চি ন্তা শী ল তা
ঘূর্ণিঝড় ফণী ও কিছু পর্যবেক্ষণ
মে মাসে যে ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের উড়িষ্যা দিয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে গেল তা ছিল নানা দিক দিয়ে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় একটি ঘটনা। ফণী নামক এই ঝড়টি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কারণ, তা ছিল প্রচ- রকমের শক্তিশালী। এর কারণে যে কোনো ভূখ-ে প্রলয়ঙ্করী বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। এ নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও ছিল ব্যাপক আলোচনা । বলা যায় এই ঘূর্ণিঝড়ের আগের সময়টাতে মিডিয়ার প্রধান বিষয়গুলোর একটি ছিল ফণী। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি কমানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সব কিছু মিলিয়ে গোটা দেশবাসী উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যে ছিলেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে যে, ‘এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
ঘূর্ণিঝড়টির কারণে ভারতের কিছু অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও আল্লাহর রহমতে আমাদের দেশে ক্ষয়ক্ষতি ছিল অপেক্ষাকৃত কম। ঘূর্ণিঝড়টি বয়ে যাওয়ার পর উৎকণ্ঠা দূর হয় এবং জনমনে স্বস্তি নেমে আসে।
এই ঘটনাটিতে আমাদের জন্য চিন্তা-ভাবনার অনেক উপাদান আছে। জীবনযাত্রার এই ঘটনাগুলোকে আমরা সাধারণত এড়িয়ে যাই। চিন্তা-চেতনায় তার প্রভাব খুব কম গ্রহণ করি। অথচ তা গ্রহণ করা উচিত। বিশেষত মুমিন হিসেবে তা আরো বেশি উচিত। কেননা ঈমানের বদৌলতে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি দান করেছেন। মানব-জীবনের কোনো কাজ দায়হীন নয়, জগতের কোনো কিছুই তাৎপর্যহীন নয়। জীবন ও জগতের নানা পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীতে উদাসীনতা ও ভ্রুক্ষেপহীনতা ‘গাফলত’ নামে আখ্যায়িত, যা থেকে একজন মুমিনকে অবশ্যই উপরে উঠতে হবে।
ঈমান আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষা দান করে তা হচ্ছে তাওহীদ। তাওহীদের শিক্ষা অতি গভীর ও বিস্তৃত। তাওহীদের শিক্ষার মধ্যে যেমন আছে ইবাদত একমাত্র আল্লাহর, তেমনি আছে আল্লাহই একমাত্র রব। গোটা জগৎ তিনিই সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁরই হুকুমে তা পরিচালিত হচ্ছে।
আকাশ-বাতাস আল্লাহর সৃষ্টি, সাগর-মহাসাগর আল্লাহর সৃষ্টি, পাহাড়-পর্বত আল্লাহর সৃষ্টি। এই সব কিছু আল্লাহর মাখলুক। এরা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে।
বাতাস আল্লাহর মাখলুক। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তা কত প্রয়োজনীয়। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে বাতাসই মানুষের প্রাণহানীর কারণ হয়ে যেতে পারে। এর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই, আল্লাহর হুকুমেই তা মানুষের জন্য উপকারী হয় কিংবা ক্ষতিকর হয়। আল্লাহর হুকুমেই তা স্বাভাবিক থাকে আবার তাঁরই হুকুমে তা প্রচ- ঝড়-তুফানের রূপ ধারণ করে।
এই পরিবর্তনের পিছনেও মহাশক্তিমান আল্লাহ তাআলার যে নেযাম ও ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে সে সম্পর্কে সামান্য কিছু জ্ঞান ও উপলব্ধিও মানুষকে অভিভূত করতে পারে এবং আল্লাহ তাআলার ইলম ও কুদরত তথা সীমাহীন জ্ঞান ও শক্তির পরিচয় লাভে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি যেন অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ভোগবাদী ও বিনোদনমুখী প্রবণতাও চরমে পৌঁছেছে।
সৃষ্টিজগতের যে বিষয়গুলো আল্লাহ তাআলার শক্তি ও কুদরতের পরিচয় পাওয়ার এবং তাঁকে স্মরণ করার উপায় হতে পারত সেগুলোকেই আরো বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্নতার উপায় বানিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যে পরিস্থিতিগুলো আল্লাহর ভয়ে ভীত হওয়ার এবং আল্লাহ-অভিমুখী হওয়ার উপায় হতে পারত সেগুলোকেই উদাসীনতা ও বিনোদন-চাহিদা চরিতার্থ করার উপায় বানিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ফণী প্রবাহিত হয়ে যাওয়ার আগে-পরে মিডিয়ার নানা বক্তব্য, প্রচার-প্রচারণার ধরন, ভাষা ও উপস্থাপনায় এই বিষয়গুলো বেশ প্রকটভাবে দেখা গেছে।
ঘূর্ণিঝড়টি তো আল্লাহর মাখলুক, কিন্তু আমাদের প্রচার-প্রচারণার ভাব ও ভাষায় এই বিষয়টি উচ্চারিত হওয়ার তো প্রত্যাশাও করা যায় না; বরং গোটা বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন ঘূর্ণিঝড়টি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা, এটি যে কোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। গোটা বিষয়টিকেই হয়ত রূপক অর্থে ব্যবহার বলে ব্যাখ্যা করা যায় কিন্তু তারও তো একটা সীমা-সরহদ থাকতে হবে। রূপকের ব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছা কি উচিত হবে, যা বাস্তবতাকে স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলে?
এই ধরনের প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব হ্রাস করার জন্য পূর্বপ্রস্তুতিমূলক যেসব কার্যক্রম হাতে নেয়া হয় সেগুলোর বিবরণের ক্ষেত্রেও নিজেদের প্রস্তুতির উপর অতিআস্থা প্রকাশক ভাব-ভাষা পরিহার করা উচিত। এক্ষেত্রেও আল্লাহর প্রতি ভয় ও বিনয়ের প্রকাশ থাকা উচিত। কারণ আল্লাহ যদি রক্ষা না করেন তাহলে শত প্রস্তুতিও কোনো কাজে আসে না। আর তিনি রক্ষা করলে যথাসাধ্য প্রস্তুতিও অনেক ফল দিতে পারে। জীবনের সকল পরিস্থিতিতেই আমাদের আচরণ-উচ্চারণে আমাদের বিশ্বাস ও আদর্শের প্রতিফলন থাকা বাঞ্ছনীয়।
ঘূর্ণিঝড়টিকে কেন্দ্র করে প্রচার-প্রচারণার মধ্যে বিনোদনমুখী বিষয়টিও ছিল চোখে পড়ার মতো। ইন্টারনেটের ‘কল্যাণে’ এখন সব কিছুতেই প্রচারমুখিতা ও বিনোদনমুখিতা প্রকট। ঝড়-তুফানে মানুষের প্রাণহানী ঘটছে, ঘর-বাড়ি হারিয়ে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ছে, মানুষের জীবন-মরণের এই সমস্যাগুলোও প্রযুক্তি আমাদের কাছে দর্শনীয় ও উপভোগ্য বিষয় বানিয়ে দিয়েছে। এভাবে মানুষ তার মানবিকতা হারিয়ে জীবন্ত রোবটে পরিণত হতে চলেছে। এটা তো হতে দেয়া যাবে না। এমনটা হলে তো ধীরে ধীরে দয়া, মায়া, সহানুভূতি, সহমর্মিতার মতো মানবিক বৃত্তিগুলো ভোঁতা হতে হতে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আমাদের প্রয়োজন। একে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুপাতে ব্যবহার করতে হবে। একে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে ব্যবহার করলে তা আমাদের পুষ্টি যোগাবে কিন্তু এর বদ হজম হয়ে গেলে তা যত পুষ্টিকর বস্তুই হোক, আমাদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করবে।
যাই হোক, গাফলতি ও বিনোদনমুখী জীবন নয়, কর্ম ও গঠনমুখী জীবন যেন আমরা অবলম্বন করি। কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতামুখী আচরণ-উচ্চারণ নয়, তাওহীদ ও আল্লাহমুখী আচরণ-উচ্চারণ যেন আমরা অবলম্বন করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন।