Zilqad 1440   ||   July 2019

খুন-লাম্পট্যের সংস্কৃতি : ‘কীসে মুক্তি, সেই সুযুক্তি কর্ অন্বেষণ’

Mawlana Muhammad Zakaria Abdullah

দৈনিক পত্রিকার পাতা ওল্টালে মন-ভালো-করা খবর তেমন পাওয়া যায় না। অধিকাংশ খবরই মন খারাপ করে দেয়। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দেয়। বারবার একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অস্বাভাবিককেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে প্ররোচিত করে। মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা আমাদের বিচলিত করলেও খুব তাড়াতাড়ি আমরা তা ভুলে যাই। এরপর নতুন আরেকটি অস্বাভাবিক ঘটনায় ব্যস্ত ও বিচলিত হয়ে উঠি।

সম্প্রতি বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রীর সামনে তরুণ স্বামীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা মিডিয়ায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী ওই ঘটনায় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনলে হাইকোর্টের একজন সিনিয়র বিচারপতি আক্ষেপ প্রকাশ  করে বলেছেন, ‘দেশের পরিস্থিতি কোথায় গেছে? অনেকে দাঁড়িয়ে দেখলেন। কেউ প্রতিবাদ করলেন না। আমরা সবাই মর্মাহত।’

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই ধরনের নৃশংস ঘটনায় কোনো বিবেকবান মানুষই মর্মাহত না হয়ে পারেন না। তবে একই সাথে এটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হল। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে এগিয়ে আসার পরিবর্তে ভয়াবহ ধরনের নির্জীবতা ও এড়িয়ে চলার  প্রবণতা কীভাবে তৈরি হল।  সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের ক্ষমতাবান ও কর্তৃত্বশালীগণ যদি তাদের ক্ষমতা ও সামর্থ্য অন্যায়ের প্রতিরোধে ও দুষ্টের দমনে ব্যবহার না করেন তাহলে সাধারণ জনগণ কীভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদে সাহসী হবে? কাজেই আইন-আদালত, প্রশাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনায় যারা আছেন নিজ নিজ সামর্থ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের অন্যায়ের প্রতিরোধে ভ‚মিকা রাখতে হবে। এই রকম কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলে আশা করা যায় যে, জনগণ আবারো অন্যায়ের প্রতিরোধে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে আসবেন।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, ঘটনার সাথে জড়িত প্রায় সকলেই তরুণ। আমাদের তরুণেরাই এখন দল বেঁধে রামদা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাদেরই মতো আরেক তরুণের উপর। অসহায়ের আর্তচিৎকার এদের মধ্যে বিন্দুমাত্র মমতাও জাগ্রত করছে না। কুপিয়ে হত্যার মতো জঘন্য কর্মও এদের মনে কিছুমাত্র দ্বিধারও সঞ্চার করছে না। এই উদ্ধত নির্মম তারুণ্যই কি আমাদের প্রত্যাশিত?

কাছাকাছি সময়ের আরেকটি সংবাদ হচ্ছে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকার একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড হাইস্কুলের এক লম্পট শিক্ষকের ঘটনা। এ যেন আরেক পরিমল। বছরের পর বছর ধরে বহু ছাত্রীকে সে বø্যাকমেইল করে ধর্ষণ করেছে। পরে তার কুকীর্তি ফাঁস হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী তাকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ঘটনাটি সিরিয়াল ধর্ষণের ঘটনা হওয়ায় তা জনসমক্ষে চলে এসেছে। নতুবা স্কুল-কলেজে এই ধরনের ঘটনাকে হয়ত এখন অবচেতনে ‘শিক্ষিত হওয়ার মূল্য’ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। বিষয়টা যেন অনেকটা এরকম যে, আধুনিক যুগে মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা অর্জন করতে হলে কমপক্ষে মান-ইজ্জত হারাবার কিংবা চারিত্রিক শুভ্রতা বিসর্জনের ঝুঁকি নিতেই হবে। এটা ‘এই শিক্ষার মূল্য’! কোনো শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থার জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে?

এই ভয়াবহ মাত্রার হিং¯্রতা ও অনৈতিকতার ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত করলেও এবং এই উদ্বেগ-উত্তেজনার তাৎক্ষণিক কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হলেও অন্যায়ের মূলোৎপাটনের ও অনাচারের ধারা পরিবর্তনের যথার্থ ও টেকসই কোনো উদ্যোগ কিন্তু দৃশ্যমান নয়। বরগুনার রিফাত হত্যাকাÐ হোক আর সিদ্ধিরগঞ্জের ছাত্রী ধর্ষণ- এই ভয়াবহ ঘটনাগুলো তাৎক্ষণিক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও অশ্লীলতা ও নৃশংসতা বিস্তারের বাস্তব কারণগুলো সম্পর্কে এবং এর বিস্তার রোধের কার্যকর পদ্ধতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা খুবই কম। অন্যায়-অনাচার রোধে প্রতিরোধ ও শাস্তির যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি রয়েছে আমাদের সাধারণ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনেরও প্রয়োজন। বর্তমান পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী চিন্তাধারার সাথে সাথে ধর্ম-বিমুখ ও ধর্মদ্রোহী চিন্তা-ধারাও আমাদের দূরে সরিয়ে রেখেছে সমস্যার মূল সমাধান থেকে।

খুব সহজ একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ভাবুন তো আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, যোগাযোগ-মাধ্যমে আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার বর্ণনায় আমরা সচরাচর কী ধরনের কথা শুনি। আমরা শুনি- ‘উন্নয়নের রাজপথে বাংলাদেশ।’ আমরা শুনি- ‘নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ।’ এবং এই ধরনের বিভিন্ন শব্দ-বাক্য। এগুলোই আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার প্রতিনিধি। চিন্তা করে দেখুন তো, বিগত দশ-বিশ বছরেও কি আমরা আমাদের রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজের সদস্যদের মুখে এরকম কোনো কথা শুনেছি যে, ‘নানা প্রতিক‚লতা মোকাবিলা করে  নৈতিকতার পথে বাংলাদেশ!’ কী হাস্যকর কথা তাই না? নৈতিকতার পথে বাংলাদেশ!

আসলে সুন্দর স্বভাব-চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতা ইত্যাদি এখন আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার জায়গায় অনুপস্থিত। এমনকি অবক্ষয়-অধপতনের বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বড়সড় আঘাত পেলেও আমরা খুব তাড়াতাড়িই তা ভুলে যাচ্ছি এবং আবার আগের ধারায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় পর্যায়ে  স্বভাব-চরিত্র গঠনের কার্যকর চিন্তা-ভাবনা, মানবিকতা গঠনের বাস্তবসম্মত কর্মপন্থা এবং অনৈতিকতা-অশ্লীলতা রোধের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ শুধু অনুপস্থিতই নয়, এই অনুপস্থিতির উপলব্ধিও সাধারণত অনুপস্থিত। এই যখন অবস্থা তখন আমাদের বস্তুগত ও অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হলেও নৈতিক ও চারিত্রিক অধপতন যে অনিবার্য তা তো বলাই বাহুল্য।

এবার একটু আমাদের দ্বীনী ভাষায় বলি। এখন তো মুসলিম-সমাজের বৃহত্তর জীবনে দ্বীনী দৃষ্টিভঙ্গির বিলুপ্তির পাশাপাশি দ্বীনী পরিভাষাগুলোও বিলুপ্ত করে ফেলা হচ্ছে। এরপরও যে কোনো মুসলিম বুঝবেন যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে দ্বীন দান করেছেন তা আমাদের বিশ্বাস, কর্ম ও স্বভাব-চরিত্র গঠনের অনেক বড় উপায়। যে অবক্ষয় ও অধপতনের নানা ঘটনায় আমরা জেরবার, সেই অবক্ষয়-অধপতন থেকে মুক্তির ব্যবস্থা ইসলাম আমাদের দিয়েছিল, কিন্তু সামাজিকভাবে সেই ব্যবস্থার বদলে পশ্চিমা বস্তুবাদী ও ভোগবাদী ব্যবস্থার পিছনে ছোটার ফলে পশ্চিমের অবক্ষয়-অধপতনের দৃষ্টান্তগুলো আমাদের সমাজেও বিস্তার লাভ করছে।

ইসলামের বিধানে ভয়াবহ কবীরা গুনাহগুলোর একটি হচ্ছে অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করা। আরেকটি ভয়াবহ কবীরা গুনাহ হচ্ছে যিনা। সেটা পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে হোক, কিংবা জোরপূর্বক। মুসলিম সমাজে খুনী, ব্যভিচারী চরম ঘৃণ্য দুটি চরিত্রের নাম। যে সমাজে আল্লাহ-ভীতি ও ইসলামী শরীয়তের প্রতি আনুগত্য বিস্তার লাভ করবে সেই সমাজে অবশ্যই যিনা-ব্যভিচার ও নিরপরাধ মানুষ হত্যার হার হ্রাস পাবে। কারণ মানুষ খুন করা কবীরা গুনাহ, অতি ভয়াবহ অপরাধ। তেমনি যিনা-ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়াও কবীরা গুনাহ। অতি হীন ও ঘৃণ্য অপকর্ম। কাজেই ইসলামী ধ্যান-ধারণার অধিকারীগণ এইসব কাজকে মন থেকে ঘৃণা করবেন। তাদের স্বভাব-প্রকৃতিই এমনভাবে গঠিত হবে যে, তারা এই সব ঘৃণ্য কর্মকে অতি ঘৃণ্য ও জঘন্য মনে করবেন। এসবের কাছাকাছি যাওয়াকেও নিজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মনে করবেন। যিনা-ব্যভিচারের সুযোগ সন্ধান কিংবা মানুষ খুনকে বীরত্বের ব্যাপার মনে করার তো প্রশ্নই আসে না।

আমাদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যে, এই রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজের এক বৃহৎ অংশ থেকে কীভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল? আমাদের কি খুঁজে বের করা প্রয়োজন নয় যে, কোন কোন দর্শন ও মতবাদ আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও বিবাহ-বহির্ভূত যৌনাচারের বিস্তার ঘটিয়েছে। আমাদের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালীদের কোনো কোনো কর্ম ও স্বভাব আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভয়াবহ মাত্রায় নির্মম ও নৃশংস করে তুলেছে। সমাজের প্রাজ্ঞ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গকে নির্মোহভাবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।

ইসলাম শুধু যিনা-ব্যভিচারকেই হারাম করেনি, যিনা-ব্যভিচারের ছিদ্রপথগুলোও বন্ধ করেছে। ইসলামের পর্দা-বিধান নারী-পুরুষের চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার এক বড় উপায়; যে পবিত্রতার সাথে আমাদের ব্যক্তি-জীবন ও সামাজিক জীবনের শান্তি, স্বস্তি ও সম্মানও গভীরভাবে যুক্ত। আমাদের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিগুলোতে ইসলামের পর্দার বিধানকে উপেক্ষা করা হয়েছে, ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশার এক প্রশ্নহীন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। ফলে এখন যিনাকার, ব্যভিচারী পুরুষ আর ‘সম্মতি’র অপেক্ষা করছে না, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বশালীরা এক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে।

এই ক্ষমতাশালীদের মধ্যে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী  বা তাদের মদদপুষ্ট শ্রেণিটি তেমনি আছে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যে কোনো পর্যায়ের ক্ষমতাশালীরাও। ফেনীর নুসরাত হত্যাকাÐের বিচার-প্রক্রিয়া এখনো চলমান। একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কী জঘন্য ও মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত বহন করছে ওই ঘটনা।

নারী-পুরুষকে অবশ্যই ইসলামের পর্দার বিধান মেনে চলতে হবে। এই বিধান যদি ‘মাদরাসা’ নামক কোনো প্রতিষ্ঠানেও লঙ্ঘিত হয় সেখানেও অনাচার বিস্তার লাভ করবে। ইসলামের পর্দার বিধান থেকে সরে যাওয়া নারী-পুরুষের জন্য কত ক্ষতিকর তার হাজারো দৃষ্টান্তের মধ্যে ফেনীর ঐ ঘটনাও একটি মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত।

সহশিক্ষা এখন আমাদের মুসলিম-সমাজে এক প্রশ্নহীন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন তো দূরের কথা, এ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলাও যেন আত্মস্বীকৃত নিবুর্দ্ধিতা! অথচ নারী-পুরুষ উভয়ের স্বস্তি-সম্মান, শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থেই ছেলে-মেয়ের আলাদা শিক্ষাঙ্গন অপরিহার্য। যে পর্যন্ত এই বাস্তবতা উপলব্ধি না করা হবে এবং এর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ না নেয়া হবে ঐ পর্যন্ত এই সমাজ ছেলে-মেয়ে উভয়ের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকবে।

অন্যায়-অনাচার রোধে ন্যায়-বিচারের ভ‚মিকাও অপরিসীম। অন্যায়ের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক প্রকারভেদ যেমন অন্যায় তেমনি অন্যায়কারীদের মধ্যে বিভেদ-বৈষম্যও অন্যায়।

যিনা পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে হলে বৈধ আর বলপূর্বক হলে অবৈধ; মানুষ খুন ধর্মের নামে হলে ‘জঙ্গিবাদ’ আর রাজনীতির নামে হলে ডাল-ভাত, তেমনি এই সব অপকর্ম প্রভাবশালীদের আশীষপ্রাপ্তদের দ্বারা হলে উপেক্ষার বস্তু- এই বিভেদ ও প্রকারভেদ সমাজে অন্যায়-অনাচার বিস্তারের এক বড় কারণ।

ইসলাম যেমন কবীরা গুনাহের ব্যাপারে মানুষের মনে আখিরাতের ভয় জাগ্রত করেছে তেমনি অনেক কবীরাগুনাহের ক্ষেত্রে কঠিন পার্থিব সাজারও বিধান দান করেছে; যে বিধান সবার জন্য সমান। ওই সব গুনাহের  মধ্যে যিনা ও অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা অন্যতম। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলেরা যখন ইসলামের ন্যায়বিচারের নীতি থেকে এবং ইসলামী দÐবিধি বাস্তবায়ন থেকে দূরে সরে গিয়েছেন তখন অন্যায়-অনাচার বেপরোয়া গতি লাভ করেছে।

আমাদের বর্তমান তরুণ-প্রজন্মের অধঃপতনের এক বড় কারণ প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া। এটা যে কত তরুণকে চরম অন্যায়ের পথে নিয়ে গেছে এবং তস্করবৃত্তিতে নিয়োজিত করেছে তার হিসাব কে রাখে? আমাদের তরুণদের বুঝতে হবে, অন্যায়-অনাচারের ক্ষেত্রে যারা তাদের মদদ দেয় তারা কিছুতেই তাদের বন্ধু নয়। এরা নিজেদের নানাবিধ স্বার্থ রক্ষায় তরুণ প্রজন্মকে ব্যবহার করছে মাত্র। যখন প্রয়োজন ফুরোবে কিংবা স্বার্থহানীর আশংকা দেখা দিবে তখন ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মতোই ছুঁড়ে ফেলে দিবে। সম্প্রতি মিডিয়ায় এই সংবাদও পরিবেশিত হয়েছে যে, রিফাত হত্যার প্রধান আসামী নয়ন বন্ড ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। শেষ। এক তরুণ নিহত হল অপর তরুণের রামদার কোপে। সেই অপরজনও নিহত হল ক্রসফায়ারে। আমাদের তরুণদের বুঝতে হবে, এই পরিণামই তাদের বাঞ্ছিত কি না।

সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণির অনেক বড় দায়িত্ব রয়েছে। আল্লাহর দরবারে অনেক কঠিন জবাবদিহিতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তরুণ প্রজন্মকে অন্যায় মদদ দেয়া থেকে তো তাদের বেরিয়ে আসতেই হবে, সমাজে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠায়ও ভ‚মিকা রাখতে হবে। অন্যায়-অনাচারের বিস্তার রোধে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।

বরগুনার রিফাত-হত্যাকাÐ কিংবা সিদ্ধিরগঞ্জের ছাত্রী-ধর্ষণ সাদা চোখে অস্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হলেও সমাজে ধর্মহীনতা ও বিচারহীনতার যে ধারা প্রতিষ্ঠিত তার বিচারে এই সব ঘটনা কি খুব অস্বাভাবিক কিছু? এ তো সেই বিষবৃক্ষেরই বিষফলমাত্র, যা মুসলিম-সমাজে পশ্চিমা শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রোপণ করা হয়েছিল। এরপর অন্যায়-অনাচারের অবাধ পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে একে ফলে-ফুলে সুশোভিত (?) করে তোলা হয়েছে!

এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে আবার ইসলামের শিক্ষার দিকেই ফিরে আসতে হবে। আল্লাহভীতি ও আখিরাতমুখিতার বিস্তার ঘটাতে হবে। ইসলামের বিধানে অন্যায় ও ঘৃণ্য অপকর্মগুলোকে অন্যায় বলে জানতে হবে, ঘৃণা করতে শিখতে হবে। পাশাপাশি সুশাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ইসলাম আশাবাদের ধর্ম। কুরআন আমাদের শোনায় আল্লাহর রহমতের পয়গাম-

 وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوْبِهِمْ  وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللهُ  وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ اُولٰٓىِٕكَ جَزَآؤُهُمْ مَّغْفِرَةٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَ جَنّٰتٌ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا  وَ نِعْمَ اَجْرُ الْعٰمِلِیْنَ.

...এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের উপর যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ব্যতীত কে পাপ ক্ষমা করবে? এবং তারা যা করে ফেলে, জেনে-শুনে তার পুনরাবৃত্তি করে না। ওরা তারাই, যাদের পুরস্কার জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কতই না উত্তম! -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫-১৩৬

আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিন। আমাদের ঈমানকে জাগ্রত করে দিন। তাঁর আনুগত্যের পথে চলা আমাদের সবার জন্য সহজ করে দিন- আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

 

advertisement