Rabiul Auwal 1441   ||   November 2019

আবরার ফাহাদ হত্যা ও ভোলায় রক্তপাত কী বার্তা দেয়

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর ছাত্র আবরার ফাহাদকে গত ৬ অক্টোবর রাতে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাটি দেশব্যাপী বেদনা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর পড়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন মানুষকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করতে পারেÑ এটা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। জাতি হিসাবে আমরা কি এত নীচে নেমে গেলাম! আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির ছাত্র এত নৃশংস ও নির্মম হয়ে উঠল!

হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটির জের ধরে আন্দোলন, বিক্ষোভ, গ্রেফতার ও দাবি-দরবারের খবরগুলো প্রায় সবাই জানেন। এমন ঘটনা কেন ঘটতে পারল? এজাতীয় নৃশংস ঘটনার আড়ালে কী কী বিষয় আছে? কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমনতর হত্যাকা- থেকে ভবিষ্যতে বেঁেচ থাকা সম্ভবÑ এসব প্রশ্ন জনমানুষের মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসব প্রশ্ন নিয়ে আমরা কিছু আলোচনার চেষ্টা করব এবং একইসঙ্গে গত ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানুদ্দীনে রাসূল অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আসা হাজারো বিক্ষুব্ধ জনতার মাঝে পুলিশ কর্তৃক গুলিবর্ষণ করে চারজনকে হত্যা করা এবং শতাধিক মানুষকে আহত করার ন্যক্কারজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনাটি নিয়েও দু-একটি কথা তুলে ধরব।

 

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে আবরার ফাহাদ নামের  মেধাবী, নামাযী ছাত্রটিকে হত্যা করে তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরের শ্রেণির ছাত্ররা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিক থেকে হত্যাকারীরা ছিল আবরারেই ‘বড় ভাই’। এরা ছিল সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। হত্যার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, আবরারকে ‘শিবির’ সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে। আবরার নামায পড়তো এবং ফেসবুক স্ট্যাটাসে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আগ্রাসী আচরণের সমালোচনা করেছিল। এজন্য তাকে ‘শিবির’ সন্দেহ করা হয়। এবং উপরের শ্রেণির ছাত্রলীগের ছেলেরা দফায় দফায় পিটিয়ে তাকে হত্যা করে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিবির কি আইনত নিষিদ্ধ কোনো সংগঠন? শিবির যদি আইন করে নিষিদ্ধও করে দেওয়া হয়, তবুও ‘শিবির’ করার সন্দেহে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা কীভাবে পেতে পারে? আইনত নিষিদ্ধ হলে এবং সে সংগঠনের সঙ্গে কেউ যুক্ত থাকলে বড় জোর তার সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনো ছাত্রকে মেরে ফেলার অধিকার ও সাহস সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের ছেলেরা পায় কীভাবে? যদিও খোদ আবরারের এলাকার সরকারদলীয় এমপির বক্তব্য থেকে জানা গেছে, জামাত-শিবিরের সাথে এ পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, আবরার ফাহাদের যে স্ট্যাটাসের কারণে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে বলে বলা হচ্ছেÑ দেখা গেছে, সেখানে সে কোমল ভাষায় ভারতের একতরফা নদীর পানি দখলের সমালোচনা করেছে। বাংলাদেশের প্রতি ভারত সরকারের আচরণের সমালোচনা করেছে মাত্র। এটি তো দেশপ্রেমের প্রমাণ বহন করছিল; কিন্তু এজন্য ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে পিটিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছে ছাত্রলীগের ছেলেরা! অনেকের কাছেই এটি বিস্ময়কর ব্যাপার মনে হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে যারা চোখ রাখেন এমন অনেকেই বলছেন, ভারতের ভেতরে যেখানে মোদী সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা হচ্ছে, কবি ও বুদ্ধিজীবীরা বক্তব্য দিচ্ছেন, বড় বড় কবি-সম্মেলন, মোদী বিরোধী ব্যাঙ্গাত্মক, বিদ্রুপাত্মক অনুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের সমালোচনা বরদাশত করা যাচ্ছে না কেন? ভারতের ভেতরে ভারত সরকারের সমালোচনা চলতে পারছে, বাংলাদেশে ভারতের সমালোচনার জন্য হত্যা করে ফেলা হচ্ছে! তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, বাংলাদেশে ভারতীয় লবি এবং ভারতের স্বার্থ রক্ষাকারী গোষ্ঠীটি খোদ ভারতের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা দেখে যারা এমন প্রশ্ন উঠাচ্ছেন তাদের প্রশ্নগুলোকে একদম অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

 

হত্যার সাহস কীভাবে পায়?

আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এ প্রশ্নটি আবার এসেছে যে, প্রায় প্রকাশ্যে সবার মধ্যে এভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে একজন মানুষকে মেরে ফেলার দুঃসাহস হত্যাকারীগণ পায় কীভাবে? হত্যার বিচার নিয়ে ভয় থাকলে তো এমন সাহস পাওয়ার কথা ছিল না। আর এজাতীয় ঘটনা তো এটাই প্রথম নয়; বরং বারবার এমন বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটছে। এত নির্ভয়ে হত্যাকা- ঘটানোর পেছনের কারণ কী?

অনেকেই এজাতীয় হত্যার ঘটনা বারবার ঘটানোর পেছনে যে কারণটিকে দায়ী করছেন সেটি হল, হত্যার যথাযথ বিচার না হওয়া কিংবা বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বজায় থাকা। একেকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের পর তার বিচার খুব সহসাই হতে দেখা যায় না। বিশেষত সেসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যদি ক্ষমতাসীন সংগঠনের কোনো নেতাকর্মীর যুক্ততা থাকেÑ তাহলে যেন সেটির বিচার আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়। এ চিত্রটা সবার সামনেই থাকে। যারা নিহত হয় তাদের স্বজনদের সামনেও, যারা হত্যা করে তাদের সামনেও এবং যারা হত্যা করার মানসিকতা লালন করে তাদের মধ্যেও। এতেই হত্যাকারীরা হত্যার ‘বিচার’ নিয়ে নির্ভয়ে থাকার দুঃসাহসটা বিশেষভাবে পায় বলে অনেকে মনে করেন।

কয়েক বছর আগে বিশ্বজিৎ নামে এক হিন্দু যুবককে পুরান ঢাকায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর সামিউল আলম রাজনসহ আরো কয়েকটি শিশুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর সবাইকে ব্যথিত করেছে। সেসব ঘটনারও ভিডিও ফুটেজ মানুষজন দেখেছে। চারদিক থেকে প্রতিবাদ ও ঘৃণা উচ্চারিত হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তখন। কিন্তু এত বছর পার হয়ে যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত সেসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউ যথাযথ শাস্তি পেয়েছে বলে শোনা যায়নি। ২০১৫ সালের আলকাউসারের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় সেসব প্রেক্ষাপট সামনে নিয়েই লিখেছিলামÑ ‘একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার অন্তত ইসলামী আইনে করুন।’

এজাতীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার চূড়ান্তভাবে বেশিরভাগ সময়ই সম্পন্ন হতে দেখা যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। হত্যাকা- হয় প্রকাশ্যে, শত শত মানুষের সামনে। ভিডিও ফুটেজ থাকে, ছবি থাকে। বিচারের সময় দেখা যায়  উপযুক্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্যের অভাবে চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া হয়নি বা হচ্ছে না। অনেকে রেহাই পেয়ে যায়, অনেকে গ্রেফতারের কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে বের হয়ে যায়। এতে হত্যায় জড়িত এবং হত্যাকাণ্ডের মানসিকতা লালনকারী গোষ্ঠীর ভেতরে ‘অভয়’ জেগে ওঠে। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, এসবের বিচার হবেÑ তবু এত দীর্ঘসূত্রিতা এত দীর্ঘ সময়ের পর বিচারের রায় ঘোষিত হয় যে, বিচারপ্রার্থীদের কান্না শুকিয়ে যায় এবং হত্যাকারীদের সাহস বেড়ে যায়, তৈরি হয় আরো বহু নতুন নির্যাতক ও হত্যাকারী। বিচারের অপেক্ষা করতে করতে অনেকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। এছাড়া বিচারের প্রক্রিয়াটা থাকে এমন যে, এক কোর্ট থেকে হত্যাকারীর শাস্তি ঘোষিত হলে কখনো আরেক কোর্টে গিয়ে শাস্তি কমে যায়। আবার কখনো আরেক কোর্টে রেহাই মিলে যায়। এরপর রয়েছে আপিল ও প্রাণভিক্ষা নামক প্রক্রিয়া। সেখানেও হত্যাকারীদের মুক্তির ঘটনা ঘটে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে শাস্তিপ্রাপ্ত হত্যাকারীর মুক্তি পাওয়ার ঘটনা তো কারো অজানা নয়।

মুসলিম হিসাবে হত্যাকারীদের শাস্তির বিষয়ে আমাদের এই ব্যর্থতা এবং ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতাপূর্ণ সেকেলে বৃটিশ আইনের প্রতি এই নির্ভরতা নিঃসন্দেহে লজ্জার ঘটনা। ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসন ও ঐতিহ্যের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কোনো মুসলিম দেশে বিচারের র্দীঘসূত্রিতায় হত্যাকারীর মুক্তি পেয়ে যাওয়া বা শাস্তি পেতে দেরি হওয়া লজ্জাজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা। তাই এ প্রক্রিয়াটি সংশোধন করে হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ইসলামের ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণের এখনই উপযুক্ত সময়। দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক চূড়ান্ত শাস্তির ব্যবস্থা করলে এজাতীয় ‘ভয়ভীতিহীন’ হত্যাকাণ্ডের সাহস কেউ পাবে না।

 

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

আবরার হত্যাকা- চলাকালে, হত্যাকাণ্ডের পরপর এবং বিচারের আন্দোলন শুরু হলে বুয়েটের একশ্রেণির শিক্ষক ও ভিসিসহ প্রশাসনের (তারাও শিক্ষক) ভূমিকা ছিল হতাশাজনক। ছাত্রের প্রতি মমতার পরিবর্তে গা বাঁচানো আচরণ। ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য ও পক্ষপাতের চিত্রও সামনে এসেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। মুসলিম হিসাবে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হচ্ছে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ও তাঁর নির্দেশনা। এক হাদীসে তিনি নির্দেশ দিয়েছেনÑ

فَاسْتَوْصُوا بِهِمْ خَيْرًا.

(যারা তোমাদের কাছে শিখতে আসে) তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ কর। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৫০

অপর এক হাদীসে তিনি ইরশাদ করেনÑ

لَيْسَ مِنّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا.

যারা আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৯

অপর একজন সাহাবীর  স্বাক্ষ্যÑ

مَا رَأَيْتُ مُعَلِّمًا قَبْلَهُ وَلَا بَعْدَهُ أَحْسَنَ تَعْلِيمًا مِنْهُ.

শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে উত্তম শিক্ষক আমি আগে-পরে আর কাউকে দেখিনি। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৩৭

শিক্ষকরা হবেন আদর্শবান। তাঁদের  দেখে ছাত্ররা শিখবে। ইসলাম শিক্ষা দেয়Ñ শিক্ষক শুধু জ্ঞানই দান করবেন না, সদাচার শেখাবেন। ছাত্ররা তাদের কাছ থেকে জীবনের ভালো আচরণ শিখবে। অথচ বুয়েটের মতো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ শুধু নয়; বরং মনে করা হয় সর্বোচ্চ মেধাবীদের বিদ্যাপীঠ, বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেখানকার একদল শিক্ষক যদি এভাবে পক্ষপাতমূলক আচরণ বা নীরবতা পালন করেন, লেজুড়বৃত্তি করেন তাহলে ছাত্ররা তাদের থেকে কী শিখবে? এ ছেলেরাই তো একসময় দেশের সরকারি-বেসরকারি বড় বড় দায়িত্বভার গ্রহণ করবে।

সন্দেহ নেই এসব প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক শিক্ষকও রয়েছেন, যারা নীতি-নৈতিকতায় সৎ ও আদর্শবান, কিন্তু বিপুলসংখ্যক বিচ্যুত মানুষের ভিড়ে ও চাপে তারাও তাদের কাক্সিক্ষত ভূমিকাটা রাখতে পারেন না। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি ও প্রস্তাব জোরালো হচ্ছে, আমি বলব, তার চেয়েও আগে দরকার দেশের সকল প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকদের রাজনীতি ও দলাদলি বন্ধ করা। শিক্ষকদের বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন রঙের নাম শোনা যায়; লাল, নীল, গোলাপী কত রংয়ের দল। কেন, তাদের সবার রঙ এক হতে পারে না? ঐ শিক্ষকদের থেকে দলাদলি, আদর্শহীনতা, অনৈতিকতা দূরীভূত হয়ে সততা, নিরপেক্ষতা, আদর্শবাদিতা, নৈতিকতা এসে গেলে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অপরাধমূলক কর্মকা- দ্রুতই বিদায় নেবে ইনশাআল্লাহ। বিদ্বান, সৎ ও আদর্শবান সম্মানিত শিক্ষকম-লীর উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমরা এ কথাগুলো আরজ করলাম।

 

ছাত্রদের রাজনীতি ও লেজুড়বৃত্তি

আবরার ফাহাদ হত্যার পর ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা উঠেছে। সাধারণ ছাত্রদের দাবির মুখে বুয়েটে সেটা মেনেও নেয়া হয়েছে। এই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নিয়ে দু-রকম কথা শোনা যাচ্ছে। যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন, তারা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের প্রস্তাবের পক্ষে কথা বলছেন। তবে তাদের কেউ কেউ আবার বলছেন যে, কোনো দলের লেজুড়বৃত্তিমুক্ত ছাত্র রাজনীতি চলতে দেওয়া উচিত। আর যারা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, তারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার দাবির বিরোধিতা করে বলছেন, মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা যাবে না। ছাত্ররাজনীতি কি ছাত্রদের জন্য মাথা? এই উপমাটা কি ঠিক হল? বরং এখনকার ছাত্ররাজনীতি তো ছাত্র নামক দেহের মধ্যে একটা টিউমারের মতো বিষয়। বিগত দশকগুলোতে প্রচলিত ছাত্ররাজনীতি দেশে কোন্ মহা কল্যাণ বয়ে এনেছে?

আগে ছাত্র রাজনীতি টিকে থাকা দরকার মনে করা হত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য। ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করা হত। বর্তমানে কি সে অর্থে ছাত্রসংগঠনের দরকার আছে? রাজনৈতিক দলগুলো যেসব কারণে ছাত্ররাজনীতিকে উৎসাহিত করে এসেছে বর্তমানে তো এসব কারণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। এখন কি ক্ষমতার জন্য জনসমর্থন বা ছাত্রদের ব্যবহার খুব প্রাসঙ্গিক। এখন তো বিভিন্ন বাহিনী দিয়েই সরকার চলে। ছাত্রদের রাজনীতি করতে দিয়ে কয়দিন পরপর কমিটি বদল, কমিটি বরখাস্তের ঘটনাও ঘটে থাকে। এ নিয়ে বাদ-বিবাদ ও উত্তেজনাও তৈরি হয়।

ছাত্র রাজনীতির পক্ষে বলতে গিয়ে এক বাম রাজনীতিক নেতা বলেছেন, ‘ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমি এসেছি।’ তিনি সমবয়সী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার নামও উচ্চারণ করেছেন, যারা ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে এসেছেন। তার কথা শুনে অনেকেরই হাসবে না কাঁদবে এমন দশা হয়েছে। তিনি নিজেকে এবং আরো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে যে উদাহরণ হিসাবে পেশ করলেন মন্ত্রী হওয়া ছাড়া তারা জাতির জন্য আর কী করেছেনÑ সেটার কি হিসাব দিতে পারবেন? রাজনৈতিক বিরোধ জিইয়ে রাখা, ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া ছাড়া নিঃস্বার্থভাবে ভালো কিছু করতে তো জাতি দেখতে পায়নি। ঐ বাম নেতাসহ আরো কেউ কেউ বলে থাকেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলে জঙ্গি তৈরি হবে। তাহলে কি জঙ্গির জু জু দেখিয়ে আরেকদল ‘জঙ্গি’ লালন করে যেতে হবে?

আর যারা বলছেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বাইরে ছাত্রদের স্বতন্ত্র রাজনীতির সুযোগ দেওয়া উচিত, দৃশ্যত তাদের কথায় যুক্তি আছে। ছাত্ররা উদ্যোগ নেওয়ায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় ভেবে দেখা দরকার। বড়রা যা করতে পারে না, শিক্ষকরা যা করতে পারেন না, সেসব কাজের প্রত্যাশা ছাত্রদের থেকে করা কতটা সঙ্গত? ওরা আমাদের থেকে শিখবে, নাকি আমরা তাদের থেকে শিখব? কেন তাদেরকে এগিয়ে দিতে চাই? কেন তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি? ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে যেসব ভালো কাজ প্রত্যাশা করা হয়, সেগুলোর জন্য শিক্ষকদের সোচ্চার হলেই তো হয়। প্রশাসন ও সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করে ফেললেই তো আর কথা থাকে না। ছাত্ররা কেন লেখাপড়া ছেড়ে আন্দোলনে নামবে।  ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার করার কথা ইসলাম শিক্ষা দেয় না; বরং ইসলামের শিক্ষা হল, ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কাজ সবাই করবে। এজন্যই লেজুড়বৃত্তি বলি আর স্বতন্ত্রভাবেই বলি, ছাত্রদের ব্যবহার করার জন্য বা নিজেরা না করে তাদের কাছে প্রত্যাশা করার জন্য ছাত্ররাজনীতি চালু রাখার পক্ষে অবস্থান রাখার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।

 

উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

যদি আন্তরিকভাবে সবাই চান যে, ছাত্রদের মধ্যে মারামারি, বিশৃঙ্খলা, হত্যাকা- বন্ধ হোক, তাহলে দরকারÑ যে কোনো হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করা। বিশেষত ওইসকল হত্যাকা-, যেগুলো প্রকাশ্যে ঘটে। হত্যাকারীরা সুচিহ্নিত থাকে, ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ছবি-ফুটেজ ইত্যাদি থাকেÑ এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার অল্প সময়ে দ্রুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘসূত্রিতায় না গিয়ে শিগগির ও ঘটনাটি আলোচিত থাকতে থাকতেই এসব  বিচার সম্পন্ন করা উচিত। এভাবে দ্রুত সময়ে হত্যাকারীদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হলে অন্য অপরাধীদের মধ্যে ভীতি তৈরি হবে। কাউকে মেরে ফেলে সহজে পার পেয়ে যাওয়ার চিন্তা না থাকলে এমন অপকর্ম করার সাহসও করবে না। কুরআনুল কারীমের ভাষায়Ñ

وَ لَكُمْ فِی الْقِصَاصِ حَیٰوةٌ یّٰۤاُولِی الْاَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ.

হে জ্ঞানী সমাজ! তোমাদের জন্য কিসাসে (হত্যার বিনিময়ে হত্যার শাস্তি) রয়েছে জীবন (রক্ষার ব্যবস্থা)। যাতে তোমরা সাবধান হতে পার। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৭৯

আরেকটি ব্যাপার হল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং নামের এই বিষাক্ত সয়লাব বন্ধ করতে হবে পুরোপুরিভাবে। বড় ছাত্রদের দিয়ে ছোট ছাত্রদের নির্যাতন, লজ্জাজনক কর্মকা-, অশ্লীলতা, এমনকি ছাত্রী নির্যাতনের মত যেসব ঘটনার কথা শোনা যায় এটা কীভাবে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টগণ সহ্য করেনÑ বিস্ময় লাগে। জাতি হিসাবে আমাদের জন্য এটি অনেক লজ্জার। কোনো খারাপ বিষয়কে শুধু রেওয়াজ হয়ে যাওয়ার কারণেই চালু রাখা যায় না। শিক্ষক, প্রশাসনের আন্তরিকতা এবং সরকারি সিদ্ধান্ত থাকলে র‌্যাগিং দ্রুত বন্ধ করা অসম্ভব কিছু নয়। যদি এটা তারা বন্ধই করতে না পারেন তাহলে জনগণের করের টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান চালানোর কী দরকার? বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য ঢুকেই যদি শিক্ষার্থীগণ এমন জঘন্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তবে ভবিষ্যতে এর খারাপ প্রভাব তাদের উপর থাকতে বাধ্য।

খুব অবাক করা ব্যাপার হল, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পরপর শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘র‌্যাগিং কমবেশি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হয়।’ এটা বলে কি র‌্যাগিংয়ের মতো ভয়ংকর জুলুমের বিষয়টাকে তিনি স্বাভাবিক ও সহনীয়ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। র‌্যাগিং নামের এই জুলুম চলতে দেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তিই আসলে সুযুক্তি নয়।

 

ভোলায় হত্যাকা-

গত ২০ অক্টোবর রোববার ভোলার বোরহানুদ্দীনে ফেসবুকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নামে অবমাননাকর উক্তির প্রতিবাদ জানাতে আসা বিক্ষুব্ধ মানুষের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে চারজন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক। আল্লাহ নিহদের মাগফিরাত করুন, শাহাদাতের মর্যাদা নসীব করুন, আহতদের দ্রুত শেফা দান করুন।

বিক্ষুব্ধ ধর্মপ্রাণ মানুষদের মিছিল করতে না দেওয়া ও প্রতিবাদ জানাতে না দেওয়ায়, তারা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ পরিবেশ শান্ত করার জন্য পুলিশ কর্তৃক নির্বিচার গুলি বর্ষণের এ ঘটনা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বলা হচ্ছে, কেউ কেউ পুলিশকে লক্ষ করে পাথর-কংকর নিক্ষেপ করেছে। এটি সমর্থনযোগ্য নয়, প্রতিবাদ হবে অহিংস ও শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু যদি এমন কিছু হয়েও থাকে তার প্রতিকার কি গুলি করে কিছু মানুষকে মেরে ফেলা?! কংকরের জবাব কি বুকে গুলি মেরে দিতে হয়! সাধারণত এমন ক্ষেত্রে পুলিশকে কাঁদানে গ্যাসসহ বিভিন্ন কিছুর ব্যবহার করতে দেখা যায়। কিন্তু এখানে কেন এভাবে গুলি মেরে শেষ করে দেয়া হল কয়েকজন নিরপরাধ রাসূলভক্ত মুমিনের জান। মনে রাখতে হবে, গুলি করে মানুষ মেরে মেরে সবসময়ের জন্য পরিস্থিতি শান্ত রাখা যাবে  না; বরং দরকার মূল সমস্যায় হাত দেওয়া। ইসলামবিদ্বেষ ও রাসূল অবমাননার কঠোর বিচার করা এবং তৎক্ষণাৎ করা। সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। তাহলে এজাতীয় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরিই হবে না। ইসলামবিদ্বেষীরাও উসকানি সৃষ্টি করার দুঃসাহস পাবে না।

পুলিশের গুলিতে ভোলায় নবীপ্রেমিক মানুষ হত্যার পর নানা রকম হয়রানির খবর আসছে। অজ্ঞাত ৫০০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের খবর এসেছে (যা দ্বারা মূলত পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যের সুযোগই তৈরি হয়েছে হয়ত)। সাম্প্রদায়িক উসকানি সৃষ্টির চেষ্টাও চলছে বলে জানা গেছে। এভাবে পরিস্থিতি কেবল উত্তপ্তই হবে। আমরা দায়িত্বশীলদের আরও সতর্ক ও সংযত হতে আহ্বান জানাই। ভোলার বোরহানুদ্দীনে ধর্মপ্রাণ মানুষদের হত্যাকাণ্ডে দায়ী পুলিশদের অবশ্যই বিচারের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে হবে এবং দেশের যে কোনো প্রান্তে ইসলামবিদ্বেষ ও রাসূল অবমাননার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার যেন ইসলামবিদ্বেষীদের ব্যাপারে কঠোর হয়ে ইসলামপ্রিয় জনতার প্রতি তাদের যৌক্তিক ও আত্মিক দাবির প্রতি যতœবান হনÑ সে ধরনের পদক্ষেপই জনগণ দেখতে চায়।

ভোলার ঘটনা ভিন্ন মাত্রার বার্তা প্রদান করেছে। সেখানে জমায়েত হয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ জনগণ। এটি কোনো মাদরাসার ছাত্র বা উলামা সমাবেশ ছিল না। সাধারণত আন্দোলন হয় শহরকেন্দ্রিক, বড় বড় নেতারা তা ডাক দেন। একসময় বিভিন্ন অদৃশ্য কারণে তা স্তিমিতও হয়ে যায়। ভোলার মানুষ প্রমাণ করেছেন তাদের নবীপ্রেমের ভিন্ন মাত্রা। এ রাসূলপ্রেমীদের প্রতি রইল আমাদের আন্তরিক অভিনন্দ।

 

advertisement