Zilhajj 1440   ||   August 2019

না খোদাহী মিলা না বেসালে ছনম

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে খবরটি পড়েই কবির এই বিখ্যাত পংক্তিটি মনে পড়ে গেছে। আরো মনে পড়ল, ছাত্র জামানায় বহুবার শোনা একটি লোককথা। উজানীর তৎকালীন পীর হযরত মাওলানা মোবারক করীম রাহ. তাঁর প্রায় ওয়াজেই এ কিসসাটি বলতেন, খেড়িহর মাদরাসা ও আমাদের গ্রামের এলাকায় অনেক মাহফিল হত তাঁর। আকর্ষণীয় আন্দাজে তিনি শোনাতেন কাক পাখির সোজা হয়ে হাঁটতে না পারার কারণ। তাঁর ভাষায় “কাউয়া গেছিল কবুতরেরটা শিখতে। অনেক দিন চেষ্টা করেও তা তো শিখতে পারেইনি, ফাঁকে নিজেরটাও ভুলে গেছে। এখন সে পাথালে নাচে।’’

যে খবর পড়ে এত কিছু মনে পড়ল সেটির শিরোনাম হল, মার্কিন গায়িকা নিকি মিনাজ কর্তৃক সৌদি আরবে তার নির্ধারিত কনসার্ট বাতিলের ঘোষণা। এর কিছুদিন আগে থেকে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ক্ষোভ ও বেদনা প্রকাশের খবর প্রকাশিত ও  প্রচারিত হচ্ছিল। তারা পবিত্র হজ্বের মৌসুমে মক্কা মুকাররমার অদূরে জেদ্দা নগরীতে অনুষ্ঠিতব্য কনসার্টের ব্যাপারে বিশ্বের আনাচে-কানাচে থেকে নিন্দার ঝড় তুলেছিলেন। ১৮ জুলাই ২০১৯  حفل مهرجان جدة العالمي  ‘হাফলু মেহেরজান জেদ্দা আলআলামী’ শিরোনামে জেদ্দা শহরে এ কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল। এত নিন্দা-প্রতিবাদের পরও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করার তাগিদ অনুভব করেননি। এরই মধ্যে খোদ গায়িকা কর্তৃক উক্ত অনুষ্ঠানে হাজির না হওয়ার ঘোষণা এল। খবরে প্রকাশ, নিকি মিনাজ একজন আমেরিকান গায়িকা, যে কিনা খোলামেলা পোশাক এবং অশ্লীল বক্তব্য সংবলিত গানের কারণে পরিচিত। অশ্লীল পারফরমেন্সই নাকি তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

ওই মহিলা জেদ্দার অনুষ্ঠানটিতে নিজের উপস্থিতি বাতিলের ঘোষণায় এর কারণও উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়- “সৌদি আরবে আমার ভক্তদের সামনে পারফর্ম করা আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। কিন্তু সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, আমার জন্য নারীবাদী ও সমকামীদের সমর্থন আরো গুরুত্বপূর্ণ।”

গায়িকা নিকি মিনাজ জেদ্দায় উপস্থিত না হওয়ার কারণ হিসেবে এসব কথা কেন বললেন? যতদূর জানা গেছে, নিকি মিনাজ নারীবাদী ও কথিত মানবাধিকার ও সমকামী গোষ্ঠীর সমর্থক। এসব গোষ্ঠী সৌদি আরবের জেদ্দায় কনসার্টে তার অংশ নেওয়ার নিন্দা করে আসছিল। তারা বিভিন্ন প্রতিবাদ বিবৃতিতে গায়িকাকে বলছিল, তুমি সৌদি আরবের তেলের টাকা ছুঁড়ে ফেল। কারণ তাদের ভাষায়, ‘‘সৌদি আরব নারীদের নির্যাতন করে, মানবাধিকার লংঘন করে, সমকামীদের বিরোধিতা করে।” অপরদিকে যেহেতু এই গায়িকা নারীবাদী ও সমকামীদের পক্ষে আগে থেকেই কাজ করে আসছে, সেজন্য সে এদের পক্ষ থেকে চাপের মধ্যেই ছিল। বিদেশি এজাতীয় সংস্থা ও গোষ্ঠীগুলো তার কাছে আরও দাবি করেছে, সৌদি আরবে অনেক মানবাধিকারকর্মী আটক। নারীরা সেখানে অধিকার পায় না। সমকামিতা সেখানে আইনত নিষিদ্ধ। তুমি সেখানে যাওয়ার অর্থ হবে তুমি সেসবকে সমর্থন করছ। তাদের কেউ কেউ একথাও বলেছে যে, ‘রক্ষণশীল’ সৌদি আরবের লোকজন তোমার নাচগানের ভঙ্গি, তোমার বেশভূষা ও পারফরমেন্স কীভাবে নেবে তোমার ভেবে দেখা উচিত।

এ ছিল জেদ্দায় নিকি মিনাজের কনসার্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার পশ্চিমারূপ। অপরদিকে জেদ্দায় এ জাতীয় কনসার্টের খবর পেয়ে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের হৃদয় কাঁদছিল শুরু থেকেই। মক্কা মুকাররমায় যাওয়ার পথ জেদ্দা, জেদ্দা সেই পবিত্র শহরের প্রবেশদ্বার-শহর। বাইতুল্লাহয় যখন হাজ্বী সাহেবরা পুণ্যের প্রবল আবেগ নিয়ে হাজির হবেন, গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য লাখো লাখো মানুষ লাব্বাইক ধ্বনিতে চারদিক আন্দোলিত করবেন, এমনই সময় প্রকাশ্যে সেখানে আল্লাহর নাফরমানির আয়োজন চলবে। ঈমানদীপ্ত মুসলমানদের জন্য এ ছিল বুকভরা কান্নার কারণ ও উপলক্ষ।

এতে শুধু হাজ্বীদের নয়, কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছিল। দেশে দেশে নানাভাবে প্রতিবাদ ও ক্ষোভধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছিল। সৌদি আরবের জেদ্দায় কনসার্টের আয়োজন যারা করছিল তারা এসব প্রতিবাদে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও যাকে নিয়ে এই আয়োজন সেই নিকি মিনাজ নিজেই ওই কনসার্টে উপস্থিত না হওয়ার ঘোষণা দেন। এতে ওই কনসার্ট বাতিল হয়ে যায়। তিনি কেন এই কনসার্টে হাজির হবেন না- এর কারণও তখন প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন।

জেদ্দায় নিকি মিনাজের কনসার্ট আয়োজন, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ এবং আয়োজকদের পক্ষ থেকে কাউকে কোনো পরোয়া না করা আর শেষ পর্যন্ত ওই গায়িকা কর্তৃক কনসার্টে হাজির না হওয়ার ঘোষণার এই সামগ্রিক চিত্রটি দুনিয়ার আত্মভোলা মুসলমানদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়ে গেছে। কী সেই বার্তা? এটা নিয়েই আমরা কয়েকটি কথা আরজ করতে চাই।

 

রিয়াদ গেট

প্রথম যে প্রসঙ্গটি নিয়ে বলতে চাই, সেটি হল, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে প্রবেশদ্বার বা একটি বড় ফটক আছে।  সে ফটকের দু পাশের স্তম্ভগুলোতে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে-

...عزنا وفخرنا بالإسلام : عبدالعزيز

অর্থাৎ বর্তমান সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীযের বাণী হল; ‘আমাদের সম্মান ও গৌরব ইসলামের বদৌলতেই।’ সৌদি রাজপরিবারের পূর্বপুরুষরা ক্ষমতা দখলে বিদেশিদের সহযোগিতা নিয়েছিলেন, উসমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, সেসব ঘটনার ব্যাপারে তাদের ব্যাপক সমালোচনাও ছিল ও রয়েছে, তবুও সৌদি আরব  প্রতিষ্ঠার পর সৌদি বাদশাহগণ কর্তৃক কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসনের প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন মুবারক স্থাপনার সংস্কার ও সেবামূলক কাজ করায় বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এক ধরনের মৌন সমর্থন তারা পেয়ে আসছিলেন। কিছু কিছু বিষয়ে অতি বাড়াবাড়ি, ইখতিলাফী মাসআলাগুলোতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করা অনেক ছাত্র কর্তৃক নানান দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অব্যাহত চেষ্টা সত্ত্বেও সৌদি সরকারগুলোকে তুলনামূলকভাবে ইসলামবান্ধব, মুসলিমবান্ধব সরকার হিসেবে বিশ্বের  মুসলমানরা দেখে আসছিলেন। ধারণা করা যায়, সৌদি বাদশাহদের ইসলামবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও তাদের প্রতি বিশ্বমুসলিমের অনুচ্চারিত সমর্থনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীযের উপরোক্ত স্লোগান বা বাণীর কিছু প্রতিফলন ঘটেছিল।

 

প্রসঙ্গ খাদেমুল হারামাইন

ইসলামবান্ধব কর্মসূচি ও পবিত্র ভূমির সেবার এই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে সৌদি বাদশাহরা নিজেদের খেতাব হিসেবে ‘খাদেমুল হারামাইন আশশারীফাইন’ (যার অর্থ : দুই হারাম (মক্কা-মদীনা) -এর সেবক) ব্যবহার শুরু করেছেন। এই খেতাবটি স্থলাভিষিক্ত হয় ‘জালালাতুল মালিক’ (মহামান্য সম্রাট) উপাধির। আগে সৌদি বাদশাহরা ‘জালালাতুল মালিক’ উপাধিটি ব্যবহার করতেন। সম্ভবত বাদশাহ ফাহাদ সর্বপ্রথম খাদিমুল হারামাইন আশশারীফাইন খেতাবটি গ্রহণ করেছেন। খেতাবটি সুন্দর ছিল। মুসলিম বিশ্বের মানুষ সুন্দরভাবে সেটি গ্রহণও করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিশ্বের মুসলমানরা তাদের প্রতি  আন্তরিকতা পোষণ করে এসেছেন।

সৌদি আরবে যদিও রাজতন্ত্র প্রচলিত, ইসলামী শাসনও সেখানে নেই, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছিল ইসলামী অনুশাসন। ইসলামী অনুশাসন ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা। যেমন : পর্দার বিধান, প্রকাশ্যে অশ্লীল গানবাদ্যের অনুমতি না থাকা, নারীরা দূরে কোথাও গেলে সাথে মাহরাম থাকার আইন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলামী দ-বিধির উপস্থিতি ইত্যাদি। এজন্য বাদশাহ আবদুল আযীয ও তার পরবর্তী কারো কারো শাসনামলে বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলমানদের তাদের প্রতি নীরব সমর্থন ছিল। এ বিষয়গুলোতে তাদেরকে অনেকে রোলমডেল হিসেবেও দেখত। অনেকেই তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপের উদাহরণও দিত।

 

এমবিএসের আবির্ভাব

কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের প্রশংসার বিষয়গুলোতে অধঃপতনের বিভিন্ন আলামত ফুটে ওঠে। হঠাৎ করেই বর্তমান বাদশাহ সালমান প্রথমে তার ভাই, পরে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে সরিয়ে তার নিজের ৩০/৩২ বছরের ছেলেকে যুবরাজ বা ভবিষ্যত ক্ষমতাধর হিসেবে ঘোষণা করেন। এভাবে বাদশার ছেলেকেই যুবরাজ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি অনেকের কাছে অসুন্দর লাগলেও প্রথমে তাকে দেখে কিছু মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। শ্মশ্রুম-িত এক যুবক। সৌদির ভবিষ্যত বাদশাহ। অনেকের ভেতরেই সুধারণা ও প্রত্যাশা জেগে ওঠে, ইসলামের অনেক খেদমত হয়ত করবে এ যুবক। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্বের মুসলমানদের মোহভঙ্গ ঘটে যায়।

এমবিএস খ্যাত মুহাম্মাদ বিন সালমান ক’দিন পার হতেই নতুন কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, তার পূর্বপুরুষরা ইসলামের খেদমত হিসেবে যা যা করেছিল, সেগুলোর অনেক কিছুই ছিল ভুল। বিশ্ব মুসলিমের কাছে পূর্ববর্তী সৌদি বাদশাহদের প্রশংসিত পদক্ষেপগুলোকে ভুল সাব্যস্ত করে তিনি ‘মডারেট’ ইসলাম চালু করার চেষ্টা শুরু করেন। ঘোষণা করেন ভিশন ২০৩০ সংস্কারের নামে সৌদি আরবে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিষয়গুলোকে একের পর এক বৈধতা দিতে থাকেন। ইতিমধ্যেই সিনেমা হল চালু করা, নারী-পুরুষ একত্র হয়ে খেলা দেখা, নারীদের কনসার্টের আয়োজনসহ আরও অনেক হারাম বা নিষিদ্ধ কাজকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। খেলাধুলা, আমদানিকৃত সংস্কৃতির প্রসার এবং বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের নামে খরচ হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন রিয়াল। আর এগুলো করে তিনি বিদেশিদের আনুকূল্য অর্জনেরই চেষ্টা করেছেন।

 

বিদেশিদের আনুকূল্য অর্জন

তথাকথিত সংস্কার কর্মকা- বা কথিত আধুনিকতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এমবিএস বাহ্যত বিদেশিদের আনুকূল্য লাভে সক্ষম হয়েছেন। শুধু আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যই তার লাভ হয়নি, বরং আমেরিকার প্রধান চলচ্চিত্র- বিনোদনকেন্দ্র-হলিউডেও তাকে সংবর্ধনা দিতে দেখা গিয়েছে।  সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, হলিউডে এত জমকালো সংবর্ধনা নাকি অন্য কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে দেওয়া হয়নি।

অবশ্য এমবিএসের এমন রমরমা অবস্থার মধ্যে দৃশ্যত কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছিল তুরস্কে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশুকজির হত্যাকাণ্ডের পর। যদিও এমবিএসের বিশেষ বন্ধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন বলেছিলেন, “খাশুকজি হত্যার বিচার চলতে থাকুক। আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। তাদের সঙ্গে আমাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রির চুক্তি রয়েছে।”

সৌদি যুবরাজ হতে পারে এসব প্রতিকূলতা কাটানোর জন্যই মুসলমানদের শ্রদ্ধা ও আবেগের বিপক্ষে নিজের অবস্থানটাকে দিন দিন জোরালো করছেন। ইসরাইলের সাথে সখ্য, ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টকে ইসরাইলের দাবি মেনে নিতে মৌখিক চাপ প্রয়োগ তারই সাক্ষ্য বহন করে এবং একই ধারাবাহিকতায় তিনি চীনের জিনজিয়ানে উইঘুর মুসলমানদের প্রতি চরম নির্যাতন সত্ত্বেও জাতিসংঘে চীনকে সমর্থন দিয়েছেন এবং চীনের পক্ষে কথা বলেছেন। যেখানে লাখ লাখ নির্যাতিত অসহায় উইঘুর মুসলমানকে চীন জঙ্গি বলে চিত্রায়িত করতে চেষ্টা করছে, সেখানে সৌদি সরকারও তাতে সমর্থন দিয়েছে।

এদিকে বেহায়াপনার সর্বশেষ ঘোষণা এসেছে জেদ্দায় নাইটক্লাব খোলার খবরে। আবার বৈধকরণের জন্য সেটার নামের শুরুতে নাকি ‘হালাল’ শব্দও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া হজ্বের মাসে ১৮ জুলাই নিকি মিনাজের গানের অনুষ্ঠান আয়োজন ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত। অবশ্য গায়িকা কর্তৃক তার উপস্থিতি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও এ লেখা তৈরি করার সময় খবর পাওয়া গেছে, একই জায়গায় পশ্চিমা দেশ থেকে একদল গায়ক-গায়িকা এনে কনসার্ট বহাল রাখা হচ্ছে। কিন্তু আয়োজকদের মনোনীত প্রধান ওই গায়িকা তাদের ঠিকই প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ ঘটনায় একজন উর্দু কবির একটি বিখ্যাত পংক্তি মনে পড়ে গেলো-

نہ خدا ہی ملا، نہ وصال صنم

نہ اُدهر كے رہے، نہ اِدهر كے ہوئے.

[না পেল সে খোদার নৈকট্য, না পেল দেবতার সান্নিধ্য/হতে পারল না সে ওই দিকের, থাকলো না এই দিকেরও।]

উর্দু এই কবিতাটি মর্মার্থের কারণে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। উর্দু জানে না, এমন অনেকেও ক্ষেত্র বিশেষে এই পংক্তিটা বলে থাকেন। কবি এখানে ওইসব লোককে ইঙ্গিত করেছেন, যারা নিজে একটি বিশেষ অবস্থানে থেকেও বিপরীতমুখী কিছু লোকের মনোতুষ্টির জন্য তাদের অনুকরণ করে, তাদের মতো হতে চেষ্টা করে। ফলে নিজের অবস্থানও হারায়, আবার অন্যদের ঠিকমতো খুশি করতে পারে না। নিজের পক্ষের লোকদের কাছেও সে বিরাগভাজন হয়, অন্য পক্ষের লোকেরাও তাকে আপন করে নেয় না। যা কিনা আরেকটি প্রবাদকে স্মরণ করিয়ে দেয় ‘যার ঘর চুরি করে সেও বলে চোর, আর যার জন্য চুরি করে সেও বলে চোর।’

 

এই ঘটনা যে বার্তা দেয়

পুরো ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে যে চিত্রটি দেখা যায় সেটি হল, একজন গায়িকা- নর্তকী তো টাকার জন্যই তার কাজ করে। নিকি মিনাজও এর ব্যতিক্রম নয়। সৌদি আরবে তার নির্ধারিত প্রোগ্রাম যদি সে কোনো কারণ না দেখিয়ে এমনিতেই বাতিল করে দিত তাহলে হয়ত অন্য কথা বলা যেত। কিন্তু সে যে কারণ দেখিয়েছে  তাতে সৌদি সরকারের কাছে সে বরং নারীবাদী ও সমকামীদের ‘অধিকার’ প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তুলল।  সে তো এমবিএস তথা সৌদি সরকারের কথিত সংস্কারকেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ছাড়ল। তাকে তো খুশি করা গেলই না, প্রকারান্তরে  তার আরও অশ্লীল ও অবৈধ দাবির চাপে পড়ল সৌদি সরকার।

আল্লাহ মাফ করুন। তিনি স্বীয় অনুগ্রহে হারামাইন শরীফাইন ও আশপাশের অঞ্চলগুলোকে দূষণ থেকে পবিত্র রাখুন। এমনটি যেন কখনো না হয়, কিন্তু মানুষ ভয় পাচ্ছে- তাহলে কি বিদেশিদের খুশি করতে একসময় সৌদি আরবে সমকামিতাকেও বৈধতা দেয়া হবে? কথিত নারী অধিকার বলতে যা যা বুঝানো হয় সবকিছুই কি সেখানে বাস্তবায়ন করা হবে? কিন্তু তাদের চাওয়া মতো সবকিছু করেও কি সৌদি শাসকরা তাদের খুশি করতে পারবেন?

কুরআনে কারীমের সুস্পষ্ট ঘোষণা-

وَ لَنْ تَرْضٰی عَنْكَ الْیَهُوْدُ وَ لَا النَّصٰرٰی حَتّٰی تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ .

[যতক্ষণ না তুমি ইহুদী বা খ্রিস্ট ধর্ম অনুসরণ করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। -সূরা বাক্বারা (২) : ১২০]

দেশে দেশে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের বিজাতিদের প্রতি নতজানু অবস্থা দেখে বারবার আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই অমোঘ বাণী সামনে চলে আসে। নিজেদের ধর্ম অর্ধেক অথবা ৭০% কিংবা ৮০% ছেড়ে দিলেও যে তাদের পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট করা যাবে না- এর জন্য আর কত প্রমাণ তাদের দেখতে হবে?

 

গোটা দুনিয়ার মুসলমানের অন্তরের দাবি, সৌদি সরকার তাদের পূর্বসূরীদের দেওয়া খেতাবের (খাদেমুল হারামাইন), যা তারা এখনও ধরে রেখেছে, লাজ রক্ষা করুক এবং ‘সংস্কারের’ নামে ইসলামবিরোধী যেসব কর্মকা- সেখানে চালু করা হয়েছে ও হচ্ছে, সেগুলো অবিলম্বে বাতিল করা হোক। একইসঙ্গে রাবেতায়ে আলমে ইসলামীসহ অন্যান্য সৌদি সংস্থার মাধ্যমে الوسط/ الاعتدال ইত্যাদি নামে তথাকথিত যে ‘মডারেট ইসলাম’ (ইসলামের মনগড়া, একপেশে,  ‘আধুনিক’ ব্যাখ্যা) প্রচারের জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছেন এবং দেশ-বিদেশের দরবারী হুযূরদের এ কাজে লাগিয়েছেন শিগগিরই সেসব বন্ধ করা হোক।

এসব তথাকথিত সংস্কার একে তো অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার সুযোগ করে দিয়ে আল্লাহর নাফরমানিতে ডুবে যাওয়ার পথ সুগম করছে, অন্যদিকে রাবেতা ও তাদের নিয়োগ করা কিছু ‘ধর্মীয় ব্যক্তির’ মাধ্যমে ইসলামকে বিকৃত করার জঘন্যতম কাজও আঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। তাদের এসব পদক্ষেপের দ্বারা সাধারণ মুসলমানদের বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে  হেফাজত করুন, সুমতি দান করুন।

 

advertisement