আমার মা
নাম নূর জাহান। জন্মেছেন কালকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বড় হয়েছেন বাবা-মায়ের অনেক আদরে। পরম মমতায়। শৈশব কেটেছে প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্যের মাঝে। বাবার চাকরি হল ঢাকায়। চলে এলেন বাংলাদেশে। এ মাটির আলো-বাতাসে বড় হতে লাগলেন। ভর্তি করা হল স্কুলে। শুরু হল শিক্ষাজীবন। স্কুলের পর কলেজ। জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে- এটাই ছিল বাবা-মার ইচ্ছা। কিন্তু হল না। তাকদীরে যা ছিল তার কি আর পরিবর্তন হয়? ইসলামের প্রতি প্রবল টান তাকে নিয়ে গেল কুরআনের কাছে। কোথাও কুরআনের তিলাওয়াত হলে কান পেতে শুনতেন। নিজেও তিলাওয়াতের চেষ্টা করতেন। বড় ভাইয়ের কাছে কিছুটা শিখেছেন। নিজের কর্মে ও বিশ্বাসে কুরআনের আলো ধারণের চেষ্টা করতেন। বাস্তবে তার পুরো প্রতিফলন ঘটাতে পারছিলেন না।
তিনি ভাবলেন আমার বিয়ে যদি কোনো দ্বীনদার আলেমের সাথে হয় তাহলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু তিনি পেরেশান হলেন- সত্যিই কি আমার বিয়ে কোনো আলেমের সাথে হবে! আমি তো দ্বীন শিখিনি। আমি তো আলেম নই। তবে কেন কোনো আলেম আমাকে বিয়ে করবে? আর বাবা মা কি এতে রাজি হবেন! তার ভয় আশংকায় পরিণত হল। কারণ বাসায় সব মডার্ন ছেলেদের প্রস্তাব আসতে লাগল। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। আল্লাহর সাহায্যের আশায় থাকলেন এবং তিনি কঠোর হলেন। ঠিক করলেন, কোনো প্রস্তাবে রাজি হবেন না। একমাত্র দ্বীনদার ছেলে হলেই বিয়ের পিড়িতে বসবেন।
তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন, যিনি হবেন আমার জীবনসঙ্গি তিনি দ্বীনদার না হলে সারা জীবন আমাকে কষ্ট করতে হবে। আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন যেভাবেই হোক দ্বীনকে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দিবেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন আল্লাহর সাহায্যের। অবশেষে এক আলেম বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন, যার বাবা মা ছিল না। ছিল না অর্থ ও প্রাচুর্য। তাকে কাছেই ঘেষতে দেওয়া হল না। কিন্তু তিনি প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। কোনো বাধাই তাকে এ সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। কত ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার আসল। কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। অবশেষে এক ভাই রাজি হয়ে গেল। পরিবারের অন্যদেরকে উপেক্ষা করে বিয়ে হল। স্বামীর ঘরে আসলেন। এবার শুরু হল এতদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পালা। দ্বীন ও ঈমানের উপর চলার সংগ্রাম-সূচনা।
বিয়ের পর
সম্পদ আর প্রাচুর্যের মাঝে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ে কীভাবে কষ্ট আর দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করলেন, কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান আহরণের জন্য কীভাবে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন, আসবাব ও উপকরণ না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে দ্বীনের উপর অটল ও অবিচল ছিলেন, সত্যিই তা ছিল বড় বিস্ময়কর। তিনি ছিলেন তার উজ্জ্বল নমুনা। আমি তার জীবনের কয়েকটি দিক তুলে ধরছি।
শরয়ী পর্দা
এ বিষয়ে তিনি ছিলেন আপোষহীন। আগে তো বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ছিল, ছিল না হিম্মত ও সাহস; কিন্তু এখন উপায় উপকরণ তো নেই তবে রয়েছে বুকভরা হিম্মত ও মনোবল। আগে তো বিশাল বাড়ি ছিল। উঁচু দেয়াল ছিল। পর্দা করার বাহ্যিক সব আয়োজন ছিল। কিন্তু এখন তার কিছুই নেই। আছে শুধু একটি কুড়ে ঘর। রান্নাঘরও নেই, হাম্মামও সাথে নেই, তবে রয়েছে অদম্য স্পৃহা আর দৃঢ় ইচ্ছা । যেভাবেই হোক তিনি পর্দা করবেন। তাই ঠিক করলেন বাহিরের সব কাজ মধ্যরাতে করবেন আর দিনে ঘরে থাকবেন। এভাবে এগিয়ে চলল সময়। শত কষ্ট আর পরিশ্রমেও তিনি দমে যাননি। এমনকি নিজের গলার শব্দও যেন অন্যের কান পর্যন্ত না যায় সে বিষয়ে সজাগ ছিলেন।
একসময় প্রশস্ত বাড়ি হল। কষ্ট অনেক লাঘব হল। তিনিও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। তবে তিনি নিজের ঘরেই সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। বাহিরে একদম বের হতেন না। কোনো সময় বাবা-মায়ের কাছে যেতে চাইলে ফজরের আগে বের হতেন আবার মাগরিবের পর চলে আসতেন। একবার জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ছবি তুলতে গেলেন। ফেরার সময় ঘরের অনেক কাছাকাছি এসে বাবা বললেন, তুমি যাও, আমি আসছি। ঘরের কাছে এসেই তিনি বাসা হারিয়ে ফেললেন। সামনেই পরিচিত এক ছেলেকে (যাকে তিনি সকালে কুরআন শেখাতেন) দেখতে পেলেন। তাকে ডেকে বললেন, বাবা আমাদের ঘর কোন্টি। ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, দাদী এই তো আপনার ঘর। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি এ অবস্থার উপর অবিচল ছিলেন।
এবাদাত, ইলম অর্জন ও দ্বীনের দাওয়াত
বিয়ের পর তিনি ইলম অর্জনে মগ্ন হলেন। দিন-রাত শুধু কিতাবের পাতায় দৃষ্টি। ধর্মীয় যে কোনো বই সামনে এলেই তিনি তা পড়ে ফেলতেন। আর ফরয তো দূরের কথা কোনো নফল নামাযও তার কাযা হত না (আমার যতটুকু মনে আছে)। ইশরাক চাশত আওয়াবীন নামায নিয়মিত আদায়ের ইহতিমাম করতেন। প্রতিদিন ফজরের পর তিলাওয়াত করার পর ইশরাক পরে জায়নামায থেকে উঠতেন। (আমি কখনো এর ব্যতিক্রম দেখিনি) জীবনের প্রথম দিকে তিনি যে নামায ও রোযা আদায় করেননি তা কাযা করা শুরু করলেন। কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। ফজরের পর, মাগরিবের পর এবং অনেক রাত পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। জীবনের শেষ দিকে এসে কুরআনের তরজমা বোঝার চেষ্টা করেছিলেন।
নারীদের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত ও কুসংস্কারের ইসলাহ বিষয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। তার বাসায় যারা আসত তিনি তাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলতেন। তাদেরকে বোঝাতেন। কুসংস্কারের কারণে মানুষ দ্বীনকে বড় কঠিন মনে করে তাই তিনি মানুষের সামনে দ্বীনকে সহজভাবে পেশ করতেন। দান-খয়রাতের প্রতি তার ঝোঁক ছিল প্রবল। প্রতিবেশীর হকের প্রতি বেশ সচেতন ছিলেন। নিজের ঘরে ভালো রান্না হলে প্রতিবেশীদের ঘরে পাঠাতেন।
তিনি ছিলেন আমার রাহবার
ছোটবেলায় আমাদেরকে কখনো ডাইনি বুড়ির গল্প শোনাতেন না। নবীদের জীবনী, সাহাবীদের মোজাহাদা বা কোনো ঈমানদীপ্ত ঘটনা শোনাতেন। যা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে।
আমার মা ছিলেন আমার বান্ধবীর মত। আমার কোনো সমস্যা হলে আমি প্রথমে মার কাছে বলতাম। ছোট বড় সব বিষয় তার সাথে পরামর্শ করতাম। তিনি আদর করে বোঝাতেন। সুন্দর সমাধান দিতেন। সামাজিক গোনাহের সয়লাব থেকে আমাদেরকে সতর্ক করতেন। তিনি সবসময় বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। আর আমাকেও এর জন্য তাগিদ দিতেন। অশুদ্ধ কথা শুনলে রাগ করতেন। মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তাও শেখাতেন।
ছেলের বউ
পুত্রবধুর ব্যাপারে তার ছিল বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। বড় ভাইয়ের বিয়ের আগেই আমাকে এ ব্যাপারে উপদেশ দিতেন। ননদ-ভাবির কেমন সম্পর্ক হওয়া উচিত আমাকে খুলে খুলে বলতেন। তিনি বলতেন, ভাবিকে ভাবি নয় বরং নিজের বোনের মত ভাববে। (তাই আমি তাকে একবারও ভাবি ডাকিনি; বরং সবসময় আপু ডেকেছি) তার সাথে ভালো আচরণ করবে। কখনো কর্কশ ভাষায় কথা বলবে না। সে তো নিজের পরিবার রেখে আমাদের কাছে আসবে। আমরাই যদি তার সাথে খারাপ আচরণ করি তাহলে সে কেমন কষ্ট পাবে চিন্তা কর। এগুলো তো হল ভাবি আসার আগের কথা। ভাবি আসার পরে যা হয়েছে তা ছিল আমার ভাবনার অতীত। তিনি নিজের পুত্রবধুর সাথে মেয়ের মত আচরণ করলেন; বরং বললে ভুল হবে না যে, তার থেকেও বেশি। তার কাপড় নিজে ধুয়ে দিতেন। রান্নার ক্ষেত্রেও তাকে সহযোগিতা করতেন। তার মাথায় তেল মেখে দিতেন। কদাচিৎ হত এমন নয়। বরং যতদিন তিনি সুস্থ ছিলেন নিয়মিত করার চেষ্টা করতেন। কখনো তাকে ধমক দিতেন না। উল্টো আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক করতেন। আর তিনি পুত্রবধুকে নিজ বাড়িতে যেতে কখনো বারণ করতেন না; বরং অনেকসময় নিজেই তাকে বাড়ি পাঠাতেন। এতে আমার রাগ হত। আমি মাকে বলতাম, এখন তো তুমি অসুস্থ । তাকে বাড়ি পাঠালে তোমার সহযোগিতা কে করবে? তিনি বলতেন, মেয়েটা কতদিন হয়েছে বাবা মাকে দেখে না (অথচ দেখা যেত এক সপ্তাহও হয়নি)। যাক কয়েকদিন বেড়িয়ে আসুক। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিতেন না। এজন্য তার উপর আমার ঈর্ষা হত।
খুব বেশিদিন আর সুস্থ রইলেন না। সবসময় দুআ করতেন যেন তার কারণে অন্যের কষ্ট না হয়। অবশেষে নিজ রবের ডাকে সাড়া দিয়ে এ পৃথিবী ত্যগ করলেন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭-এর সেই রাতটি এখনো আমার চোখে ভাসে। আমার জীবনের নীল বেদনার স্বাক্ষী হয়ে থাকবে সেই রাতটি। আমি আমার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছি। চোখের পানি দিয়ে আমার বুক ভাসাচ্ছি।
তিনি শুধু আমার মা ছিলেন না। ছিলেন আমার শিক্ষক। ছিলেন আমার রাহবার। তিনি ছিলেন আমার আশ্রয়। ছিলেন আমার ব্যথার উপশম। শেষ মুহূর্তেও আমার হাতটি ধরে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। বিদায়ের সময়ের হাসিমাখা সেই মুখটি এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। তার মাগফিরাতের জন্য সবার কাছে দুআর দরখাস্ত করছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করেন- আমীন।