ষ ড় য ন্ত্র : উদ্দেশ্য-প্রণোদিত গবেষণা ও ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেত্রী প্রিয়া সাহার বক্তব্য ও তৎপরতায় গোটা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়েছেন। মিডিয়ায় ঘটনাটি সম্পর্কে যা এসেছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, গত ১৬ জুলাই ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’ ২৭ ব্যক্তির সাথে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। দেশগুলো হচ্ছে, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ইয়েমেন, চীন, কিউবা, ইরিত্রিয়া, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, সুদান, ইরাক, আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইরান ও জার্মানী। এই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশী পরিচয়ে প্রিয়া সাহা উপস্থিত হয়ে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেন, “আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই। এখন সেখানে এক কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।”
এই হিন্দু নারী বারবার বুকে হাত দিয়ে, চোখেমুখে অসহায় ভাব ফুটিয়ে তুলে এই জঘন্য মিথ্যা কথাগুলো অবলীলায় বলে গেছেন।
একপর্যায়ে ট্রাম্প প্রিয়া সাহার সাথে হাত মেলান। এ সময় ট্রাম্প প্রশ্ন করেন, কারা জমি দখল করেছে? কারা বাড়িঘর দখল করেছে?
ট্রাম্পের প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘তারা মুসলিম মৌলবাদী গ্রুপ এবং তারা সবসময় রাজনৈতিক আশ্রয় পায়।’ (নয়া দিগন্ত, ২০ জুলাই ২০১৯)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে দেয়া তার ঐ মিথ্যা অভিযোগের ভিডিও প্রকাশ করে মার্কিন টিভি চ্যানেল এবিসি ফোর। প্রকাশের পরপরই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং গোটা দেশ এই দেশদ্রোহী ঘৃণ্য কর্মে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতৃবৃন্দ প্রথম দিকে কিছু ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেললেও পরে সংযত হন।
এ ঘটনায় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ও ঘৃণা জেগে উঠেছে তা খুবই স্বাভাবিক। তবে এখানে বেশ কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। প্রথমত, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মত একটি সংগঠনের একজন নেত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে গেল, কিন্তু দেশের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো কিছুই জানতে পারল না- এটা খুবই ভয়াবহ একটি ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে মার্কিন দূতাবাসকে অভিযুক্ত করে বলেন, “প্রিয়া সাহাকে আমেরিকায় পাঠানো হয় বাংলাদেশ মার্কিন দূতাবাসের মনোনয়নে। অনেক সমালোচনার পর আজ (রোববার) তারা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, তারা অংশগ্রহণকারীদের কথাবার্তার উপর কোনো বিধি নিষেধ আরোপ করেন না। কিন্তু যখন তাদের একজন মনোনীত অংশগ্রহণকারী তাদেরই রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে কোনো ভয়ঙ্কর মিথ্যা বক্তব্য দিলেন, তাদের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ জানানো, যা তারা করেননি। এই বিষয়টি থেকে কিন্তু মার্কিন দূতাবাসেরই দূরভিসন্ধি প্রকাশ পায়। তারা জেনেশুনেই প্রিয়া সাহাকে বাছাই করে। কারণ, তারা জানত, উনি এ ধরনের ভয়ঙ্কর মিথ্যা মন্তব্য করবেন। এ ধরনের কাজের পিছে একটাই কারণ চিন্তা করা যায় : মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের এ অঞ্চলে সেনা অভিযানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। মনে রাখা ভালো, কয়েকদিন আগেই মার্কিন এক কংগ্রেসম্যান একটি বক্তব্যে বলেছিলেন- ‘বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দখল করা’।”
উদ্বেগের বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে একজন হিন্দু নারী সংখ্যালঘু নির্যাতনের মারাত্মক মিথ্যা অভিযোগ এমন এক সময়ে করলেন যখন প্রতিবেশী দেশে ভয়াবহ মুসলিম নির্যাতন চলছে। বিশেষত এনআরসির চক্করে আসামের লাখ লাখ মুসলিম রয়েছেন বাস্তুচ্যুতির বাস্তব আশঙ্কায়। প্রতিনিয়ত সেখানে উচ্চারিত হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী হটানোর নামে মুসলিম নাগরিকদের স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করার প্রকাশ্য ঘোষণা। এই প্রেক্ষাপটে এদেশেরই এক হিন্দু নারীর এই মারাত্মক মিথ্যাচারে স্বদেশ ও স্বদেশবাসী মুসলিমদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
এখানে মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল। মুসলিমরাই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। একারণে -আল্লাহ না করুন- এদেশ ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হলে জাতি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মুসলিমরাই। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুসলিমদের সহায়-সম্পদ, দ্বীনী ও দুনিয়াবী প্রতিষ্ঠান ও কর্মতৎপরতাসমূহ। একারণে এই আশংকা জাগা অমূলক নয় যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের একশ্রেণির উগ্র হিন্দুর মত এ দেশীয় কিছু কিছু হিন্দুও কি তবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল!
ইসলাম যেমন এই শিক্ষা দান করে যে, কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের অন্যায়-অবিচারে প্ররোচিত না করে তেমনি এই শিক্ষাও দেয় যে, যারা তোমাদের ক্ষতিসাধনে কোনো কসূর করে না ওদের বন্ধু ও পরামর্শকরূপে গ্রহণ করো না।
আমাদের সর্বস্তরের মুসলিমের কর্তব্য, এই ভূখ-ের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া।
এই বিচক্ষণতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দেশের ক্ষতি সাধনকারী অসত্য ও বিকৃত গবেষণা ও পরিসংখ্যানের বিষয়ে সচেতন থাকা। তাদের এহেন কর্ম যে ষড়যন্ত্রমূলক এবং এর সাথে দেশ-বিদেশের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য বহু শক্তি জড়িত তা লক্ষণাদির কারণে খুব সহজেই বোঝা যায়।
প্রিয়া সাহা তার জঘন্য মিথ্যাচার সম্বলিত বক্তব্যের যে ‘ব্যাখ্যা’ দিয়েছে তা-ও মিথ্যাচার-নির্ভর। সেই ‘ব্যাখ্যা’র একটি অংশ নি¤œরূপ : ‘২০০১ সালে বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান বইয়ের তথ্য অনুসারে দেশভাগের সময় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৯ দশমিক ৭ ভাগ। আর বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৮ কোটির মত। বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বেড়েছে সে হারে যদি সংখ্যালঘুও বাড়ত তাহলে এই পরিমাণ সংখ্যা (তার অভিযোগে উল্লেখিত নিখোঁজ ৩ কোটি ৭০ লাখ) থাকার কথা। কিন্তু সেটা নাই। সেটা নাই কেন? সে জনসংখ্যা হারিয়ে গেছে।’
প্রিয়া সাহা আরো বলেছে, সরকারি বইয়ের এ তথ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাত। তিনি এ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ৬৩২ জন সংখ্যালঘু হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগতভাবে সংখ্যালঘুরা হারিয়ে গেছে। ২০১১ সালে আমি তখন স্যারের সাথে কাজ করেছি। সে কারণে আমি এ বিষয়টা সম্পর্কে জানি।’
খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কীভাবে একটি জঘন্য মিথ্যাচারকে গবেষণার মোড়কে প্রস্তুত করা হয়েছে। সাধারণ বুদ্ধিতেও বিষয়টা ধরা পড়ে। প্রধানমন্ত্রীপুত্র তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন- “আপনারা হয়ত দেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার ভয়ঙ্কর ও মিথ্যা দাবি। উনি বলেছেন বাংলাদেশ থেকে নাকি তিন কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ‘গায়েব’ ও ‘গুম’ হয়ে গেছেন। প্রায় চার কোটির কাছাকাছি যে সংখ্যাটি উনি বলছেন, তা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যার ১০ গুণেরও বেশি, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যার কাছাকাছি। এত মানুষ গুম হলো সবার অজান্তে? তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ গায়েব হলো কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই?”
প্রিয়া সাহা যে ড. আবুল বারাকাতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তিনিও এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন, যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এসেছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে প্রিয়া সাহা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন তারই স্বামী প্রজাতন্ত্রের দুর্নীতি দমন কমিশনের মত একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের উপপরিচালক। তার মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ এদেশে বড় বড় পদে কর্মরত আছেন। কোনো নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে একটি নিবিড় জরিপ চালানো হলে বিষয়টি সামনে আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাধারণ চাকরি-বাকরি ছাড়াও প্রশাসন, বিচার, আইন, শিক্ষা, প্রযুক্তি, যোগাযোগ ও স্বাস্থ্যবিভাগে এবং পুলিশ, আনসার, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে কতজন সংখ্যালঘু উচ্চপদে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছেন তার সর্বশেষ তালিকা জনসমক্ষে আসলে প্রমাণ হবে, জনসংখ্যার অনুপাতে তারা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, না ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি ভোগ করছেন।
আমরা মনে করি, আমাদের শিক্ষিত সমাজকে দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষার্থে গঠনমূলক ও সত্যসন্ধানী গবেষণায় প্রবৃত্ত হওয়া প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে মুসলিম শিক্ষানুরাগীদেরই দায়িত্ব বেশি। আমাদের কলেজ-ভার্সিটির দ্বীনপ্রিয় তরুণেরা যদি এসব ক্ষেত্রে গঠনমূলক গবেষণায় এগিয়ে আসেন তাহলে আশা করা যায় এসব মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে সামরিক আগ্রাসন বা অন্য যে কোনো প্রকারের আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য প্রথমত ভাড়াটে গবেষকদের মাধ্যমে ভিত্তিহীন গবেষণাপত্র প্রস্তুত করা হয়। এরপর সেগুলো মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়। এরপর সেগুলোকে ‘যথাসময়ে’ কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়। ঐ সময় সেগুলো আর নিছক তথ্য-সন্ত্রাস থাকে না, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জান-মাল ইজ্জত-আব্রু হানিকর ভয়াবহ আগ্রাসনের রূপ পরিগ্রহ করে। স্থানীয় জনমত ও বিশ্বজনমত গঠনের ক্ষেত্রে এইসব ভিত্তিহীন গবেষণা ও প্রচারণার প্রভাব যে কত এবং মুসলিম দেশগুলোতে তা যে কত মর্মান্তিক ট্রাজেডির জন্ম দিয়েছে তা সচেতন কারো অজানা থাকার কথা নয়। আল্লাহ তাআলা নিজ করুণা ও কুদরতে এই ভূখণ্ডকে ও গোটা মুসলিম জাহানকে হেফাযত করুন- আমীন।