Zilqad 1440   ||   July 2019

আসুন সবাই আমরা নিজের ইসলাহের চেষ্টা করি এবং কাজে নিমগ্ন হয়ে যাই

Mawlana Muhammad Abdul Malek

الحمدللهوسلامعلىعبادهالذيناصطفى،وأشهدأنلاإلهإلااللهوحدهلاشريكلهوأشهدأنمحمداعبدهورسوله،أمابعد :

তাবলীগ জামাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ অনেক আগে থেকেই ছিল এবং কমবেশ (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) তিন দেশেই এ অবস্থা বিদ্যমান ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি আগের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। বর্তমানের এই বিভেদ তো খুবই ভয়াবহ, এ বিভেদ পুরো বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছে। আর এখন তো তা ইসলামী শিক্ষা ও শিষ্টাচারের গÐি ছাড়িয়ে মানবতা ও ভদ্রতার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

মাওলানা মুহাম্মাদ সা‘দ হাফিযাহুল্লাহর বিচ্ছিন্নতা, চিন্তাগত বিপথগামিতা, তার মারাত্মক মারাত্মক ভ্রান্তি এবং শূরা ব্যতীত তার ইমারতের দাবির কারণে সারা বিশে^র তাবলীগ জামাত এখন দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল তার অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করে। তার এবং নিযামুদ্দীন মারকাযের শর্তহীন আনুগত্যকে জরুরি মনে করে। বাংলাদেশে এই দল ‘এতাআতী জামাত’ নামে পরিচিত। তাদেরকে ‘সা‘দপন্থী’ বা ‘সা‘দ সাহেবের অনুসারী’ও বলা হয়। যদিও তাদের দাবি, তারা নাকি ‘মূল ধারার তাবলীগওয়ালা’। আবার কিছু দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে আজকাল কাগজপত্রে তারা নিজেদের জন্য ‘তাবলীগ জামাত বাংলাদেশ’ এই নামও ব্যবহার করে। অথচ পূর্বোক্ত নাম তথা ‘মূল ধারার তাবলীগ’ এটা বাস্তবতা পরিপন্থী। আর পরের নামটি তো অস্পষ্ট।

আর দ্বিতীয় দল মাওলানা সা‘দ সাহেব হাফিযাহুল্লাহর আনুগত্য করে না। কেননা তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মাসলাক ও পথ থেকে সরে গেছেন। শুযূয ও চিন্তাগত বিপথগামিতার কারণে তারা মাওলানা সা‘দ সাহেবকে দ্বীনী জামাতের দ্বীনী বিষয়ক যিম্মাদার হিসেবে মানতে রাজী নন। এবং শুরা ব্যতীত তার ইমারতের দাবিও তারা সমর্থন করেন না। যেহেতু মাওলানা সা‘দ সাহেবের শুযূয ও চিন্তাগত বিপথগামিতার ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম তাম্বীহ বা সতর্ক করেছিলেন এবং তারাই এই নসীহত করেছেন যে, তাবলীগের কাজ পূর্ববর্তী আকাবিরের উসূল অনুযায়ী করা হবে এবং নব আবিষ্কৃত উসূল ও তা উদ্ভাবনকারীদের আনুগত্য থেকে এই কাজকে মুক্ত রাখতে হবে। এজন্য বাংলাদেশে এই জামাতকে ‘উলামায়ে কেরামের অনুসারী’ বলা হয়। ইদানীং তাদের ক্ষেত্রে ‘শুরায়ী নেযামের অনুসারী’ নামও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেহেতু এই জামাত কার্যত কোনো এক ব্যক্তিকে নিজেদের আমীর নির্ধারণ না করে মাশওয়ারার ভিত্তিতে কাজ করে, এজন্যই ‘শুরায়ী নেযামের অনুসারী’- এই নাম প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে।

অধমের এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় তাবলীগ জামাতের বর্তমান মতবিরোধের কারণ বিশ্লেষণ করা নয় এবং এই মতবিরোধ কীভাবে দূর করা যেতে পারে- তা নিয়ে আলোচনা করাও নয়। যদিও ঐ আলোচনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আজ আমার আলোচ্য বিষয় সেটা নয়; বরং আজ আমার ইচ্ছা, উভয় পক্ষের সাথীদের খেদমতে কিছু নিবেদন পেশ করব। আশা করছি, এই নিবেদন যেমন কল্যাণকামিতার প্রেরণা থেকে করা হচ্ছে, তেমনই মহব্বত ও ইকরামের সাথে তা গ্রহণ করা হবে।

وماتوفيقيإلابالله،عليهتوكلتوإليهأنيب.

প্রথম নিবেদন

قوت نيکی نداری بد مکن # بر وجود خود ستم   بےحد مکن

‘কুওয়তে নেকী নাদা-রী বদ মাকুন / বর অজূদে খোদ সেতাম বে-হদ মাকুন’।

“ভালো কাজ করতে না পারলে অন্তত খারাপ কিছু করো না। নিজের উপর এত বেশি যুলুম করো না।”

এটা একটা ফারসী কবিতা। শায়েখ ফরীদুদ্দীন আত্তার রাহ.-এর (মৃ. ৫৮৯হি.) পান্দেনামাহ-এ এই কবিতা আছে। এতে তিনি বাস্তবসম্মত অতি মূল্যবান একটি নসীহত করেছেন, যা খালেস কুরআনী নসীহত। কুরআনের অনেক আয়াতে মানুষকে যেমন অন্যের  উপর যুলুম করতে নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি নিজের উপর যুলুম করতেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। শায়েখ আত্তার রাহ. এই কবিতায় বলেছেন, যদি ভালো কাজ করার হিম্মত না থাকে তাহলে অন্তত খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাক। এভাবে নিজের উপর মাত্রাতিরিক্ত যুলুম করো না যে, ভালো কাজও করতে পারলে না, আবার মন্দ কাজ থেকেও বিরত থাকলে না। যদি মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পার, তাহলে ভালো কাজ না করলেও অন্তত এটুকু রেহাই হল যে, মন্দের পাহাড় চাপিয়ে নিজের উপর যুলুম করার অপরাধ থেকে বাঁচলে।

قوتنيکینداریبدمکن + بروجودخودستمبےحدمکن

ফরীদুদ্দীন আত্তার রাহ.-এর এই মূল্যবান নসীহত থেকে প্রত্যেকেরই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু এই উপদেশ এখন আমি বিশেষভাবে আমাদের এতাআতী ভাইদের সামনে পেশ করছি। তাদের খেদমতে আরজ করছি যে, আপনাদের উচিত ছিল, ভুল ও শরীয়তবিরোধী আনুগত্য থেকে বেঁচে আনুগত্যের শরয়ী সীমারেখা মেনে চলা এবং তাবলীগ জামাতের কাজে বিভেদ সৃষ্টি না করে হকের ভিত্তিতে এক হয়ে থাকা। অথবা বিভেদ হয়ে যাওয়ার পরে পুনরায় হিম্মত করে নিজের খেয়ালখুশি কুরবানী করে হকের উপর এক হয়ে যাওয়া। যদি এই নেক কাজ আপনাদের দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত এটুকু করুন যে, আপনারা আরও অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে নিজের উপর অতিরিক্ত যুলুম করবেন না।

কীভাবে আরো যুলুম হচ্ছে

কী কী উপায়ে নিজের উপর যুলুম হচ্ছে, তা তো স্পষ্ট। তবুও তা আবার মুযাকারা করছি। লক্ষ করে দেখুন, নিচের প্রত্যেকটি কাজ যুলুমের এক একটি  প্রকার। যদি এসব থেকে বিরত না থাকেন তাহলে আপনি নিজের উপর একের পর এক যুলুম করে যেতে থাকবেন :

১. দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করা।

২. উলামায়ে কেরামের সমালোচনা, তাদের ব্যাপারে বদগুমানী ও বদযবানী করা।

৩. দ্বীনী ফতোয়ার সমালোচনা করা।

৪. নিজের বা অন্য কারো ভুলের ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা।

৫. ভুলের পক্ষে দলীল খুঁজে বেড়ানো।

৬. মানুষকে নিজের ভুল চিন্তাধারার দিকে দাওয়াত দেওয়া।

৭. উপরন্তু এই দাওয়াতের ক্ষেত্রে মিথ্যাচার, ভুল বিবরণ, ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া।

৮. ভুলকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শরীয়তবিরোধী উসূলের আশ্রয় নেওয়া এবং এজন্য নতুন উসূল বানানো ও নতুন মাসআলা সৃষ্টি করা।

৯. ভুলকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হক-বাতিল চেনার শরয়ী মাপকাঠি পরিবর্তন করা, নতুন নতুন মাপকাঠি সৃষ্টি করা। অথবা বিদআতীদের সৃষ্ট মাপকাঠি আঁকড়ে ধরা।

১০. ভুলকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পূর্ববর্তী কোনো লেখকের শুযূয ও যাল্লাত তথা বিচ্ছিন্নতা বা পদস্খলনের আশ্রয় নেওয়া।

১১. কারও অন্যায় পক্ষপাতিত্বে এত বাড়াবাড়ি করা যে, তাতে কুফর-এর শিকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। যেমন, এটা বলা যে, ‘অমুক জাহান্নামে  গেলে সেও জাহান্নামে যাবে’। অথবা এটা বলা যে, ‘এদেশে তো মাইজভাÐারিসহ আরও কত দল আছে, এটাও না হয় সেরকমই একটি দল।’

১২. যারা ভুল চিহ্নিত করে দেয়, তাদের শোকর আদায় করে নিজেকে সংশোধন করার পরিবর্তে তাদের উপর অভিযোগ-আপত্তি তোলা।

১৩. নিজেদেরকে ও অন্যদেরকে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তায় ব্যস্ত করে নিজের জন্য সান্ত¡নার পথ খোঁজা এবং নিজের সংশোধনের ব্যাপারে উদাসীন থাকা।

১৪. ঢালাওভাবে অপর পক্ষের অথবা তাদের কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির গীবত করা। অন্যায় অপবাদ দেওয়া। কেবল ধারণার ভিত্তিতে তাদের উপর অভিযোগ-আপত্তি তোলা।

১৫. কারও নাম বিকৃত করা।

১৬. গালমন্দ করা।

১৭. হাত ও মুখের অপব্যবহার করা।

১৮. প্রভাব-প্রতিপত্তির অন্যায় ব্যবহার করে বিরোধীদের ক্ষতি সাধন করা অথবা নিজের জন্য অন্যায় সমর্থন আদায় করা।

১৯. সম্পদের অপব্যবহার করে নিজের দল ভারি করার অপচেষ্টা করা।

২০. দ্বীনের অকাট্য ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয় অমান্য করে নিজের ঈমান নষ্ট করা অথবা বাস্তবসিদ্ধ কোনো বিষয় অস্বীকার করে নিজের বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

আমি কেবল অন্যায় ও সীমালঙ্ঘনের কিছু শিরোনাম লিখে দিলাম। এতাআতী ভাইয়েরা যদি নিজেদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ দেখতে পাবেন যে, তারা এসকল বাড়াবাড়িতে লিপ্ত। তারা মাওলানা সা‘দ সাহেবের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, তাই বলে কি প্রয়োজন ছিল যে, সাথে সাথে তারা এসকল গর্হিত অপরাধ ও বাড়াবাড়িতেও লিপ্ত হবেন? যদি তারা মনে করেন যে, এসব ছাড়া মাওলানা সা‘দ সাহেবের আনুগত্য সম্ভব নয়, তাহলে তাদেরকে মাওলানা সা‘দ সাহেবের আনুগত্যের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত। আর যদি এসব ছাড়া তাঁর আনুগত্য সম্ভব হয়, তাহলে আমি তাদের খেদমতে ফরীদুদ্দীন আত্তার রাহ.-এর উল্লেখিত নসীহত পেশ করছি-

قوتنيکینداریبدمکن + بروجودخودستمبےحدمکن

‘কুওয়তে নেকী নাদা-রী বদ মাকুন / বর অজূদে খোদ সেতাম বে-হদ মাকুন’।

দ্বিতীয় নিবেদন

وَلاتُبْطِلُواأَعْمالَكُمْ.

নিজেদের আমল বিনষ্ট করো না। -সূরা মুহাম্মাদ (৪৭) : ৩৩

ঈমান ও আমল যতটা গুরুত্বপূর্ণ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ তা হেফাযত করা এবং বরবাদ হওয়া থেকে রক্ষা করা। এমন সব কর্ম ও আচরণ থেকে বেঁচে থাকা, যা দ্বারা আমল বরবাদ হয়ে যায় বা তার কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহযুক্ত হয়। অথবা আখেরাতে প্রয়োজনের সময় তা অন্যের আমলনামায় চলে যাওয়ার আশংকা হয়।

এই নসীহতও সকলের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এখন আমি বিশেষভাবে তাবলীগ জামাতের ঐ সাথীদের খেদমতে পেশ করছি, যারা এই কাজকে পূর্ববর্তী আকাবিরের উসূল অনুযায়ী জারি রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং যারা উলামায়ে কেরামের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

ঐ ভাইদের প্রতি আবেদন এই যে, আপনারা ভুল আনুগত্য ও নব আবিষ্কৃত উসূল থেকে কাজকে রক্ষা করার জন্য বিচ্ছিন্ন মতবাদ গ্রহণকারীদের সঙ্গ দেননি এবং কাজের যে প্রাণ পূর্ব থেকে সর্বজনস্বীকৃত ছিল যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামের রাহনুমায়ীতে তা আনজাম দেওয়া হবে, আপনারা সে অনুযায়ী উলামায়ে কেরামের রাহনুমায়ীতে এ কাজ জারি রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিঃসন্দেহে আপনারা অনেক বড় ঈমানী দায়িত্ব আদায় করেছেন। এটা অনেক বড় হিম্মত ও কুরবানীর বিষয় এবং অনেক বড় নেক আমল। এর প্রত্যাশা ও দাবি পূরণ করা এবং একে বরবাদী থেকে রক্ষা করা আপনাদের যিম্মাদারী। এর প্রত্যাশা ও দাবি কীভাবে পূরণ করা যেতে পারে ‘তৃতীয় নিবেদন’-এ তা আলোচনা করা হবে। এখন একে হেফাযত ও বরবাদী থেকে রক্ষার ব্যাপারে কিছু কথা আরয করছি।

আমল নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটি সূরত তো হল, তার কিছুই আর বাকি থাকে না, এমনকি পুনরায় তা আদায় না করলে আদায় হয়েছে বলেই গণ্য হয় না। দ্বিতীয় সূরত হল, তার সওয়াব ও প্রতিদান পুরোপুরি বিনষ্ট হয়ে যায় এবং আল্লাহ তাআলার নিকট তার কোনোই মূল্য থাকে না। আমল কবুল না হওয়ার এটাই সবচে খতরনাক সূরত।

তৃতীয় সূরত এই যে, আমলের নেক আসর ও বরকত নষ্ট হয়ে যায়। মুমিনের ঈমানী যিন্দেগীতে নেক আমলের যে ভালো প্রভাব পড়ার ছিল এবং আমলের কারণে যে বরকত ও নূরানিয়্যাত হাসিল হওয়ার ছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়। আমল কবুল না হওয়ার এটাও একটা অর্থ। আমল বরবাদ হওয়ার চতুর্থ সূরত হল, আমলের সবচে বেশি প্রয়োজন যেখানে সেখানে তা নিজের নেকীর পাল্লার পরিবর্তে অন্যের নেকীর পাল্লায় চলে যাওয়া।

প্রথম সূরত তো -নাউযুবিল্লাহ- কুফর, শিরক, মুনাফেকী এধরনের ভয়াবহ অপরাধের কারণে হয়। দ্বিতীয় সূরত রিয়া অর্থাৎ লোক দেখানো বা দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্যে আমল করার দ্বারা হয়। দান খয়রাত করে খোঁটা দেওয়ার কারণে হয়। আর তৃতীয় সূরত যেসকল কারণে হয়, তার মধ্যে একটি কারণ হল, খানাপিনা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে হারাম থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে যতœবান না হওয়া। দ্বিতীয় কারণ, কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে মনোযোগী না হওয়া। এটাও হতে পারে যে, এসব কারণে ক্ষেত্রবিশেষে -আল্লাহ রক্ষা করুন- আমল একেবারেই কবুল হবে না।

আর চতুর্থ সূরত হুকূকুল ইবাদ বা বান্দার হকের ব্যাপারে শিথিলতা করার কারণে হয়। মানুষের হক নষ্ট করা, মুখ বা হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট দেওয়া। মোটকথা, মানুষের হকের সাথে সংশ্লিষ্ট যত কবীরা গুনাহ আছে, সেগুলোর আবশ্যকীয় পরিণাম হল, নিজের সহীহ-সালিম নেক কাজের সওয়াব, যার হক নষ্ট করা হয়েছে, তার নেকীর পাল্লায় দিয়ে দেওয়া হবে।

যেহেতু আমল বরবাদ হয়ে যাওয়ার এসকল সূরতের দালায়েল সকলের জানা, এজন্য এখানে তা উল্লেখ করা হল না। এখন তো কেবল স্মরণ করিয়ে দেওয়া উদ্দেশ্য। আমাদের উচিত নিজেদেরকে যাচাই করে দেখা যে, আমরা এমন কোনো কথা বা কাজে লিপ্ত নই তো, যার কারণে নেক আমল বরবাদ হয়ে যায়? যদি আমরা তা করে থাকি, তাহলে এরচে বড় খাসারাহ ও ক্ষতি আর কী হতে পারে? এজন্য অনেক গুরুত্বের সাথে মুহাসাবা করে নিজেদের সংশোধনের দিকে দৃষ্টিপাত করা উচিত। এবং এই ধরনের সকল গুনাহ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা উচিত। এ জিনিসগুলো প্রায় সকলেরই জানা, তবুও পুনরায় মুযাকারা করতে কোনো আপত্তি নেই।

যে বিষয়গুলো নেক আমল বরবাদ করে দেয়

১. লোক দেখানো ও দুনিয়াবী উদ্দেশ্য।

হাদীস শরীফে আছে-

إِنّمَاالْأَعْمَالُبِالنِّيّاتِ،وَإِنّمَالِكُلِّامْرِئٍمَانَوَى،فَمَنْكَانَتْهِجْرَتُهُإِلَىاللهِوَرَسُولِهِفَهِجْرَتُهُإِلَىاللهِوَرَسُولِهِ،وَمَنْكَانَتْهِجْرَتُهُلِدُنْيَايُصِيبُهَا،أَوِامْرَأَةٍيَتَزَوّجُهَا،فَهِجْرَتُهُإِلَىمَاهَاجَرَإِلَيْهِ.

নিয়তের উপরই কাজের ফলাফল নির্ভরশীল। মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্যই গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার স্বার্থপ্রাপ্তির জন্য অথবা কোনো নারীকে বিবাহ করার জন্য হিজরত করবে, সেই হিজরত তার নিয়ত অনুসারেই হবে; যে নিয়তে সে হিজরত করেছে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২২০১

এজন্য আমাদের কর্তব্য, আমরা নিজেদের নিয়তের নযরে ছানী করি। নিয়তের তাসহীহ বা শুদ্ধতা, ইখলাস বা একনিষ্ঠতা এবং তাজদীদ বা নবায়নের খুব ইহতিমাম করি; যেন এই ইতমিনান হয়ে যায় যে, ইনশাআল্লাহ আমার হকের পক্ষ অবলম্বন করা কেবল আল্লাহর হুকুম মানা ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই। এর মধ্যে কোনো দুনিয়াবী উদ্দেশ্য নেই।

২. বিদ্বেষ পোষণ ও পরস্পর সম্পর্ক বিনষ্ট করা।

عَنْأَبِيهُرَيْرَةَ،أَنّالنّبِيّصَلّىاللهُعَلَيْهِوَسَلَّمَقَالَ: إِيّاكُمْوَالْحَسَدَ،فَإِنّالْحَسَدَيَأْكُلُالْحَسَنَاتِكَمَاتَأْكُلُالنّارُالْحَطَبَ.

সাবধান! তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থেকো। কারণ হিংসা সৎকর্মগুলোকে এমনভাবে শেষ করে দেয় যেমন আগুন কাষ্ঠখÐকে জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯০৩ (হাদীসটি হাসান)

عَنْأَبِيالدّرْدَاءِ،قَالَ: قَالَرَسُولُاللهِصَلّىاللهُعَلَيْهِوَسَلّمَ: أَلَاأُخْبِرُكُمْبِأَفْضَلَمِنْدَرَجَةِالصِّيَامِوَالصّلَاةِوَالصّدَقَة،قَالُوا: بَلَى،قَالَ: صَلَاحُذَاتِالبَيْنِ،فَإِنّفَسَادَذَاتِالبَيْنِهِيَالحَالِقَة.

هَذَاحَدِيثٌحَسَنٌصَحِيحٌ.

وَيُرْوَىعَنِالنّبِيِّصَلّىاللهُعَلَيْهِوَسَلّمَأَنّهُقَالَ:هِيَالحَالِقَةُلَاأَقُولُتَحْلِقُالشّعرَ،وَلَكِنْتَحْلِقُالدِّينَ.

আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (নফল) সিয়াম, সালাত ও সাদাকা অপেক্ষা উত্তম আমলের কথা তোমাদের বলব কি? সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, পরষ্পর সুসম্পর্ক স্থাপন করা। কেননা পরষ্পর সম্পর্ক বিনষ্ট করা হল দ্বীন ধ্বংসকারী বিষয়।

তিরমিযী রাহ. বলেন, এই হাদীসটি সহীহ।

ইমাম তিরমিযী রাহ. আরও বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, এ হল মুÐনকারী। আমি বলি না যে, তা মাথা মুÐন করে; বরং তা দ্বীনকে মুÐন করে দেয়- বিনষ্ট করে দেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫০৯

৩. ঐসকল গুনাহ, যার কারণে নেক আমল কবুল না হওয়ার ওয়ীদ বা ধমকি এসেছে।

কুরআনে কারীম এবং হাদীস শরীফ থেকে ঐসকল গুনাহের তালিকা জেনে নেওয়া উচিত। যেমন-

ক. বিদআতী আকীদা গ্রহণ করা।

খ. হারাম উপার্জন থেকে বিরত না থাকা; খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ ও বাসস্থান হারাম সম্পদ থেকে হওয়া ইত্যাদি।

৪. কারো গীবত করা।

৫. কাউকে অপবাদ দেওয়া। কেবল ধারণার ভিত্তিতে কারো উপর অভিযোগ তোলা।

৬. কাউকে গালমন্দ করা।

৭. মুখ বা হাত দিয়ে কাউকে কষ্ট দেওয়া।

৮. কারো নাম বিকৃত করা।

৯. কাউকে কটাক্ষ, বিদ্রæপ ও তাচ্ছিল্য করা।

১০. কারো সাথে অসদাচরণ করা।

১১. কারো উপর যুলুম করা। কাউকে ধোঁকা দেওয়া, প্রতারণা করা।

এসকল গুনাহ নেক আমলকে বরবাদ করে দেয়। এজন্য অনেক ইহতিমামের সাথে এগুলো থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। অন্যথায় আমরা যেন সত্যের উপর অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকার লাজ রক্ষা করতে পারলাম না এবং নিজেদের নেক আমলেরও কোনো কদর করতে পারলাম না।

মনে রাখা দরকার যে, আপনার আকীদা সঠিক হওয়া এবং আহলে হকের পক্ষাবলম্বন করা এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয়। কিন্তু এটা এই বিষয়ের যামানত নয় যে, এখন আপনি মুক্ত, যা ইচ্ছা করুন, যা ইচ্ছা বলুন, যার উপর চান যুলুম করুন, যার সাথে ইচ্ছা বাড়াবাড়ি করুন। মোটেই বিষয়টি এমন নয়। বরং এর দাবি তো হল, আপনার মধ্যে ঈমানী গুণাবলি আরো বাড়তে থাকবে, আপনার আখলাক মুমিনীনের আখলাক হবে। আপনার আচরণ আরও সুন্দর হবে।

আপনি কথা বলা ও শোনার ক্ষেত্রে সংযমী হবেন এবং হাত, মুখ ও কানের ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক ও হুঁশিয়ার থাকবেন। কারো হকের উপর থাকার অর্থ এটা নয় যে, সে জায়েয-নাজায়েয যেকোনোভাবেই হকের নুসরত করতে পারবে অথবা জায়েয-নাজায়েয যেকোনোভাবেই বাতিল ও আহলে বাতিলের খÐন করতে পারবে; কখনো নয়!

আল্লাহ তাআলার কাছে হকের ঐ ধরনের নুসরতই গ্রহণযোগ্য, যা শরীয়তের আহকাম অনুযায়ী হয় এবং বাতিলের ঐ খÐনই গ্রহণযোগ্য, যা জায়েয পদ্ধতিতে ইসলামী আদাব সম্মত হয়। অপরপক্ষ যদি ভুল পথেও থাকে, তবুও একজন মুসলমান হওয়ার কারণে, মানুষ হওয়ার কারণে, আল্লাহ তাআলার মাখলূক হওয়ার কারণে তার কিছু হক রয়েছে। তার সেসব হক নষ্ট করা খিয়ানত ও কবীরা গুনাহ এবং এটা এমন কবীরা গুনাহ, যা আমলকে বরবাদ করে দেয়।

একবার অপর পক্ষের কারো গীবত করার দ্বারা, একবার নাম বিকৃত করে কষ্ট দেওয়ার দ্বারা, একবার কটাক্ষ করে তাচ্ছিল্য করার দ্বারা, একবার কারও উপর অপবাদ দেওয়ার দ্বারা, একবার কেবল ধারণার ভিত্তিতে কারো উপর অভিযোগ আরোপ করার দ্বারা, হতে পারে যে, কেবল দশ-বিশ চিল্লা নয়; বরং সারা জীবনের সকল চিল্লাই বিনষ্ট হয়ে যাবে।

এজন্য আমার ভাইয়েরা! আমাদের সকলের সব অন্যায়, যুলুম ও বাড়াবাড়ি থেকে তওবা করে নেক আখলাক ও নেক সীরাত বা সদাচরণ ও সচ্চরিত্র গ্রহণ করা উচিত। যেন আমাদের হকের উপর হওয়ার প্রমাণ আমাদের আচরণ ও চরিত্র থেকেই ফুটে ওঠে এবং আমরা সহীহ আকীদা ও নেক আমল বরবাদ হওয়া থেকে নিরাপদ থাকতে পারি।

আমরা সবাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীসটি সবসময় স্মরণে রাখি-

أَتَدْرُونَمَاالْمُفْلِسُ؟قَالُوا: الْمُفْلِسُفِينَامَنْلاَدِرْهَمَلَهُوَلاَمَتَاعَ،فَقَالَ: إِنّالْمُفْلِسَمِنْأُمّتِييَأْتِييَوْمَالْقِيَامَةِبِصَلاَةٍ،وَصِيَام،وَزَكَاةٍ،وَيَأْتِيقَدْشَتَمَهَذَا،وَقَذَفَهَذَا،وَأَكَلَمَالَهَذَا،وَسَفَكَدَمَهَذَا،وَضَرَبَهَذَا،فَيُعْطَىهَذَامِنْحَسَنَاتِهِ،وَهَذَامِنْحَسَنَاتِهِ،فَإِنْفَنِيَتْحَسَنَاتُهُقَبْلَأَنْيُقْضَىمَاعَلَيْهِأُخِذَمِنْخَطَايَاهُمْفَطُرِحَتْعَلَيْهِ،ثُمّطُرِحَفِيالنّارِ.

(একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,) তোমরা কি জানো, নিঃস্ব কে? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যার কোনো দিরহাম নেই, কোনো আসবাব-পত্র নেই। তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব তো সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন অনেক নামায, রোযা ও যাকাতের নেকী নিয়ে হাযির হবে, কিন্তু এর সাথে সাথে সে এই অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারো সম্পদ ভক্ষণ করেছে, কারো রক্তপাত ঘটিয়েছে, কাউকে মেরেছে, তারপর অমুক অত্যাচারিতকে তার নেকী দিয়ে দেওয়া হবে, তমুক অত্যাচারিতকে তার নেকী দিয়ে দেওয়া হবে, তারপর অন্যদের দাবি পূরণের আগেই যদি তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তাহলে অন্যদের পাপরাশি নিয়ে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১

তৃতীয় নিবেদন

হকের উপর হওয়ার দাবি ও প্রত্যাশা পূরণ করা

এটা তো আপনি অনেক ভালো কাজ করেছেন যে, আপনি শুযূয অবলম্বনকারী ও ভুল আনুগত্যকারীদের পক্ষে যাননি; বরং আহলে হকের সাথে থেকে সঠিক পন্থায় হকের দাওয়াত দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এজন্য আপনাকে অনেক অনেক মুবারকবাদ। আল্লাহ তাআলা আপনার এই প্রচেষ্টা ও কুরবানীকে কবুল করুন। দুনিয়াবী স্বার্থ ও বিভিন্ন সম্পর্কের উপর হককে প্রাধান্য দেওয়া অনেক বড় কুরবানী। এর চে’ও বড় কুরবানী হল, কারও সাথে আপনার দ্বীনী সম্পর্ক ছিল, কিন্তু দ্বীনের খাতিরেই এখন তার সঙ্গ ও আনুগত্য ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এই ত্যাগ বাস্তবিকই অনেক কঠিন। আলহামদু লিল্লাহ, আপনি এই ত্যাগও স্বীকার করেছেন। এজন্য আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করে শেষ করা যাবে না।

মনে রাখবেন, এই নিআমতের আসল শোকর হল, আমরা এর দাবি ও প্রত্যাশাগুলো পূর্ণ করব এবং নিজের হকের উপর হওয়াকে পূর্ণতায় পৌঁছাব।

এজন্য আমাদেরকে অন্তত তিনটি কাজ করতে হবে। একটির কথা তো আগেই বলা হয়েছে যে, আমরা আমাদের আমলকে বরবাদ হওয়া থেকে হেফাযত করব। দ্বিতীয়টি হল, আমরা নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তাধারা শুদ্ধ করব। আর তৃতীয়টি হল, আমরা নিজেদের লেনদেন ও পারস্পরিক আচার ব্যবহার ঠিক করব।

চিন্তার শুদ্ধতা

তাবলীগ জামাতের ছয় নম্বরের তৃতীয় নম্বর হল, ‘ইলম ও যিকির’। এই নম্বরটি এই জামাতের সকল কাজের প্রাণকাঠি। কিন্তু এই নাম্বার- যার দুটি অংশ : ইলম ও যিকির-এর দিকে যথাযথ দৃষ্টি না দেওয়ার কারণে সাথীদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ত্রæটি থেকে যায়, অথবা ত্রæটি সৃষ্টি হয়। হকপন্থীদের পক্ষ অবলম্বন করার মানেই এটা নয় যে, আমাদের কারো মধ্যেই আর চিন্তাগত কোনো ত্রæটি নেই অথবা আমাদের সকল ত্রæটি আপনা আপনিই সংশোধন হয়ে গেছে। এজন্য খুবই জরুরি যে, আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের চিন্তা-চেতনার হিসাব নিই এবং যেসব গলত ফিকির চেতনে বা অবচেতনে নিজেদের মধ্যে থেকে গেছে, শীঘ্রই তা সংশোধন করে নিই। যেমন :

১. ‘এটাই’ এবং ‘এটাও’-এর মধ্যে পার্থক্য না করা

বড়রা তো আমাদেরকে সেটাই শিখিয়েছিলেন, যা শরয়ী দলীলের দাবি। তা এই যে, তাবলীগ জামাতের এই কাজ অনেক উপকারী। কিন্তু এটা ছাড়াও দ্বীনের আরও অনেক কাজ আছে। এজন্য একথা বলো যে, ‘এটাও করণীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ’। একথা বলো না যে, ‘এটাই একমাত্র কাজ’। বিভিন্ন দ্বীনী কর্মক্ষেত্রে মশগুল ব্যক্তিগণ পরস্পরের উত্তম সঙ্গী ও সহচর। একজন অপরজনের বিরোধীপক্ষ নয়। একে অপরের রফীক, ফরীক নয়। ‘এটাই’ এবং ‘এটাও’-এর এই শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এর চর্চা হওয়া অতীব প্রয়োজন। এই মনোভাব যে, এই মেহনতই একমাত্র দ্বীনের কাজ, অথবা এটাই একমাত্র নবীওয়ালা কাজ। অথবা এটাই একমাত্র কাজ, যা সাবীলুল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তা- একেবারেই ভুল চিন্তা। যদি কারো মধ্যে এই ভ্রান্ত চিন্তা থেকে থাকে তাহলে জরুরি ভিত্তিতে তার ইসলাহ প্রয়োজন।

২. দাওয়াত আসল মাকসাদ, নাকি দ্বীন আসল মাকসাদ?

কিছু সাধারণ মানুষ তো এই ভুলেও আক্রান্ত যে, তারা দ্বীনের পরিবর্তে দাওয়াতকেই আসল মাকসাদ মনে করে। অথচ একথা তো একেবারেই সুস্পষ্ট যে, দ্বীন আসল মাকসাদ হওয়ার কারণেই তো দাওয়াত ইলাদ্ দ্বীন-এর হুকুম এসেছে। ভালো করে বুঝে নেওয়া উচিত যে, তাবলীগ জামাতের এই মেহনতের মাকসাদ প্রথমত নিজের ভেতর, দ্বিতীয়ত অন্যের ভেতর দ্বীন যিন্দা করার তলব সৃষ্টি করা। এই মেহনত কতটা সফল হচ্ছে তার হিসাব এভাবে নেওয়া হবে যে, এর দ্বারা কি শুধু মেহনতই যিন্দা হচ্ছে, নাকি দ্বীনও যিন্দা হচ্ছে? এবং এই মেহনতের দ্বারা আমার ভেতরে দ্বীন শেখার ও শরীয়ত অনুযায়ী চলার মৌলিক চেতনা বাড়ছে কি না?

৩. এই মেহনতকে সব দৃষ্টিকোণ থেকেই পরিপূর্ণ মনে করা

আকাবির বুযুর্গরা তো এভাবে বলেছেন যে, এই মেহনত উপকারী বটে, কিন্তু যথেষ্ট নয়। কল্যাণকর, কিন্তু পরিপূর্ণ নয়। অর্থাৎ প্রচলিত পন্থায় কেবল জামাতে বের হওয়া ও জামাত বের করার দ্বারাই এক ব্যক্তির মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইলম, আমল, আকায়েদ ও আফকারের পরিশুদ্ধি, হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা ও আত্মশুদ্ধি তথা পরিপূর্ণ দ্বীন এসে যাবে- এটা ভাবার অবকাশ নেই। এই মেহনতকে সর্ববিচারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা মারাত্মক ভুল। এমন দাবি বাস্তবতা বিবর্জিত এবং তাবলীগের আকাবিরের কথা ও কাজ উভয়টিরই পরিপন্থী। হাকীকত তো এই যে, এই মেহনতের দ্বারা দ্বীনের অনুভূতি ও আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি নকল ও হরকতের মাধ্যমে ইলম ও আমলের সামান্য যা কিছু অর্জিত হয়, উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে তারও পরিশোধন করিয়ে নেওয়া জরুরি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ফরজ ইলমও শিখে নেওয়া জরুরি। উলামা-মাশায়েখের সোহবত-সংসর্গের মাধ্যমে দ্বীনের সঠিক বুঝ ও আত্মশুদ্ধির দিকে মনোযোগী হওয়াও জরুরি।

হযরতজী মাওলানা ইনআমুল হাসান রাহ.-এর উপস্থিতিতে হযরত মাওলানা আবরারুল হক ছাহেব হারদুঈ রাহ. এক বিশাল তাবলীগী ইজতিমায় একথা বলেছেন-

يہکامنافعہےليکنکافینہيں

এ কাজ উপকারী, তবে শুধু এটি যথেষ্ট নয়।

এই কথাটি শুধু তাবলীগের এই মেহনত সম্পর্কে নয়, বরং দ্বীনী মেহনতের যে কোনো অঙ্গন সম্পর্কে। শুধু একটি অঙ্গনকে  বা একটি অঙ্গনের বিশেষ কোনো মেহনতকে না যথেষ্ট বলা যায়, না পরিপূর্ণ। যে এমন বলবে সে বাড়াবাড়ির স্বীকার।

 

৪. ইলম, উলামা এবং মাদারিসকে কম গুরুত্ব দেওয়া

এক ব্যক্তিকে কোনো দ্বীনী মাসআলা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে সে বলতে লাগল-

مسائلامتکوتوڑتےہيں

‘মাসায়েল উম্মতের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে’।

কোনো সন্দেহ নেই যে, এমন ধারণা একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত। এই মেহনত এজন্যই করা হয়, যেন দ্বীন ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং শরীয়তের বিধান আমলে এসে যায়। শরীয়তের উপর যত বেশি আমল হতে থাকবে পরস্পরের মধ্যে বন্ধন তত বাড়তে থাকবে। ভাঙ্গন তো শরীয়তের বিধিবিধান ও আদাব ছেড়ে দেওয়ার কারণে সৃষ্টি হয়।

এজন্য নিজে অন্ততপক্ষে ফরযে আইন পরিমাণ ইলম ভালোভাবে শেখার চেষ্টা করুন। জরুরি ইলমের একটি অংশ হল নামাযের আমলী মশক। সুন্নাহ ও আদাবের তালীমও বেশি বেশি কাম্য।

নিজের সন্তানাদিকে আলেম বানানোর চেষ্টা করুন। সন্তানকে মাদরাসায় ভর্তি করার পর তার তালীম ও তরবিয়াতের ব্যাপারে মাদরাসার ব্যবস্থাপক ও আসাতিযায়ে কেরামের পরামর্শের মূল্যায়ন করা উচিত। তালিবে ইলমের মর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের পর সে তাবলীগে সাল লাগাবে, নাকি তাদরীসের খেদমত করবে, নাকি অন্য কোনো খেদমত শুরু করবে- এ ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া ঠিক নয়; বরং এ ব্যাপারে সন্তান ও তার আসাতিযায়ে কেরামের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নতুবা পরোক্ষভাবে এর দ্বারা ইলমকে অবমূল্যায়ন করা হবে।

আকাবিরে তাবলীগ এ ব্যাপারে সতর্ক করতেন যে, উলামায়ে কেরামের সাথে কেবল মহব্বত ও দুআ চাওয়ার সম্পর্ক রাখা যথেষ্ট নয়। পূর্ণ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে তাদেরকে দ্বীনী বিষয়ে অনুসরণীয় মনে করা আবশ্যক। তাদের হেদায়েতের উপর আমল করা, তাদের সংশোধন ও সতর্কীকরণকে গ্রহণ করা এবং তাদের সোহবতে থাকার জন্য সময় বের করাও আবশ্যক। ওয়াজ-মাহফিল বা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত উলামায়ে কেরামের অবমূল্যায়ন, তাদের ব্যাপারে বদগুমানী ও কট‚ক্তি করাও উলামায়ে কেরামের অবমাননার অন্তর্ভুক্ত।

আবার উলামায়ে কেরামের মধ্যে এই ভাগ করা যে, যারা সাল ও চিল্লা দেয়নি, তাদের কোনো মূল্য নেই। তাদের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস না করা ও তাদের থেকে পরামর্শ না নেওয়া উচিত। এসব ভাবনা অমূলক ও অজ্ঞতাপ্রসূত। এর ইসলাহ করা ফরয। মসজিদে অথবা নিজের কাছাকাছি কোথাও যদি সহীহ আকীদাওয়ালা আলেমের কোনো দরস বা মজলিস হয়, দরসে কুরআন বা দরসে হাদীস যাই হোক, অথবা কোনো ইসলাহী মজলিস হয়, তাহলে তা অপছন্দ করা বা ইচ্ছা করে তা থেকে দূরে থাকা নিতান্তই ভুল পদক্ষেপ, যা গলত ফিকিরের পরিণতি। কোনো সন্দেহ নেই যে, এটাও উলামায়ে কেরামের অমর্যাদার শামিল।

আরেকটি ভয়াবহ রকমের গোমরাহী হল, উলামায়ে কেরাম বেতন নেওয়ার কারণে তাদের ব্যাপারে এটা ভাবা যে, তারা দ্বীনের কাজ করেন না। যার ভেতরেই এধরনের ওয়াসওয়াসা আসবে তার খাঁটি মনে তওবা করে উলামায়ে কেরামের মাকাম বোঝার চেষ্টা করা উচিত। মূলত এ ধরনের ওয়াসওয়াসা ইলমে দ্বীন সম্পর্কে বে-খবর থাকা ও দ্বীনের সহীহ বুঝের কমতির কারণে আসে। হাকীকত তো হল, দ্বীনী কাজে উলামায়ে কেরাম যে বেতন গ্রহণ করেন তা এক বন্ধু অপর বন্ধুকে পূর্ণ ইখলাসের সাথে মহব্বত করে দেওয়া হাদিয়ার চে’ও বেশি হালাল এবং বেশি মর্যাদার। একারণে এটাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা জাহালত বা অজ্ঞতা এবং দ্বলালাত বা ভ্রষ্টতা। আর এটা তো একেবারেই সুস্পষ্ট যে, বর্তমানে দ্বীনী মাদারিসই তালীম ও হেফাযতে দ্বীনের দুর্গ। কোনো ব্যাক্তি দ্বীনের কোনো মেহনতের সাথে সম্পৃক্ত, কিন্তু দ্বীনী মাদারিসের ব্যাপারে তার মনে বিদ্বেষ অথবা দ্বীনী মাদারিসকে সে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে, তাহলে তার ব্যাপারে আফসোস ও দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কী করা যেতে পারে!! আল্লাহ তাআলা সব সাথীকে এ ধরনের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হেফাযত করুন- আমীন।

৫. কুরআন তিলাওয়াতের শুদ্ধতা ও যিকিরের দিকে কম দৃষ্টি দেওয়া

কুরআন তিলাওয়াতের শুদ্ধতা ও যিকিরের দিকে কম দৃষ্টি দেওয়া হয়। অথচ শুদ্ধ করে কুরআন তিলাওয়াত শেখা ফরয। এবং যিকির ঈমানী যিন্দেগীর পাথেয় ও পথ্য। ‘ফাযায়েলে কুরআন ও ফাযায়েলে যিকির’ নেসাবে থাকা সত্তে¡ও এদিকে মনোযোগ না দেওয়া বড় আশ্চর্যের বিষয়। যদি এই অমনোযোগিতা শুধু আমলে শিথিলতার কারণে হয়, তাহলে এর ইসলাহ করে নেওয়া উচিত। আর যদি এজন্য হয় যে, কুরআনে কারীমের সহীহ তিলাওয়াত শেখার গুরুত্বই অন্তরে না থাকে, তাহলে তো এটা অনেক বড় গোমরাহী। এ থেকে খালেস দিলে তওবা করে নিজের আকীদা ঠিক করে নেওয়া উচিত। কুরআনে কারীমের সাথে মজবুত সম্পর্ক গড়ার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। সহীহ তিলাওয়াত শেখা এবং প্রতিদিন কিছু কিছু তিলাওয়াত করার অভ্যাস গড়ে তোলা আবশ্যক। এমনিভাবে আদইয়ায়ে মাছ‚রা এবং আযকারের এক উল্লেখযোগ্য অংশ মুখস্থ করে নিয়মিত আমল করা আবশ্যক। এবং দ্বীনের যে মেহনতের সঙ্গে নিজে সম্পৃক্ত তাতে বরকত হওয়ার জন্য, নিজের ঈমানী যিন্দেগী নিরাপদ হওয়ার জন্যও তা আবশ্যক। এতে শিথিলতা প্রদর্শনের অর্থ যেন ছয় নম্বরেরই অমর্যাদা করা।

৬. জিহাদ ও নাহী আনিল মুনকার এবং ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা

জিহাদ এবং নাহী আনিল মুনকার বা অন্যায় কাজে বাধা প্রদান দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গন। এমনিভাবে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। তাবলীগ জামাতের প্রচলিত মেহনত সরাসরি এ অঙ্গনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।  এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু এই মেহনতের সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তি অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি দ্বীনের এ শাখাগুলোকে বা অন্য কোনো শাখাকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করলে তা সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতা। এ গোমরাহী থেকে বাঁচা ফরয। কাউকে একথা বলতে শোনা গেছে যে, ‘নাহী আনিল মুনকারের জরুরত নেই, আমর বিল মারুফ করতে থাক, তাহলে নাহী আনিল মুনকার আপনা থেকেই বাস্তবায়ন হয়ে যাবে।’ একথা বাস্তবতা পরিপন্থী এবং কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী।

এমনিভাবে এমন সকল কথা, যা দ্বারা জিহাদকে ইনকার করা হয়, মুজাহিদীনকে তাহকীর করা হয়, অথবা এমন কথা, যা থেকে অনুভ‚ত হয় যে, দাওয়াতের মেহনত বা তাবলীগ জামাতের প্রচলিত মেহনত, এটা জিহাদ বা ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠারই পরিবর্তিত রূপ বা বিকল্প কোনো সূরত- এ জাতীয় সকল কথা খালেস গোমরাহী।

৭. প্রচলিত মেহনতের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়াদিকে ফতোয়ার ঊর্ধ্বে মনে করা

শরীয়তের বিধান এবং দ্বীনী ফতোয়া দ্বীনের সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দাওয়াত ও তাবলীগ এবং তাবলীগের প্রচলিত এই মেহনতের সকল বিষয় শরীয়তের বিধানের অধীন, যার সমাধান উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে এবং দারুল ইফতা থেকে নিতে হবে। দ্বীনের কোনো কাজের সাথে যুক্ত কোনো ব্যক্তির নিজেকে এবং নিজের মেহনতকে আহকামে শরীয়ত থেকে মুক্ত মনে করা হারাম। মুফতী ও ফতোয়া, তালীম ও মুআল্লিম, দায়ী ও দাওয়াত, তাবলীগ ও মুবাল্লিগ, জিহাদ ও মুজাহিদ... সকলেই আহকামে শরীয়তের অনুগামী। কেউই এর ঊর্ধ্বে নয়। এটা খুবই ভুল ধারণা যে, দাওয়াতের বিষয়ে কোনো মাসআলা নেই। এ ধারণার ইসলাহ করা ফরয। হাঁ, এটা আলাদা কথা যে, আলেম কখনো মাসআলা বয়ান করেন, কখনো শুধু মাশওয়ারা দেন। তো মাসআলাকে মাসআলার মতো মানা জরুরি। আর মাশওয়ারাকে মাশওয়ারার মতো কদর করতে হবে।

৮. বয়ানের মধ্যে অসতর্কতাকে অন্যায় মনে না করা

হাদীস বর্ণনা করা, আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ও খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতের কোনো ঘটনা বর্ণনা করা, সাহাবায়ে কেরামের কোনো ঘটনা শোনানো অনেক ভারী যিম্মাদারী। দ্বীনের বিষয়ে কিছু বলাই তো অনেক ভারী যিম্মাদারী। এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ফরয। এই যিম্মাদারী আদায়ের জন্য সহীহ ইলম প্রয়োজন। শরীয়তের বিধান হল, যে বিষয়ের সহীহ ইলম তোমার কাছে নেই সে বিষয়ে কিছু বলতে যেয়ো না। বিশেষ করে তাহকীক ছাড়া যে কারো কাছ থেকে শোনার উপর নির্ভর করে হাদীস বর্ণনা করা অনেক বড় অন্যায়। কোনো দ্বীনী মেহনতের শরয়ী অবস্থান এবং আমল ও আহকামের হিকমত ও গূঢ় তত্তে¡র আলোচনা অনেক স্পর্শকাতর। এর সঠিক ও যথাযথ আলোচনা তো সকল আলেমের জন্যও সহজ নয়। তাহলে কীভাবে তাবলীগে চিল্লা লাগিয়ে অর্জিত অপরিপক্ক ও ভুল-শুদ্ধ মিশ্রিত জ্ঞান এই আলোচনার জন্য যথেষ্ট হতে পারে?! কিন্তু তাবলীগের অনেক সাথীদের দেখা যায়, তারা এজাতীয় বিষয়েও বয়ান করতে থাকেন, যা পুরোপুরি অন্যায় মনোভাব ও স্পষ্ট গুনাহ।

এখন এসব গুনাহকে যদি গুনাহই না মনে করা হয়, তাহলে তো এটা আকীদার গোমরাহী। আর যদি গুনাহ মনে করে আমলের ক্ষেত্রে অসতর্ক থাকা হয় তাহলে এটাও অনেক বড় অপরাধ। অবস্থা যাই হোক, তার ইসলাহ প্রয়োজন।

বয়ানে অসতর্কতার কারণে কত গলত কথা, গলত চিন্তা, গলত ব্যাখ্যা ও উপস্থাপন, অশুদ্ধ বর্ণনা, কত ভিত্তিহীন ও জাল হাদীস, কত মুনকার ও বাতিল ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত হয়ে যাচ্ছে এবং সেগুলোকে পুরোপুরি সহীহ-এর মতো বয়ান করা হচ্ছে, এর তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এসব বিষয় আলোচনা করার জন্য প্রবন্ধ নয়; বরং স্বতন্ত্র রচনা দরকার।

৯. দাওয়াতের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য অবচেতনে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের উপর অভিযোগ-আপত্তি তোলা

ভয়াবহ একটি ব্যাধি হল, দাওয়াতের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ঘটনা কোনো কোনো সাথীকে এমনভাবে পেশ করতে শোনা যায় যে, এর দ্বারা দাওয়াতের গুরুত্ব তো স্পষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের উপর আপত্তি উঠে আসে। এ ব্যাপারে তাদেরকে এতটাই অসতর্কতা অবলম্বন করতে দেখা যায়, ঘটনা বর্ণনা করার সময় এটা খেয়ালও করে না যে, এ ঘটনার আদৌ কোনো সত্যতা আছে কি না? কখনো কখনো অমূলক ঘটনা কোথাও থেকে শুনে বা বাজারী কোনো বই থেকে পড়ে কোনো দ্বিধা ছাড়াই বয়ানে শুনিয়ে দেয়। আবার কখনো এমন হয় যে, ঘটনা তো কুরআন কারীমে বা সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে, কিন্ত তারা কুরআন-হাদীসের বিবরণের সাথে ইসরাঈলী বর্ণনা ও মুনকার রেওয়ায়েত এবং গলত তাফসীর এমনকি নিজের থেকে বানানো কথা মিশ্রিত করে বলে থাকে। এতে তাদের দৃষ্টিতে দাওয়াতের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়। যেন তাদের মতে দাওয়াতের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য কুরআন-হাদীসের বর্ণনা যথেষ্ট নয়। এজন্য বানানো বা ভুল-শুদ্ধ মিশ্রিত কিচ্ছা-কাহিনীর সাহায্য নিতে হয়। যদিও তাতে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের পবিত্র সীরাতের উপর আপত্তি উঠুক!! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

মনে রাখা উচিত, এটা অনেক ভয়াবহ ব্যাধি। মাওলানা সা‘দ সাহেবের উপর উলামায়ে কেরামের অভিযোগসমূহের মধ্যে অনেক বড় একটা অভিযোগ এটাও যে, তিনি আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ঘটনা এমনভাবে বর্ণনা করেন, যেন তিনি তাদের ত্রæটি খুঁজছেন এবং যেন তিনি তাদেরকে সংশোধনী দিচ্ছেন। তার মানসিকতা যেন কিছুটা এমন যে, দাওয়াতের গুরুত্ব তো স্পষ্ট হচ্ছে, যদি নবীদের মাকামের উপর কিছু আপত্তি আসে, তো আসুক!

 نعوذباللهالعظيم!

আফসোস যে, এতাআতী ভাইয়েরা নিজেদের সংশোধন করার পরিবর্তে উল্টো এ গুরুতর অন্যায় কাজের ব্যাপারে মাওলানা সা‘দ সাহেবের পক্ষ থেকে সাফাই পেশ করার চেষ্টায় রত।

সাথীদের উচিত, এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা। প্রথমত অমূলক কোনো কাহিনী বর্ণনাই করবে না। দ্বিতীয়ত কুরআনে কারীমে উল্লেখিত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের সীরাত বিষয়ক ঘটনাগুলোর সঠিক মর্ম মুহাক্কিক উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নেবে; যেন উল্টো ব্যাখ্যা বুঝে নিজেও গোমরাহ না হয় এবং অন্যদেরকেও গোমরাহ না করে।

১০. ‘ঈমান শেখা’-এর অর্থের ব্যাপারে অনেক সংকীর্ণ মনোভাব

ঈমানও যে শেখার জিনিস, এটা তো অনেকের জানাই নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এব্যাপারে উদাসীনতা আগেও ছিল, এখনো আছে। আল্লাহ তাআলা তাবলীগের এই মেহনতের সাথে জড়িত সাথীদের জাযায়ে খায়ের দান করুন, তারা মাশাআল্লাহ মানুষের মধ্যে ঈমান শেখার কথার অনেক চর্চা করেছে।

কিন্তু সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়, আর তা হল তাদের অনেকের মধ্যেই এই গাফলতী আছে যে, তারা ‘ঈমান শেখা’র অর্থকে সীমাবদ্ধ ও সঙ্কুচিত অর্থে বুঝেছে। তাদের অনেকের ভাবভঙ্গি থেকে মনে হয়, তারা ‘ঈমান শেখা’  বলতে কেবল একথাকেই বুঝায় যে, মানুষ আসবাব থেকে বিশ্বাস সরিয়ে আসবাবের সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস স্থির করবে। যেন ‘আল্লাহ থেকে হওয়ার বিশ্বাস এবং গাইরুল্লাহ থেকে না হওয়ার বিশ্বাস’- ব্যস, এটার নামই ‘ঈমান শেখা’।

নিঃসন্দেহে এই বিশ্বাসও এর সঠিক ইসলামী মর্ম অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ আকীদা। যদিও আসবাবের শরয়ী অবস্থান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত বিধি-বিধান বুঝার ক্ষেত্রেও সাথীদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি পাওয়া যায়। তারপরও যদি তারা এই আকীদাকে ঠিকঠাকভাবে বুঝে নেয় এবং ভালোভাবে আত্মস্থও করে নেয়, তবুও একথা তো ঈমানের শাখা-প্রশাখার একটি শাখার একটি অংশমাত্র। ইসলামী আকায়েদ এবং ঈমানের অন্যান্য শাখা জানা ব্যতীত ‘ঈমান শেখা’ কীভাবে পূর্ণ হবে! কুরআন তিলাওয়াত শেখা ব্যতীত, নামায শেখা ব্যতীত ‘ঈমান শেখা’ কীভাবে হতে পারে?

ইসলামের ফরযগুলো কী কী? কুরআন কী কী হারাম করেছে? ইসলাম কার কী হক রেখেছে? লেনদেন এবং আয়-ব্যয়ের শরয়ী বিধি-বিধান কী? সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান কী? ইসলামী আদবসমূহ কী? আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা কী? এসব জানা বুঝা ব্যতীত ‘ঈমান শেখা’ কীভাবে পূর্ণ হয়ে যাবে?

সীরাত এবং তারীখ থেকে খাইরুল কুরূনের ‘ঈমান শেখা’র ঘটনা অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তারা পুরো شرائعالإسلام (ইসলামের মৌলিক বিধানসমূহ) শেখাকেই ‘ঈমান শেখা’ বলতেন। কুরআনে কারীমে ঈমানী যিন্দেগীর যে চিত্র দেওয়া হয়েছে তা শিখে নিজের আমলে নিয়ে আসাকেই তখন ‘ঈমান শেখা’ বলা হত।

এবং ঈমান শেখার পর যে কুরআন শেখার কথা এসেছে সেখানে কুরআন শেখার দ্বারা কুরআনের ইলমী ও আমলী বিস্তারিত তাফসীর শেখা উদ্দেশ্য। যেমন বর্ণিত আছে যে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. আট বছরে শুধু সূরা বাকারার তাফসীর শিখেছেন।

এখন শুধু এতটুকু বলাই উদ্দেশ্য যে, ‘ঈমান শেখা’র শরয়ী ব্যাখ্যা যেহেনে রাখা আবশ্যক। এবং এটাও স্মরণ রাখা জরুরি যে, ‘ঈমান শেখা’ সঠিক হচ্ছে, নাকি ভুল; পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে, নাকি অসম্পূর্ণ- এই ফায়সালাও ইলমে ওহীর ভিত্তিতেই করা হবে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামই ইলমে ওহীর ভিত্তিতে এই ফায়সালা করবেন।

এটা ভাবা চ‚ড়ান্ত অজ্ঞতা ও গোমরাহী যে, যে ব্যক্তি প্রচলিত পন্থায় চিল্লা লাগিয়েছে, সে ঈমান শিখেছে, চাই সে এত সাধারণ হোক না কেন যে, দ্বীন-শরীয়তের অধিকাংশ বিষয় তার অজানা। আর যে চিল্লা লাগায়নি সে ঈমান শিখেনি, চাই সে সুন্নতের অনুসারী মুত্তাকী আলেমই হোক না কেন!

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সবধরনের গলত চিন্তা ও সবধরনের প্রান্তিকতা থেকে রক্ষা করুন- আমীন।

ভুল চিন্তা-চেতনার সংশোধন সম্পর্কে এই সামান্য কিছু আবেদন পেশ করা হল। সুযোগ হলে আরো কিছু কথা এবং উল্লেখিত কথাগুলোর আরো ব্যাখ্যা আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে অন্য কোনো সময়ে করা হবে- ইনশাআল্লাহ।

অতীতের ক্ষতিপূরণ ও বর্তমানের সংশোধন

ভুল চিন্তা-চেতনার সংশোধনের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, নিজের অতীতের ক্ষতিপূরণ করা। অর্থাৎ যেহেতু আল্লাহ তাআলার ফযল ও করমে দ্বীনী চেতনা ও অনুভ‚তি সৃষ্টি হয়েছে, তাই এখন তা কাজে লাগানো উচিত। এখনই দুটি কাজ করা আবশ্যক। একটি হল, অতীত জীবনে ফারায়েয এবং ওয়াজিবাতের মধ্যে যত গাফলতী হয়েছে সে ব্যাপারে মাসাআলা জেনে যা কাযা করা দরকার, তা কাযা করা আর যার কাফফারা আদায় করা দরকার, কাফফারা আদায় করা। হিসাব করে অতীতের বছরগুলোর যাকাত দেওয়া। হজ্ব ফরয হয়ে থাকলে হজ্ব করা।... আর দ্বিতীয়টি হল, যদি আল্লাহর কোনো বান্দার হক নষ্ট করা হয়ে থাকে, কারো ঋণ আদায় করা বাকি থাকে, কারো হক আদায় করা না হয়ে থাকে, কারো উপর শারীরিক অথবা আর্থিক কোনো যুলুম করা হয়ে থাকে, কথায় কাউকে কষ্ট  দেওয়া হয়ে থাকে, সেসব কাজের ক্ষতিপূরণ করা। হক নষ্ট করা হলে তা আদায় করা। ঋণ আদায় করা। হকদারদের হক পৌঁছে দেওয়া। ফুফু বা বোনদের মীরাছ নিজেদের দখলে থাকলে তা যথাযথভাবে আদায় করে দেওয়া। যুলুমের জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং পাওনাদারের কাছে নিজেকে পেশ করা। মালী যুলুমের ক্ষেত্রে মাল আদায় করে মাফ চেয়ে নেওয়া এবং সাথে সাথে ইসতিগফার করতে থাকা।

এটা অত্যন্ত গোমরাহী দৃষ্টিভঙ্গি যে, তওবা করার পর অতীতের আর কোনো ব্যাপারে যিম্মাদারী বাকি থাকে না; বরং আসল কথা হল, তওবা তো তওবা হিসেবে গণ্যই হয় না, যতক্ষণ না তওবার সাথে সাথে নিজের অতীতের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়। তার ক্ষতিপূরণ ও বদলা আদায় করার পরিপূর্ণ ইহতিমাম করা হয়। তওবা করে নিজের অতীতের ক্ষতিপূরণ করা থেকে উদাসীন হয়ে যাওয়া অনেক বড় গুনাহ। এ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।

এরপর তওবার প্রভাব নিজের বর্তমান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পড়া উচিত। লেনদেন, মুআশারাত এবং চরিত্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রগুলো নিয়ে মুহাসাবা না করা চূড়ান্ত পর্যায়ের অপরাধ। চিল্লাও লাগানো হচ্ছে, হজ্বও করা হচ্ছে, যিকিরও করা হচ্ছে... আবার  এদিকে হারাম ব্যবসা পরিত্যাগ করা হয়নি, সুদি ঋণ থেকে বের হওয়ার চিন্তা নেই, নিজের অতীতের অসৎ কাজের ক্ষতিপূরণের কথা ভাবা হয়নি। অসদাচরণ ছেড়ে ইসলামী আদাবে নিজেকে রাঙ্গানোর কথা ভাবা হয়নি।

‘ইকরামুল মুসলিমীন’কে শুধু মুরুব্বীদের সাথে অথবা ঘরের বাহিরের লোকদের সাথে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার জাহালত থেকে বের হওয়ার ফিকির করা হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকার কারণে যে কুফরী ও গোমরাহী দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করা হয়েছে তা সংশোধনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, কিন্তু জামাতের সাথে নামায পড়া হয়, পাগড়ী বাঁধা হয়, নিয়মিত চিল্লা লাগানো হয়, পীর সাহেবের দেওয়া অযীফাও নিয়মিত আদায় করা হয়, বছর বছর হজ্ব-উমরাও করা হয়।

মনে রাখুন, খুব ভালো করে বুঝে নিন। এমন তওবা তওবা নয়; বরং ধোঁকা। এবং এধরনের অসম্পূর্ণ ইসলাহের উপর খুশি হয়ে যাওয়া, অথবা এটা ভাবা যে, আমি ঈমানের মেহনত করছি- এসব কঠিন গোমরাহী, অনেক বড় ক্ষতির কারণ। দ্বীনী চেতনা ও অনুভ‚তি যে যেভাবে পেয়েছে, চাই তা তাবলীগের এই মেহনতের মাধ্যমে হোক বা কোনো বুযুর্গের হাতে বাইআত হওয়ার দ্বারা হোক, কোনো আলেমের সোহবতের কারণে বা হজ্ব ও উমরার প্রভাবে হোক, অথবা কোনো ওয়াজ শুনে, কোনো ধর্মীয় বই পড়ে অথবা অন্য যে কোনো মাধ্যমেই হোক, প্রত্যেকের  উপর ফরয- এই দ্বীনী মূল্যবোধ সৃষ্টি হওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করা এবং তা যথাযথভাবে আমলে নিয়ে আসা। অতীতের ক্ষতিপূরণ করা, বর্তমানের ইসলাহকে পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক করা, ভবিষ্যত জীবনে উন্নতির চেষ্টায় রত থাকা, একথা কেবল তাবলীগের সাথীদের জন্যই নয়; বরং প্রত্যেক মুসলিম ভাইয়ের খেদমতেই এ আবেদন।

চতুর্থ নিবেদন

নিজের গÐির বাইরে দখলদারি না  দেওয়া

নিজের পরিধির বাইরে কারোই হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। যেটা যার কাজ নয়, সেখানে অনধিকার চর্চা করা কেবল ইসলামী তা‘লীমাতেরই খেলাফ নয়; বরং এটা সাধারণ ভদ্রতারও পরিপন্থী। অথচ আমাদের সমাজে এই মুসিবত অনেক ব্যাপক। এখন যেহেতু আমরা তাবলীগ জামাত সম্পর্কে আলোচনা করছি, তাই উদাহরণ এখান থেকেই পেশ করছি। ধরুন, আপনি এতাআতী জামাতের পক্ষে নন, আপনি ঈমানের দাবিতেই মাওলানা সা‘দ সাহেবের জামাতের পক্ষ অবলম্বন করেননি। এপর্যন্ত আপনার কাজ পুরোপুরি ঠিক এবং এজন্য অনেক মুবারকবাদ। কিন্তু যদি আপনি আলেম না হন, (এবং এটাও মনে রাখবেন যে, প্রত্যেক দাওরা ফারেগ মৌলভীই আলেম নন) তাহলে আপনার জন্য জায়েয নেই যে, আপনি নিজেই মাওলানা সা‘দ সাহেবের সমালোচনা করবেন। এটা আপনার কাজ নয়; বরং আলেমদের কাজ। কোনো এতাআতী ভাইকে যদি বুঝানোর দরকার পড়ে তাহলে আপনি তাকে কোনো আলেমের খেদমতে নিয়ে যান। অথবা তাকে এ সম্পর্কে দলীল-প্রমাণ সম্বলিত নির্ভরযোগ্য কোনো প্রবন্ধ বা বই দিয়ে দিন। অথবা তার সামনে দারুল উলূম দেওবন্দের ফতোয়া পেশ করুন। এর চেয়ে বেশি কিছু করার আপনি মুকাল্লাফ বা আদিষ্ট নন। কেউ যদি ভুল পথে চলতে থাকে তাহলে তার অনুসরণ করা কারো জন্যই জায়েয নেই। কিন্তু তার সমালোচনা করাও প্রত্যেকের কাজ নয়। সমালোচনা সেই করবে, যে বিচার-বিশ্লেষণ করার যোগ্য। যার এ সম্পর্কিত উসূল ও আদাব জানা আছে। এবং ঈমানী দায়িত্ববোধ থেকে স্বভাব-বিরুদ্ধ ও কঠিন এ দায়িত্ব আদায় করে। এমনিভাবে ধরুন, কোনো সাথী এতাআতী -আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন এবং সঠিক পথে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন- যদি তার ধারণা অনুযায়ী (যদিও দ্বীনী বিষয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা ধর্তব্য নয়, তাকে নিজের খেয়াল মতো নয়; কোনো আলেমের ফতোয়ার উপর আমল করতে হবে) তার এতাআতী হওয়া সঠিকও হয়, তবুও এটা কখনোই জায়েয নেই যে, সে কোনো আলেমের সমালোচনা করবে, কোনো ফতোয়া বিভাগের সমালোচনা করবে, মাওলানা সা‘দ সাহেবের কোনো ভুলের ব্যাখ্যা করবে, অথবা তার সমর্থনে দলীল পেশ করার চেষ্টা করবে। কেননা সমালোচনা ঠিক না ভুল, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুদ্ধ না অশুদ্ধ, তার পেশ করা দলীল তার পক্ষে যায়, নাকি বিপক্ষে- সেটা তো পরের কথা, আগের কথা হল, এ কাজ তো তার নয়। সে কেন এই ময়দানে অনধিকার চর্চা করতে আসল?

তাই প্রত্যেক দলের সাথীদের নিকট আমার দরখাস্ত এই যে, আমরা কেউ নিজের পরিধির বাইরে যবানও ব্যবহার করব না, কলমও না। সর্বদা আল্লাহ তাআলার ইরশাদ স্মরণ রাখব-

وَلَاتَقْفُمَالَیْسَلَكَبِهٖعِلْمٌ  اِنَّالسَّمْعَوَالْبَصَرَوَالْفُؤَادَكُلُّاُولٰٓىِٕكَكَانَعَنْهُمَسْـُٔوْلًا.

যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই  তার পেছনে পড়ো না। জেনে রেখো, কান, চোখ ও অন্তর এর প্রতিটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। -সূরা বনী ঈসরাইল (১৭) : ৩৬

পঞ্চম নিবেদন

ঝগড়া-বিবাদ এবং তর্ক ও বাকবিতÐা থেকে বিরত থাকা

মনে রাখুন, হকের পথে দাওয়াত দেওয়া এবং যে ব্যক্তি কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে ও অন্তরে হক স্পষ্ট হয়ে গেলে তা মানার আগ্রহ রাখে, এমন মানুষকে যোগ্যতা থাকলে হকের কথা বুঝানো, এটা অনেক ভালো কাজ। কিন্তু যে হককে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়, তার সাথে তর্ক-বিতর্ক এবং ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া কখনোই ভালো কাজ নয়। এতে বৈরিতা সৃষ্টি হয়। সময় নষ্ট হয়। কখনো কথা আলোচ্য বিষয় থেকে বের হয়ে রেষারেষি ও হঠকারিতার দিকে গড়ায়। কখনো যবান অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় এবং ভুলভাল বলা ও গালিগালাজ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এজন্য এই অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকাই একজন মুমিনের দায়িত্ব।

এজন্য যে সাথী ভুলের পক্ষে আছে সেও এ কাজ করবে না। কেননা সে তা করলে শুরু থেকেই তাকে ভুল বিবরণের আশ্রয় নিতে হবে। আর যে সাথী হকের পক্ষে আছে, সেও এ কাজ করবে না। কেননা যদিও সে হকের উপর আছে, তথাপি অনর্থক তর্ক-বিতর্কে সময় নষ্ট করা কাম্য নয়। এদিকে এটাও হতে পারে যে, কথা অনেক লম্বা হয়ে যাবে আর আপনি মুযাকারার উসূল ও আদাবের উপর অটল থাকতে পারবেন না। অথবা যবানকে তার সীমায় আটকে রাখতে অক্ষম হয়ে যাবেন। হাদীস শরীফে এসেছে-

مَنْتَرَكَالكَذِبَوَهُوَبَاطِلٌبُنِيَلَهُفِيرَبَضِالجَنّةِ،وَمَنْتَرَكَالمِرَاءَوَهُوَمُحِقّبُنِيَلَهُفِيوَسَطِهَا،وَمَنْحَسّنَخُلُقَهُبُنِيَلَهُفِيأَعْلَاهَا.

অর্থাৎ যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ছেড়ে দেয় এবং মিথ্যা যেহেতু বাতিল, তাই তা ছেড়ে দেওয়াই কাম্য, তার জন্য জান্নাতের কিনারায় মহল বানানো হবে। আর যে ব্যক্তি হকের উপর থাকা সত্তে¡ও বিবাদে লিপ্ত হল না, তার জন্য জান্নাতের মধ্যখানে মহল বানানো হবে। আর যে উত্তম আচরণ গ্রহণ করল তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকামে মহল বানানো হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৯৩, অধ্যায় ৫৭, কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাহ, প্রকাশক : আররিসালাতুল আলামিয়্যাহ, বাইরুত

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জান্নাতের ঐসকল মহল হাসিল করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

ষষ্ঠ নিবেদন

ইসলামী শিষ্টাচার ও মানবিক গুণাবলীর প্রতি লক্ষ রাখা, মুখ ও কলমকে নিয়ন্ত্রণে রাখা

প্রথম ও দ্বিতীয় নিবেদনে একথা যদিও এসে গেছে, তবুও আমরা গুরুত্বের বিচারে পৃথকভাবে এটা নিবেদন করছি। আমার ভাইয়েরা! উভয় দলের সাথীগণ! মুখ ও কলমকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। মুখ ও কলমের অশোভন আচরণ ও উচ্চারণ থেকে বাঁচা তো মানবিক ভদ্রতারই দাবি। আপনার যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মহব্বত আছে তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দাবিও এটা যে, আপনি আপনার যবান ও কলমকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ন¤্র ও সুন্দর আচরণ করুন। সত্য বলুন। দৃঢ়তার সাথে বলুন। স্পষ্ট করে বলুন। কিন্তু কথা ও উপস্থাপনায় বিন¤্র ও সংযত হোন। অন্ততপক্ষে অভদ্রতা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকুন। ইসলাম এই স্বভাবজাত গুণকে আরও জোরালো করে দিয়েছে। ফেরাউনের সাথেও নরম কথা বলতে বলেছে। মুমিনের শান হল, ইসলামের আকীদা ও চিন্তা-চেতনায় এবং আদর্শ ও ঐতিহ্যগত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে তার মধ্যে কোনো দুর্বলতা ও নমনীয়তা থাকবে না। কিন্তু তার যবান ও কলম সীমালঙ্ঘন করবে না। কখনো কোনো অশোভন ও অশালীন শব্দ মুখ ও কলম থেকে বের হবে না।

মুখ ও কলম যদি সীমা অতিক্রম করতে থাকে, তাহলে একসময় তা মানুষকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এ হাদীস তো সকলেরই জানা, যেখানে ইরশাদ হয়েছে-

وَهَلْيَكُبّالنّاسَفِيالنّارِعَلَىوُجُوهِهِمْأَوْعَلَىمَنَاخِرِهِمْإِلّاحَصَائِدُأَلْسِنَتِهِمْ.

আরে! যবানের কামাই-ই তো মানুষকে অধঃমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে! -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬১৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৯৭৩

যে ব্যক্তিকে অনেক মানুষ অনুসরণীয় মনে করে, (যদিও সে শরীয়তের দৃষ্টিতে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব না হয়) এবং প্রতিষ্ঠানিকভাবে সে মাদরাসার শিক্ষা পরিপূর্ণও করেছে, (তাফাক্কুহ ফিদ দ্বীন ও রুসূখ ফিল ইলম হাসিল করেছে কি না তা ভিন্ন বিষয়) আপনি যদি তার ব্যাপারে লিখে দেন যে, তার জন্য ‘মাওলানা’ শব্দ ব্যবহার করা এই শব্দের জন্য কলঙ্ক, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটা অভদ্রতা। যে এ ধরনের অভদ্রতা করে তার আসলে কিছু বলার ও লেখার অধিকারই নেই। কারও বাতিল বিষয় খÐন করার সময় ‘মুখোশ উন্মোচন’ ‘গোমর ফাঁক’... এজাতীয় শব্দ ব্যবহার করাও অভদ্রতার পরিচয়। আর যদি কারো হক কথার খÐন করতে গিয়ে কেউ এমন ভাষা ব্যবহার করে তাহলে আপনিই বলুন, ব্যাপারটা কেমন হবে!! ব্যস, এই ইশারা করেই ক্ষান্ত হচ্ছি। আজকাল উভয় পক্ষের অতি উৎসাহী তরুণদের পক্ষ থেকে পরস্পরে যে বিদ্রæপাত্মক কথা এবং উস্কানিমূলক ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় সামনে আসছে, তা খুবই কষ্টদায়ক। উভয় পক্ষের সাথীদের কাছে আরয, অনুগ্রহপূর্বক সব ধরনের অশালীন আচরণ থেকে নিজেকে হেফাযত করুন। নিজের মুখ ও কলমকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন, সীমারেখায় আটকে রাখুন।

ভালোভাবে স্মরণ রাখুন!! হকের নুসরত করতে এবং বাতিলকে খÐন করতে ইসলামী আদাবের রেয়ায়েত করা এবং মুখ ও কলমকে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি। যে বাতিলকে সমর্থন করে তার যবান ও কলম সীমালঙ্ঘন করা যত ক্ষতিকর, তার চে’ও ক্ষতিকর হল, যে হকের সমর্থন করে, তার যবান ও কলম সীমালঙ্ঘন করা।

আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, ইসলামী শিক্ষায় উত্তম আচরণের বিষয়টি এমন নয় যে, আমার সাথে যদি ভালো আচরণ করা হয়, তাহলে আমিও ভালো আচরণ করব। অন্যথায় আমি ইটের জবাব পাথর দিয়ে বা অন্তত ইট দিয়েই দিব। না, না, এটা কখনো নয়। বরং ইসলামের শিক্ষা তো হল-

وَلَاتَسْتَوِیالْحَسَنَةُوَلَاالسَّیِّئَةُ،  اِدْفَعْبِالَّتِیْهِیَاَحْسَنُفَاِذَاالَّذِیْبَیْنَكَوَبَیْنَهٗعَدَاوَةٌكَاَنَّهٗوَلِیٌّحَمِیْمٌ،وَمَایُلَقّٰىهَاۤاِلَّاالَّذِیْنَصَبَرُوْا،  وَمَایُلَقّٰىهَاۤاِلَّاذُوْحَظٍّعَظِیْمٍ.

ভালো ও মন্দ সমান হয় না। তুমি মন্দকে প্রতিহত করো এমন পন্থায়, যা হবে উৎকৃষ্ট। তার ফল হবে এই যে, যার ও তোমার মধ্যে শত্রæতা ছিল সে সহসাই হয়ে যাবে তোমার বন্ধু। আর এ গুণ কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা সবরের পরিচয় দেয় এবং এ গুণ  কেবল তাদেরকেই দান করা হয়, যারা মহাভাগ্যবান। -সূরা ফুসসিলাত (৪১) : ৩৪-৩৫

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَاتَكُونُواإِمّعَةً،تَقُولُونَ: إِنْأَحْسَنَالنّاسُأَحْسَنّا،وَإِنْظَلَمُواظَلَمْنَا،وَلَكِنْوَطِّنُواأَنْفُسَكُمْ،إِنْأَحْسَنَالنّاسُأَنْتُحْسِنُوا،وَإِنْأَسَاءُوافَلَاتَظْلِمُوا.

তোমরা ‘ইম্মা‘আ’ হয়ো না অর্থাৎ (সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ এবং হক-বাতিলের) শরয়ী মানদÐ ত্যাগ করে অন্ধ অনুকরণকারী বা অন্ধ অনুসারী হয়ো না। এমন বলো না, ‘লোকেরা সদাচার করলে আমরা সদাচার করব আর লোকেরা যুলুম করলে আমরাও যুলুম করব’; বরং নিজেদের (এই নীতিতে) অভ্যস্ত কর যে, লোকেরা সদাচার করলে তোমরাও সদাচার করবে আর লোকেরা অসদাচার করলে তোমরা যুলুম থেকে বিরত থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২০০৭

শেষ নিবেদন

হৃদয়ের সৌহার্দ্য ও অবস্থার সংশোধনের জন্য দুআ করতে থাকা

অবস্থার প্রভাবে হতাশ হয়ে যাওয়া মুমিনের শান নয়। মুমিন তো হালাত দেখে শোকরের স্থলে শোকর ও সবরের স্থলে সবর করতে থাকে। বিপদ-আপদ বা কোনো বিশেষ অবস্থার সম্মুখীন হলে সে সেখান থেকে সবক হাসিল করে এবং তওবা-ইসতিগফার করে আরো চাঙ্গা হয়ে উঠে। নিজের ত্রæটি পূরণ করতে থাকে এবং কল্যাণের দিকে দ্বিগুণ উৎসাহে এগুতে থাকে। অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে হীনবল হয়ে যাওয়া, আপন কাজে মন্থর হয়ে যাওয়া এটা মুমিনের শান কখনো নয়। এজন্য সকল সাথীর নিকট আবেদন, তারা যেন আল্লাহ তাআলার দিকে রুজু করে, খুব দুআ করে এবং অত্যন্ত উদ্যমের সাথে সুচিন্তিত কর্মসূচি অনুযায়ী নিজ নিজ কাজে   ও দ্বীনী মেহনতে নিবিষ্টভাবে লেগে যান। এবং মনেপ্রাণে এই দুআ করতে থাকেন-

اللّهُمّأَلِّفْبَيْنَقُلُوبِنَا،وَأَصْلِحْذَاتَبَيْنِنَا،وَاهْدِنَاسُبُلَالسّلَامِ،وَنَجِّنَامِنَالظّلُمَاتِإِلَىالنّورِ،وَجَنِّبْنَاالْفَوَاحِشَمَاظَهَرَمِنْهَاوَمَابَطَنَ.

অর্থাৎ, ইয়া আল্লাহ! আমাদের অন্তরে প্রীতির সঞ্চার করুন এবং পরস্পরের সম্পর্ক সদ্ভাব-পূর্ণ করুন। আমাদের সম্মুখে শান্তি ও নিরাপত্তার পথসমূহ খুলে দিন এবং সকল অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোর দিকে পরিচালিত করুন। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম থেকে আমাদের দূরে রাখুন, আমীন।

এতাআতী ভাইদের কাছে আবেদন, যদি আপনাদের তাবলীগ জামাতের এই মেহনতের সাথে বাস্তবিকই মহব্বত থাকে, তাহলে এটাকে নব আবিষ্কৃত উসূল থেকে হেফাযত করুন। গলত এতাআতের দৃষ্টিভঙ্গি, যা যে কোনো দ্বীনী জামাতের জন্যই বিলকুল গলত নযরিয়া,  তা থেকে এই কাজকে মাহফুয রাখুন। অনুগ্রহ করে ভুল উসূলের বৃদ্ধি ঘটিয়ে এই মুবারক মেহনতকে ত্রæটিযুক্ত করবেন না। এবং ত্রæটিপূর্ণ মেহনতের দিকে কাউকে দাওয়াত দিবেন না। বিশেষভাবে আপনাদের কর্তব্য- মসজিদসমূহকে এমন ত্রæটিযুক্ত দাওয়াত থেকে রক্ষা করা।

هذا،وصلىاللهتعلىوباركوسلمعلىسيدناومولانامحمد،خاتمالنبيينوسيدولدآدم،وعلىآلهوصحبهأجمعين،وآخردعواناأنالحمدللهربالعالمين

 

advertisement