Rabiul Auwal 1441   ||   November 2019

খ্রিস্টানদের মহাসভা : খ্রিস্টধর্ম বিকৃতির এক প্রকৃষ্ট প্রমাণ

Mawlana Abdul Matin

ভূমিকা :

প্রচলিত খ্রিস্টবাদ বিকৃত ধর্ম হওয়া একটি সাধারণ বাস্তবতা। তেমনি বাইবেল বা প্রচলিত ‘ইঞ্জিল শরীফ’ আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত তাওরাত, জাবুর ও ইঞ্জিল না হওয়ার বিষয়টিও স্বীকৃত বাস্তবতা। তাছাড়া এ-ও এক বাস্তবতা যে, বাইবেল বা প্রচলিত ‘ইঞ্জিল শরীফ’ সীরাত বা ইতিহাসের মানবরচিত কোনো নির্ভরযোগ্য গ্রন্থও নয়। কারণ এতে রয়েছে অগণিত বিকৃতি ও পরিবর্তন, বৈপরিত্য ও ভুলভ্রান্তি। স্বয়ং খ্রিস্টান গবেষকগণও এ বিষয়ের সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

এসকল বাস্তবতা যাদের জানা নেই তাদের কমপক্ষে নিম্নোক্ত কিতাবগুলো অধ্যয়ন করে নেওয়া উচিত।

১. عیسائیت کیا ہے، شیخ  الاسلام حضرت مولانا محمد تقی عثمانی دامت برکاتہم

বাংলা : খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, অনুবাদ : হযরত মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম।

২. খৃষ্টবাদ বিকৃতি : তথ্য ও প্রমাণ, হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন।

৩. বাইবেল বিকৃতি : তথ্য ও প্রমাণ, হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন।

৪. ইঞ্জিল ও প্রচলিত ইঞ্জিল : একটি পর্যালোচনা, মাওলানা মুনশী মুহাম্মদ মহিউদ্দিন।

প্রচলিত খ্রিস্টবাদ বিকৃত ও পরিবর্তিত হওয়ার ছোট্ট (কিন্তু নিজ স্থানে তা অনেক বড় ও সুস্পষ্ট) একটি প্রমাণ হল খ্রিস্টানদের মহাসভাসমূহ। মহাসভার স্বরূপ ও ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এ বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রচলিত খ্রিস্টধর্ম আসমানী ধর্ম নয় বরং মানবরচিত। যাতে বিকৃতিকারীদের হামলা লাগাতার চলেছে।

দ্বীনী বিষয়ে দ্বীনের ধারক-বাহকগণের মজলিস বা সভা হতেই পারে। কিন্তু এ ধরনের মজলিস বা সভা নতুন উদ্ভূত সমস্যাসমূহের সমাধানকল্পে অথবা দ্বীন ও শরীয়তকে বিদআতমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই আয়োজিত হয়। কিংবা বিভ্রান্তকারীদের ভ্রান্তি ও সংশয়কে প্রতিহত করার জন্য হয়ে থাকে। আর শরীয়তের মৌলিক ও অকাট্য বিষয়াবলি তো স্বীকৃত ও স্বতঃসিদ্ধ হয়ে থাকে।

খ্রিস্টানদের মহাসভার সংজ্ঞায় তারা যা-ই বলুক না কেন, এর স্বরূপ ও ইতিহাস কিন্তু সকলের নিকট সুস্পষ্ট। মহাসভার ভিত্তিই যেন এর উপর রচিত হয়েছে যে, খোদ খ্রিস্টানদের কাছেই দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের নবীর দেওয়া শিক্ষা সংরক্ষিত নেই। আর কিছু সংরক্ষিত থাকলেও তারা জেনে বুঝে মহাসভার মাধ্যমে নবীর মূল শিক্ষার পরিবর্তে বিকৃতিকারীদের বিকৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে।

আল্লাহ তাআলা হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেবকে জাযায়ে খায়েন দান করুন। তিনি প্রামাণ্য গ্রন্থাবলির উদ্ধৃতিতে সাবলীল ও সহজ ভাষায় মহাসভার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। এ প্রবন্ধ অনেক পাঠকের হয়ত কাজে নাও আসতে পারে; কিন্তু গবেষক ও যারা ‘রদ্দে ঈসাইয়্যাত’ বিষয়ে কাজ করতে চান তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তোহফা। বিশেষভাবে ‘দাওয়াহ বিভাগ’ ও ‘আদইয়ানে বাতিলা ও ফিরাকে মুনহারিফা’ বিভাগ-এর তালিবে ইলমদের জন্য একটি উপকারী প্রবন্ধ।

দাওরায়ে হাদীসের তালিবে ইলমগণ সহীহ বুখারীর হাদীস فإن عليك إثم الأريسيين -এর মর্মার্থ বুঝার জন্যও এই প্রবন্ধ থেকে উপকৃত হতে পারেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক দ্বীনের উপর অটল থাকার সৌভাগ্য দান করুন। দ্বীন ও শরীয়তকে সালাফে সালেহীনের অনুসৃত পন্থায় বুঝার ও মানার তাওফীক দান করুন- আমীন।

মহাসভার বাতিল সিদ্ধান্তগুলো বাতিল হওয়ার বিষয়টি যদিও স্পষ্ট তাও পাঠকদের সুবিধার জন্য কোথাও কোথাও টীকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। টীকাগুলো লিখেছেন মাওলানা মুনশী মুহাম্মদ মহিউদ্দিন। প্রবন্ধকার হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন ছাহেব সেগুলো দেখে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে জাযায়ে খায়ের দান করুন।

-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

 

মহাসভা কী?

ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় মহাসভার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে-

In the christian church, a meeting of beeshops and other leaders to consider and rule on questions of doctrine, administration, discipline, and other matters.

অর্থাৎ চার্চের পরিভাষায় মহাসভা হল খ্রিস্টীয় বিশ্বাস, চার্চ পরিচালনা, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য বিষয়ে কোনো নীতি নির্ধারণের নিমিত্তে বিশপ ও অন্যান্য নেতৃবর্গের সভা।

 

সার্বজনীন মহাসভা

কাথলিক খ্রিস্টানদের মতে মহামান্য পোপ দ্বারা আহূত বা তৎকর্তৃক অনুমোদিত মহাসভাকে সার্বজনীন মহাসভা বলা হয়। প্রটেস্ট্যান্টরা অবশ্য এ সংজ্ঞা সমর্থন করে না।

 

মহাসভা কেন?

খ্রিস্টধর্ম গবেষকগণ বলে থাকেন, যীশুখ্রিস্ট তাঁর ধর্ম পরিচালনার ভার দিয়েছেন মণ্ডলীর (চার্চ) উপর। তিনি তাঁর ধর্মের সবকিছু খোলাখুলিভাবে বলে যাননি। ফলে মণ্ডলীকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হয়- তারা কী বিশ্বাস পোষণ করবেন এবং ধর্মকার্য কীভাবে পালন করবেন। সেইসঙ্গে পূর্ববর্তী বিশ্বাসমন্ত্রের সঙ্গে যে বিভিন্নমুখী চিন্তাস্রােত এগিয়ে চলতে থাকে, সেগুলোর মধ্য থেকে সত্যটাকে আলাদা করতে হয়। এগুলিই মহাসভার কাজ।

 

মহাসভার অভ্রান্ততা

কাথলিক বিশ্বাসমতে-

Decrees so promulgated have the highest authority in the Roman Catholic Church.

অর্থাৎ মহাসভাগুলোতে যেসব সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয় সেগুলো রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ দলিল ও উৎস। ২য় ভ্যাটিকান মহাসভায় এ সিদ্ধান্ত হয় যে, মহাসভার অভ্রান্ততার সীমানা ঐশ প্রত্যাদেশের সত্য পর্যন্ত প্রসারিত। (দেখুন, ক্যাথলিক মণ্ডলীর ধর্মশিক্ষা, পৃ. ২৫২, ধারা নং ৮৯১)

 

সার্বজনীন মহাসভার সংখ্যা

এ ধরনের মহাসভা মোট একুশটি। প্রথমটি নিসিয়া মহাসভা। আর শেষটি হল দ্বিতীয় ভ্যাটিকান মহাসভা। তন্মধ্যে অর্থডক্স চার্চ সমর্থন করে মাত্র প্রথম সাতটিকে। অবশিষ্ট চৌদ্দটি নিজেদের আভ্যন্তরীণ গোলযোগ মেটানোর জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর প্রথম সাতটি সার্বজনীন মহাসভার সপ্তমটি ছিল আইকোনক্লাজম বা মূর্তি ভাঙ্গার বিষয়ে (৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে)। অবশিষ্ট ছয়টিতে খ্রিস্টান জগতের বর্তমানে প্রচলিত মূল ধর্মবিশ্বাস নিরূপিত ও চূড়ান্ত অনুমোদিত হয়। প্রথম দুটিতে ত্রিত্বের বিশ্বাস চূড়ান্ত হয়। বাকি চারটি অনুষ্ঠিত হয় ঈসা আলাইহিস সালামের ঈশ্বরত্ব নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে এবং এ নিয়ে জন্ম নেওয়া নানা মতবাদের খণ্ডনে। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা প্রথম মহাসভা থেকে ষষ্ঠ মহাসভা পর্যন্ত Age of councils ev Controversy period (বাদানুবাদকালীন সময়) বলে থাকেন। নিম্নে আমরা এ ছয়টি সার্বজনীন মহাসভা নিয়ে অল্প বিস্তর আলোচনার প্রয়াস পাব।

 

১ম মহাসভা

১ম নিকিয়া/নিসিয়া মহাসভা

(৩২৫ খ্রি.)

 

স্থান পরিচিতি

খ্রিস্টান লেখক ও গবেষকগণ বাংলায় এ মহাসভার স্থানটিকে নিসিয়া নামে উল্লেখ করেছেন। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে এটির অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে, বোসফরাসের একটু দক্ষিণে বিথিনিয়ায় অবস্থিত নিসিয়া। (পৃষ্ঠা: ৯০) কিন্তু আরবীতে বলা হয়েছে نيقية (নিকিয়া)। খ্রিস্টান আভিধানিক আলমুনজিদ গ্রন্থে আ‘লাম বা প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের জীবনী অংশে লিখেছেন نيقيا। ইংরেজিতে লিখেছেন ঘরশধরধ। সে হিসাবে বাংলা উচ্চারণ হয় নিকায়া। আলমুনজিদ গ্রন্থকার আরও বলেছেন, এর বর্তমান নাম ইযনিক (Iznik)। উচ্চারণ যাই হোক এটি বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত একটি স্থান।

 

প্রেক্ষাপট

ক. খ্রিস্টধর্মে বহিরাগত পৌল ত্রিত্ববাদের ভিত রচনা করেছিলেন। পক্ষান্তরে হযরত ঈসা মাসীহ আলাইহিস সালামের শিষ্য-শাগরিদগণ জীবনভর নির্ভেজাল একত্ববাদ শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এ দ্বিমুখী শিক্ষা সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে এর ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। নিজেদের মধ্যে ভীষণ মারামারি ও হানাহানি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘খৃষ্টবাদ বিকৃতি : তথ্য ও প্রমাণ’ পুস্তকে স্বয়ং পলের বিভিন্ন চিঠিপত্রের আলোকে এ নিয়ে আমরা সবিস্তার আলোচনা করেছি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সম্রাট কর্তৃক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের উপর চরম নির্যাতন ও নিপীড়ন চলতে থাকলে চলমান ঐ পারস্পরিক সংঘাত ও হানাহানি কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।

৩১৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টান্টাইন (২৭২-৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ) (Constantine the Great) খ্রিস্টানদের ধর্ম পালন ও প্রচারে স্বাধীনতা ঘোষণা (যাকে বলা হয় The Edict of Milan) করলে উক্ত সংঘাত ও হানাহানি আবারও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘খ্রিস্টমণ্ডলীর উপর নির্যাতন প্রশমিত হওয়ার আগে বিভিন্ন মতানৈক্যগুলো মূলত কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু ৩১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে তা দ্রুত গোটা সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৮৯)

আলেকজান্দ্রিয়ার যাজক আরিয়ুস (Arius of Alexandria) (২৫৬-৩৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ও ধর্মপাল আলেকজান্ডার (Alexander of Alexandria) (মৃত্যু ৩২৬/৩২৮ খ্রিস্টাব্দ)-এর মতভেদ ও দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যজুড়ে ভীষণ হৈ চৈ ফেলে দেয়। আরিয়ুস যীশুর ঈশ্বরত্ব স্বীকার করতেন না। বরং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহতে বিশ্বাস করতেন। পক্ষান্তরে আলেকজান্ডার ছিলেন যীশুর ঈশ্বারত্বের ঘোর সমর্থক। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-                                                                 

‘যখন বৈঠক ও আলাপ আলোচনায় কোনো ফল হল না, তখন আরিয়ুস ও তার এক ডজন অনুসারীকে মণ্ডলীচ্যুত করা হয় (৩১৮ খ্রিস্টাব্দ)। অবশ্য আরিয়ুস তার বিরুদ্ধে এই শাস্তিকে মেনে নেননি। তিনি তার অনুসারীদের সঙ্গে দেখা করতে যান। প্রাচ্যে তাদের সংখ্যা ছিল বিপুল। এরা তার অভিমতকে শিক্ষা পরম্পরা বলে গণ্য করে থাকে। এ নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় গোলযোগ বেধে গেল। হাটে বাজারে ও সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ধর্মতাত্ত্বিক অবমাননা চলতে থাকল। তার ধ্যান-ধারণা বিপক্ষ দলের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার্থে আরিয়ুস বই-পত্র লিখলেন ও গান রচনা করলেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯০)।

 

কে ছিলেন এই আরিয়ুস :

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘আলেকজান্দ্রিয়ার কোনো এক ধর্মপল্লীর একজন কড়া ও শ্রদ্ধাভাজন যাজক ছিলেন আরিয়ুস। তার আগের অন্যান্য আরও অনেকের মত তিনিও এক অদ্বিতীয় ঈশ্বরের অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখতে চেয়েছিলেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৮৯)

খ্রিস্টান গবেষক ড. আসাদ রুস্তম লিখেছেন -

وكان أريوس فيما يظهر عالماً زاهداً متقشفا يجيد الوعظ والإرشاد، فالتف حوله عدد من المؤمنين، ...، وانضم إليه عدد كبير من رجال الاكليروس الذين وجدوا في وعظه غذاء للنفوس، فآثروا الإصغاء إليه. (كنيسة مدينة الله الأنطاكية العظمى، الدكتور أسد رستم، ج ص ১৯৩)

অর্থাৎ আরিয়ুস ছিলেন একজন জ্ঞানী, দুনিয়াবিমুখ ও সাধক, বক্তৃতা ও উপদেশদানে তিনি খুব পটু ছিলেন। ফলে বিশ্বাসীদের অনেকে তার পাশে ভিড়তে থাকেন।... তার উপদেশে তারা মনের খোরাক পেতেন। ফলে তারা আগ্রহভরে তার কথা শুনতেন। (কানীসাতু মাদীনাতিল্লাহিল আনতাকিয়্যাহ আলউযমা, ড. আসাদ রুস্তম, খ- : ১, পৃষ্ঠা : ১৯৩)

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে যে বলা হয়েছে, “তার আগের অন্যান্য আরও অনেকের মত তিনিও এক-অদ্বিতীয় ঈশ্বরের অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখতে চেয়েছিলেন।” এ ‘অন্যান্য আরও অনেক’ কারা তা এখানে স্পষ্ট করা হয়নি। আমরা পূর্বেই বলে এসেছি, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিষ্যগণ সকলে একত্ববাদেরই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এ শিক্ষাপরম্পরাই ছিল আরিয়ুসের শিক্ষার মূল ভিত্তি।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে অন্যত্র বলা হয়েছে-

‘ইহুদী-খ্রিস্টানগণ যে কোনো মূল্যে তাদের নিজস্ব বিশেষ ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মাচার অক্ষুণ্ন রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। তারা পরিচ্ছেদন ও খাদ্য সংক্রান্ত নানা বিধি-নিষেধের ব্যাপারে একনিষ্ঠ ছিল। বাইবেলে নির্দেশিত একেশ্বরবাদ টিকিয়ে রাখতে উদ্বিগ্ন ছিল। তারা মনে করত যীশু একজন মানুষের মত। যাঁকে ঈশ্বর তাঁর দীক্ষাদানের দিনে সন্তানরূপে গ্রহণ করেছেন। এরূপ মত পোষণের দরুন তারা অন্যান্য খ্রিস্টীয় সম্প্রদায় কর্তৃক ভ্রান্ত মতবাদী বলে অচিরেই গণ্য হয় এবং তাঁরা নিজেদের মধ্যে পিছু হটতে বাধ্য হয়।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৬২)

এখানেই প্রশ্ন হয়, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিষ্যরা তো সকলেই ছিলেন ইহুদীয় খ্রিস্টান। তবে এ অন্যান্য খ্রিস্টীয় সম্প্রদায় কারা, যারা নাকি ইহুদীয় খ্রিস্টানদেরকে ভ্রান্ত মতবাদী আখ্যা দেয়? এরাই কি পলের দীক্ষাগ্রহণকারী মানসপুত্ররা নয়?

 

আরিয়ুসের বিশ্বাস কী ছিল?

আরিয়ুসের বিশ্বাস সম্পর্কে মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকের এক স্থানে বলা হয়েছে-

‘নিম্নোক্ত রচনাটিতে আরিয়ুস তার শিক্ষা তুলে ধরেছেন। তার বিরোধীদের উদ্ধৃতি থেকে এ রচনার কথা জানা যায়। “ঈশ্বর সর্বদা পিতা ছিলেন না। এমন এক সময় ছিল, যখন তিনি তখনও পিতা হননি; তারপর পিতা হলেন তিনি। পুত্রও সবসময় ছিলেন না; কেননা সবকিছুই তো শূন্য হতে সৃষ্ট হয়েছে, সমস্ত অস্তিত্বশীল জীব ও কার‌্যাবলী সৃষ্ট হয়েছে। তদ্রূপ স্বয়ং ঈশ্বরের বাণীও শূন্য হতে সৃষ্ট হয়েছে এবং একসময় তাঁর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সৃষ্ট হবার আগে তিনি ছিলেন না। কিন্তু তাঁরও সৃষ্টির একটা আরম্ভ ছিল। কেননা ঈশ্বর নিঃসঙ্গ ছিলেন, বাণী ও প্রজ্ঞা তখনও অস্তিত্ব লাভ করেনি...।

“আমাদের সকলের মত ঐশ বাণীও পরিবর্তনসাপেক্ষ, কিন্তু নিজের মধ্যে তিনি মুক্ত; তাঁর যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ তিনি ভাল থাকেন। ইচ্ছা করা মাত্র তিনি আমাদের মত বদলে যেতে পারেন; যেহেতু স্বভাবে তিনি পরিবর্তনসাপেক্ষ...।

“ঐশবাণী সত্যিকারের ঈশ্বর নন। তাঁকে ঈশ্বর বলা হলেও আসলে তিনি তা নন; ঐশ অনুগ্রহে অংশগ্রহণের ফলেই তিনি তা...। স্বভাবে সমস্ত কিছু যেমন ঈশ্বর হতে পৃথক ও তাঁর থেকে ভিন্ন, তেমনি ঐশ বাণীও পিতার মূল সত্তা ও স্বধর্ম থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক; তিনি তো জীব ও কার‌্যাবলীর শ্রেণী-বিন্যাসের অন্তর্গত; তিনি তাদেরই একজন...।

“পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মূলসত্তা স্বভাগতভাবে বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন, অসংযুক্ত এবং তাদের মধ্যে আদান-প্রদান বিহীন; এভাবে তাঁরা মূল সত্তায় ও মহিমায় সম্পূর্ণরূপে অসদৃশ বা ভিন্ন...।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯০)

এ উদ্ধৃতিতে আরিয়ুসের বক্তব্য কতটুকু বিশুদ্ধরূপে উপস্থাপিত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। শূন্যস্থানগুলোতে আর কী কী কথা ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন জাগাও অবান্তর কিছু নয়। যতটুকু উদ্ধৃত হয়েছে, তার সারাংশ হল, পুত্র সৃষ্ট, তিনি অনাদি নন, ফলে তিনি ঈশ্বর হতে পারেন না। এ বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক।

যাকি শানুদা তার তারীখুল আকবাত গ্রন্থে (খ. ১, পৃ. ১৫১) বলেছেন-

إنه يؤمن بإله واحد متعال يفوق حد التصور منطو على نفسه. وهو من العلو بحيث لا صلة له بتاتا بأي شيء له نهاية، و هو فريد لا شبيه له، أزلي لا بداية له، وهو وحده سبحانه ينفرد بهذه الصفات، وعندما شاءت إرادته أن يخلق عالما ذا نهاية احتاج إلى وسيط، ولم يكن في هذا الوسيط قوة خالقة، وإنما كان عاملا بسيطا علمه الأب كيفية القيام بهذه المهمة. وهذا الوسيط لم يأت من عند الرب بأن صدر عنه أو انحدر منه. بل خلقه الأب خلقا. فهو إذن غير أزلي. وهو مخلوق مثل باقي المخلوقات. ولا يمتاز عنها إلا بكونه خلق قبلها، وبأنه كان الواسطة التي استخدمها الله في عملية الخلق. ثم بعد ذلك عملية الفداء. وليس هو مساويا للأب في الجوهر بل بالعكس. تتغير طبيعته مثل أي مخلوق. وهو كأي مخلوق قادر على عمل الخير والشر...

وهو أيضا معرض للخطأ ولا يستطيع أن يحيط بكل شيء...

(النصرانية من التوحيد إلى التثليث، ص১৭০-১৬৯)

অর্থাৎ তার বিশ্বাসের সারকথা হল, তিনি এক আল্লাহতে বিশ্বাস করতেন। যিনি সর্বোচ্চ ও কল্পনাতীত। তিনি এতই সুউচ্চ যে, অন্ত ও শেষ আছে এমন কিছুর সাথে তার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তিনি একক, তার মত কেউ নেই। তিনি অনাদি, তার কোনো শুরু নেই। তিনি এককভাবে এসকল গুণে গুণান্বিত। তিনি যখন এমন এক জগৎ সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলেন, যার অন্ত ও শেষ আছে, তখন প্রয়োজন দেখা দিল একজন মাধ্যমের। উক্ত মাধ্যমের মধ্যে সৃষ্টি করার ক্ষমতা ছিল না। পিতা এককভাবে তাকে কাজে লাগিয়েছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পালনের পন্থা শিখিয়েছেন। এই মাধ্যম আল্লাহ থেকে সঞ্জাত হয়নি, তাঁর কাছ থেকে নেমেও আসেনি। বরং পিতাই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনি অনাদি নন। বরং অন্যান্য সৃষ্টির মতই এক সৃষ্টি। অন্যান্য সৃষ্টি থেকে তার বৈশিষ্ট্য শুধু এতটুকু যে, তাকে সকল কিছুর পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছে।১  পরে ব্যবহার করা হয়েছে পরিত্রাণের কাজে।২  তিনি মূল সত্তায় পিতার সমান নন; বরং এর বিপরীত। অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় তার স্বভাব পরিবর্তন হয়। অন্যদের মত তিনিও ভাল ও মন্দ কাজ করতে পারেন।৩  তাঁর ভুল-ভ্রান্তিও হতে পারে। তিনি কোনো কিছুকেই আবেষ্টন করতে পারেন না। (আননাসরানিয়্যাহ মিনাত তাওহীদ ইলাত তাছলীছ, পৃ. ১৬৯-১৭০)

আরিয়ুসকে এক ডজন অনুসারীসহ মণ্ডলীচ্যুত করার পর তিনি কোথায় গেছেন তাও ‘মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি’তে স্পষ্ট করা হয়নি।

মুহাম্মাদ আহমাদ আলহাজ¦ লিখেছেন-

ولكن أريوس استمر بدعوته نشيطا واستطاع أن يكسب أعدادا كبيرة من رجال الدين وكثر مؤيدوه من الأساقفة خارج مصر (>وبين هؤلاء أساقفة كل من نيقوميدية، قيصرية فلسطين، بَيْسَان، اللد، صور، بيروت، اللاذقية، عين زربة في قلقيلية، وتبعه عدد كبير من غير الأساقفة<. كنسية مدينة الله الأنطاكية العظمى، د. أسد رستم: ১/১৯৪). (النصرانية من التوحيد إلى التثليث، ص ১৭৩)

অর্থাৎ আরিয়ুস জোর প্রচার অব্যাহত রাখেন এবং মিসরের বাইরে বিপুলসংখ্যক ধর্মপালকে তার স্বপক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। (সেইসব ধর্মপালের মধ্যে ছিলেন নিকোমেদিয়া, ফিলিস্তিনের কায়সারিয়া (সিজারিয়া), বায়সান, লুদ, সূর (টায়ার), বৈরুত, লাজেকিয়া (লোডেসিয়া) ও কিলকিলিয়ার আয়ন যারবার ধর্মপাল। এছাড়াও সাধারণ জনগণের মধ্যেও বিপুলসংখ্যক তার অনুসারী হয়ে যান। -কানীসাতু মাদীনাতিল্লাহিল আনতাকিয়্যাহ আলউযমা, ড. আসাদ রুস্তম, খ. ১, পৃ. ১৯৪) (আননাসরানিয়্যাহ মিনাত তাওহীদ ইলাত তাছলীছ, পৃ. ১৭৩)

এখানে আননাসরানিয়্যাহর লেখক আলেকজান্দ্রিয়ার চিত্র তুলে ধরেননি। তিনি আসাদ রুস্তমের বক্তব্যের ঐ অংশটুকু উদ্ধৃত করেননি, যাতে আলেকজান্দ্রিয়ার অবস্থা আলোচিত হয়েছে। আসাদ রুস্তমের পূর্ণ বক্তব্য থেকে আমরা সেখানের অবস্থা জানতে পারি। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকেও বলা হয়েছে- এ নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় গোলযোগ বেধে গেল। হাটে বাজারে ও সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ধর্মতাত্ত্বিক অবমাননা চলতে থাকল। (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯০)

অবস্থা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে গড়িয়েছিল তা বোঝার জন্য মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটিই যথেষ্ট :

“রাজপথে ঐশতত্ত্ব

‘অলিগলি, চৌরাস্তা, উন্মুক্ত স্থান, সড়ক-শহরের সর্বত্রই শুধু এই আলাপ-আলোচনা। কাপড় বিক্রেতা, মুদ্রা-বিনিময়কারী, মুদি- সবাই এ আলোচনায় মুখর।

আপনি যদি কোনো মুদ্রা বিনিময়কারীকে জিজ্ঞেস করেন বিনিময় হার কত, তাহলে সে জাত ও অজাত-এর উপর একটি সারগর্ভ বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শুরু করবে তারপর এর জবাব দেবে। রুটি বিক্রেতাকে রুটির গুণগত মান ও মূল্য সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেবে- পিতাই সর্বশ্রেষ্ঠ আর পুত্র তাঁর অধীন। স্নানগৃহের জল প্রস্তুত আছে কি না জিজ্ঞেস করলে ম্যানেজারের জবাব পুত্রের উৎপত্তি শূন্য হতে। জানি না এই উপদ্রবকে কী নামে অভিহিত করা যায়- উন্মত্ততা নাকি পাগলামী...।”

নিসার গ্রেগরী, পুত্র ও পবিত্র আত্মা ঐশ্বরত্ব বিষয়ক, ৫ম’। (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৫)

এ থেকে অনুমিত হয় আলেকজান্দ্রিয়ায় কত বিপুলসংখ্যক লোক আরিয়ুসের ভক্ত ও সমর্থক ছিলেন।

একজন ক্যাথলিক ইতিহাসবিদ তার সম্পর্কে বলেন-

>كان أريوس... طويل القامة، نحيل الجسم، مكتئب المظهر، ذا مظهر تبدو فيه خشونة العيش، وكان معروفا بأنه من الزهاد،... وكان له بين رجال الدين عدد كبير من المؤيدين< (قصة الحضارة، ول وايريل ديورانت، ج১১، ص ৩৯২)

অর্থাৎ আরিয়ুস ছিলেন... দীর্ঘাকৃতির ও শীর্ণকায়। ক্লেশপূর্ণ জীবন যাপন তার চেহারায় ফুটে উঠত। দুনিয়াবিমুখতায় তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন।... ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের এক বিরাট সংখ্যা তার অনুগামী ছিলেন। (কিছ্ছাতুল হাদারাহ, ভেল ডিওরান্ট, খ. ১১, পৃ. ৩৯২)

نشأ فى بيئة مسيحية خالصة، درس اللاهوت فى الإسكندرية منذ ريعان شبابه، واهتم بالمسائل الدينية، وعرف بالتقوى والزهد والتقشف، فعينه بطريك إسكندرية شماساً ثم قساً وواعظا، ووصف بأنه كان ذكيا فصيحا، يجيد الوعظ والإرشاد،...، هذا يشير إلى إخلاصه وعدم اتهامه بالزندقة وغيرها،... أضف إلى ذلك صموده وصبره الطويل أمام رجال الدين المنحرفين وأمام الإمبراطور نفسه بجبروته و عظمته. (النصرانية من التوحيد إلى التثليث، د. محمد أحمد الحاج، ص১৬৯-১৬৮)

অর্থাৎ আরিয়ুস খাঁটি খ্রিস্টান পরিবারে লালিত-পালিত হন। যৌবনকালেই আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মীয় ও ঐশী বিদ্যা অর্জন করেন। ধর্মীয় একাধিক বিষয়ের প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন। খোদা-ভীতি, দুনিয়াবিমুখতা ও বিলাস বিবর্জিত জীবন যাপনে তিনি বেশ খ্যাতি লাভ করেন। এসব কারণেই আলেকজান্দ্রিয়ার পেট্রিয়ার্ক তাকে প্রথমে শামমাস বা ধর্মীয় গুরু পরে উপদেশ দানকারী পাদ্রী পদে নিয়োগ দান করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বিশুদ্ধভাষী। হিতোপদেশ দানে তিনি ছিলেন খুবই দক্ষ। ...এসব থেকে তার একনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁকে ধর্মের অপব্যাখ্যাকারীরূপে অভিযুক্ত করার কোনো কারণ পাওয়া যায় না। সেইসঙ্গে ভিন্ন মতাবলম্বীদের সামনে তার অবিচলতা ও অসম ধৈর্য, বিশেষভাবে সম্রাটের শৌর্য-বীর্য ও প্রতাপের সামনে এভাবে অটল অবিচল থাকা তার নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতাই প্রমাণ করে। (আননাসরানিয়্যাহ মিনাত তাওহীদ ইলাত তাছলীছ, পৃ. ১৬৮-১৬৯)

যাহোক, সাম্রাজ্যজুড়ে এ গোলযোগ সম্রাটকে ভাবিয়ে তোলে। রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তিনি ৩২৫ খ্রিস্টাব্দে এক মহাসভা আহ্বান করেন। ইতিহাসে এটিই নিসিয়া মহাসভা নামে খ্যাতি লাভ করে। কারও কারও মতে এ মহাসভা দুই মাস বারো দিন অর্থাৎ ৭২ দিন পর্যন্ত চলমান থাকে। কেউ কেউ বলেছেন, ৯৭ দিনের কথা।

 

সদস্য সংখ্যা

যাকি শানুদার মতে ২০০০ জন।

ইবনুল বিতরিকের মতে ২০৪৮ জন।

হেলারিউসের মতে ৩১৮ জন।

আফতাতিউসের মতে ২৭০ জন।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতিতে বলা হয়েছে ৩০০ জনের কথা।

‘দ্বিতীয় ভ্যাটিকান মহাসভার দলিলসমূহ’ বইয়ের শেষে ‘খ্রিস্টমণ্ডলীর সার্বজনীন মহাসভাসমূহ’ শিরোনামের একটি তালিকায় প্রথম নেসিয়া মহাসভার পোপ হিসেবে তৎকালীন রোমের পোপ প্রথম সিলভেস্টার (Sylvester I) (সময়কাল ৩১৪-৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দ)-কে দেখানো হয়েছে। তবে তিনি অসুস্থতার কারণে তাতে উপস্থিত হতে পারেননি। তার প্রতিনিধিত্বকারী দুজন যাজক- গলদেশের দিয়ার ধর্মপাল নিকাসিয়াস Nicasius of Dia in Gaul) ও কর্ডোবার ধর্মপাল হোসিয়াস (Hosius of Cordoba) (২৫৬-৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ) তাতে অংশগ্রহণ করেন এবং হোসিয়াস মহাসভার সভাপত্বি করেন। এছাড়াও উপস্থিত ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে আরিয়ুস, আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল আথানাসিয়াস (Athanasius of Alexandria)  (মৃত্যু ৩৭৩ খ্রিস্টাব্দ), কার্থেজের সিসিলিয়ানের  (Cecilianus)  নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

 

আলোচ্য বিষয় : যীশুর ঈশ্বরত্ব

মহাসভায় বিতর্ক

মহাসভার পুরো আলোচনা কারও লেখাতেই ফুটে ওঠেনি। এতটুকু পাওয়া যায় যে, আলোচনার একপর্যায়ে আরিয়ুস ও আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল আথানাসিয়াসের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্কটি ছিল এমন :

আরিয়ুস : সুলায়মান আ.-এর যবানে যীশু বলেছেন, আপন সৃষ্টিকর্মের সূচনা থেকেই প্রভু আমাকে সৃষ্টি করেছেন। (মেছাল/প্রবচন  ৮ : ২২)

বোঝা গেল যীশু সৃষ্ট। আর সৃষ্ট কখনও খোদা হতে পারেন না।

আথানাসিয়াস : সৃষ্টি করেছেন অর্থ জন্ম দিয়েছেন। যেমন দাউদকে আল্লাহ বলেছেন, তুমি আমার পুত্র, আজ আমি তোমাকে জন্ম দিলাম।

আরিয়ুস : পুত্র তো বলেছেন, পিতা আমার চেয়ে বড়। (যোহন ১৪ : ২৮) তাহলে পুত্র পিতার চেয়ে ছোট হচ্ছেন। সমান নয়।

আথানাসিয়াস : হাঁ, পুত্র পিতা থেকে এ হিসাবে ছোট যে, তিনি মানবদেহ ধারণ করেছেন। যেমন উক্ত পদের শুরুতেই বলা হয়েছে- তোমরা যদি আমাকে মহব্বত করতে তবে আমি আমার পিতার নিকট যাচ্ছি বলে আনন্দ করতে। কারণ পিতা আমার চেয়েও বড়।

আরিয়ুস : পুত্র তো (বিচার দিবস সম্পর্কে) বলেছেন, সেই দিন ও সময়ের কথা কেউ জানে না, বেহেস্তের ফেরেস্তারাও না, পুত্রও না। কেবল পিতাই জানেন। (মথি ২৪ : ৩৬)

আথানাসিয়াস : যীশু তাঁর শিষ্যদের এ কথা এজন্য বলেছেন, যাতে তারা এই গুপ্ত বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস না করে, যে বিষয়ে তাদের অবহিত হওয়া উচিত নয়।

আরিয়ুস : যীশু তো বলেছেন, এটা আমি তোমার ইচ্ছায় করতে পারি না। বরং যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাঁর ইচ্ছায়।

তবে তো তিনি পিতার দাস এবং তাঁর অপেক্ষা ছোট প্রমাণিত হলেন।

আথানাসিয়াস : যীশু কখনো কথা বলেছেন, দেহ ধারণকারী ঈশ্বররূপে। যেমন :

ক. খোদা আমার, খোদা আমার, কেন তুমি আমাকে ছেড়ে গেছ। (মথি ২৭ : ৪৫)

খ. যিনি আমার ও তোমাদের পিতা, যিনি আমার ও তোমাদের খোদা, আমি উপরে তাঁর নিকট যাচ্ছি। (যোহন ২০ : ১৭)

কখনও তিনি ঈশ্বররূপে কথা বলেছেন, যেমন :

ক. যে আমাকে দেখে, যিনি আমাকে পাঠিয়েছেন, সে তাঁকেই দেখে। (যোহন ১২ : ৪৫)

খ. পিতা আমার মধ্যে আছেন, আর আমি পিতার মধ্যে আছি। (যোহন ১০ : ৩৮)

(দেখুন, আলখারীদাতুন নাফীসাহ ফী তারীখিল কানীসা, খ. ১, পৃ. ২৮৯-২৯২)

দেখা যাচ্ছে, আরিয়ুসের সব দলিল-প্রমাণই বলিষ্ঠ, তথ্যপূর্ণ, ধর্মীয় কিতাবভিত্তিক ও যুক্তিপূর্ণ। পক্ষান্তরে আথানাসিয়াসের বক্তব্য নিজের স্থিরিকৃত বিশ্বাসের পক্ষে টেনে-হিঁচড়ে ব্যাখ্যা দাঁড় করানো বৈ কিছু নয়।

 

ফলাফল ও সিদ্ধান্ত

এক. ১ম নিসিয়া মহাসভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, যীশু খোদার পুত্র। তিনি ঈশ্বর।৪ সম্রাট কনস্টান্টাইনও এ মতের পক্ষে জোর সমর্থন ব্যক্ত করেন। সম্রাট যেহেতু পৌত্তলিক ছিলেন এবং খ্রিস্টান গবেষকদের মতে তিনি মৃত্যুশয্যায় দীক্ষাস্নাত হয়েছিলেন। (দ্র. মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৬৯)।

তাই যীশু ঈশ্বর হলে তার কিছু আসে যায় না। তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। ফলে সভার অধিকাংশ সদস্যের মতামত অনুযায়ী তিনি সরকারি ফরমান জারি করেন এবং আরিয়ুস ও তার পক্ষাবলম্বনকারী সদস্যদেরকে নির্বাসিত করেন। আরিয়ুসের লেখা বই-পুস্তক বাজেয়াপ্ত করা হয়। এতেই বোঝা যায়, সভার অধিকাংশ সদস্য ছিলেন পলের মানসপুত্র।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে মহাসভার সিদ্ধান্ত এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে- 

‘এক পরমেশ্বর, দৃশ্য-অদৃশ্য সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা, সর্ব শক্তিমান পিতায় আমরা বিশ্বাস করি।

পরমেশ্বরের পুত্র, একমাত্র প্রভু যীশুখ্রিস্টেও আমরা বিশ্বাস করি। তিনি পিতা হতে জাত, একমাত্র জাত তিনি অর্থাৎ পিতার প্রকৃত সত্তা হতে জাত, তিনি ঈশ্বর সঞ্জাত ঈশ্বর, জ্যোতি সঞ্জাত জ্যোতি, প্রকৃত ঈশ্বর সঞ্জাত প্রকৃত ঈশ্বর। জনিত তিনি, সৃষ্ট নন, পিতার সঙ্গে অভিন্ন স্বরূপ। তাঁর দ্বারা স্বর্গ-মর্তের সমস্তই হল সৃষ্ট। মানব জাতির জন্য, আমাদের পরিত্রাণার্থে তিনি স্বর্গ থেকে অবরোহন এবং দেহ ধারণ করে মানুষ হয়ে জন্মালেন; যন্ত্রণা ভোগ করলেন এবং তৃতীয় দিবসে পুনরুত্থান করলেন। তিনি স্বর্গে আরোহণ করলেন এবং জীবিত ও মৃতদের বিচারার্থে সগৌরবে পুণরাগমন করবেন।

পবিত্র আত্মায়ও আমরা বিশ্বাস করি। আর যারা বলে, ‘এক সময় ছিল যখন তাঁর কোন অস্তিত্ব ছিল না’ এবং ‘তাঁর জন্মের আগে তিনি ছিলেন না’ ও ‘তাঁর উৎপত্তি শূন্য হতে’ কিংবা যারা মিথ্যা দাবি করে বলে যে, ঈশ্বর-পুত্র ‘অন্য ব্যক্তিসত্তা (hypostatis) বা অন্য প্রকৃত সত্তা (substance) বিশিষ্ট অথবা ‘সৃষ্ট বা পরিবর্তনযোগ্য’ বা ‘পরিবর্তনশীল’ সর্বজনীন ও প্রৈরিতিক মণ্ডলী তাদেরকে অভিশাপ দেয়। স্টিফেনস, A New Eusebius, ৩৬৬।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৩)

এটি নিসিয় বিশ্বাসমন্ত্র নামে খ্যাত। এটিকে আথানাসিয়াসের বিশ্বাসমন্ত্রও (Athanasian Creed)বলা হয়। খুব সম্ভব এ কারণে যে, আথানাসিয়াস এটি লিখেছেন।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘ধর্মমত সম্পর্কে তাঁদেরকে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে বলে সিজারিয়ার ইউসেবিয়ুস তাঁর মণ্ডলীর বিশ্বাসমন্ত্রটি সকলের বিবেচনার্থে পেশ করেন। মহাসভা তা মেনে নেন। কিন্তু হোসিয়াসের পরামর্শে কনস্টান্টাইন অনুরোধ করলেন, যেন ধর্মপালগণ ঈশ্বর-পুত্রের প্রসঙ্গে Homoousios (একই সত্তা বিশিষ্ট) বিশেষণটি যোগ করেন; অর্থাৎ পিতার ন্যায় পুত্রেরও একই ousia, একই প্রকৃত সত্তা বা তাঁর সমসত্তাবিশিষ্ট। উক্ত পদ বা শব্দটি পিতা ও পুত্রের মধ্যে পরিপূর্ণ সমতা প্রকাশ করে। যেহেতু সম্রাট এই সংশোধনের প্রস্তাব করেছিলেন, তাই মাত্র দুজন ছাড়া অন্য সকল ধর্মপাল তা স্বাক্ষর দিয়ে দৃঢ়ভাবে অনুমোদন করেন। যে দুজন তা অনুমোদন করেননি, তাদেরকে আরিয়ুসের সঙ্গে নির্বাসনে পাঠানো হয়। উক্ত মহাসভা এ সুযোগে মণ্ডলীর নিয়মণ্ডশৃঙ্খলা সম্পর্কে কয়েকটি সমস্যা সমাধান করে নিয়েছিল। (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯২)

এখানে ইউসেবিয়ুসের (Eusebius) নাম উল্লেখ করাটা ভুল। কারণ তিনি ছিলেন আরিয়ুসের অনুসারী।

উক্ত পুস্তকে আরো বলা হয়েছে-

“নিসিয়া মহাসভায় যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা অচিরেই ভেস্তে যায়। অনেকেই Homoousios (একই সত্তা বিশিষ্ট) কথাটি প্রত্যাখ্যান করল। কারণ ধর্মশাস্ত্রে কথাটি খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যেরা মনে করল, শব্দটি ভ্রান্ত মতবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে, যা পিতা ও পুত্রের মধ্যকার পার্থক্য ভালোমত নির্দেশ করে না। অচিরেই প্রাচ্যের অধিকাংশ মানুষ নিসিয়ার সূত্র প্রত্যাখ্যান করল- এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন আথানাসিয়াস। যিনি ৩২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল ছিলেন। পাশ্চাত্যের ল্যটিনপন্থী অঞ্চল মোটামুটি নিসিয়া মহাসভার প্রতি অনুগত রইল।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৪)

কী আশ্চর্য, বলা হচ্ছে, হোসিয়াসের পরামর্শে...। বলা হচ্ছে, দুজন ছাড়া মহাসভার সকল ধর্মপাল তা স্বাক্ষর দিয়ে দৃঢ়ভাবে অনুমোদন করেন। আবার বলা হচ্ছে, নিসিয়ার সূত্র প্রত্যখ্যানকারীদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন আথানাসিয়াস। আর সেটাকেই পরবর্তীদের অধিকাংশ প্রত্যাখ্যান করল!! তাহলে কি ভুল বিশ্বাসই সব ধর্মপাল স্বাক্ষর দিয়ে দৃঢ়ভাবে অনুমোদন করেছিলেন? যীশুর ঈশ্বরত্ব যে এ ভুলের অন্তর্ভুক্ত ছিল না তাঁরই বা গ্যারান্টি কী? ভ্রান্ত মতবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হলে সকল ধর্মপাল কীভাবে স্বাক্ষর দিয়ে তা অনুমোদন করলেন? আথানাসিয়াস ও কর্ডোবার ধর্মপাল হোসিয়াসই বা এটিকে সমর্থন করলেন কীভাবে? তাহলে কি ভুল বিশ্বাসের উপর সকলে একমত হওয়াও সম্ভব?

এ তো গেল সংযুক্ত একটি সূত্রের কথা। পরবর্তীতে পুরো নিসিয়া বিশ্বাসমন্ত্রটিই প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।

 

সম্রাটের মন পরিবর্তন ও নিসিয়া বিশ্বাসমন্ত্র প্রত্যাখ্যান

আগেই বলেছি, সম্রাট কনস্টান্টাইনের মূল চিন্তা ছিল সাম্রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলা। তাই তিনি যখন ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের গোড়াপত্তন ও সেখানে রাজধানী স্থানান্তর করেন তখন লক্ষ্য করলেন, প্রাচ্যের অধিকাংশ খ্রিস্টান ও তাদের নেতৃবর্গ আরিয়ুসের চিন্তা ও বিশ্বাস লালন করেন। সম্রাট একই লক্ষ্যে তাদের সাথে সখ্যতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মন পরিবর্তন করলেন। তিনি আরিয়ুসকে নির্বাসন থেকে আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরিয়ে আনলেন এবং তাঁকে তার পদে পুনর্বহাল করলেন, আর আথানাসিয়াসসহ অনেককে দেশান্তর করলেন।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

“সম্রাট কনস্টান্টাইন যিনি সর্বান্তঃকরণে নিসিয় বিশ্বাসসূত্রের প্রতি তার সমর্থন দান করেছিলেন। পরে কিন্তু তাঁর মত পরিবর্তন করে ফেললেন। সহিংসতার প্রাদুর্ভাব ঘটল ও অচিরেই ঘাত প্রতিঘাতের পালা শুরু হয়ে গেল। আথানাসিয়াস আরিয়ুসকে পুনর্বহাল করার পক্ষপাতী ছিলেন না বলে ৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে টায়ারের মহাসভা কর্তৃক পদচ্যুত হন ও জার্মান সীমান্তের ট্রাইয়েরে নির্বাসিত হন। নিসিয়ার প্রতি তাঁর আনুগত্যের জন্য তাঁকে আরও চারবার নির্বাসনে যেতে হয়েছে। (পৃ. ৯৪)

আরিয়ুসকে ফিরিয়ে আনার পেছনে ইউসেবিয়ূস (Eusebius of Caesarea) (মৃত্যু ৩৩৯) [যিনি ফিলিস্তিনের কায়সারিয়া (সিজারিয়া)-এর ধর্মপাল ছিলেন]-এর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। এই ইউসেবিয়ূস সম্রাটের নৈকট্য লাভ করে কনস্টান্টিনোপলের প্রেট্রিয়ার্ক নিযুক্ত হন এবং একত্ববাদের জোর প্রচার করতে থাকেন। সূর সম্মেলনে (টায়ার মহাসভা) আলেকজান্দ্রিয়ার প্রেট্রিয়ার্ক (আথানাসিয়াস) উপস্থিত হলে তিনি কৌশলে আরিয়ুসের বক্তব্য উস্কে দেন। তখন চরম হট্টগোল সৃষ্টি হয়। আথানাসিয়াসকে মেরে রক্তাক্ত করা হয়।

এ সময়কার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. মুহাম্মাদ আহমাদ তার আননাসরানিয়া গ্রন্থে বলেন-

يقول ابن البطريق: >وفي ذلك العصر غلبت مقالة أريوس على القسطنطنية وأنطاكية وبابل، والإسكندرية< (كتاب التاريخ المجموع على التحقيق والتصديق لسعيد ابن بطريق، ص ১৩৫).

ويقول: بأن الأريوسيين تغلبوا على كنائس مصر والإسكندرية >ووثبوا على اثناسيوس بطريق الإسكندرية الذي كان رئيس شمامسة الإسكندرية ليقتلوه فهرب منه واختفى... وثب أهل بيت المقدس ومن كان منهم أريوسيا على كوريس أسقف بيت المقدس ليقتلوه فهرب منهم فصيروا أراقليوس أسقفا على بيت المقدس وكان أريوسيا< (كتاب التاريخ المجموع على التحقيق والتصديق لسعيد ابن بطريق، ص ১৩৬-১৩৭). (النصرانية من التوحيد إلى التثليث،ص. ১৮২)

অর্থাৎ ইবনুল বিতরিক বলেছেন, সে যুগে আরিয়ুসের মত ও বক্তব্য কনস্টান্টিনোপল, আন্তাকিয়া (এন্টিয়ক) ব্যাবিলন ও আলেকজান্দ্রিয়া এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে। আরিয়ুসপন্থীরা মিসর ও আলেকজান্দ্রিয়ার চার্চগুলোর উপর প্রভুত্ব লাভ করে। তারা আলেকজান্দ্রিয়ার প্রেট্রিয়ার্ক আথানাসিয়াসকে- যিনি আলেকজান্ডারের নিয়োগকৃত প্রধান ধর্মপাল ছিলেন- হত্যা করার জন্য তার উপর চড়াও হয়। তিনি পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন এবং আত্মগোপন করেন। একইভাবে বায়তুল মোকাদ্দাসের অধিবাসীরা ও সেখানকার আরিয়ুসপন্থীরা বায়তুল মোকাদ্দাসের ধর্মপাল কোরেসের উপর চড়াও হয় তাকে হত্যা করার জন্য। তিনিও পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। তারা তার স্থলে আরাক্লিয়ূসকে ধর্মপাল নিযুক্ত করেন। তিনি ছিলেন আরিয়ুসপন্থী। (আননাসরানিয়্যাহ মিনাত তাওহীদ ইলাত তাছলীছ, পৃ. ১৮২ )

সম্রাট মারা যান ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে। আর আরিয়ুস মৃত্যুবরণ করেন ৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে। আরিয়ুসের মৃত্যুর পর তার চিন্তা ও বিশ্বাস আরও বেশি প্রচারিত ও প্রসারিত হয়। যাকি শানূদা বলেন-

أما تعاليم أريوس فقد انتشر بعد موته أكثر مما انتشر فى حياته وأصبح خطرا حقيقيا يهدد الكنيسة بالانهيار، وقد اشتد ساعد الأريوسيين بمعاندة الإمبراطور (يا أهل الكتاب، للدكتور رؤوف شلبي، ص.২১৭ )

অর্থাৎ আরিয়ুসের দেওয়া শিক্ষা-দীক্ষা তার জীবদ্দশায় যতটুকু বিস্তার লাভ করেছিল তার মৃত্যুর পর তা অনেক গুণে বেশি প্রসার লাভ করেছিল। এমনকি চার্চগুলির জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় আরিয়ুসপন্থীদের শক্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। (ইয়া আহলাল কিতাব, পৃ. ২১৭)

এ বক্তব্যের বিস্তারিত বিবরণ এই যে, সম্রাট কনস্টান্টাইন ৩৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আরিয়ুসের চিন্তা ও বিশ্বাসকে সমর্থন করেন এবং এর উপর থেকে সকল বাধা দূর করেন। সরকারিভাবে তিনি এর প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করেন।

সম্রাট তার মৃত্যুর পূর্বে গোটা সাম্রাজ্য তার তিন ছেলেকে বণ্টন করে দিয়ে যান।

১. দ্বিতীয় কনস্টান্টাইন (Constantine II), উত্তর আফ্রিকার মধ্যাঞ্চলের সম্রাট (৩৩৭ -৩৪০ খ্রিস্টাব্দ)।

২. কনস্টান্টিয়াস (Constantius), প্রাচ্যের সম্রাট (৩৩৭-৩৬১ খ্রিস্টাব্দ)।

৩. কনস্টান্স (Constans), রোম ও পাশ্চাত্যের সম্রাট (৩৩৭-৩৫০ খ্রিস্টাব্দ)।

দ্বিতীয় কনস্টান্টাইন অপর ভাই কনস্টান্স -এর রাজত্ব কেড়ে নিতে চাইলে দুই ভাইয়ের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। এতে কনস্টান্স জয়ী হন এবং ভাইকে হত্যা করে তার সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। কনস্টান্স ছিলেন ত্রিত্ববাদের সমর্থক, আর কনস্টান্টিয়াস ছিলেন আরিয়ুস ও তার চিন্তা ও বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের সমর্থক। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্স মৃত্যুবরণ করলে গোটা সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি ও সম্রাট বনে যান প্রাচ্যের সম্রাট কনস্টান্টিয়াস। তখন থেকে ৩৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গোটা সাম্রাজ্যে তিনি একত্ববাদের প্রচার-প্রসারে খুব মনোযোগ দেন এবং আরিয়ুসের চিন্তা-বিশ্বাাস গোটা সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে দেন। আলমুনজিদ-এর খ্রিস্টান গ্রন্থকার লিখেছেন-

مال إلى بدعة الأريوسيين. وأرسل منهم وفدا إلى جنوب الجزيرة العربية حيث أنشأوا كنائس في عدن و في أرض حمير ৩৫৬.

তিনি আরিয়ুসপন্থীদের বিশ্বাস গ্রহণ করেন এবং আরব উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। তারা সেখানে ইডেন ও হিময়ার এলাকায় ৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে অনেকগুলি চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘৩৫১ খ্রিস্টাব্দ হতে কনস্টান্টিয়াস ছিলেন সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট। তিনি আরিয়ুসবাদকে পুরোপুরি সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেন। এবার ল্যাটির ধর্মপালদেরকেই প্রাচ্যে নির্বাসনে প্রেরণ করা হয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন রোমের ধর্মপাল লিবেরিয়ুস, পৈতিয়ের হিলারী, কর্ডোবার হোসিয়াস অন্যতম।’ (পৃ. ৯৪)

এ সময়টি ছিল আরিয়ুসপন্থীদের স্বর্ণযুগ। এরপর ৩৬১ থেকে ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় আসেন কনস্টান্টাইনের ভাগ্নে জুলিয়ান (Julian)। তিনি খ্রিস্টধর্ম পরিত্যাগ করে পৌত্তলিকতা গ্রহণ করেন। (আলমুনজিদ, يوليان)

এরপর ৩৬৪ থেকে ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সম্রাট ছিলেন ভ্যালেন্স (Valens)। তার সম্পর্কে আলমুনজিদ গ্রন্থে বলা হয়েছে- اعتنق الأريوسية। অর্থাৎ তিনি আরিয়ুসের চিন্তা ও বিশ্বাস লালন করতেন। এ সময় পাশ্চাত্যে সম্রাট ছিলেন তার ভাই ১ম ভেলেন্টিনিয়ান্স (Valentinianus)| । ৩৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আলমুনজিদ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, দু’ভাই মিলে-মিশেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শাসন করতেন।

এখান থেকে বোঝা গেল, সেই ৩৩০ থেকে ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৮ বছর আরিয়ুসের চিন্তা ও বিশ্বাস রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আকাশে আরোহণের পর থেকে আরিয়ুসের মণ্ডলীচ্যুত হওয়া পর্যন্ত সময়েও বিপুল খ্রিস্টান একত্ববাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। কখনো কখনো এদের সংখ্যা বেশি ছিল, যেমনটি ‘খ্রিস্টবাদ বিকৃতি : তথ্য ও প্রমাণ’ পুস্তকে আমরা তুলে ধরেছি। এরপর ক্ষমতায় আসেন প্রথম থিওডোসিয়াস (Theodosius I) (সময়কাল ৩৭৯-৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ত্রিত্ববাদের পক্ষাবলম্বন করেন এবং আরিয়ুসপন্থীদের চিন্তা ও বিশ্বাাস নির্মূলে তৎপর হন। এ সময়েও জার্মানীতে আরিয়ুসের চিন্তা ও বিশ্বাস জোর প্রচার লাভ করে। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতিতে বলা হয়েছে-

‘উলফিলাস (৩৮৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে) জার্মানদের আরিয়ুসপন্থী খ্রিস্টীয় মতবাদে দীক্ষিত করেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৮১)

এ কারণে আলমুনজিদ প্রণেতা আরিয়ুসের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন-

انتشرت الأريوسية عند القوط واللومبارد ودامت حتى القرن ৭ ...

অর্থাৎ আরিয়ুসের চিন্তা ও বিশ্বাস কুথ (বা গোথ Goths) সম্প্রদায় (জার্মানীর একটি প্রাচীন সম্প্রদায়) ও লোমবার্দ (উত্তর ইটালির একটি এলাকার লোক) নিবাসীদের নিকট প্রসার লাভ করেছিল। এমনকি ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত তা টিকে থাকে।

দুই. নিসিয়া মহাসভায় আরেকটি মৌলিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল ধর্মীয় পুস্তক বা সুখবর বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। কুরআনে কারীমে বর্ণিত হযরত ঈসা আ.-এর উপর নাযিলকৃত ইঞ্জিলের কোনো হদিস খ্রিস্টান জগতের কাছে নেই। কখন কোথায় এটি হারিয়ে গেল কেউ তা বলতে পারে না।

তবে প্রতিটি দল ও গোত্রের কাছে যে আলাদা আলাদা ইঞ্জিল বা সুখবর পুস্তক ছিল সেকথা খ্রিস্টানরা স্বীকার করে। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘প্রেরিতগণ যখন মারা যান বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন, তখন তাঁদের লেখা স্মরণে রাখা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কোনো রচনা বা লেখাকে প্রামাণ্য বলে স্বীকৃতি দেবার উদ্দেশ্যে সেটাকে একজন প্রেরিতের নামে তুলে ধরা হয়। প্রতিটি ক্ষুদ্র দল বা গোষ্ঠীরই তার নিজস্ব মঙ্গল সমাচার ছিল। হোক তা থোমাসের, যাকোবের, পলের বা পিতরের, যে কারও। কেউ কেউ আবার মর্সিয়ান বা অন্যদেরকে নিজ পছন্দ মত বেছে নিত।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৬৫)

প্রতিটি গোষ্ঠীরই যে আলাদা আলাদা মঙ্গলসমাচার ছিল সে কথা পৌলের একাধিক চিঠিপত্রের লেখা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। তবে পৌল দাবি করেছেন, কেবল তার প্রচারিত মঙ্গল সমাচার বা সুখবরই সঠিক ছিল, অন্যগুলো নয়। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ‘খৃষ্টবাদ বিকৃতি’ পুস্তকে তুলে ধরা হয়েছে।

নিসিয়া মহাসভায় পৌলপন্থীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। ফলে বিশ্বাাসমন্ত্র যেমন তারা নিজেদের মত করে তৈরি করেছিল, তেমনি সুখবর বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। মথি, মার্ক, লুক ও যোহনের নামে যে চারটি সুখবর বাছাই করা হয়, এতে বাছাইয়ের কোনো মানদ- ছিল না। ইতিপূর্বের এ চারটির প্রামাণ্য হওয়ার কোনো কথা পাওয়া যায় না। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে গোলমেলেভাবে বলা হয়েছে-

‘এতগুলো রচনার কারণে বিভিন্ন ভক্ত সমাজে উক্ত বাছাইয়ের মানদ- খুঁজতে শুরু করলেন। ‘প্রৈরিতিকতা’ ছিল একটি। কেননা একটি রচনা প্রৈরিতিক বলতে এও বোঝায় অতি প্রাচীন, প্রেরিতশিষ্যদের আমল। কিন্তু তা হলে কী হবে, জালিয়াতি তখন মানুষের অজানা ছিল না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জালিয়াতিগুলোর প্রতি দ্বিতীয় শতাব্দীতে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়। ইরেনিয়ুসের মত অনুসারে চারটি মাত্র সুসমাচার সার্বজনীনভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এর অধিক নয়। প্রত্যক্ষ হোক আর পরোক্ষভাবেই হোক, সুসমাচারগুলো এবং তার দ্বারা সনাক্ত অন্যান্য পুস্তকাদি ছিল চারজন প্রেরিতের রচনা : মথি (সুসমাচার), পিতর (পত্র, মার্কের সুসমাচার), পল (পত্রাবলী, লুকের সুসমাচার ও শিষ্যচরিত), যোহন (সুসমাচার, প্রত্যাদেশ, পত্রাবলী)।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৬৫)৫ 

এ থেকে বোঝা যায়, জালিয়াতির অজুহাতেই অন্যগুলিকে বর্জন করা হয়। কিন্তু যেগুলো গ্রহণ করা হল তাতে যে জালিয়াতি হয়নি তার কী প্রমাণ? ইরেনিয়ুসের লেখায় তো মার্ক ও লুকের কথা বলা হয়নি। আর পৌল কীভাবে প্রেরিত হলেন সে বিতর্কও তো থেকে যায়। পৌলপন্থীদের হস্তক্ষেপে যে এ বাছাইপর্ব চূড়ান্ত হয়েছে তার বড় প্রমাণ এতে পৌলের ১২/১৩ টি পত্রকেও ঐশী গ্রন্থের মর্যাদা দিয়ে নতুন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

যা হোক, এ মহাসভায় যুডিথের পুস্তককেও প্রামাণ্য গণ্য করা হয়েছে। অবশিষ্টগুলোকে (সামনে এগুলোর নাম আসছে) সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। ৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে লোডেসিয়ার মহাসভায় (Council of Laodicea) যুডিথের পুস্তক ছাড়াও আরও সাতটি পুস্তককে প্রমাণ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেগুলি যথাক্রমে :

১. ইস্টের পুস্তক

২. ইয়াকুবের পত্র

৩. পিতরের ২য় পত্র

৪. যোহনের ২য় পত্র

৫. যোহনের তৃতীয় পত্র

৬. এহুদার পত্র

৭. ইব্রিয়

৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে কার্থেজ সম্মেলনে (Councils of Carthage) ১২৯ জন ধর্মগুরু পূর্ববর্তী দু’টি মহাসম্মেলনের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে আরও সাতটি পুস্তককে প্রামাণ্য বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেগুলির নাম যথাক্রমে :

১. উইসডম বা জ্ঞানপুস্তক

২. যোবিথ

৩. বারুখ

৪. যাজকগণ

৫. মাকাবী ১

৬. মাকাবী ২

৭. প্রকাশিত বাক্য

পরবর্তীতে টরলো (Council in Trullo)  (৬৯২ খ্রিস্টাব্দ), ফ্লোরেন্স (Council of Florence) (১৪৩১-১৪৩৯ খ্রিস্টাব্দ) ও ট্রেন্ট (Council of Trent) (১৫৪২-১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ) তিনটি মহাসভায় কার্থেজ মহাসভার সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। ৪র্থ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এগুলি প্রামাণ্য হিসেবে স্বীকৃত ছিল। পরবর্তীকালে প্রোটেস্ট্যান্টরা এসে প্রকাশিত বাক্য ছাড়া শেষোক্ত পুস্তকগুলিকে অপ্রামাণ্য আখ্যা দেয়।

 

আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত

নিসিয়া মহাসভায় আরও কয়েকটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল :

ক. মণ্ডলীর নিয়মণ্ডশৃংখলা বিষয়ে কয়েকটি সমস্য সমাধান করা।

খ. ধর্মপাল পদ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা।

গ. যাজকদের স্ত্রী থাকা নিয়ে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা।

 

২য় মহাসভা

১ম কনস্টান্টিনোপল মহাসভা

(৩৮১ খ্রিস্টাব্দ)

 

প্রেক্ষাপট :

এ সময় তিনটি মতবাদ প্রকাশ পায় এবং তা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও মতভেদ সৃষ্টি হয়। মতবাদগুলি নিম্নরূপ :

১. মেসিডনীয় মতবাদ (Macedonians)। আরিয়ুসপন্থীদের নিয়োগকৃত কনস্টান্টিনোপলের বিশপ মেসিডনিস (Macedonius of Constantinople) (সময়কাল ৩৫১-৩৬০ খ্রিস্টাব্দ) পবিত্র আত্মা সম্পর্কে প্রচার করেন যে, পবিত্র আত্মা ঈশ্বার নন। তার দিকে সম্বন্ধ করেই এই মতবাদকে মেসিডনীয় মতবাদ বলা হয়। ৩৬২ সালে তার মৃত্যু হয়।

এ মতবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন সিজারিয়ার ধর্মপাল বাসিল (Basil of Caesarea) (সময়কাল ৩৭০-৩৭৯ খ্রিস্টাব্দ)। তার দাবি ছিল, পবিত্র আত্মাও ঈশ্বার এবং পিতার ন্যায় অভিন্ন মূল সত্তা-বিশিষ্ট। বাসিলকে সমর্থন করেন নাজিয়ানূসের ধর্মপাল গ্রেগরী (Gregory of Nazianzus) (৩২৯-৩৯০ খ্রিস্টাব্দ) ও অন্যান্য অনেক ধর্মপাল। উভয় মতের সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলতে থাকে।

২. ইউসাবিয়ুসের (Eusebius) মতবাদ। তিনি ত্রিত্বের তিন সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলেন, তিনের একটি মাত্র সত্তা। অন্যান্যদের মত ছিল ত্রিত্বের সত্তাও তিনটি। এ নিয়েও সংঘাত দেখা দেয়।

৩. আপল্লিনারিয়ূসের (Apollinarianism) মতবাদ। তিনি ছিলেন সিরিয়ার অন্তর্গত লোডেসিয়ার ধর্মপাল (Apollinaris of Laodicea) (৩১০-৩৯০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি আথানিয়াসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন।

তিনি যীশুর মধ্যে মানবাত্মা থাকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি মনে করতেন, পরিপূর্ণ ঈশ্বার ও পরিপূর্ণ মানুষ তাদের পূর্ণ গুণাবলীসহ এক হতে পারে না। তাছাড়া মানবাত্মা পাপী। তাই যীশুর মানবাত্মা থাকতে পারে না। মৃত্যু ও যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষেত্রে যীশুর ঐশ্বারিক আত্মাই মানবাত্মার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল। এ মতটি নিয়েও অন্যদের দ্বিমত ছিল। সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস (Theodosius I) (সময়কাল ৩৪৭-৩৯৫ খ্রিস্টাব্দ) ৩৭৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা লাভ করেন। ৩৮০ সালে তিনি খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। তিনি ছিলেন ত্রিত্ববাদের পক্ষে। ৩৮১ সালে এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত মেটানোর জন্য পোপ দামাসুস ১ম কে (Damasus I) (সময়কাল ৩৬৬-৩৮৪ খ্রিস্টাব্দ) আহ্বায়ক করে উক্ত মহাসভার আয়োজন করেন।

 

সদস্য সংখ্যা :

১৫০ বা ১৮৬। সদস্যদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন জেরুযালেমের ধর্মপাল সিরিল (Cyril of Jerusalem) (৩১৫-৩৮৬ খ্রিস্টাব্দ) ।

 

সিদ্ধান্তসমূহ

১. নিসিয়া মহাসভায় নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি রক্ষার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।

২. পবিত্র আত্মা (পাক রূহ) সম্পর্কে এ কথাটি যোগ করা হয়। “আমি পিতার সম্ভূত জীবনদাতা পরম প্রভূ পবিত্র আত্মায় বিশ্বাাস করি, যিনি পিতা ও পুত্রের সমতূল্য স্তুতির আধার, আরাধনার ভাজন” (দ্র. মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৫-৯৬) ৬

৩. তিনটি মতবাদকেই বাতিল আখ্যা দেওয়া হয়। মেসিডনিস, তার অনুসারী ও যেসব ধর্মপাল উপরিউক্ত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন, তাদের লানত করা হয়।

 

৩য় মহাসভা

এফেসাস (إفسس- Ephesos) মহাসভা

(৪৩১ খ্রিস্টাব্দ)

প্রেক্ষাপট :

৪৩১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে খ্রিস্টান ধর্মগুরুদের মধ্যে কয়েকটি মতবাদ বেশ প্রচার লাভ করে এবং সেগুলিকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দানা বাঁধতে থাকে। মতবাদগুলোর মধ্যে ছিল :

১. নেস্তরিয়ুস (Nestorius)-এর মতবাদ বা নেস্তরিয়ুসবাদ। নেস্তরিয়ুস (৩৮০-৪৫১ খ্রিস্টাব্দ) সিরিয়ার কায়সারিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৪২৮ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্ক নিযুক্ত হন। (আলমুনজিদ)

 

নেস্তরিয়ুসের চিন্তা ও বিশ্বাস :

আলমুনজিদ গ্রন্থে বলা হয়েছে-

قال بأقنومين فى المسيح و أنكر على مريم لقب أم الله.

তিনি ঈসা মাসীহ-এর মধ্যে দু’টি ব্যক্তিসত্তা বিদ্যমান থাকার কথা বলতেন। (একটি মানবিক, অপরটি ঐশ্বারিক) আর তিনি মরিয়মের ‘ঈশ্বার-জননী’ উপাধিকে অস্বীকার করেছেন।

নেস্তরিয়ুসের মতে, হযরত ঈসার দুটি ব্যক্তিসত্তা ছিল। তিনি মানবিক সত্তায় জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই মরিয়মকে ঈশ্বার জননী বলা উচিত হবে না। কারণ ঐশ্বারিক সত্তা নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি। একথাটি এভাবে বলা চলে, মানব ব্যক্তি জন্ম নিয়েছে মরিয়ম থেকে, আর ঐশ্বারিক ব্যক্তি ছিলেন, ঈশ্বারের শাশ্বাত বাণী।

আলমুনজিদ গ্রন্থকার এখানে নেস্তরিয়ুসের আসল বিশ্বাসটিই চেপে গেছেন। একইভাবে মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকেও তার মৌলিক বিশ্বাসটি উল্লেখ হয়নি। তবে টীকায় ‘তৎকালীন একজন ঐতিহাসিকের মতে এফেসাসের মহাসভা’ শিরোনামে বলা হয়েছে-

‘যখন অনেকেই ঘোষণা করলেন খ্রিস্ট ঈশ্বার, নেস্তরিয়ুস তখন বলে উঠলেন : “যার বয়স ছিল দু’ কি তিন মাস মাত্র, তাকে আমি ঈশ্বার বলে অভিহিত করতে পারি না। কাজেই আমি আপনাদের দলে নেই এবং ভবিষ্যতে আর আপনাদের মাঝে আসব না।” একথা বলেই তিনি সভা ত্যাগ করেন এবং পরে অন্যান্য ধর্মপালদের সঙ্গে বৈঠক করেন, যারা তার অনুরূপ অভিমত পোষণ করতেন। ফলে উপস্থিত ধর্মপালগণ দু’ দলে বিভক্ত হয়ে পড়লেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৭)

নিচে বরাত হিসেবে লেখা হয়েছে- সক্রেটিস, মণ্ডলীর ইতিহাস, ৭ম, ৩৪।

এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নেস্তরিয়ুসও আরিয়ুসের মত হযরত ঈসার ঈশ্বারত্ব অস্বীকার করতেন। শায়খ ড. মুহাম্মাদ আহমাদ ‘আননাসরানিয়্যাহ মিনাত তাওহীদ ইলাত তাছলীছ’ গ্রন্থে লিখেছেন-

ونسطور وإن كان يعتقد أن المسيح فوق البشر إلا أنه أنكر ألوهيته و قد جاء فى تاريخ الأمة القبطية ما نصه: (أما هرطقة نسطور هذه فلم تكن كغيرها، نشأت عن اختلاف في العقائد التي وضعها الآباء والأحبار، بل هي جوهرية، ذلك أن نسطور ذهب إلى أن ربنا يسوع المسيح لم يكن إلها في حد ذاته، بل هو إنسان مملوء من البركة والنعمة، أو هو ملهم من الله لم يرتكب خطيئة. (محاضرات في النصرانية، محمد أبو زهرة: ص ১৫০) (النصرانية من التوحيد إلى التثليث، ص ১৮৫-১৮৪)

নেস্তরিয়ুস যদিও বিশ্বাস করতেন মসীহ ছিলেন অতি মানব, তবে তিনি তার ঈশ্বারত্বকে অস্বীকার করতেন। তারীখুল উম্মাতিল কিবতিয়্যাহ (কিবতী [কপ্টিক] খ্রিস্টানদের ইতিহাস) গ্রন্থে তার মত ও পথ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নেস্তরিয়ুসের এই মত ও পথ অন্যান্য মত ও পথের ন্যায় ছিল না, যা নাকি পোপ ও ধর্মগুরুদের কর্তৃক রচিত বিশ্বাসমালা নিয়ে দ্বিমত থেকে সৃষ্ট। বরং সেটি ছিল মৌলিক। কারণ নেস্তরিয়ুস বিশ্বাস করতেন যে, আমাদের প্রভু যীশু মসীহ মূলত ঈশ্বার ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন বরকত ও নিআমতে পূর্ণ একজন মানুষ। কিংবা তিনি ছিলেন আল্লাহর পক্ষ হতে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত। যিনি কখনো পাপ করেননি। 

ড. রউফ চেলপি তার ‘ইয়া আহলাল কিতাব’ গ্রন্থেও অনুরূপ উল্লেখ করে আরও বলেছেন-

ويقول ابن البطريق: إن نسطور كان يرى:

أن هذا الإنسان الذي يقول أنه المسيح بالمحبة اتحد مع الأب.

ويقال: أنه الله، وابن الله ليس بالحقيقة، ولكن بالموهبة... اهـ. (يا أهل الكتاب، الدكتور رؤوف شلبي، ص ২৩২، الطبعة الأولى ১৩৯৪هـ، مكتبة الأزهر)

অর্থাৎ ইবনুল বিতরিক বলেন, নেস্তরিয়ুস বিশ্বাস করতেন ভালবাসা দ্বারা সিক্ত এই মহামানব আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাকে যে ঈশ্বার ও ঈশ্বারপুত্র বলা হয় তা প্রকৃত অর্থে নয়। আল্লাহর বিশেষ দান ছিল তাঁর প্রতি...।

নেস্তরিয়ুসের ঘোর বিরোধী ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল সিরিল (Cyril of Alexandria) (সময়কাল ৪১২-৪৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি মনে করতেন, যীশু কেবল একটি মাত্র ব্যক্তি সত্তারই ধারক ছিলেন। আর তা ছিল মানবিক সত্তা। সেই সঙ্গে অন্য অনেকের মত তিনি মনে করতেন মারিয়া (মরিয়ম) ছিলেন ঈশ্বার জননী। 

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘তার এ মতের বিরোধিতা করে সিরিল খ্রিস্টের ঐক্য এবং খ্রিস্টবাসীদের অভিন্ন বিশ্বাস রক্ষা করেন। তিনি খ্রিস্টের মধ্যে একটি মাত্র স্বভাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। সিরিল রোমের ধর্মপাল সেলেস্টিনুসের পক্ষে যোগ দেন। এই সেলেস্টিনুসই নেস্তরিয়ুসকে অভিযুক্ত করেছিলেন ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে। সিরিল আবেদন জানান নেস্তরিয়ুস যেন এই মর্মে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যে, যীশুর মধ্যে ঐশবাণী ও মানুষ একটি মাত্র স্বভাবে সংযুক্ত হয়েছে। নেস্তরিয়ুস আন্তিয়োকে তার সুহৃদ জন (যোহন, আন্তিয়োকের পেট্রিয়ার্ক) ও থিওডরেটের নিকট আবেদন জানান এবং সিরিলকে আপল্লিনারিয়ূসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৮)

এই লেখক এখানে, ‘খ্রিস্টবাসীদের অভিন্ন বিশ্বাস রক্ষা’-এর কথা বলেছেন, অথচ আরিয়ুসসহ বিশাল এক দল এমন মত পোষণ করতেন না। তাছাড়া এই লেখকই পূর্বের পৃষ্ঠায় সক্রেটিসের বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, ‘ফলে উপস্থিত ধর্মপালগণ দু’ দলে বিভক্ত হয়ে পড়লেন।’ তাহলে অভিন্ন বিশ্বাস রইল কোথায়?

২. পেলাজিয়ুসবাদ : পেলাজিয়ুস (pelagius)  ছিলেন আলমুনজিদের ভাষায় راهب برطاني বৃটেনের একজন সন্ন্যাসী (৩৬০-৪১৮ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি বিশ্বাস করতেন, আদম আলাইহিস সালামণ্ডএর পাপ তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি কখনো হারায়নি। আদিপাপ ধারণার উপর তিনি আপত্তি উত্থাপন করেন। তিনি মনে করতেন, মানুষ শুধু তার কর্মের মাধ্যমেই মুক্তি লাভ করতে পারে। যীশুর মাধ্যমে মুক্তি ও পরিত্রাণ লাভের ধারণা তিনি অস্বীকার করতেন। সেন্ট অগাস্টিন (Saint Augustine) (৩৫৫-৪৩০ খ্রিস্টাব্দ) তার তীব্র বিরোধিতা করেন।

এসব সমস্যার সমাধানকল্পে সম্রাট ২য় থিওডোসিয়াস (Theodosius II) (সময়কাল ৪০১-৪৫০ খ্রিস্টাব্দ) ৪৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে এফেসাসে একটি মহাসভা আহ্বান করেন এবং এতে সমস্ত প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব থাকার অনুরোধ করেন। রোমের ধর্মপাল সেলেস্টিনুস (Celestine) ও হিপ্পোর অগাস্টিনও এ মহাসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু অগাস্টিন সে বছরেরই আগস্ট মাসের ৩০ তারিখে প্রাণত্যাগ করেন। (দেখুন, মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৮)

সদস্য সংখ্যা

দু’ শতাধিক বিশপ। আহ্বায়ক ছিলেন রোমের পোপ ১ম সেলেস্টিনুস (Celestine I) (সময়কাল ৪২২-৪৩২ খ্রিস্টাব্দ)। সভাপতি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মপাল সিরিল (সময়কাল ৪১২-৪৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘সিরিল তার সঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁরই অনুগত পঞ্চাশজনের মত মিশরীয় ধর্মপাল ও অসংখ্য উপহারসমাগ্রী। সিরিল একজন সাধু ব্যক্তি ছিলেন বটে, তবে তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, তাঁর সমস্ত কার্যকলাপ সাধুসুলভ ছিল।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৮)

 

সিদ্ধান্ত

মহাসভায় তুমুল হট্টগোল হয়। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘মহাসভার উদ্বোধনী দিবসে অনেকের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এবং সম্রাটের কর্মকর্তাদেরও প্রায় ৬০ জনের মত ধর্মপালের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ২২শে জুন ৪৩১ খ্রিস্টাব্দে সিরিল মহাসভার উদ্বোধন করেন। নেস্তরিয়ুস ২০০ জন ধর্মপাল কর্তৃক পদচ্যুত হন। যদিও সমস্যাটি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয়নি, তবুও ‘ঈশ্বর-জননী’ শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করে।

পরবর্তীতে শীঘ্রই নেস্তরিয়ুসের কয়েকজন অনুসারী যেমন এসে পৌছেন, ঠিক তেমনি কিছুসংখ্যক ধর্মপালও আসেন, যারা নাকি সিরিলের আচরণে ভীষণ অসুবিধায় পড়েছিলেন। এবং তাঁকে ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের অভিযুক্ত করেন। কিন্তু এতে বুঝার কোনো উপায় ছিল না- ধর্মপালদের মধ্যে কাকে অভিযুক্ত করা হল বা না হল। নেস্তরিয়ুস ও সিরিল উভয়কে পদচ্যুত করে সম্রাটের প্রতিনিধি সকলকে খুশি করতে চেষ্টা করেন। সিরিল কিন্তু পালিয়ে যেতে সক্ষম হন ও বিজয়ীর বেশে আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে আসেন। আর নেস্তরিয়ুস সারা জীবন নির্বাসনে অতিবাহিত করেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৮)

 

এখানে কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায় :

১. সম্রাট মহাসভা আহ্বান করেন ৪৩০ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা নভেম্বর। কিন্তু তা এত বিলম্বে ৪৩১ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে জুন শুরু হল কেন?

২. মহাসভা আহ্বানই করা হল, ‘ঈশ্বর-জননী’ বলা না বলা ও আরও কিছু বিষয়ের সমাধানের জন্য। তাহলে কেন বলা হচ্ছে, যদিও সমস্যাটি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয়নি, তবুও ঈশ্বর-জননী শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে? তাহলে কি এটা পৌলপন্থীদের বল প্রয়োগে প্রচারের ফলেই জয় লাভ করেছিল?

৩. তৃতীয় বিষয় হল, একদিকে বলা হচ্ছে, তাঁকে ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের অভিযুক্ত করেন। অপরদিকে বলা হচ্ছে, ‘কিন্তু এতে বুঝার কোনো উপায় ছিল না ধর্মপালদের মধ্যে কাকে অভিযুক্ত করা হল বা না হল’, এটা কি এক ধরনের গোঁজামিল ও সত্যকে গোপন করার অপচেষ্টা নয়?

উক্ত পুস্তকের পূর্ব পৃষ্ঠায় সক্রেটিসের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে-

‘পুনরুত্থান পার্বণের অব্যবহিত পরেই নেস্তরিয়ুস তার সমর্থকদের একটি বিশাল জনতা সমভিব্যহারে এফেসাসে যান। (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৭)

এতে সিরিল ও জেরুজালেমের ধর্মপাল জুভেনাল (Juvenal of Jerusalem)-এর অংশগ্রহণের কথাও উল্লেখ করা হয়। পদচ্যুতির পর নেস্তরিয়ুস সম্পর্কে বলা হয়-

‘এমনটা হওয়ার পর নেস্তরিয়ুসপন্থীরাও অপর একটি মহাসভা আহ্বান করেন। আর এতে তারা স্বয়ং সিরিলকে পদচ্যুত করেন এবং তাঁর সঙ্গে এফেসাসের ধর্মপাল মেম্ননকেও। এসমস্ত ঘটনা ঘটার পর পরই আন্তিয়োকের ধর্মপাল জনসভায় এসে উপস্থিত হন। সভায় কী কী ঘটেছে সমস্ত অবহিত হয়ে এত তাড়াহুড়ো করে নেস্তরিয়ুসকে পদচ্যুতকরণে প্রবৃত্ত হয়ে সমস্ত গোলযোগের হোতা হিসেবে তিনি সিরিলের তীব্র সমালোচনা করেন। অতপর জনের উপর প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে সিরিল জুবেনালের সঙ্গে যোগ দেন এবং তারা জনকেও পদচ্যুত করেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৭)

এরপর আরও বলা হয়-

‘তিনি (নেস্তরিয়ুস) তার পূর্বের মত বা বিশ্বাস পরিহারসূচক বিবৃতি প্রদান করলেও এর প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি, বরং তাকে ওয়াসিস দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়। ধর্মপাল জন তাঁর নিজ ধর্মপাল পদে ফিরে গিয়ে কয়েকজন ধর্মপালকে এক জরুরি সভায় আহ্বান করেন ও সিরিলকে পদচ্যুত করেন।’ (প্রাগুক্ত)

উল্লেখ্য, এই সক্রেটিস প্রসিদ্ধ দার্শনিক সক্রেটিস নয়, তিনি তো খ্রিস্টপূর্ব (৪৭০-৩৯৯) সালের মানুষ। আর এই সক্রেটিস ৫ম শতাব্দীর মানুষ।৭

এখানে এও উল্লেখযোগ্য যে, এই ঐতিহাসিক কিন্তু রোমের পোপ সেলেস্টিনুসের কোনো ভূমিকার কথা উল্লেখ করেননি। মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকের লেখকও তা উল্লেখ করেননি।

যাহোক, নেস্তরিয়ুসকে এই মহাসভায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল সেকথা অনস্বীকার্য। আর পেলাজিউসবাদ ভ্রান্ত হওয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্তের কথাও কোনো কোনো পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আলমুনজিদ গ্রন্থকার শুধু এতটুকু লিখেছেন-

دحض تعليمه وحاربه القديس أوغسطينس.

অর্থাৎ পেলাজিয়ুসের শিক্ষা নির্মূলে ও তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সাধু অগাস্টিন।

 

নেস্তরিয়ুসবাদের ভবিষ্যত

আননাসরানিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে-

ومع نفي نسطور وطرده فقد انتشر مذهبه. يقول ابن البطريق:- تكاثرت النسطورية فى المشرق والمغرب والعراق والموصل والفرات والجزيرة-(محاضرات في النصرانية، ص ১৫১)- (النصرانية، ص ১৮৫)

অর্থাৎ নেস্তরিয়ুসকে নির্বাসিত ও বিতাড়িত করা হলেও তার মত ও বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছিল। ইবনুল বিতরিক বলেছেন, নেস্তরিয়ুসপন্থীদের বিপুল সংখ্যা প্রাচ্যে, ইরাক, মাওসেল (মুসেল) ফোরাত ও মেসোপটেমিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। (আননাসরানিয়্যাহ, পৃ. ১৮৫)

এর প্রমাণ মেলে আলমুনজিদ গ্রন্থে। সেখানে ২য় থেওডোসিয়াস কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট (৪০৮-৪৫০ খ্রিস্টাব্দ) সম্পর্কে বলা হয়েছে-

تأثر بزوجته وبأخته فمال إلى رأي نسطور ودعا إلى عقد مجمع أفسس حيث خذل.

অর্থাৎ তিনি (সম্রাট) তার স্ত্রী ও বোনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নেস্তরিয়ুসের মত ও চিন্তা গ্রহণ করেন এবং এফেসাস মহাসভার আয়োজন করেন, যেখানে তিনি লজ্জিত হয়েছেন।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘সাম্রাজ্যের প্রাচ্য সীমানার বাইরের এলাকাগুলোতেও সমভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল, যা এ অঞ্চলের মণ্ডলীগুলোতে এক স্বভাববাদ বা নেস্তরিয়ুসের মতবাদ গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। পঞ্চম শতাব্দীর শেষ দিকে সম্রাট এডেসার (ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত উফা) ঐশবিদ্যা শিক্ষালয়টি বন্ধ করে দেন। উক্ত শিক্ষালয়টিকে সম্রাটের নিকট নেস্তরিয়ুসপন্থী শিক্ষালয় বলে মনে হয়েছিল। এটি পরে পারস্য এলাকায় নিসিবিসে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে টেসিফোন-এর ধর্মসভায় নেস্তরিয়ুসবাদ পারস্য সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের সরকারি ধর্ম হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পারস্যের নেস্তরিয়ুসপন্থীরা মধ্য এশিয়া ও সুদূর চীন পর্যন্ত তাদের বিশাল প্রচারকার্য পরিচালনা করে। তদানীন্তন চীনের রাজধানী শহরে ৭৮১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত পাথরের উপর খোদাই করা সিরীয়-চীনা ভাষায় একটি সি-গান-ফূ-এর উক্ত ধর্মপ্রচারের উদ্দীপনার সাক্ষ্য বহন করে।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ১০১)

এখানে অনুমিত হয় নেস্তরিয়ুসবাদ কতটা প্রচার ও প্রসার লাভ করেছিল। ৭ম শতাব্দীতে দার্শনিক সার্জিয়াসও নেস্তরপন্থী ছিলেন। (আলমুনজিদ سرجيوس الفيلسوف)

 

৪র্থ মহাসভা

ক্যালসিডন (خلقيدونية) মহাসভা  

(৪৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দ)

 

প্রেক্ষাপট

ইতিমধ্যে মোনোফিসাইটিজম (Monophysytism) বা এক স্বভাববাদ বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কন্সটান্টিনোপলের সন্ন্যাসী ইউটাইকেস (Eutyches) ও আলেকজান্দ্রিয়ার পোপ প্রথম ডাইওসকোরাস (Dioscorus I of Alexandria) (সময়কাল ৪৪৪-৪৫৪ খ্রিস্টাব্দ) এ মতবাদের মূল কথা হল হযরত ঈসার মধ্যে একটিমাত্র স্বভাব ছিল।

এ নিয়ে ইউটাইকেস ও সাইপ্রাসের ধর্মপাল থিওডোরেট (Theodoret of Cyrus) (সময়কাল ৪২৩-৪৫৭ খ্রিস্টাব্দ)-এর মধ্যে বিবাদ শুরু হয়ে যায়। থিওডোরেট দু’স্বভাবের পক্ষে। তিনি মনে করতেন বিনা সংমিশ্রণে দু’টি স্বভাবের ঐক্য হয়েছে। পক্ষান্তরে ইউটাইকেস মনে করতেন খ্রিস্টের মধ্যে ঐশ স্বভাব মানব স্বভাবকে আত্মীভূত করেছে। সুতরাং তাঁর স্বভাব শুধু একটিই। কোনো কোনো পুস্তকে তার বিশ্বাস এ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে- “খ্রিস্ট ছিলেন মাত্র একজন ব্যক্তি। কিন্তু তার কোনো মানব স্বভাব ছিল না। শুধু ঐশ্বারিক স্বভাব ব্যতীত।”

কনস্টান্টিনোপলের ধর্মপাল ফ্লাবিয়ান কর্তৃক আহূত এক ধর্মসভায় উক্ত সন্ন্যাসীকে অভিযুক্ত ও মণ্ডলীচ্যুত করা হয়। (দেখুন, মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৯) সম্রাট থিওডোসিয়াস ছিলেন ইউটাইকেসের বন্ধু। তিনি সমস্যা সমাধান কল্পে ২য় এফেসাস মহাসভা আহ্বান করেন ৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে। যেখানে শুধু ইউটাইকেসের সমর্থকদের ও রোমের ধর্মপাল ১ম লিও (Pope Leo I) (সময়কাল ৪৪০-৪৬১ খ্রিস্টাব্দ)-কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১ম লিও উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি তার প্রতিনিধি হিসেবে বিশপ জুলিয়াসকে প্রেরণ করেন।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে এফেসাসের মহাসভাটি ছিল প্রধানত ইউটাইকেসের সমর্থকদের সভা। এদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার ডাইওসকোরাস। যিনি তাঁর সঙ্গে এনেছিলেন একদল উচ্ছৃঙ্খল সন্ন্যাসী। রোমের ধর্মপালের প্রতিনিধিগণ- যারা গ্রীক ভাষা জানতেন না- তাদের বক্তব্য অন্যদের শোনাতে সক্ষম হলেন না। তুমুল তর্ক-বিতর্কের মধ্যে (কনস্টান্টিনোপলের ধর্মপাল) ফ্লাবিয়ানকে এবং যারা তার সঙ্গে দু’স্বভাবের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে, তাদেরকে পদচ্যুত করা হয়। অধিবেশনে তুমুল বাক-বিত-ার সময় পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং এতে ফ্লাবিয়ান আহত হয়ে কিছুকাল পরে মৃত্যুমুখে পতিত হন। থেওডোরেত রোমের কাছে আবেদন জানান যেখানে লিও এফেসাসের দস্যুতার ধর্মসভার প্রতি অত্যন্ত ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ প্রকাশ করেন।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৯)

এসব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সম্রাট মার্সিয়ান (মৃত্যু ৪৫৯) ক্যালসিডনে (বসফরাস নদীর পাড়ে এশিয়া মাইনরে অবস্থিত প্রাচীন শহর (خلقيدونية) বর্তমানে كاديكوي - আলমুনজিদ) মহাসভা আহ্বান করেন। এবং রোমের পোপ প্রথম লিও (সময়কাল ৪৪০-৪৬১ খ্রিস্টাব্দ)-কে সভাপতিত্ব করতে আহ্বান জানান। তিনি আসতে পারেননি, কারণ তখন হুনরা পাশ্চাত্য আক্রমণ করেছিল। তাই এ মহাসভায় তিনি তার একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। (দেখুন, মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ৯৯)

 

সদস্য সংখ্যা : ১৫০ জন বিশপ

সিদ্ধান্ত

১. ২য় এফেসাসের সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করা হয়।

২. ইউটাইকেস ও ডাইওসকোরাসকে মণ্ডলীচ্যুত করা হয়।

৩. যীশুর পৃথক দুটি স্বভাবের কথা ঘোষণা করে বলা হয়, দুই স্বভাবে খ্রিস্ট এক ব্যক্তি।৮

কিন্তু আরমেনীয় (গ্রেগরীয়) মণ্ডলী, সিরিয়ার যাকোবাইট মণ্ডলী ও মিশরের কপটিক মণ্ডলী এ মহাসভার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি।

মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকে বলা হয়েছে-

‘অনেক প্রদেশ বা এলাকাই... উক্ত ধর্মমত প্রত্যাখ্যান করে। মিসরের ডাইওসকোরাস ও সিরিলের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে খ্রিস্টবিশ্বাসীগণ কপ্টিক ভাষাভাষী একটি জাতীয় মণ্ডলী হিসাবে এক স্বভাববাদকে বেছে নেয়।... সিরিয়াতেও অনেকটা একই ব্যাপার ঘটে; সেখানে এক স্বভাববাদ হয়ে ওঠে সিরীয় ভাষাভাষী খ্রিস্টানদের ধর্ম। আর আরমেনীয়রা নেস্তরিয়ুসপন্থী পারসিক ও কনস্টানিপোলের গ্রীকদের বিরোধিতায় এক স্বভাববাদ গ্রহণ করে। আলেকজান্দ্রিয়ার উপর নির্ভরশীল ইথিওপিয়ানরা একস্বভাবকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিল।’ (মণ্ডলীর ইতিহাস পরিচিতি, পৃ. ১০১)

একস্বভাববাদের প্রবক্তাদের উল্লেখযোগ্য ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার পেট্রিয়ার্ক (৫৩৫-৫৬৬ খ্রিস্টাব্দ) থিওডোসিয়াস ও এফেসাসের বিশপ যোহন (John of Ephesus) (৫০৭- ৫৮৬ খ্রি.)।

 

 

৫ম মহাসভা

২য় কনস্টান্টিনোপল মহাসভা

(৫৫৩ খ্রিস্টাব্দ)

প্রেক্ষাপট : কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট জাস্টিনিয়ান্স (Justinian the Great) (সময়কাল ৫২৭-৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর আমলে একস্বভাববাদ বেশ চর্চিত ছিল। সম্রাট যদিও এর সমর্থক ছিলেন না কিন্তু সম্রাজ্ঞী এ মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্রাট স্ত্রীর মতামতকে মূল্যায়ন করতেন। তাই তিনি চাইলেন উভয় দলের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখতে। ইতিমধ্যে সম্রাটের বিরুদ্ধে ইটালিতে বিদ্রোহ দেখা দিলে সম্রাট স্ত্রীকে খুশি করার সুযোগ পেয়ে যান। তিনি বিদ্রোহ দমনে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠান। তারা রোমে প্রবেশ করে পোপ ভিজিলিয়ুস (vigilius) (সময়কাল ৫৩৭-৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ)-কে এক স্বভাববাদ গ্রহণে চাপ প্রয়োগ করে। পোপ তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তাকে জোরপূর্বক কনস্টান্টিনোপলে ধরে আনা হয়। এসময় কিছু বিশপ কিয়ামতকে অস্বীকার করেন। আর কতিপয় বিশপ মনে করতে লাগলেন যীশুর অস্তিত্ব ছিল খেয়ালী বা কাল্পনিক, বাস্তবিক ছিল না। এসব সমস্যা সমাধানকল্পে এ মহাসভা আহ্বান করা হয়।

সদস্য সংখ্যা : পাশ্চাত্যের মাত্র ৬ জনসহ ১৪০ জন বিশপ।

 

সিদ্ধান্ত

১. এক স্বভাববাদকে সমর্থন দেওয়া হয়।৯

২. কিয়ামত অস্বীকারকারীদের বিতাড়িত ও অভিসম্পাত করা হয়।

৩. যারা যীশুর ব্যক্তিত্বকে কাল্পনিক মনে করত তাদেরকে অভিসম্পাত করা হয়। পোপকে এ মহাসভার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।

 

৬ষ্ঠ মহাসভা

৩য় কনস্টান্টিনোপল মহাসভা

(৬৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দ)

প্রেক্ষাপট : এ সময় কয়েকটি মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।

১. মনোথেলিটিজম (Monothelitism) অর্থাৎ এক ইচ্ছাশক্তির মতবাদ। যার মূল কথা হল, যীশু খ্রিস্টের মধ্যে স্বভাব দু’টো থাকলেও ইচ্ছাশক্তি (مشيئة) ছিল একটিই। এ মতের প্রসিদ্ধ প্রবক্তা ছিলেন কনস্টান্টিনোপলের পেট্রিয়ার্ক ১ম সার্জিয়াস (Sergius I of Constantinople) (সময়কাল ৬১০-৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। যোহন মারূনী (John Maron) (৬২৮-৭০৭ খ্রিস্টাব্দ)ও এ মতবাদের পোষক ছিলেন। রুহা’র বিশপ (সময়কাল ৫৪১-৫৭৮ খ্রিস্টাব্দ) যাকোব বারোডিয়ুস (Jacobus Baradeus)ও এ মতের সমর্থক ছিলেন। বরং তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, যীশুর স্বভাব যেমন একটি তেমনি তার হাকীকত বা মূলসত্তাও মাত্র একটি আর তা হলো ঐশ্বরিক। খ্রিস্টমণ্ডলীর অনেকের বিশ্বাস ছিল স্বভাবও দুটি, ইচ্ছাও দুটি, একটি মানবিক, অপরটি ঐশ্বারিক। এ সময় মিসর ও শাম মুসলিম শাসনাধীন ছিল। সেখানেই একস্বভাববাদীদের প্রধান কেন্দ্র ছিল। এ সময় খ্রিস্টান সম্রাট ছিলেন ৪র্থ কনস্টান্টাইন পগোনাটাস (Pogonatos)  (৬৫২-৬৮৫ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি পোপ আগাথোকে (Agatho) (সময়কাল ৬৭৮-৬৮১ খ্রিস্টাব্দ) খুশি করার জন্য এক স্বভাববাদ বা মোনোফিসাইট ও এক ইচ্ছার মতবাদ বা মোনোথেলিটিজমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চাইলেন। আর সে উদ্দেশ্যেই এই মহাসভার আয়োজন।

আহ্বায়ক : পোপ আগাথো। কিন্তু সভা চলাকালীন সময়ে তিনি মৃত্যুবরণ করলে পরবর্তী পোপ ২য় লিও (Pope Leo II) (সময়কাল ৬৮২-৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ) মহাসভা পরিচালনা করেন।

সদস্য সংখ্যা : ২৮৯ মতান্তরে ১৭৪ জন বিশপ।

 

 সিদ্ধান্ত

১. সভায় এক স্বভাববাদ ও এক ইচ্ছার মতবাদকে শক্তভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে ঘোষণা করা হয় যে, যীশুর স্বভাবও দুটি, ইচ্ছাশক্তিও দুটি।১০

২. সার্জিয়াস ও তার অনুসারীদের বিতাড়িত ও লানত করা হয়।

এ সময় থেকে মারূনী সম্প্রদায় তাদের গীর্জাকে আলাদা করে ফেলে। ইয়াকুবী সম্প্রদায়ও নিজেদের বিশ্বাসের উপর অবিচল থাকে। হ

 

 

টীকাসমূহ :

১. হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এ ধারণা করা যে, ‘তাকে সকল কিছুর পূর্বে সৃষ্টি করা হয়েছে’, সম্পূর্ণই অবাস্তব ধারণা। কুরআন-হাদীসে প্রথম সৃষ্টির ব্যাপারে যেসকল বিবরণ এসেছে তা থেকে বুঝা যায়, অন্যান্য সৃষ্টিকেই আল্লাহ তাআলা আগে সৃষ্টি করেছেন; তারপর মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া প্রচলিত বাইবেলের আদিপুস্তকের প্রথম দুই অধ্যায়ে সৃষ্টির ক্রম বিষয়ক বর্ণনা থেকেও একথা বুঝা যায় যে, অন্যান্য সৃষ্টির পর প্রথম মানব আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও আদিপুস্তকের এই দুই অধ্যায়ের আলোচনায় রয়েছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। (দেখুন : আদিপুস্তকের অধ্যায় ১-২)

 

২. হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে পরিত্রাণ বা পাপমোচনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, এও একটি অমূলক ও ভ্রান্ত বিশ্বাস। ঈসা আলাইহিস সালাম থেকে এ সম্পর্কে কোনো কিছুই বর্ণিত নেই। প্রশ্ন হয়, যদি প্রায়শ্চিত্তের বিশ্বাস সঠিক হয় তাহলে ঈসা আলাইহিস সালাম কেন বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করলেন না? এমনিভাবে আরো প্রশ্ন হয়, আল্লাহ তাআলার ন্যায়নীতি অনুযায়ী একজনের পাপ অন্যজনের উপর চাপানোর অবকাশ আছে কি? আল্লাহ তাআলার নীতি তো- একজনের পাপের বোঝা অন্যজন বহন করবে না। কুরআনে কারীমে এও বলা হয়েছে যে, এ নীতির ঘোষণা পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহেও এসেছে। ইরশাদ হয়েছে-

اَمْ لَمْ یُنَبَّاْ بِمَا فِیْ صُحُفِ مُوْسٰی،  وَ اِبْرٰهِیْمَ الَّذِیْ وَفّٰی،اَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی، وَ اَنْ لَّیْسَ لِلْاِنْسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی، وَ اَنَّ سَعْیَهٗ سَوْفَ یُرٰی،  ثُمَّ یُجْزٰىهُ الْجَزَآءَ الْاَوْفٰی.

তাকে কি অবগত করা হয়নি, যা আছে মূসার সহীফাসমূহে এবং ইবরাহীমের সহীফাসমূহেও, যে পরিপূর্ণ আনুগত্য করেছিল? সে সহীফাসমূহে যা ছিল তা এই যে, কোনো বহনকারী অন্য কারও (গোনাহের) বোঝা বহন করতে পারে না। আর এই যে, মানুষ নিজের প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর (বিনিময় লাভের) হকদার হয় না এবং এই যে, তার চেষ্টা অচিরেই দেখা যাবে। তারপর তার প্রতিফল তাকে পুরোপুরি দেওয়া হবে। [সূরা নাজম (৫৩) : ৩৬-৪১]

বর্তমান বাইবেলেও লেখা আছে, ‘যে গুনাহ করবে সেই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে। যদি একজন দুষ্ট লোক তার সব গুনাহ থেকে ফিরে আমার সব নিয়মণ্ডকানুন পালন করে আর ন্যায় ও ঠিক কাজ করে, তবে সে নিশ্চয়ই বাঁচবে, মরবে না’ (ইহিস্কেল ১৮ : ২০-২১)। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, খৃষ্টধর্মের স্বরূপ, পৃষ্ঠা : ৪৩-৫৩।

৩. হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার নবী। তিনি বনী ইসরাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন। সকল নবীই পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার খলীফা। তাদেরকে মানবজাতির হেদায়েত ও তারবিয়াতের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাঁদের মাধ্যমে ‘মানুষ গড়ার’ কাজ নেওয়া হয়েছে। তাঁদের এই দায়িত্ব ও অবস্থানের দাবি হল, তাঁরা নিজেরা সৎ কর্ম, সুন্দর আখলাক ও উত্তম আদর্শের প্রতীক হবেন। তাঁরা আল্লাহর দ্বীনের বাস্তব নমুনা হবেন। তাদের অনুসরণের মাধ্যমে মানব জাতি মুক্তি লাভ করবে। এটিই নবীগণের ব্যাপারে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের সারকথা। আর নবীগণ মন্দ কাজ করেন বা গোনাহে লিপ্ত হন এ বিশ্বাস পোষণ করা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ন্যায়-পরিপন্থী কাজ। এর সাথে ঈমানী আকীদা-বিশ্বাসের বিন্দু মাত্র সম্পর্ক নেই।

৪. ‘যীশু খোদার পুত্র। তিনি ঈশ্বর’- এসব কিছুর মূল হচ্ছে ত্রিত্ববাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস। ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللهَ ثَالِثُ ثَلٰثَةٍ ۘ وَ مَا مِنْ اِلٰهٍ اِلَّاۤ اِلٰهٌ وَّاحِد

নিশ্চয় তারা কাফের হয়ে গেছে, যারা বলেছে, ‘আল্লাহ তো তিনের একজন’। অথচ এক মাবুদ ছাড়া কোনই মাবুদ নেই।’ [সূরা মায়েদা (৫) : ৭৩]।

তাছাড়া ত্রিত্ববাদ এমন একটি বিশ্বাস, যার পেছনে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়মের কোনো সমর্থন নেই। আর এ কারণেই ত্রিত্ববাদ ও যীশুর ঈশ্বরত্ব বিষয়ক বিশ্বাসগুলো পরবর্তীতে মহাসভার মাধ্যমে জোরপূর্বক অনুমোদন করতে হয়েছে।

 

৬. ‘পাক-রূহ’কে খ্রিস্টানরা ত্রিত্বের একজন মনে করেন। কিন্তু এ বিশ্বাসটিও একটি ভ্রান্ত ও অমূলক বিশ্বাস। ‘পাক-রূহে’র ঈশ্বরত্ব সম্পর্কে হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর শিষ্যগণের কারো কোনো বক্তব্য নেই। আর এজন্যই মহাসভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘পাক-রূহে’র শুধু মর্যাদার কথা সাব্যস্ত করা হয়। মূলত এসব ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাসের আবিষ্কারক হলেন পৌল। মহাসভার মাধ্যমে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে মাত্র।

৭. এই সক্রেটিস (৩৮৩-৪৩৯ খ্রিস্টাব্দ) হলেন কনস্ট্যান্টিনোপলের সক্রেটিস। তিনি ৫ম শতাব্দীর খ্রিস্টান মণ্ডলীর ঐতিহাসিক। যিনি সক্রেটিস স্কোলাস্টিকাস (Socrates Scholasticus) নামে অধিক পরিচিত। তার প্রসিদ্ধ রচনা হল Historia Ecclesiastica। এর ইংরেজি অনুবাদ হল history of the church (বাংলায় বলা হয় মাণ্ডলিক ঘটনা-বিবরণ)।

৮. এ মহাসভায় যীশুর পৃথক দুটি স্বভাবের কথা ঘোষণা করা হলেও অনেক এলাকাতেই এ মত প্রত্যাখ্যান করা হয়। যেমনটি মণ্ডলির ইতিহাস পরিচিতি পুস্তকের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট। এমনকি পরবর্তীতে ৫ম মহাসভায় (২য় কনস্টান্টিনোপল ৫৫৩ খ্রিস্টাব্দ) যীশুর এক স্বভাববাদকে সমর্থন দিয়ে তা সকলকে মানতে বাধ্য করা হয়। পোপ ভিজিলিয়ুস (vigilius) (সময়কাল ৫৩৭-৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ) তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তাকে জোরপূর্বক কনস্টান্টিনোপলে ধরে আনা হয়।

মূলত এই উভয় মতবাদই অবাস্তব। ঈসা আলাইহিস সালাম তো মারইয়ামের পুত্র ও মানব, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। বিষয়টি সামনের টীকাদুটিতে বিস্তারিত দেখুন।

৯. এ মহাসভায় এক স্বভাববাদকে সমর্থন দেওয়া হয়। এ মতবাদের সারকথা, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সত্তা ছিল মাত্র একটি। আর তা ছিল ঐশ্বরিক সত্তা।

কুরআনে কারীম এ মতবাদকে খণ্ডন করে ইরশাদ করেছে-

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللهَ هُوَ الْمَسِیْحُ ابْنُ مَرْیَمَ.

যারা বলে, ‘মারইয়ামণ্ডতনয় মসীহই আল্লাহ’, তারা তো কুফরী করেছেই। [সূরা মায়েদা (৫) : ৭২]

১০. এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট করা মুনাসিব, ৪র্থ মহাসভা ক্যালসিডন মহাসভায় যীশুর পৃথক দুটি স্বভাবের কথা ঘোষণা করে বলা হয়, দুই স্বভাবে খ্রিস্ট এক ব্যক্তি। পরবর্তী ৫ম মহাসভায় (২য় কনস্টান্টিনোপল ৫৫৩ খ্রিস্টাব্দ) দুই স্বভাববাদকে নিষিদ্ধ করে একস্বভাববাদকে সমর্থন দেওয়া হয়। এরপর ৬ষ্ঠ মহাসভায় (৩য় কনস্টান্টিনোপল ৬৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দ) এক স্বভাববাদকে শক্তভাবে নিষিদ্ধ করে ঘোষণা করা হয় যে, যীশুর স্বভাবও দুটি, ইচ্ছাশক্তিও দুটি। আসলে এগুলো সবই ছিল হযরত মাসীহ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে তাদের কল্পিত ভ্রান্ত বিশ্বাস; তার অবতারত্বের ব্যাখ্যা দান ও এ বিশ্বাসকে যুক্তি-বুদ্ধির কাছাকাছি নিয়ে আসার বিভিন্ন খ্রিস্টান চিন্তাবিদের অপপ্রয়াস।

কুরআনে কারীম এ বিষয়গুলোকে স্পষ্টভাবে রদ করে ইরশাদ করেছে-

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّ اللهَ هُوَ الْمَسِیْحُ ابْنُ مَرْیَمَ.

যারা বলে, ‘মারইয়ামণ্ডতনয় মসীহই আল্লাহ’, তারা তো কুফরী করেছেই। [সূরা মায়েদা (৫) : ৭২]

আরো ইরশাদ হয়েছে-

مَا الْمَسِیْحُ ابْنُ مَرْیَمَ اِلَّا رَسُوْلٌ،  قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ،  وَ اُمُّهٗ صِدِّیْقَةٌ،  كَانَا یَاْكُلٰنِ الطَّعَامَ،  اُنْظُرْ كَیْفَ نُبَیِّنُ لَهُمُ الْاٰیٰتِ ثُمَّ انْظُرْ اَنّٰی یُؤْفَكُوْنَ.

মাসীহ ইবনে মারইয়াম তো একজন রাসূলই ছিলেন, তার বেশি কিছু নয়। তার পূর্বেও বহু রাসূল গত হয়েছে। তার মা ছিল সিদ্দীকা। তারা উভয়ে খাবার খেত। দেখ, আমি তাদের সামনে নিদর্শনাবলী কেমন সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করছি। তারপর এটাও দেখ যে, তাদেরকে উল্টোমুখে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! [সূরা মায়েদা (৫) : ৭৫]

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ لَا تَغْلُوْا فِیْ دِیْنِكُمْ وَ لَا تَقُوْلُوْا عَلَی اللهِ اِلَّا الْحَقَّ،  اِنَّمَا الْمَسِیْحُ عِیْسَی ابْنُ مَرْیَمَ رَسُوْلُ اللهِ وَ كَلِمَتُهٗ،  اَلْقٰىهَاۤ اِلٰی مَرْیَمَ وَ رُوْحٌ مِّنْهُ ؗ فَاٰمِنُوْا بِاللهِ وَ رُسُلِهٖ،  وَ لَا تَقُوْلُوْا ثَلٰثَةٌ،  اِنْتَهُوْا خَیْرًا لَّكُمْ،  اِنَّمَا اللهُ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ،  سُبْحٰنَهٗۤ اَنْ یَّكُوْنَ لَهٗ وَلَدٌ  لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الْاَرْضِ،  وَ كَفٰی بِاللهِ وَكِیْلًا،  لَنْ یَّسْتَنْكِفَ الْمَسِیْحُ اَنْ یَّكُوْنَ عَبْدًا لِلهِ وَلَا الْمَلٰٓىِٕكَةُ الْمُقَرَّبُوْنَ، وَمَنْ یَّسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهٖ وَیَسْتَكْبِرْ فَسَیَحْشُرُهُمْ اِلَیْهِ جَمِیْعًا.

হে আহলে কিতাব, তোমরা নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করো না। আর আল্লাহর শানে হক ছাড়া ভ্রান্ত কথা বলো না। নিঃসন্দেহে মারইয়ামণ্ডপুত্র ঈসা মাসীহ কেবল আল্লাহর রাসূল এবং তার কালিমা, যা তিনি মারইয়ামের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আর তার পক্ষ থেকে আগত এক রূহ। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আন। আর তিন বলো না। এ কথা পরিহার কর, তোমাদের জন্য মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহই একমাত্র ইলাহ। এ থেকে তিনি পবিত্র যে, তার জন্য সন্তান হতে পারে। আসমানসমূহে এবং জমিনে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। বস্তুত কার্যসম্পাদনে আল্লাহই যথেষ্ট।

মাসীহ কখনও আল্লাহর বান্দা হওয়াকে লজ্জার বিষয় মনে করে না এবং নিকটতম ফিরিশতাগণও (এতে লজ্জাবোধ করে) না। যে-কেউ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে লজ্জাবোধ করবে ও অহমিকা প্রদর্শন করবে (সে ভালো করে জেনে রাখুক) আল্লাহ তাদের সকলকে তাঁর নিকট একত্র করবেন। [সূরা নিসা (৪) : ১৭১-১৭২]

 

advertisement