ট্রেন-দুর্ঘটনা : দায়িত্বে অবহেলার দৃষ্টান্ত
গত ২৩ জুন রবিবার দিবাগত রাতে কুলাউড়ার বরমচালের ট্রেন দুর্ঘটনাটি যে নিছক দুর্ঘটনা ছিল না; বরং এর পিছনে সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও অন্তরিকতার অভাবও দায়ী- তার কিছু লক্ষণ পত্র-পত্রিকার খবর ও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সিলেট থেকে ছেড়ে আসা আন্তনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত সাড়ে এগারটার দিকে কুলাউড়ার বরমচাল রেলস্টেশনের অদূরে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ে। ট্রেনের পিছনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং তিনটি বগি ব্রিজের ¯িøপার ভেঙ্গে পাশর্^বর্তী খালে গিয়ে পড়ে। এতে চার জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হন।
পত্র-পত্রিকার খবরে এসেছে যে, কয়েক মাস ধরেই সেতুটির ¯িøপারের কোথাও নাট নেই, কোথাও ক্লিপ নেই। এর উপর দিয়েই মাসের পর মাস লক্কর-ঝক্কর করে ট্রেন চলত। কয়েকমাস পর ভয়াবহ একটি দুর্ঘটনা যখন ঘটল তখন সবাই তৎপর হয়ে উঠেছেন। স্থানীয়রা বলছেন, বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানালেও তারা একে গুরুত্ব দেননি। এ নিয়ে স্থানীয় একজন সৌদীআরব প্রবাসী ও সাবেক সংবাদ কর্মী লুৎফর রহমান রাজু চলতি বছরের ২৮ ফেব্রæয়ারি একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এতে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং স্থানীয়দের সচেতন হওয়ার আহŸান জানান। কিন্তু এর পরও স্টেশন কর্তৃপক্ষ কোনো গুরুত্ব দেয়নি।
সরকারি দায়িত্ব পালনে অবহেলা যেন আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে। এটা জাতি হিসেবে যেমন লজ্জার তেমনি উদ্বেগেরও বিষয়। আন্তরিকতা থাকলে সরকারি দায়িত্বও যে নিষ্ঠার সাথে পালন করা যায় এবং সত্যি সত্যি জনগণের সেবা করে তাদের মন জয় করা যায় এর ছোটখাট কিছু দৃষ্টান্ত যে একেবারেই চোখে পড়ে না তা নয়।
এই জুনেই একটি জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল- ‘সারা বছর যদি এমন হত!’ সংবাদের বিষয়বস্তু ছিল নকশা অনুমোদন, ভ‚মি ব্যবহার ছাড়পত্র প্রদানে রাজউকের সেবাদান। বলা হচ্ছে, অন্য সময় রাজউক থেকে একটি ইমারত নির্মানের অনুমতি পেতে কমপক্ষে ৪৫ দিন সময় তো লাগেই, কেউ কেউ এক বছরেও পান না। কিন্তু সেবা-সপ্তাহ উপলক্ষে ২২ জুন থেকে ২৭ জুন এই পাঁচ দিনে ইমারত নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদন করা হয়েছে ১৮৮টি। প্ল্যানিং বিভাগ ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র দিয়েছে ২৩০টি। এর বাইরে আরো অনেক নামজারি, দখল-হস্তান্তর, আম মোক্তার হস্তান্তর প্রভৃতি সেবাও প্রদান করেছে। এককথায় সারা বছরে যা হয় না, এক সপ্তাহে তা করে দেখিয়েছে রাজউক। অধিকাংশ কাজের গ্রাউন্ডওয়ার্ক আগেই করা থাকলেও সেবা-সপ্তাহে রাজউকের যে তৎপরতা দেখা গেছে, বিশেষত সেবাপ্রত্যাশীদের সাথে আন্তরিক আচরণের যে দৃষ্টান্ত দেখা গেছে সেটা তো অন্য সময়েও সম্ভব।
এই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে এতগুলো কাজ সম্ভব হল- জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ কামরুল ইসলাম সোহাগ বলেছেন, ‘আন্তরিকতা থাকলে অল্প দিনের মধ্যেই এ ধরনের সেবা দেয়া সম্ভব।’
দয়িত্ব পালনে এই আন্তরিকতা কীভাবে তৈরি হতে পারে- এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। দায়িত্ব ও দায়িত্বের বিষয়ে জবাবদিহিতা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের পেশাগত জীবনে আমরা যেসকল দায়-দায়িত্ব পালন করি সেগুলো নিছক দুনিয়াবী ও পার্থিব কাজ-কর্ম নয়; বরং এগুলো আমাদের আখিরাতের সঞ্চয়ও বটে। ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ দায়-দায়িত্ব পালন যেমন হালাল উপার্জনের উপায়, তেমনি তা সেবা ও সওয়াবের কাজও বটে। অন্যদিকে এই দায়-দায়িত্বের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যেমন জবাবদিহিতার ব্যাপার আছে, তেমনি আছে আখিরাতে আল্লাহর কাছেও জবাবদিহিতার ব্যাপার। কাজেই পেশাগত জীবনের ও আয়-উপার্জনের সাথে সংশ্লিষ্ট দায়-দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালনে আমরা মুমিন হিসেবেও দায়বদ্ধ। এই চেতনা ও উপলব্ধি সমাজে বিস্তৃত করা গেলে ‘আন্তরিকতা’ নামক চাবিকাঠিটি আয়ত্ব করা আমাদের জন্য সহজ হতে পারে।
এখানে একথাও বলা বাহুল্য হবে না যে, আন্তরিকতা শুধু অধীনস্তদের মধ্যে থাকাই যথেষ্ট নয়; উপরস্থদের মধ্যেও তা থাকতে হবে। উপরের আলোচ্য বিষয়ে এক সেবা-গ্রহীতার মন্তব্য ছিল- ‘বর্তমান গৃহায়ন মন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কিছু পরিবর্তন দেখছি।’
একারণে সর্বস্তরে আল্লাহর বান্দাদের সেবা দানে আন্তরিকতার বিস্তার ঘটা অতি প্রয়োজন। এই আন্তরিকতার অভাব বরমচালের ভয়াবহ ট্রেন-দুর্ঘটনার অনেক বড় একটি কারণ।
দায়িত্বশীলদের আন্তরিকতা দ্বারা যে অভাবনীয় ব্যাপারও ঘটে যেতে পারে এর আরেক দৃষ্টান্ত দেখা গেল ঝিনাইদহে। একটি জাতীয় দৈনিকের ২২ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল- ‘ঝিনাইদহে ঘুষের টাকা ফেরত পেলেন পল্লী বিদ্যুতের শতাধিক গ্রাহক।’ কীভাবে এই অসাধ্য সাধন হল এ বিষয়ে ঘটনার এক দায়িত্বশীল প্রকৌশলী আলতাফ হোসেন বলেন-
“শৈলকূপা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বিদ্যুৎলাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এ সুযোগে ওই এলাকার এক শ্রেণীর দালালচক্র বিদ্যুৎসংযোগ দেয়ার কথা বলে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে টাকা আদায় করে আসছে- এমন খবরের ভিত্তিতে গোপন অনুসন্ধানে নামেন তারা। জেনারেল ম্যানেজার আলতাফ হোসেন আরো জানান, কয়েক দিনের গোপন অনুসন্ধানে এ খবরের সত্যতা বেরিয়ে আসে। ঘটনার সাথে জড়িতদের মধ্যে ঝিনাইদহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির শৈলকূপার একজন পরিচালকের নাম প্রকাশ হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ মিটারসহ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কথা বলে সে মোটা অংকের টাকা লেনদেন করে আসছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। এ টাকা কৌশলে ঘুষগ্রহীতার কাছ থেকে আদায় করে গ্রাহকদের ফেরত দেয়ার পরিকল্পনা করেন তারা। গ্রাহকরা খবর পেয়ে এলাকায় জড়ো হন। লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা ফেরত নেয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় ওই ঘুষগ্রহীতা পরিচালক নিজে গ্রাহকদের হাতে সেই টাকা তুলে দেন। ওই দিন দুর্নীতি বিরোধী ব্যানার ঝুলিয়ে ১২৬ পরিবারকে এক লাখ ৩৮ হাজার ১০০ ঘুষের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে বলে জানান জেনারেল ম্যানেজার।
এদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির শৈলকূপা উপজেলার ওই পরিচালক গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২২ জুন, ২০১৯)
যেখানে এই দেশে দুর্নীতির চিত্র এই যে, হাইকোর্টের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে খেলাপি ও অকার্যকর ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা সেখানে কিছু সৎ লোকের আন্তরিকতা যে এ ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টান্তও স্থাপন করতে পারে ঝিনাইদহের ঘটনাটি তার একটি দৃষ্টান্ত। যাইহোক, যে কথাটি নিবেদন করতে চাচ্ছি তা হল, সমাজ-জীবনে আমাদের আরো আন্তরিক ও দায়িত্ব-সচেতন হতে হবে। এর সুফল আমরা সবাই মিলে ভোগ করব। আর এটা যে অসম্ভব নয়- এর দুটি নজীরও এই লেখায় উপস্থিত করা হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলার ক্ষতি শুধু অন্যকেই ভোগাবে না, আখেরে তা সবচেয়ে বেশি ভোগাবে খোদ অবহেলাকারীকেও।
বরমচালের সেই দুর্ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ হতেও নির্দেশ এসেছে। তিনি দেশের সকল ঝুঁকিপূর্ণ রেল ও সড়কসেতু সংস্কারের নির্দেশ দিয়েছেন, এটা ইতিবাচক। দেশের রেলপথ ও সড়কপথগুলো ঝুঁকিমুক্ত হোক- এই প্রত্যাশা।