জান্নাতী ছিফাতের এক নারী
হযরত মুফতী রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী রাহ. একবার প্রসঙ্গক্রমে নিজ নেককার বিবির কিছু হালত বর্ণনা করেন। একজন জান্নাতী নারীর যিন্দেগী কেমন হতে পারেÑ এ থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়। হযরত বলেনÑ
নিজেকে ও এতটাই বিলীন করে দিয়েছে যে, নিজ থেকে এসে মতামত দিবে তো দূরের কথা, কোনো বিষয়ে তার মতামত জিজ্ঞাসা করা হলেও সর্বদা তার জবাব থাকে একটাইÑ ‘আপনি যা ভালো মনে করেন’। শুনেছি ছেলেমেয়ে বড় হলে রিশতা সম্বন্ধের মূল পর্বটা নারীরাই মিটিয়ে নেয়। যদিও শরীয়া ও বিবেক উভয় বিবেচনায় এ ব্যাপারে মূল দায়িত্বটা তাদের কাঁধে না দেওয়াই উচিত। কিন্তু আল্লাহর এ বান্দী এক্ষেত্রেও ঐ একই জবাব দিতÑ ‘আপনি যা ভালো মনে করেন’।
গৃহস্থ কায়-কারবার ও একা একাই সামাল দেয়। অসুস্থতার দরুন একবার ওর সহযোগিতার জন্য এক মহিলা রেখে দেই। কিন্তু দেখি যে, কাজের মহিলাকে মেহমানের মত চৌকিতে বসিয়ে রেখে নিজের অসুস্থ শরীর নিয়েই একা একা কাজ করে যাচ্ছে সে। বাধ্য হয়ে কাজের মহিলা বাদ দিতে হল। ঘরে মেয়েরা আছে। পুত্র বধুরা রয়েছে। তবুও প্রায় সব কাজ সেই করবে।
ঘর থেকে বের হওয়া ওর মোটেই পছন্দ নয়। ভাই-বোনদের বাড়ীতে যাবে, তাও খুবই কম। নারীদের কোনো আসরে বা গল্প-গুজবে তেমন মন নেই। খাওয়া-দাওয়া আর পোশাক-পরিচ্ছদে বিলকুল সাদাসিধা। কখনও কখনও পীড়াপীড়ির পর ভালো দামী কোনো পোশাক পরত বটে। কয়েকদিন পরেই মাযেরাত করে বলত, আমার এতে কষ্ট হচ্ছে গো! খাবার-দাবার ও পোশাক-আশাকে এমনই সাদামাটা। চলাফেরা গাম্ভীর্যপূর্ণ। প্রয়োজন ছাড়া কোনো কিছুই সংগ্রহ করবে না ও।
পঞ্চাশ বছর এভাবেই কেটে যায়। পরে যখন ইছলাহী সম্পর্কের নিসবতে এবং ঘরোয়া তালীমের কারণে বাড়ীতে মহিলাদের আসা যাওয়া বেড়ে যায়, আমি ওকে বোঝালামÑ দেখ, তোমার এমন সাদামাটা চলা ফেরায় অন্যরা ভুল বুঝতে পারে। তারা মনে করতে পারে, এদের হয়ত কিছু নেই। তাহলে আল্লাহ তাআলার নিআমতের এক ধরনের নাশুকরী হবে। আলহামদু লিল্লাহ, এভাবে বলাতে বেচারি বুঝতে পারে। এরপর থেকে কিছুটা ভালো পোশাক-আশাক পরতে শুরু করে।
নতুন নতুন ড্রেসের প্রতি ওর আগ্রহ নেই। শীত গরম মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে ওর জামা মাত্র ছয় জোড়া। প্রতি ঈদে নতুন জামা বানাবে না। গাম্ভীর্য ও অভিজাত পোশাক ব্যবহার করবে। তবে তা হবে সাদাসিধা। চাকচিক্য ও কৃত্রিম ফ্যাশনে ও একেবারে বিরক্ত। সংক্ষিপ্ত অলংকার। একবার যা হয়েছে, ব্যস। তা বাড়ানোরও ফিকির নেই। ডিজাইন পরিবর্তনেরও ইচ্ছা নেই। খোদাপ্রদত্ত গাম্ভীর্যের কারণে খান্দানে সবাই ওকে ‘রাণী’ ডাকে।
খানা পিনায় ও বেহদ রকমের অকৃত্রিম। বহু সধাসাধির পরও আয়েশি খাবারে তার আগ্রহ হয় না। নিজে খাওয়ার পরিবর্তে অন্যকে খাওয়াতে সে আনন্দ অনুভব করে। অসুস্থতায় ‘দাওয়া’র পরিবর্তে ‘দুআ’র প্রতি তার তাওয়াজ্জুহ বেশি। চিকিৎসা করলেও মামুলি কিসিমের। বড় ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ করতে চায় না।
এতটা সাদামাটা ও অনাড়ম্বর হওয়ার পরও ছাফ-সুতরা ও পয়-পরিষ্কারের ব্যাপারে ও যতটা মনোযোগী ও যতœবান, ঠাটবাট ও পারিপাট্যে আসক্ত নারীরা তা আঁচও করতে পারবে না।
ওর অভ্যাস হল, কেউ তার কোনো ক্ষতি করলেও সে কিছু বলবে না। কেউ তার বিরুদ্ধে মুখিয়ে উঠলে সে বিলকুল খামোশ থাকবে। প্রত্যুত্তর যেন তার অভিধানে নেই। কথা একেবারেই কম বলে।
আমাদের প্রতিবেশী এক মৌলবী ছাহেব ছিলেন। কী কারণে যেন বাচ্চাদের প্রসঙ্গ নিয়ে মৌলবী ছাহেবের বিবি ছাহেবা একেবারে বেলাগাম হয়ে গেল। চিৎকার করে হাবিজাবি বলতে লাগল। আমরা ঘরে বসে সব ছাফ শুনতে পাচ্ছিলাম; যেন সে আমাদের শুনিয়েই সব বলছিল। আমি খেয়াল যাহের করলাম, মৌলবী ছাহেবকে গিয়ে বলি, বিবিকে একটু বুঝিয়ে সমঝিয়ে থামান। কিন্তু ওর যেন আমার হাতে ধরা অবস্থা! বলল, না না, আপনাকে ওখানে গিয়ে কিছু বলার দরকার নেই। আমরা ছবর করব।
ঘটনাটি বোধহয় খুব সহজেই বলে ফেললাম। কিন্তু ঐ পরিবেশ পরিস্থিতিতে এরকম আখলাকের পরিচয় দেওয়া বড় হিম্মতের বিষয় ছিল।
ফিকরে আখেরাতের হালত হল, একবার কঠিন দূরারোগ্য ব্যাধিতে ও কাতর ছিল। এক বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও সুস্থ হয়ে ওঠেনি। খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর। বড় বড় দ্বীনদাররাও সে সময় রোযা রাখার হিম্মত করেন না; এমন মুহূর্তেও সে রোযা বাদ দেয়নি। কিন্তু যেহেতু তার পাকস্থলীতে সমস্যা ছিল তাই কিছুক্ষণ পর পর পেটে কিছু না দিলে উপায় থাকত না বিধায় বেচারি কয়েকটি রোযা আর রাখতেই পারল না। একদিন অসুস্থতার প্রাবল্যে বলে উঠলÑ ‘আয় আল্লাহ! তুমি ব্যস আমাকে এতটুকু জীবন দান কর, যাতে ছুটে যাওয়া রোযাগুলো কাযা করার সময় পাই!’ ওই সময় বাচ্চারা সব ছোট ছোট ছিল। কিন্তু কী পরিমাণ আখেরাতের ফিকির থাকলে একজন মা বাচ্চাদের চেয়ে নিজের আমলের কাযা আদায়ের জন্য বেশি পেরেশান হতে পারে! এটা রব্বে কারীমেরই অনুগ্রহ বৈ আর কিছু নয়।
আমার সাথে ওর সম্পর্ক হল ভালবাসা ও মহব্বতের। আমার আনুগত্যে যেন ও আত্মবিলীন। ও শুধু নিজের ঘর সংসারই বুঝে। এতেই সে আনন্দ ও তৃপ্তি বোধ করে। নিকটাত্মীয়দের বাড়ীতে বেড়াতেও ওর আগ্রহ নেই। ওর এসকল আচরণে খান্দানে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছেÑ আমি নাকি ওকে এভাবে বশ করে রাখার জন্য তদবীর করেছি। মোটকথা বাইরের পরিবেশে কারো সাথে মিশতে নেহায়েত সংকোচ বোধ করে সে।
আমরা দারুল উলূম কৌরঙ্গী অবস্থানকালে একবার মুফতী শফী রাহ.-এর আম্মাজান সকল আসাতেযার বিবিদের দাওয়াত করেন। আমি দাওয়াতের সংবাদ পৌঁছাতেই ও সংকোচে কেমন কাঁচুমাচু করতে থাকে। আমি উৎসাহ জুগিয়ে বললাম, হযরত মুফতী ছাহেব হুযূর আমাদের উস্তায। এ হিসেবে তাঁর আম্মাজান আমাদের দাদীজান হন। চলো, যেতে সমস্যা কী! কিন্তু সে এতই লাজুক ছিল যে, এতভাবে বোঝানোর পরও মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারল না। আমিও আর চাপাচাপি করা মুনাসিব মনে করলাম না। কিছুক্ষণ পর হযরত মুফতী ছাহেব নিজেই আমাদের ঘরে চলে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার আমাদের ঘরে আসছ না যে? আমি পুরো হালত খুলে বললাম। মুফতী ছাহেব হুযূর সব শুনে বললেন, ও আচ্ছা! আমি তো ভেবেছিলাম কোনো নারাযীর কারণে কি না?
আরেকবার দারুল উলূমেই ফুলপুরী রাহ. সপরিবারে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেন। কিন্তু সে হযরত পীরানী ছাহেবার সাথেও মোলাকাতের জন্য গেল না। হযরত জানলে আবার কী না কী মনে করেন ভেবে নিজেই হযরতের খেদমতে হাযির হয়ে ওযরখাহী করলাম। পুরো হালত শোনালাম। হযরত শুনে বললেন, এ তো তার তবীয়তে সালীমার আলামতÑ বিশুদ্ধ স্বভাবের পরিচয়। দ্রষ্টব্য : আনওয়ারুর রশীদ ১/২২২-২২৫ হ
তরজমা : আশিক বিল্লাহ তানভীর