Rabiul Auwal 1441   ||   November 2019

দাদা ভাইয়ের এতেকাফ

আবু মাইমুনা

জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতিগুলোর একটি হল দাদা ভাইয়ের এতেকাফের স্মৃতি। অনেক আগের কথা। তখন আমি ছোট। বয়স দশ কি বার। দাদার বয়স তখন সত্তরেরও বেশি। চুল দাড়ি সব সাদা। পল্লি-গাঁয়ের সাদাসিধা মানুষ। ছিলেন গাঁয়ের এক সাধারণ কৃষক। কিন্তু দিল ছিল আল্লাহপ্রেমে ভরপুর। আল্লাহর ভয়ে তার হৃদয় ছিল সদা কম্পমান। চোখে থাকত সর্বদা অশ্রুর বান।

প্রতি রমযানে এতেকাফে বসতেন। গ্রামের মসজিদে। বাড়ি থেকে মসজিদ খানিকটা দূরে। পায়ে হাঁটা দশ মিনিটের পথ। তিনি ছিলেন গ্রামের মসজিদের অঘোষিত মুয়ায্যিন। একাধারে অনেক বছর আযান দিয়েছেন। মসজিদের ছোট্ট একটি বারান্দা ছিল। সেখানেই আমার কুরআন মাজীদের হাতেখড়ি।

২০ই রমযান। জোহরের পর। বাড়ির সবাই ব্যস্ত। দাদা ভাই এতেকাফে যাবেন। কেউ বিছানা ভাঁজ করছে। কেউ বা জামা-কাপড়। কেউ ঠিক করছে পানের বাটা।

এরই মধ্যে দাদা ভাই বাড়ির সবাইকে ডাকতেন। আমরা ছোটরা দৌড়ে যেতাম তার কাছে। তিনি আমাদেরকে বলতেনÑ দুষ্টামি করবে না। দাদির কথা শুনবে। বৌমাদের বলতেনÑ দাদির প্রতি খেয়াল রাখতে। তাঁর কথা মেনে চলতে। দাদিকে বলতেনÑ সবার দিকে খেয়াল রেখো। আমার জন্য দুআ করো।

বিদায় নিয়ে দাদা আস্তে আস্তে হেঁটে চলতেন। আমরাও পেছনে পেছনে। কারো হাতে বিছানা, কারো হাতে ব্যাগ। এতেকাফের দিনগুলোতে মসজিদে আমরা দাদাকে ঘিরে বসতাম। তিনি আমাদেরকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের গল্প শোনাতেন।

দাদা এতেকাফে বসার পর আমার ইফতারি মসজিদেই হত। প্রতিদিন তার জন্য ইফতারি নিয়ে যেতাম মসজিদে। ইফতারের সময় দাদা আমার জন্য বাটিতে কিছু খেজুর ও ইফতার রেখে দিতেন। নামাযের পর পাশে বসিয়ে খেতে দিতেন। আর তিনি নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন।

নামায শেষে প্রাণ খুলে দুআ করতেন। আমিও পাশে বসে হাত উঠাতাম তার সঙ্গে। এখনো যেন কানে বাজে দাদার দুআÑ ‘গোনাহ করছি ভুল কইরাছি/ জীবনের গোনাহ মাফ করো গো আল্লাহ/ এ জীবনে আর গোনাহ  করব না।’

দাদা এ বলে কাঁদতেন আর কাঁদতেন। আমি তাকিয়ে থাকতাম দাদার মুখের দিকে। তারাবির নামায পড়ে বাড়ি ফিরতাম ছোট চাচার সঙ্গে। তখন খুব খারাপ লাগত। আবার সকাল হতে না হতেই দৌঁড়ে যেতাম দাদার কাছে। বাড়িতে ভালো লাগত না।

দাদা এতেকাফের সময়টা কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, যিকির আযকার আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের জীবনী আলোচনায় কাটাতেন। অন্য কোনো কথা বলতেন না। মাঝে মাঝে বাড়ির খোঁজ-খবর নিতেন। এভাবে কখন যে দশটা দিন কেটে যেত টেরই পেতাম না।

২৯ রমযানে আমরা ছোটরা মসজিদে যেতাম দলবেঁধে। পশ্চিম আকাশে একফালি বাঁকা চাঁদ। কি মিটমিট করে হাসছে। আর এরই মাঝে আমাদের ‘ঈদ’ শুরু হয়ে যেতÑ দাদা বাড়ি যাবেন বলে। সকলের মাঝে খুশির জোয়ার। চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক।

এতেকাফ শেষে দাদা বাড়ি ফেরার সময় গোল বেঁধে যেত ছোটদের মাঝে, কে কী নিয়ে যাবেÑ এ নিয়ে। ও বলে আমি বিছানা নিব, এ বলে আমি নিব। পানের বাটা একজন, ব্যাগ আরেকজন।

মাগরিবের পর খুব মজা করে সবাই মিলে দাদার সামানা নিয়ে রওয়ানা হতাম বাড়িতে। দাদা এশার নামায পড়ে তারপর আসতেন। এভাবে দাদা প্রতি বছর এতেকাফে বসতেন। আর চাঁদ ওঠার পর দাদার এতেকাফ শেষ হলে আমরা ঈদের আগেই ‘ঈদ’ করে ফেলতাম।

এই তো ক’দিন হল, দাদা আমার জান্নাতে এতেকাফে চলে গেছেন (এমনটিই আল্লাহ্র কাছে আশা রাখি)। তখন বিছানা গোছানোর ব্যস্ততা ছিল না। ছিল না ব্যাগ ও পানের বাটা ঠিক করার ব্যস্ততা। কিছুই দেওয়া হয়নি তাঁর সাথে। শুধু একটা সাদা কাফন। তাও সেলাই ছাড়া।

এখন আর আমাদের ঈদের আগে ‘ঈদ’ আসবে না। দৌড়ে যাব না দাদাকে আনতে। কারণ দাদা আর আসবেন না। আসল বাড়ি থেকে কেউ আর ফিরে আসে না!

দাদা যখন চলে গেলেন তখন আম্মু বলেছিলেন, তুমিও যদি দাদার মত ভালো মানুষ হও, নিয়মিত নামায পড়, রমযানে রোযা রাখ, এতেকাফ কর, আম্মু-আব্বুর কথা শোন তাহলে তুমিও যেতে পারবে দাদার কাছে, জান্নাতে!

আল্লাহ! আমার দাদাকে তুমি জান্নাতের উঁচু মকাম দান কর! আমাদের দাদা-দাদি সকলের সব গোনাহ মাফ করে দাও! তাদের কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দাও! আমাদেরকে তাঁদের মত ভালো মানুষ হওয়ার তাওফীক দাওÑ আমীন।

 

advertisement