একটি ভিত্তিহীন কথা
ইবলিস কি ‘মুআল্লিমুল মালাইকাহ’ ছিল?
আমাদের সমাজে একথা প্রসিদ্ধ- ইবলিস ‘মুআল্লিমুল মালাইকাহ’ তথা ফিরিশতাদের শিক্ষক ছিল। অর্থাৎ সে আল্লাহর ইবাদত করতে করতে এমন স্তরে পৌঁছেছিল যে, আল্লাহ তাকে ফিরিশতাদের শিক্ষক বানিয়ে দিয়েছিলেন। এটি একটি ভিত্তিহীন কথা। কুরআন-হাদীসে এমন কোনো কথা খুঁঁজে পাওয়া যায় না। বরং ইবলিস সম্বন্ধে এটি এমন একটি অমূলক কথা যে, ইসরাঈলী রেওয়ায়েতেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না।
ইবলিস সম্বন্ধে সমাজে অনেক কথা প্রচলিত আছে, যার অধিকাংশই ইসরাঈলী বর্ণনা নির্ভর।
ইবনে কাসীর রাহ. নিজ তাফসীরগ্রন্থে সূরা কাহফের ৫০ নং আয়াতের তাফসীরে ইবলিস-শয়তান বিষয়ে ইসরাঈলী বর্ণনা-নির্ভর বিভিন্ন বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন-
وَقَدْ رُوِيَ فِي هَذَا آثَارٌ كَثِيرَةٌ عَنِ السّلَفِ، وَغَالِبُهَا مِنَ الْإِسْرَائِيلِيّاتِ الّتِي تُنْقَلُ لِيُنْظَرَ فِيهَا، وَاللهُ أَعْلَمُ بِحَالِ كَثِيرٍ مِنْهَا، وَمِنْهَا مَا قَدْ يُقْطَعُ بِكَذِبِهِ لِمُخَالَفَتِهِ لِلْحَقِّ الّذِي بِأَيْدِينَا، وَفِي الْقُرْآنِ غُنْيَةٌ عَنْ كُلِّ مَا عَدَاهُ مِنَ الْأَخْبَارِ الْمُتَقَدِّمَةِ لِأَنّهَا لَا تَكَادُ تَخْلُو مِنْ تَبْدِيلٍ وَزِيَادَةٍ وَنُقْصَانٍ، وَقَدْ وُضِعَ فِيهَا أَشْيَاءٌ كَثِيرَةٌ...
অর্থাৎ, ইবলিস বিষয়ে বেশ কিছু বক্তব্য উল্লেখিত হয়েছে। এর অধিকাংশই ইসরাঈলী বর্ণনা। এগুলোর সত্যাসত্য বিষয়ে আল্লাহই ভালো জানেন। এগুলোর মধ্যে কিছু তো এমন রয়েছে, যেগুলো মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়; কারণ তা প্রমাণিত বিষয়ের বিপরীত। এসকল বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এসব ইসরাঈলী বর্ণনার দিকে যাওয়ার আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, এগুলোর কোনোটা বিকৃত, কোনোটাতে বাড়ানো-কমানো হয়েছে। আবার তাতে অনেক বানোয়াট কথাও রয়েছে...। (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা কাহফের ৫০ নং আয়াতের তাফসীর; আলামুল জিন্নি ওয়াশ শায়াতীন, ড. উমার সুলাইমান আলআশকার, পৃ. ১৭-১৮)
আমাদের আলোচ্য কথাটিও ইবলিস সম্বন্ধে অমূলক একটি কথা, যা ইসরাঈলী বর্ণনার ভা-ারেও পাওয়া যায় না।
কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীসে ইবলিস সম্বন্ধে যা পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নি¤œরূপ-
সে আগুনের তৈরি। কুরআনে তাকে ইবলিস বা শয়তান নামে উল্লেখ করা হয়েছে (তবে শয়তান শব্দটি ব্যাপকার্থে)। আদম আ.-কে সিজদা করতে অস্বীকার করে সে আল্লাহর অবাধ্য হয়েছে। আল্লাহ তাকে বিতাড়িত করেছেন এবং পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে বনী আদমকে বিপথগামী করার প্রতিজ্ঞা করেছে এবং আল্লাহর কাছে সময় চেয়েছে, তাকে সময় দেওয়া হয়েছে। [সূরা আরাফ (৭) : ১১-১৫; সূরা ছদ (৩৮) : ৭২-৮১; সূরা বাকারা (২) ৩৬] সে আদম-হাওয়া আ.-কে ধোঁকা দেয়। [সূরা আরাফ (৭) : ২০-২২]
বনী আদমকে সে ওয়াসওয়াসা দেয়, এমনকি মানব-শয়তানদের বিভিন্ন নির্দেশনাও দেয়। যেমন, ওহুদ যুদ্ধের দিন সে চিৎকার করে নির্দেশনা দেয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮২৪) মানুষের বেশে মানব শয়তান-বাহিনীকে সঙ্গও দেয়। যেমন, বদরের দিন। [তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা আনফাল (৮), আয়াত : ৪৮] বনী আদমের শিরা-উপশিরায় চলার ক্ষমতা রয়েছে তার। (সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৩৮) সমুদ্রে সে তার সিংহাসন স্থাপন করে এবং তার বাহিনীকে প্রেরণ করে। বনী আদমকে যে যত বড় ফেতনায় লিপ্ত করতে পারে ইবলিসের কাছে সে তত প্রিয় ও কাছের গণ্য হয়। এক শয়তান এসে বলে, আমি অমুক অমুক কাজ করে এসেছি; সে বলে, তুমি কিছুই করতে পার নাই। আরেকজন এসে বলে, আমি এক ব্যক্তির পিছে লেগেছি; অবশেষে তার মাঝে ও তার স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছেড়েছি। একথা শুনে শয়তান তাকে কাছে ডেকে নেয় এবং বলে, তুমিই সেরা; তুমিই কাজের কাজ করেছ। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮১৩) তেমনি প্রতিদিন সকালে তার বাহিনী প্রেরণ করে এবং বনী আদমকে যে যত বড় ফিতনায় লিপ্ত করতে পারে তাকে তত বাহবা দেয় এবং মুকুট পরিয়ে দেয় (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬১৬৮) ইত্যাদি।