটি বিপথগামী দলের প্রচ- আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ার সেই রক্তাক্ত উপাখ্যান; যা রক্ত ঝরিয়েছে, অশ্রু ঝরিয়েছে। আহত করেছে শরীর, আর ক্ষতবিক্ষত করেছে হৃদয়। যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দাওয়াত ও তাবলীগের এই মুবারক মেহনতকে! যে দর্শন মানুষকে এমন হিং¯্র পশু করে তোলে তা কী করে দ্বীন ও দাওয়াত হয়?!... হঠাৎ বেঁধে যাওয়া কোনো সংঘর্ষ নয়, ছিল পূর্ব পরিকল্পিত আক্রমণ! আহতদের তালিকায় উলামা-তলাবারাই শীর্ষে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মাদরাসা ছাত্র দেখামাত্র তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত। তাই সেখানে উপস্থিত উলামা-তলাবাদের মধ্যে এমন কমই আছেন, যারা সেদিন গুরুতর জখমের শিকার হননি। মাদরাসাগুলো সেদিন পরিণত হয়েছিল হাসপাতালে। কারণ আহতদের ভিড় ছিল এতই বেশি যে, হাসপাতালের বেডগুলোতে তাদের সংকুলান হয়নি। আর আঘাতও যে করা হয়েছে কত রকমে, কত পর্যায়ে এবং কী সাংঘাতিক ও ভয়ানকভাবে- ভাবলেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে এবং ভিতরে একটা আতঙ্কবোধ জেগে ওঠে, এরা তাহলে কারা? একটি দ্বীনী জামাতের ভিতরে লুকিয়ে থাকা এরা কি বেশধারী অন্য কেউ? নিজেদের স্বগোত্রীয় ও সহযাত্রীদের এমনভাবে মেরে জখম করতে পারে?...

তাদের ঐ আঘাতে উপস্থিত মাদরাসা ছাত্রদের কারো মাথা ফেটেছে, কারো হাত ভেঙ্গেছে, কব্জি ভেঙ্গেছে, মূল থেকে বাহু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে... কারো ভেঙ্গেছে পা, কারো বা গুড়িয়ে গেছে হাঁটুর বাটি, ছিঁড়েছে ঠোঁট, পায়ের রগ, থেতলে গেছে হাত ও পায়ের আঙ্গুল... কারো বা মারাত্মক জখম হয়েছে গাল, মাথার অংশ, কারো বা চোখ... আর রক্তে ভিজে গেছে গায়ের সমস্ত জামা-কাপড়, যেমন রক্ত¯œাত হয়েছে ইজতিমার বিশাল মাঠ!

এসব আক্রান্ত সাথীদের জখম ও যন্ত্রণা-কাতরতার কিছু বিবরণ রয়েছে কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ে ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে এবং প্রচারিত লিফলেটে। অনেক মাদরাসা তাদের আহত ছাত্রদের নাম ও জখমের বিবরণ নথিভুক্ত করেছে। কিছু তথ্য আমাদের কাছেও সংরক্ষিত আছে। সেটার সূত্র এই যে, ঘটনার মাসখানেকের মধ্যে আমাদের তালিবে ইলম ভাইদের একটি জামাত বেশ কয়েকটি মাদরাসার আহত ছাত্র-শিক্ষকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাদের মুখ থেকেই তাদের চোখে দেখা ঘটনার বিবরণ শুনতে। এছাড়াও তারা ফোনে আলাপ করেছেন আক্রান্ত অনেকের সাথে। অনেকে নিজের বৃত্তান্তও লিখে পাঠিয়েছেন তাদের কাছে।

এসব সাক্ষাৎকার ও ফোনালাপ আহতদের আর্তচিৎকার ও তাজা রক্তের ঘ্রাণসহ সেদিনের পুরো দৃশ্য চোখের সামনে মূর্ত করে তোলে। কী কাজের জন্যে তারা মাঠে অবস্থান করছিলেন, ময়দানের সময়গুলো কীভাবে কাটছিল, কখন থেকে তারা আঁচ করতে পারেন- একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, এরপর কখন কীভাবে হামলাকারী সেই বিপথগামী মানুষগুলো ইজতিমা ময়দানের বিভিন্ন পয়েন্টে, বিশেষত বাটা গেইটের সামনে জড়ো হতে থাকে এবং কী কৌশলে পুলিশের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর কী ভয়ানক রক্তপাত ও তা-বলীলা চলে ইজতিমা ময়দানজুড়ে সবকিছুরই বিবরণ তারা দিয়েছেন বেদনা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে।

তাদের সেই বিবরণের নির্বাচিত কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি পাঠকের জন্য, বিভিন্ন উপশিরোনামে, যেন পাঠক নিজেই চাক্ষুস অবলোকন করেন- কেন, কী উদ্দেশ্যে ছিল এই হামলা, কারা ছিল এর নিশানা এবং কত নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত ছিল সেই নির্যাতন, আর কেমন ‘সুসজ্জিত’ ও সংঘবদ্ধ ছিল আক্রমণকারী দল...।

 

আক্রমণের পূর্বাভাস

আরজাবাদ মাদরাসার এক বিশিষ্ট মুদাররিস আমাদের জানান, আক্রমণের আগের দিনগুলোতে ময়দানে কী তারতীব চলছিল। তিনি বলেন, ‘মশওয়ারাক্রমে ২২ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য জোড়ের আগ পর্যন্ত ময়দানের হেফাজত ও অপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করার জন্য ঢাকার আটটি শবগুযারী পয়েন্টের মধ্যে যিম্মাদারি ভাগ করে দেওয়া হয়। দু’দিন করে একেকটি পয়েন্টের তারতীব ছিল। সে অনুসারে আমাদের যিম্মাদারি ছিল ২৮ ও ২৯ তারিখ বুধ ও বৃহস্পতিবার। আমাদের মাদরাসার জালালাইন থেকে ইফতা পর্যন্ত দুই শতাধিক ছাত্র ময়দানে উপস্থিত হয়। মিরপুর শবগুযারী পয়েন্টের যিম্মাদারি ছিল বাটা গেইটে। বাটা গেইটের আশেপাশে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে, তাঁবু খাটিয়ে মিরপুরের হালকাগুলো অবস্থান গ্রহণ করে। বাটা গেইটের অদূরে যে টিনশেড মসজিদ সেখানে ধারাবাহিকভাবে আমল চলত। এভাবেই আমাদের সময়গুলো ময়দান প্রস্তুতির কাজ ও বিভিন্ন আমলের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে। বৃহস্পতিবার শবগুযারি পয়েন্টের কাছে মুরুব্বীদের যে মশওয়ারার কামরা রয়েছে সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, দু’দিন যথেষ্ট নয়। কাজেই শুক্রবারটা থেকে শনিবার সকালেই সবাই যাবে। কিন্তু পরামর্শ মোতাবেক যথাযথ আমল হয়নি, অনেকে শুক্রবার সকালে চলে গিয়েছে। আবার সন্ধ্যায় ও রাতেও অনেকে চলে যায়। শুক্রবার দিবাগত রাতের পাহারায় আমরা প্রায় সাত-আটশ আলিম-তালিবে ইলম উপস্থিত ছিলাম। বাইরে থেকে আমরা সংবাদ পাচ্ছিলাম, ‘সাথী কমে এলে ওরা ভিতরে প্রবেশ করবে।’

কখন থেকে গেইটের পাহারা জোরদার করা হয় সে কথা জানিয়েছেন মিরপুর জামেউল উলূম মাদরাসার এক শিক্ষক : “অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে ইজতিমার প্রস্তুতি এখনও পর্যন্ত অনেক কম হওয়ায় হালকা থেকে আমাদের কাছে জোর তাকাযা পেশ করা হয়, যেন বেশি পরিমাণে ছাত্র একটু বেশি সময় নিয়ে কাজে অংশগ্রহণ করে। সে হিসেবে আমাদের ৫৫০ জন ছাত্র ও ১৮ জন উস্তায ইজতিমার কাজে অংশ নেন। প্রথমে যখন বুধবার আমরা মাঠে যাই তখন অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে ইজতিমার কাজ করি। আমাদের সাথে তাবলীগের অন্যান্য সাথী ভাইয়েরাও সেখানে কাজ করেন। বৃহস্পতিবার আমরা জানতে পারি যে, সরকারের নিষেধাজ্ঞার পরও জোড়ের নামে সা‘দপন্থী এতাআতীরা দলে দলে ইজতিমার মাঠের আশেপাশে বিভিন্ন মসজিদে অবস্থান করছে। তখন ভিতরের লোকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে গেইটে পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। যাতে তারা ভিতরে ঢুকে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটাতে পারে।”

হামলাকারীরা কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে তার আগাম সংবাদ পেয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা মারকাযের এক মুকীম সাথী। তিনি বলেন : “ওরা দু’দিন আগে থেকেই জেলায় জেলায় গিয়ে সা‘দপন্থীদের তাশকিল করেছে যে, ত্রিশ তারিখের মধ্যে টঙ্গীর ময়দানে ওদের জোড় হবে। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই সে জোড় নিষেধ করে দিয়েছেন। আগের দিন রাতে একটা ম্যাসেজ পেলাম : ‘টঙ্গীর ময়দানকে ওরা পূর্ব-পশ্চিমে মোট ছয়-সাত হালকায় ভাগ করেছে। যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, তারপর কাকরাইল, ডেমরা, কেরাণীগঞ্জ ও সাভার। এভাবে ভাগ করে বিভিন্ন জেলাকে তাদের আন্ডারে দিয়ে ওরা কীভাবে অবস্থান করবে সেটা ঠিক করে দিয়েছে।”

 

ঐ দিন সকালে

জামিউল উলূমের ঐ শিক্ষক বলেন, “শনিবার ফজরের নামাযের সময় বাইরে তাদের শোরগোল শোনা যাচ্ছিল। কখনো তাকবীরের আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল। বোঝা-ই যাচ্ছিল, তারা বিপুল সংখ্যায় সমবেত হচ্ছে। আমাদের ছাত্ররা নামায থেকে ফারেগ হয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। বেলা যত বাড়তে থাকে ওদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।”

নারায়ণগঞ্জের মুকীম সাথী বলেন, “সকাল যখন ছয়টা বা সাড়ে ছয়টা, আমি তখন মটরসাইকেল নিয়ে প্রত্যেক পয়েন্টের গেইটগুলোতে একটা চক্কর দিলাম। বাইরের দিক থেকে ওদের শত শত লোক গেটগুলোতে আছে। আমরা বারবার প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। তারা বলল, ‘এগারোটার ভিতরেই ওনাদেরকে আমরা গেইট থেকে সরিয়ে দেব’।”

আরজাবাদ মাদরাসার ঐ মুদাররিসের বর্ণনায় রয়েছে আরো তথ্য : “সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আমরা দেখতে পেলাম, একটা বাস এসে বাটা গেইটের সামনে থামে। বাস থেকে অনেক লোক নেমে আসে। তখন থেকেই আমরা খুব সতর্ক হয়ে গেলাম যে, এখন থেকে আর কোনো সাথীকে প্রবেশ করতে বা বের হতে দেয়া যাবে না। এরপর থেকে একের পর এক বাস আসতে থাকে এবং অসংখ্য লোক ‘আশরাফ সেতু কমপ্লেক্সের সামনে জমায়েত হতে থাকে। একসময় হাজার হাজার মানুষ হয়ে যায়। এরপর দেখতে পেলাম, হ্যান্ডমাইকে ডেকে ডেকে একেক দলকে একেক দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কাপড়ের নিশানা বানিয়ে লোকদের নেতৃত্ব দিয়ে অন্য কোনো দিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তখন হ্যান্ডমাইকে বলতে শুনলাম, যাদেরকে যেই পজিশন দেয়া হয়েছে তারা নিজ নিজ স্পটে গিয়ে সেখানে অবস্থান গ্রহণ করি। হঠাৎ দেখতে পেলাম, অসংখ্য লোক, যারা দাঁড়িয়ে ছিল- আমাদের বাটা গেইটের সামনে এসে বসে পড়ছে। আরেক বিশাল দল টঙ্গী বাসস্ট্যান্ড হয়ে কামারপাড়ার দিকে চলে যাচ্ছে...।”

টঙ্গী রেললাইন সংলগ্ন জামেয়া নেসারিয়ার এক ছাত্র জানান “শনিবার বাদ ফযর এতাআতীরা যখন বিভিন্ন গেইটের কাছে অবস্থান নেয়া শুরু করে তখন আমরা শবগুজারী পয়েন্টের পাশের গেটে অবস্থান করছিলাম। তারা গেটের ওপাশে হ্যান্ড মাইকে বিভিন্ন বয়ান করে যাচ্ছিল। তারা সাহাবায়ে কেরামের উদ্ধৃতি দিয়ে জিহাদ বিষয়ক এবং জিহাদের ফযিলত সম্পর্কিত নানা ঘটনা শুনাচ্ছিল”।

 

হামলার পূর্বমুহূর্ত

মুকীম সাথী বলেন, ‘পৌনে এগারটার দিকে অনেক পয়েন্ট থেকে আমাদের কাছে প্রশ্ন আসতে থাকে যে, পুলিশ তো অনেক গেইটেই নেই? তখন আমার অনেক ভয় হল। পুলিশ বলল, এগারোটার মধ্যে সরিয়ে দেবে, কিন্তু এখন দেখি পুলিশই সরে গেছে!’

হামলার পূর্বমুহূর্তটাতে বাইরের চাঞ্চল্য ও ভিতরের নির্জীবতার বিবরণ দিয়ে আরজাবাদের মুদাররিস বলেন, এতাআতীরা দু-তিন দিন ধরে বাইরে শক্তি সঞ্চয় করেছে। অপর দিকে আমরা সারাদিন ময়দানে কাজ করে ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের মধ্যে একটা নির্জীব ভাব চলে এসেছিল। সন্ধ্যার পর কতক্ষণ আর ঘুম হয়েছে। এগারোটার সময় সবাইকে জাগিয়ে দেওয়া হয়। রাত বারোটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত আমাদের পাহারা ছিল। এখন ছিল যিম্মাদারি পরিবর্তনের সময়। আরেকটা গ্রুপ আসার কথা ছিল। কিন্তু আমরাই এখন এই গেইটের যিম্মাদার হয়ে গেলাম। আর কেউ নেই...। ওদিকে তাদের চাঞ্চল্য ছিল দেখার মতো। বারবার ওরা হ্যান্ড মাইকে ‘তালিবে ইলম ভাইয়েরা তোমরা চলে যাও। তোমাদের জন্য কামারপাড়া  গেট খোলা রেখেছি’ ইত্যাদি প্রচার করে যাচ্ছিল। ওরা ওপর দিয়ে বারবার দেখছিল যে, আমরা সংখ্যায় কমে গেছি। কথা ছিল, সামনের দিকে সাধারণ তাবলীগী ভাইয়েরা থাকবেন। তখন তাদের অনেকের মাঝে অনীহাভাব, উদাসীনতা, অনুপস্থিতি আমরা লক্ষ্য করি। এছাড়া যারা ছিলেন তাদের মধ্যে আবার অধিকাংশই বৃদ্ধ!... আমরা খুবই পেরেশান ছিলাম। সেই রাত থেকে এখন পর্যন্ত না খাওয়া। সবাই ছিলাম ক্লান্ত। হঠাৎ করে সোয়া এগারটার দিকে উত্তেজিত হয়ে শ্লোগান দিয়ে ওপাশ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়।”

 

ওদের প্রস্তুতি ও কৌশল

আরজাবাদের মুদাররিস বলেন, “আমাদের দেখা ও তথ্য অনুসারে গেইট ভেঙ্গে প্রবেশের সময় তাদের হাতে কোনো লাঠি ছিল না। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের পেছনে ব্যাগ ঝোলানো ছিল। পরে বিশ্বস্তসূত্রে আমরা জানতে পারি, এদের ব্যাগে ছোট ছোট রড ছিল, যা এক হাত লম্বা করে কাটা। আরো ছিল ইট-সুরকি। আর ফজরের পরপরই ইট বোঝাই একটা ট্রাক এসে বাটা গেইটের সামনে থামে। ট্রাকের উপরে ইটের আধলার মতো ছিল। একটু চিন্তিত হলাম, এখানে তো কোনো নির্মাণ কাজ হচ্ছে না। তাহলে এত সকালে ইটের ট্রাক এখানে কেন? কিছুক্ষণ পর ইটবোঝাই সেই ট্রাকটি কোথায় যেন চলে যায়?!”

জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আহমদ নগর মিরপুর-১-এর ইফতা বিভাগের এক ছাত্র জানান :

“রাত থেকেই এতাআতীদের উপস্থিতি শুরু হয়েছিল। দশ-বারো জন করে করে জামাত। আমরা খুব আতঙ্কে ছিলাম। আমাদের কোনো কোনো যিম্মাদার, মাথায় টুপি, গায়ে জুব্বা, গেইটের বাইরের লোকদের উপস্থিতি যত বাড়ছে তারা যেন তত উৎফুল্ল। কিছুক্ষণ পরপর মোটরসাইকেলে করে আমাদের কাছে আসছেন। আর আমাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। উপদেশ দিচ্ছেন, “হাতে লাঠি রাখা যাবে না, তাহলে পত্রিকায় ছবি চলে আসবে, এতে আমাদের দুর্নাম হবে। আমরা মারামারি করতে আসিনি, সবাই শান্ত থাকেন, দুয়া-ইস্তেগফার পড়তে থাকেন” ইত্যাদি। কিন্তু কে জানত সুন্দর হাসিমাখা চেহারার লোকগুলোই ছিল জালিমদের এজেন্ট!... কিছুক্ষণ পর একজন এসে বললেন, ওরা বলাবলি করছে, ‘আমাদের সাথে নাকি তাবলীগে সময় লাগানো সাথী নেই। সবাই নাকি ছাত্র। তো আপনারা পিছে যান। মুরব্বীদেরকে গেইটের কাছে দিন। ওরা দেখুক!’ তাদের কথামতো আমরা একটু পিছনে সরে এলাম। এরপরপরই ওরা বাইরে থেকে পাথর মারা শুরু করল। আমরা আত্মরক্ষার জন্য পাহারার লাঠি হাতে নিতে চাইলাম। কিন্তু আমীর সাহেবরা বললেন যে, “না, আমরা আল্লাহ্র উপর ভরসা করি”। তখন দেখলাম, সামনের লোকগুলোও আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। আর গেইটে হৈ চৈটা ক্রমেই বাড়ছে। প্রথমে তাদের কিছু লোক ছোট গেইটটা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে ছাত্রদের মারতে শুরু করল। এমন সময় দেখি, ভিতরের এই ‘যিম্মাদাররাও’ আমাদেরকে মারতে শুরু করেছে! আমরা আস্তে আস্তে পিছাতে থাকি। এরপর ওরা বড় গেইটটা কীভাবে ভেঙে ফেলল বুঝতেও পারলাম না।

জামেউল উলূমের ঐ শিক্ষক বলেছেন, কী করে সহজে ভাঙ্গা সম্ভব হল বাটা গেইটটা :

“এদিকে ভিতরে অনেক লোক ছাত্রদেরকে দুআ-ইস্তেগফারের তালকীন করতে থাকে। তাদেরকে গেইটের উল্টোদিকে মুখ করিয়ে সারিবদ্ধভাবে দুআয় লিপ্ত করে দেয়। যারা গেইটের কাছে ছিল তাদেরকে বলে, নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। এরপর পৌনে এগারটা  কি এগারটার দিকে ওপাশ থেকে একযোগে গেইট ভেঙ্গে ফেলে। গেইটের হুকগুলো ছিল দুর্বল। আমি একবার বলেছিলামও। কিন্তু রাতারাতি ঠিক করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।”

 

হামলা শুরু হওয়ার পর

আরজাবাদের ঐ মুদাররিস বলেন, “বাটা গেইট ইজতিমা ময়দানের সবচে মজবুত গেইট মনে করা হয়। যদিও তা কিছুটা দুর্বল ছিল। এই বাটা গেইটটা ধরে শতশত মানুষ ঝাঁকাতে লাগল। একপর্যায়ে তারা গেইট ভেঙ্গে পঙ্গপালের ন্যায় ছুটে আসতে থাকে। পড়ে থাকা লাঠিগুলো নিয়ে নেয়। আর তাদের সাথে তো যা ছিল ছিলই। তারা দশজন দশজন করে দলবদ্ধ ছিল। তাদের অনেকে বিশেষ চিহ্ন ধারণ করেছিল। একশ জনের একজন করে যিম্মাদার ছিল। এভাবে তারা খুবই সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমণ চালায়।

হামলার আকস্মিকতা কীভাবে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়, সে বিবরণ এসেছে জামেউল উলূমের মেশকাত জামাতের এক ছাত্রের যবানীতে : পৌনে এগারটার দিকে বাটা গেইট ভেঙ্গে সাদপন্থী এতাআতীরা যখন ভিতরে ঢোকে তখন তারা ছিলো প্রচ- মারমুখী। ছোট বড় সবাইকে মারধর করছিল। দূর থেকে আমাদেরকে দেখে তিন-চারজন বাঁশের লাঠি হাতে আমাদের দিকে ছুটে আসে। আমরা পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করি। আমার অন্য সাথীরা আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমাকে ধরে ফেলে। একজন জিজ্ঞাসা করে, “কোন্ মাদরাসায় পড়িস”। বলতে না বলতেই আরেকজন বাঁশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে। এরপর একের পর এক আঘাত করতেই থাকে। আর বলতে থাকে, ‘আর মাদরাসায় পড়বি? তোরাই তো বড় হলে আমাদের বিরোধিতা করবি। সা‘দ সাহেবের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিবি। আমাদের যাকাত-ফিতরা খাছ আর আমাদের বিরোধিতা করছ!’” (নাউযুবিল্লাহ)

আক্রমণ শুরু হওয়ার পর সাথীদেরকে মাঠ থেকে নিরাপদে কোথাও পার করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কি না- এ প্রশ্নের জবাবে নারায়ণগঞ্জ মারকাযের মুকীম সাথী বলেছেন : ‘তখন তো সাথীদেরকে বের করে দেওয়াও নিরাপদ ছিল না। টঙ্গীর ময়দানের চারদিক ওরা সম্পূর্ণ অবরোধ করে রাখে। হামলা হবে এরকম কথা শোনা যাচ্ছিল। এতে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং ঢাকার অন্যান্য হালকার সাথীরা টঙ্গীর উদ্দেশ্যে আসছিলও। কিন্তু তাদেরকে আব্দুল্লাহপুর ব্রীজের ঐদিক দিয়ে টঙ্গীর স্টেশনের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি, পুরোটাই ওরা অবরোধ করে রাখে’।

 

আমাদের অপ্রস্তুতি ও সিদ্ধান্তহীনতা

হামলা যখন একেবারে আসন্ন তখন ন্যূনতম প্রতিরোধ ব্যবস্থাও কেন নেয়া গেল না, তার কারণ জানিয়েছেন আরজাবাদের মুদাররিস : “এ কঠিন মুহূর্তে মশওয়ারা করব- এমন কোনো যিম্মাদার সাথী ও আলেম আমাদের সঙ্গে ছিলেন না।”

বিভিন্ন হালকার সাথীরা তো সাদপন্থীদের চেনার কথা, তবুও সাদপন্থীরা ভিতরে অবস্থান করতে পারল কীভাবে- এ প্রশ্নের জবাবে উমেউল উলূমের শিক্ষক বলেন : “আসলে তরতীব শেষ করে অনেক সাথী চলে যাওয়ায় এবং নতুন তরতীবের সাথীরা আসতে না পারায় ঘটনার দিন সকালে ভিতরে তেমন কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। যিম্মাদার সাথীদের উপস্থিতিও ছিল কম। মশওয়ারার সময় অনেককে পাওয়া গেলেও সর্বক্ষণ আমাদের হালাতের প্রতি খেয়াল রাখার মতো কোনো যিম্মাদার সাথী ছিল না। উপরন্তু পরিস্থিতির কারণে মশওয়ারার মধ্যেও দৃঢ়তা ছিল না। কখনো এক ফয়সালা করা হচ্ছে, পরক্ষণেই তা পরিবর্তন করা হচ্ছে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হচ্ছিল। সঠিক সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও শিথিলতা ছিল। এমনকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সাদপন্থীরা  ঢুকে পড়েছিল, যা পরে প্রকাশ পায়। যেমন গেইটে ও মোটর সাইকেল দিয়ে পুরো মাঠে খবর সরবরাহের দায়িত্বে যারা ছিল তারা অনেকেই ছিল সাদপন্থী। ফলে ভেতরে বিভিন্ন ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়। গেইটের কাছে ছাত্রদের বেশি ভিড়তে দেওয়া হচ্ছিল না; বরং সময়-সুযোগ বুঝে তারা সাদপন্থীদের ভেতরে ঢোকাতে থাকে। ফলে দেখা যায়, মাদরাসার ছাত্র ছাড়া যারা ভিতরে ছিল তাদের আনুমানিক ফিফটি পার্সেন্ট ছিল ওদের লোক।”

আক্রমণের পূর্বাভাস পেয়ে আশপাশের মাদরাসা থেকে সাথীদের সাহায্যের জন্য আসার চেষ্টা করলে পুলিশ কী ভূমিকা পালন করে তার বিবরণ দিয়েছেন, দারুল উলূম মাদরাসা টঙ্গী’র এক তালিবে ইলম : “আমাদের উস্তাযদের কাছে একের পর এক ফোন আসতে থাকে যে, সাদপন্থীরা ইজতেমা ময়দান চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। তখন এখান থেকে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন : “আপনাদের আসতে হবে না। বিষয়টি আমরা দেখছি। আপনারা উভয় পক্ষই যদি আসতে শুরু করেন তাহলে আমরা বুঝতে পারব না, কারা কোন্ দল। তখন আপনারাও আমাদের লাঠির নীচে চলে আসতে পারেন। পুলিশের এমন কথা শুনে আমরা আর মাঠের দিকে যাইনি।”

 

মসজিদ-মাদরাসায় হামলা

নারায়ণগঞ্জের মুকীম সাথী জানান : আমি কামারপাড়া ব্রীজের ওখানে ছিলাম। হঠাৎ বাটা গেইটের ওখান থেকে ফোন করে এক সাথী বলল, আমরা নামাযরত অবস্থায় ওরা পিছন থেকে আমাদের উপর আক্রমণ শুরু করেছে। বাটা গেইটটা ভেঙ্গে ফেলেছে। আমি দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে এগুতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম সত্যিই বাটা গেইটটা ভেঙ্গে ফেলেছে। আর সাথীরা রক্তাক্ত অবস্থায় মাঠের মাঝখানে পড়ে আছে। কিছু সাথী আমাকে দেখে দৌড়ে এল। এরপর ওরা টঙ্গী স্টেশনের গেইটটাও ভেঙ্গে ফেলল। এদিক দিয়ে টিনশেড মসজিদের গেইটটাও ভাঙল। মসজিদের ভিতরে সমস্ত ছাত্রকে মারতে মারতে ফরেন টেন্টের দিকে নিয়ে গেল। আমার চোখের সামনে একেকজনকে ওরা মারছে আর বলছে, ‘বল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সাদ ওলিয়্যুল্লাহ!’ ‘কান ধর, বল, মাদরাসায় আর যিন্দেগীতেও পড়বি না’!...

টঙ্গীর ময়দানের ভিতর যে মসাদরাসা ছিল ওখানেও ওরা ঢুকল। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, চতুর্দিক থেকে ওরা গ্লাসগুলো, দরজাগুলো সব ভাঙল। ভিতরে দলে দলে ঢুকল। সকাল থেকেই মাদরাসার উস্তাযগণ বাচ্চাদের আমলে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। মাদরাসার ছাত্ররা কুরআন শরীফ পড়ছিল কুরআন শরীফগুলো ছুঁড়ে ফেলে ওদেরকে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলল। দু-তিন জনকে উঁচু করে ধরে নদীতে নিক্ষেপ করল। এক ছাত্র পায়ে ধরে বলল, ‘আমারে নদীতে ফালায়েন না, আমি সাঁতার জানি না। আমারে পাড়ের মধ্যেই মাইরা ফেলেন...’ কিন্তু ওরা শুনল না। মাদরাসায় কেন পড়তে আসছিস? বাংলাদেশ থেকে মাদরাসা উঠাইয়া দিমু। কোনো আলেম রাখমু না... এরকম মন্তব্য  করে ছাত্রগুলোকে মারতে মারতে নদীতে নিয়ে ফেলল।

 

ধোঁকা ও ধূর্ততা

আরজাবাদের ঐ মুদাররিস হামলা চলাকালে আক্রমণকারীদের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার একটি বিবরণ দিয়েছেন এভাবে : “ইতিমধ্যে আমাদের সাথীরা নানা দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ওরা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ধেয়ে আসছিল। আমরা তখন নিরুপায় হয়ে পাশে অবস্থিত মসজিদে চলে যাই। ভেবেছিলাম, পুরো মসজিদ তাবলীগ জামাতের সাথী দিয়ে ভরা। সেখানের গেইটগুলো পাহারা দিলে হয়ত তারা সেখানে হামলা করার সাহস পাবে না। কিন্তু সবাই ছিল ক্লান্ত। ওরা আমাদের চোখের সামনে রান্নার পাতিল ও ঢাকনা দিয়ে বয়স্ক লোকদের ধরে ধরে মারছিল।...

সেখানে একটি গোডাউন ছিল। তাতে অনেক লোক ছিল। তারা সেখানে গিয়ে বলল, ‘যারা আলিম-তালিবে ইলম তারা হাত তোলেন, আমরা আপনাদের মারব না।’ কিন্তু হাত তোলা হলে তাদেরকে ধরে পিটিয়েছে। প্রধানত মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকই ছিল তাদের টার্গেট। একপর্যায়ে গোডাউনের সামনে রাখা গাড়ীগুলোতে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়।”

আরজাবাদ মাদরাসার ইফতা বিভাগের এক ছাত্র জানান, “বাটা গেইট ভেঙ্গে ফেলার পর আমরা কয়েকজন পাশেই অবস্থিত একটি কামরায় ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিই। একসময় দুর্বৃত্তরা দরজাটা ভেঙ্গে ফেলে। তখন তারা বলে, ‘সবাই বেরিয়ে আয়। কেউ ভিতরে থাকলে তাকে জানে মেরে ফেলব। আমি তখন বেরিয়ে আসি। বের হওয়ার সাথে সাথে ওরা সবাই মিলে চারদিক থেকে আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে’।”

 

চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা

আরজাবাদের মুদাররিস জানান, “মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে সর্বপ্রথম ‘হেলমেট’ পরা কিছু লোক দেখতে পাই। আমরা ঐক্যবদ্ধ একটা জামাত ছিলাম। যদিও জামাতটি ছোট ছিল। আমরা তাদেরকে যথাসম্ভব প্রতিরোধ করছিলাম। তাদেরকে ছেড়ে দিলে তো তারা সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা তাদের সাথে পেরে উঠিনি।... সেই বাটা গেইট থেকে তাদের মারার ধরন ছিল এই, একজন মুরুব্বীও যদি লাঠির আঘাত খেয়ে পড়ে যেতেন তখন চার-পাঁচজন এসে বাঁশ দিয়ে, রড দিয়ে পিটিয়ে আধমরা করে তারপর সামনে যেতো।”

না. গঞ্জের মুকীম সাথী জানিয়েছেন, ‘আক্রমণকারী সকলেই ছিল সাদপন্থী। বহিরাগত হয়ত শতের মধ্যে দু-একজন থাকতে পারে। কিন্তু আক্রমণ ও মারামারি সম্পূর্ণ ওদের পক্ষ থেকেই হয়েছে। আমি অনেককে দেখেছি, যারা জামার আস্তিনের ভিতরে মোটা বড় বড় রড নিয়ে এসেছে। আর এ রডগুলো দিয়ে আমাদের অনেক সাথীকে মেরেছে। এক সাথীকে বাথরুমের ভিতর থেকে ধরে এনে মাথায় বাড়ি দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে গেছে। তো ধরে নিচে নামিয়েছে। এ সাথীর আরো দু‘তিন বছর আগে পা ভেঙে গিয়েছিল। ডান পায়ের ভিতরে রড ছিলো। সে হাঁটতে পারত না। তাকে ওরা বলল, দৌড়াছ না ক্যান? সে বলল, আমি ভালমতো হাঁটতেও পারি না। আমার পা আগে থেকেই ভাঙা। ওরা বলল, কই দেখি তো। দেখিয়েছে, তো পা ধরে আরেকজন পায়ের মধ্যে বাড়ি দিয়ে আবার ভেঙে দিয়েছে! এখন এ সাথী মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে আছে। এরকম প্রায় প্রত্যেক ছাত্রকে ওরা মাথা টার্গেট করে পিটিয়েছে।”

জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া আলী এন্ড নূর রিয়েল এস্টেটের জালালাইন জামাতের এক ছাত্র নিজের ঘটনা বর্ণনা করেছেন : “... হুঁশ ফিরে এলে আরো বিশ-ত্রিশ জনকে আমার পাশে শোয়া দেখতে পাই, ইটের আঘাতে যাদের মাথা ফেটে গেছে। এসময় এতাআতীরা মশওয়ারার কামরা ভাঙতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে সেটা ভেঙে ঢুকেও পড়ে এবং শুয়ে থাকা সাথীদেরকে বাঁশ দিয়ে আবার মারতে থাকে। কেউ কেউ শোয়া থেকে উঠে দৌড় দেয়। আমার সে শক্তিও ছিল না। আমি ওভাবেই পড়ে ছিলাম। একজন বয়স্ক লোককে একটা বাঁশ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। আমার কাছে আসতেই পা দু‘টো জড়িয়ে ধরে বললাম, চাচা! এই দেখেন আমার মাথার বাম পাশটা ফেটে গিয়ে রক্তে আমার জামা-কাপড় ভিজে গেছে। আমাকে আর মাইরেন না। উত্তরে সে বলল, ‘তোর বাঁইচা থাকার দরকার নাই।’ তারপর বাঁশের আঘাতে কপালের ডান পাশটা চোখ পর্যন্ত ফাটিয়ে দেয়। এরপর আমার হাতে পায়ে কয়েকটা বাড়ি দিয়ে দু‘তিনজন লোক আমাকে ধরে সবগুজারি পয়েন্টের দেয়ালের ওপাশে ছুঁড়ে ফেলে!”

এ মাদরাসারই আরেক তালিবে ইলম তার উপর পাষ-দের বর্বরতার বিবরণ দিয়ে বলেন : “ইজতিমা মাঠ থেকে যেকোনো ক্রমে বের হওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। কারণ পিছন দিক থেকে তখন ওরা ধেয়ে আসছে। সামনেও তারা লাঠি নিয়ে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু না ভেবে তাদের মাঝ দিয়ে দৌড় দেই। কিন্তু রেহাই পাইনি। শেষ পর্যন্ত লাঠির একটা আঘাত আমার মুখে এসে লাগে। এতে আমার ঠোঁটের একটা অংশ ছিঁড়ে গিয়ে ঝুলে পড়ে। চারদিকের অনবরত আক্রমণে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। লাঠির আঘাতে আঘাতে আমি মাটিতে ঢলে পড়ি। তারা আমাকে তখন বলতে থাকে ‘বল্, সা‘দ সাবকে আমীর মানবি কি না’। আমি কিছু বলতে পারিনি। আমার মুখ বেয়ে তরতর করে রক্ত ঝরতে থাকে।”

 

গুরতর জখম

আরজাবাদ মাদরাসার এক সিনিয়র মুহাদ্দিস তাঁর মাদরাসায় আহত ছাত্রদের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, “আমি মাদরাসার গেইটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আহত ছেলেরা আসবে, তাদের সেবা করব।... এক তালিবুল ইলমকে দেখলাম তার জামা এক ইঞ্চিও খালি নেই। পুরোটা রক্তে রঞ্জিত। তাকে আটটা সেলাই দিতে হয়েছে। আমাদের মেহমানদের জন্য নির্ধারিত যে বড় কামরাটা রয়েছে তা পুরোটা আহতদের দিয়ে ভরে যায়। কারো হাত ভাঙা, কারো মাথা ফাটা, কারো গাল ফাটা, কারো গাল-মাথা উভয়টাই ফেটেছে...। আমাদের বেশিরভাগ ছেলেরই মাথা ফাটা ছিল। তারা বিশ থেকে পঁচিশ জন হবে। আহত তিরাশি জনের একজনও দু-তিন দিন স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারেনি। এরপর ব্যাথানাশক ট্যাবলেটের প্রভাবে কিছুটা স্বাভাবিকভাবে চলতে ফিরতে শুরু করে।... এদের প্রত্যেকেরই এক্স-রে রিপোর্টে এসেছে, কোনো না কোনো হাড় ফেটেছে কিংবা ভেঙ্গে গেছে অথবা জয়েন্ট ছুটে গেছে। দুবৃত্তরা টার্গেট করে মাথা ও জয়েন্টে আঘাত করেছে।”

তিনি আরো জানান, “আমাদের ছাত্রদের বক্তব্য হচ্ছে, ময়দানের আশপাশের বাড়িঘরের সাধারণ মহিলারা তাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। ওদের হাত থেকে উদ্ধারে মহিলারাই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে।”

ঐ ঘোরতর বিপদে উস্তাযরা ছাত্রদের পাশে ছিল উল্লেখ করে বলেন : “আমাদের মাঠের যিম্মাদার উস্তায আহত হয়েছেন, মাস্টার সাহেব গুরুতর আঘাত পেয়েছেন কিন্তু আল্লাহর শোকর তারা তালিবে ইলমদের ছেড়ে আসেননি।”

দারুল উলূম টঙ্গী মাদরাসার সেই তালিবে ইলম, যিনি নিজ হাতে ঐদিন অনেক আহতদের বহন করেছেন, সেবা দিয়েছেন- তিনি শুনিয়েছেন বিভিন্ন মাদরাসায় তার দেখা আহতদের বিবরণ। তিনি বলেন, “আমরা গাজীপুর মোগরখালা মাদরাসায় যাই। তারা প্রায় সত্তরজনের মতো ময়দানে এসেছিল। এর মধ্যে পঞ্চাশ জনের বেশি আহত। ছাব্বিশজন মারাত্মক আহত। তাদের অধিকাংশকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে একজনকে দেখলাম, তার পায়ের নলি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আরেকজনকে দেখলাম, কোনো কথা বলছে না। অনেক জিজ্ঞাসার পর জানায়, “ভাই! ওরা আমাকে পাঁচ-ছয় দফা পিটিয়েছে। প্রথমবার মেরে বেহুঁশ করেছে। হুঁশ ফিরে এলে আবার মেরেছে, আবার মেরেছে। পুলিশসহ ময়দানে আমাকে ছয়বার মেরেছে, সে আরো বলে, “এরপর যখন কোনো রকমে বাইরে এসে আমজনতার সাথে মিশে যাই তখন পুলিশ এসে বলে, ‘আপনারা কারা আহত সামনে আসেন’। তখন আহতরা এগিয়ে এলে পুলিশ তাদেরকে আবারো লাঠিপেটা করে!”

তিনি আরো জানান, “গাজীপুরেই আরেক মাদরাসা : জামিয়া মুহাম্মাদিয়া হুসাইনিয়া। ওখান থেকে ষাটজনের মতো ময়দানে এসেছিল। তাদের মধ্যেও পঞ্চাশজনের মতো আহত হয়। এক শিক্ষকের মাথায় লাঠি দিয়ে এত জোরে আঘাত করা হয় যে, তাঁর মাথায় আটাশটা সেলাই দিতে হয়েছে। তাঁর হাতও ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আর সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত...।”

তিনি বলেন, “এছাড়া আমাদের জানামতে অনেক সাধারণ এবং প্রবীণ মুরব্বী সাথীও আহত হয়েছেন। বিশেষ করে টঙ্গী বাজার এলাকার অনেক সাথী আহত হয়েছেন।”

 

বিজয় ছিনিয়ে আনার ঘোষণা!

নারায়ণগঞ্জ জেলা মারকাযের ঐ মুকীম সাথী বলেন, “তা-বলীলা থেমে যাবার পর টঙ্গী ময়দানের টিনসেড মসজিদে দেখলাম, মাওলানা আব্দুল্লাহ মাইক নিয়ে বলছে, ‘এভাবেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়। আজকে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনলাম। প্রত্যেক জেলায়, প্রত্যেক থানায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে এভাবেই আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনব।’ এই আব্দুল্লাহ হচ্ছে, ‘আলইমারাতু হিয়াস্ সুন্নাহ’ বইয়ের লেখক। যে কিতাবে সে লিখেছে, “যেই তার (সাদ সাহেবের) বিরোধিতা করবে সেই বিদ্রোহী এবং ফেতনাবাজ, একে কতল করা ওয়াজিব। কুরআন-হাদীসের আলোকে শরীয়তে বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট। এ বিধান (কতল করা) কার্যকর করার জন্য কোনো ইসলামী প্রশাসনের প্রয়োজন নেই। গোটা উম্মতের উপর এ হুকুম।” -পৃ. ১৬

মুকীম সাথী বলেন, “এরকম উস্কানিমূলক কথাবার্তা তারা আগে থেকেই বলত। যেমন, ‘মারকায দখল করার জন্য রক্ত দিতে হলেও দেব’। আজ সেটা তারা বাস্তবায়ন করে দেখাল। তবে রক্ত দিয়ে নয়, রক্ত নিয়ে!”

 

এ ঘটনা কী বার্তা দেয়

এ হল টঙ্গীর বিশ্বইজতেমার ময়দানে গত ১ ডিসেম্বর ’১৮তে ঘটে যাওয়া তা-বের কিঞ্চিত বিবরণ। এখানে মাত্র কয়েকজনেরই আলোচনা এসেছে। এ থেকেই অনুমান করতে পারেন, একদিন ইকরামুল মুসলিমীনের তালকীন হত যে ময়দান থেকে সেই ময়দানেই অপর মুসলমান ভাইয়ের উপর বাতিলকে মেনে না নেওয়ার ‘অপরাধে’ কী নির্মম লীলা চালানো হয়।

হৃদয়বিদারক এঘটনায় সব পক্ষের জন্যই রয়েছে শিক্ষার অনেক উপকরণ। যারা আক্রান্ত, যারা আক্রমণকারী’ যারা তাবলীগের মুরব্বী ও যারা সাধারণ কর্মী এবং মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও পরিচালকম-লী আর সর্বস্তরের বিবেকবান ও দ্বীনসচেতন মানুষ- সবার জন্যই এই ঘটনা অনেক অনেক বার্তা বহন করে। মর্মান্তিক এই ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও নিন্দাবাদ জানানোর পাশাপাশি আমাদের নিজেদের ভুলত্রুটিগুলোরও আলোচনা হওয়া দরকার। যেন আগামী দিনের কর্তব্য স্থির করা সহজ হয়। বারবার যেন এ দেশের আলেম ও তালিবে ইলম সমাজকে ৫ মে ও ১ ডিসেম্বরের করুণ পরিণতি বরণ করতে না হয়; সেজন্য এখন থেকেই সাবধানী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর তা সম্ভব প্রত্যেকটা ঘটনার আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে নিজেদের সরলতা আর অন্যদের ধূর্ততা ও হিং¯্রতার জায়গাগুলো সনাক্ত করার মাধ্যমে এবং ভবিষ্যতে এমন স্পর্শকাতর মুহূর্তগুলোতে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার মধ্য দিয়ে।

 

এটা জুলুম, এটা জাহেলিয়াত

সর্বপ্রথম যে কথাটি এখানে বলা অনিবার্য তা হচ্ছে, এই নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলায় অংশ নিয়ে যারা সেদিন নিরপরাধ মানুষগুলোর রক্তে হাত রঞ্জিত করল তাদের বুঝতে হবে, এটা পরিষ্কার জুলুম। এক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের জান-মালের ক্ষতি সাধন করা কিছুতেই বৈধ নয়। এরপর অন্যায়ভাবে হতাহত করে তার জন্য আবার বিজয়োল্লাস! এ তো আরো ভয়াবহ অপরাধ। এমন কবীরা গুনাহ যখন অবলীলায় সংঘটিত হয় তখন এর পরিণতি হয় অত্যন্ত ভয়ংকর। যে মতবাদ ও চিন্তাধারা অবলম্বন করার কারণে আজ এই বিপর্যয়, সে ব্যাপারে কি ভেবে দেখার সময় আসেনি!

দ্বীন রক্ষার দুর্গ মাদরাসাগুলোর প্রতি এবং দ্বীনের রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত আলেম-উলামার প্রতি দ্বীনের মেহনতের দাবিদারদের তরফ থেকে এরকম বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ও আচরণ যে কতটা খতরনাক তা কি সাথীরা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবেন! হয়ত, না বুঝেই অনেকে এমন ধ্যানধারণায় দীক্ষিত হয়েছেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলব, আমীরের এতাআতের নামে যেসব ভয়ংকর দর্শনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন এবং নিজের ঈমান-আমল বরবাদ করতে চলেছেন- সেসব চিন্তা ও দর্শনের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করে নেওয়া কি বুদ্ধিরই দাবি নয়? যে গলতমতবাদের কারণে ইসলামী দাওয়াতের কর্মীদের একটি দল তাদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত হকপন্থীদের এমন নৃশংসভাবে মারল, সে মতবাদ নিয়ে কি এ প্রশ্ন ওঠে না- এর উপাদানগুলোতে ইসলামের উপস্থিতি কতটুকু, আর জাহেলিয়াতের সংমিশ্রণ কতখানি? বরং আদৌ এতে ইসলামের উপাদান আছে কি না, নাকি আগাগোড়া পুরোটাই জাহেলিয়াত?!

যে মেহনতের মূল বুনিয়াদ হল ইকারমুল উলামা বা ইকরামুল মুসলিমীন সে মেহনতের দাবিদারগণ অন্তত এ ছিফাতের লাজ তবে কতটুকু রাখলেন!

এ ঘটনায় আমরা আরো দেখলাম, মানুষ বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হলে কত কী ঘটাতে পারে। আর সেই বিপথগামীরা যখন সংঘবদ্ধ হয়ে কোনো দল-উপদলের রূপ ধারণ করে  তখন তা কেমন ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে! মুলত এক অন্যায় ও বাতিলের তরফদারি করার জন্য আরো কত অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হয়- এতাআতী ভাইদের আচরণ এর জঘন্য উদাহরণ। যে দর্শন ও ধ্যানধারণা আপন মুসলিম ভাইয়ের রক্তকে হালাল করে দেয়, তাদেরকে অন্যায়ভাবে আঘাত করতে উৎসাহ যোগায় এবং সেটাকে পবিত্র জিহাদের সমতুল্য হওয়ার ধারণা দেয়- সেটা কি হতে পারে ইসলাম? যারা এই মতবাদে একটি বিরাট গোষ্ঠীকে দীক্ষিত করে তোলে তারা কীভাবে হতে পারে ঈমানের মেহনতওয়ালা?!

 

কর্মবণ্টন পদ্ধতি প্রয়োজন

মাদরাসার তালিবে ইলমদেরকে তাদের দরস ও মুতালাআর নিয়মিত মাশগালার বাইরে অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত করার ক্ষেত্রে কত বেশি মিতব্যয়ী ও সাবধান হওয়া প্রয়োজন- এ ঘটনা ও এ ধরনের অন্যান্য ঘটনায় সেটাও এখন সামনে এসে গেল। আসলে সবক্ষেত্রেই কর্মবণ্টন পদ্ধতি অনুসরণ করা ভালো।  তাহলে সব অঙ্গনের তাকাযা ও দাবি পূরণ করা সম্ভব হবে সহজে ও সুন্দরভাবে। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হবে না। কোথাও কোনো শূন্যতা দেখা দেবে না এবং দাওয়াত ও তাবলীগের চলমান পরিস্থিতির মতো এমন সংকটও হয়ত তৈরি হবে না ভবিষ্যতে, ইনশাআল্লাহ। তালীম ও তাযকিয়ার মতো দাওয়াতের অঙ্গনেও জাতি যোগ্য অভিভাবক ও পরিচালকদের পাশে পাবে এবং হক ও হক্কানিয়াতের উপর অটল থেকে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে আস্থা ও নির্ভরতার সাথে।

 

ইতিহাস সংরক্ষণে অবহেলা নয়

১ ডিসেম্বরের ঐ আক্রমণে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়া জরুরি। কেননা এগুলোই হল ইতিহাসের দলীল। পূর্ণাঙ্গ বিবরণসহ এ তথ্য লিপিবদ্ধ না হলে ইতিহাস বিকৃতির আশংকা আছে। যার কিছু আলামত তো ঘটনার পরপরই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

এই বিষয়ে কিছু কাজ তো হয়েছে। কেউ কেউ আহতদের তালিকা তৈরি করার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি আহতরা যদি নিজস্ব রোযনামচায় তাদের প্রত্যেকের ঘটনা বিস্তারিত লিখে রাখেন তাহলে এই মর্মান্তিক ইতিহাস সংরক্ষণে সেটা বিরাট ভূমিকা রাখবে, ইনশাআল্লাহ। নিজেদের ইতিহাস সংরক্ষণে, বিশেষত ত্যাগ, রক্তদান ও অর্জনের এমন ইতিহাসকে কাগজের বুকে গচ্ছিত রাখতে কোনোভাবেই অবহেলা করা উচিত হবে না। নিতান্ত পার্থিব স্বার্থজড়িত আবেগঘন ও চেতনা উদ্দীপক ঘটনাগুলোর বিবরণ নিয়ে অন্যরা যেখানে রচনা করে হাজার কবিতা-গল্প-উপন্যাস... সেখানে নিঃস্বার্থভাবে কেবল আল্লাহ্রই জন্য দ্বীন ও দাওয়াতের ময়দানে আমাদের ঝরানো রক্তের উপাখ্যান কেন আমরা তুলে ধরব না? এ গল্প, এ বয়ান ইসলামের বৃক্ষকেই আরো সজীব করবে- ইনশাআল্লাহ।

তাছাড়া জালিমরা দু‘ভাবেই আমাদের পরাস্ত করতে চায়। মাঠের ত্রাস ও তা-বলীলার পর তারা মেতে উঠেছে ভয়ানক তথ্যসন্ত্রাসে। হামলার দায় এড়াতে তারা পাল্টে দিতে চায় হামলাকারী পক্ষ ও গোষ্ঠীর পরিচয়। আক্রান্তকে তারা চিত্রিত করছে আক্রমণোদ্যত হিসেবে। গায়ের জোর এবং গলার জোর দুটোকে একত্র করে তারা চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘টঙ্গীর ইজতিমা মাঠ দখলে কওমী মাদরাসার কোমলমতি শিশুদের ব্যবহার করা হল কেন?’ আশ্চর্য! যারা টঙ্গী মাঠে অবস্থিত মাদরাসার হিফযখানায় ঢুকে পড়ে মাসুম বাচ্চাগুলোকে মারধর করতে পর্যন্ত ছাড়েনি, আল্লাহ্র কুরআনের অবমাননা করতেও দ্বিধা করেনি, কেঁদে কেঁদে মাফ চাওয়া সত্ত্বেও সাঁতার না জানা শিশুগুলোকে নদীতে ফেলে দিতে যাদের বাধেনি- তারা এখন এসেছে মাদরাসার নামে অভিযোগ করতে!

ইজতিমার মাঠ কারা দখল করতে গিয়েছিল এবং কী উদ্দেশ্যে- তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে, ওদেরই কর্তাব্যক্তিদের জবানবন্দী থেকে। ইজতিমার মাঠ প্রস্তুত করা ও তার পাহারা  দেয়া- এটা যদি হয় মাঠ দখলের অর্থ তাহলে এ কাজে তো প্রতিবছরই মাদরাসার ছাত্ররা অংশ নিচ্ছে। তাছাড়া কাকরাইল মারকায থেকেই প্রতি বছর ইজতিমার আগে মুরব্বীরা বিভিন্ন মাদরাসার কাছে তাকাযা পেশ করে আসছেন, তাদের কাজে সহযোগিতার জন্য। ‘কক্ষচ্যুত হওয়া’র সঙ্গে সঙ্গেই তারা সমস্ত তথ্য ভুলে গেলেন!... আসলে তাই তো হওয়ার কথা। আলো থেকে সরে গেলে শুধুই তো অন্ধকার-

فَمَا ذَا بَعْدَ الْحَقِّ اِلَّا الضَّلٰلُ.

[হককে প্রত্যাখ্যানের পর গোমরাহী ছাড়া আর কী থাকে। -সূরা ইউনুস (১০) : ৩২]

যারা বিপথগামী তারা বিপথেই হাঁটবে।   কিন্তু আমাদের সচেতন হতে হবে, যাতে সত্য ঢাকা না পড়ে যায় এবং মিথ্যার প্রচার না হয়ে পড়ে। অতএব ইতিহাস সংরক্ষণে উদসীনতা নয়।

 

সব ফিতনার ব্যাপারেই সতর্কাবস্থা

তাবলীগের দলছুট মানুষগুলোর সৃষ্ট এই বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের কারণে আমাদের সংবেদনশীলতার পাশাপাশি বর্তমানে আমাদের সমাজে উদ্ভূত অন্যান্য ফিতনা ও বিশৃঙ্খলার বিষয়েও আমাদের সজাগ সতর্ক থাকা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, সব ফিতনা ও অরাজকতার পিছনেই মূলত ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’-এর অভাব।

দ্বীন ও দ্বীনের মেযাজ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অভাব থেকেই নতুন নতুন ভ্রান্ত মত ও বিভ্রান্ত গোষ্ঠীর জন্ম ও উৎপত্তি হয়। তাই আমাদের উচিত, সর্বোতভাবে এই ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’ অর্জনের মেহনতে নিয়োজিত থাকা এবং টঙ্গী ট্রাজেডির নেপথ্যের ফিতনার মতো ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দীনে’র অভাবজনিত আরো যত ফিতনা আজকে আমাদের তালিবে ইলম সমাজকে অস্থির করে রাখছে সেক্ষেত্রে সতর্কাবস্থা গ্রহণ করা। এখানে সংবেদনশীল হব, আর ওখানে গা ভাসিয়ে দেব- এটা কাম্য নয়। চিন্তাশীলতার অভাবই অগভীর চিন্তার দিকে আমাদের দ্রুত টেনে নেয়। আমাদের উচিত পূর্বসূরীদের প্রদর্শিত পথ ও পন্থায় নিজেরা চিন্তা করতে শেখা এবং যে কোনো চটকদার কথাকে গ্রহণের আগে বিচক্ষণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে তার ভুল-ভাল জেনে নেওয়া। না হলে আমরা হয়ে পড়ব বানে ভাষা খড়কুটার মতো। যার কোথাও কোনো স্থায়িত্ব নেই। স্রােতের টানে যে কোনো দিকেই ভেসে চলে এবং যে কোনো কূলেই পাড়ি জমায়!...

আমাদের অগভীর চিন্তার আরেকটি ফলাফল এই যে, কোনো একটি ফিতনা : ভ্রান্ত ও বিভ্রান্ত নতুন চিন্তা ও মত যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন আমাদের মাঝে বিপরীতমুখী দু‘টো প্রবণতা দেখা যায়। কেউ তা নির্দ্বধায় গিলে নেয়। আর কেউ তার রদ করতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করে বসে। দু‘টোই প্রান্তিকতা। এক্ষেত্রে মধ্যপন্থা হল, উদ্ভূত ফিতনার মোকাবেলার ক্ষেত্রে শরয়ী তরীকা ও নীতি অবলম্বন করা। ইলমী তরীকায় ও বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় তথা ইসলামী নীতিমালা মেনে ঐ ফিতনার খ-ন ও আপত্তিসমূহ উত্থাপন করা হলে সেটা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে বেশি ফলদায়ক হওয়ার আশা করা যায়। এক্ষেত্রে যে কোনো স্থূল ও ভিত্তিহীন কথা সযতেœ এড়িয়ে যাওয়া উচিত। নতুবা পরোক্ষভাবে তা ফিতনাকারীদের কথাকেই জোরদার করবে। তারা তখন বলার সুযোগ পাবে, ‘আলেমরা অবাস্তব ও ভিত্তিহীন কথা বলে’। অতএব ফিতনার মোকাবেলার ক্ষেত্রে বাস্তব ও বিধিসম্মত কথা বলা চাই।

 

সকলের প্রতি

পরিশেষে সকলের কাছে দরখাস্ত, যারা বিচ্যুত পথে রয়েছেন, তারা হকের পথে ফিরে আসুন। আর যারা হক পথে আছি, আমরা হকের পথে আরো বেগবান হই। ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে হকের ভিত্তিতে এক হয়ে আমরা দ্বীন-ঈমানের মেহনত করি। এই মেহনতের যে ছয় ছিফাত রয়েছে, এর গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে একরামুল মুসলিমীন। এখন এই ছিফাতের পরিচয় দেওয়ার সময় এসেছে। বাতিলকে প্রত্যাখ্যান করে হকের উপর হিম্মতের সাথে অবিচল থাকতে হবে। মন্দ আচরণের জবাব হবে উত্তম আখলাকের মাধ্যমে; মন্দ দিয়ে নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ لَا تَسْتَوِی الْحَسَنَةُ وَ لَا السَّیِّئَةُ اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ فَاِذَا الَّذِیْ بَیْنَكَ وَ بَیْنَهٗ عَدَاوَةٌ كَاَنَّهٗ وَلِیٌّ حَمِیْمٌ.

আর ভাল এবং মন্দ সমান হতে পারে না। তুমি মন্দকে প্রতিহত কর এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। ফলে যার ও তোমার মাঝে শত্রুতা ছিল সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। -সূরা হা-মীম সাজদাহ (৪১) : ৩৪

 

advertisement