ছোট্ট সা‘দের ঈদ
ছোট্ট সা‘দ এবার মহা খুশি। কারণ আব্বু-আম্মু এই রমযানে তাকে রোযা রাখতে দিয়েছেন। এবার সে মোট ১০টা রোযা রেখেছে। আজ আব্বু বলেছিলেন, সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ উঠবে। তাই সে সকাল থেকে উদগ্রীব হয়ে আছে, কখন সন্ধ্যা হবে, কখন সে ঈদের চাঁদ দেখবে!
দেখতে দেখতে দিন ফুরিয়ে এল। ইফতারের সময় হল। আজ ইফতারের প্রতি যেন তেমন কোনো আগ্রহ নেই সা‘দের। তার সব আগ্রহ এখন ঈদের চাঁদের প্রতি। তাইতো সে কোনোরকম খেজুর আর শরবত খেয়েই বড় ভাইয়াকে নিয়ে ছাদে চলে গেল। ভাইয়াটা তার অনেক ভালো। সবসময় তাকে সঙ্গ দেয়। তার বন্ধুরাও সবাই তার সাথে ছাদে উঠল।
সবাই মিলে চাঁদ তালাশ করতে লাগল। সা‘দ তো হয়রান, পেরেশান। চাঁদটা কোথায় গেল! দেখতে পাচ্ছে না কেন! সবাই খুঁজছে। কিন্তু চাঁদটা চোখেই পড়ছে না। সবার কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কি চাঁদ উঠেনি। আগামীকাল তাহলে ঈদ হবে না। হঠাৎ ভাইয়ার চোখে পড়ল চাঁদটি। চাঁদ, চাঁদ বলে সবাইকে ডাকলেন ভাইয়া। সবাইকে চাঁদ দেখালেন। সা‘দের চাঁদ দেখতে অবশ্য বেশ বেগ পেতে হল। সুতার মতো চিকন চাঁদটা দেখা কি এত সোজা। চাঁদ দেখে সবার যে কী খুশি! কাল ঈদ, কাল ঈদ বলে পুরো ছাদ মাতিয়ে তুলল। ভাইয়া উঁচু আওয়াযে চাঁদ দেখার দুআ পড়লেন। ভাইয়ার সাথে সাথে সবাই পড়ল-
اَللّٰهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلامَةِ وَالْإِسْلاَمِ، رَبِّيْ وَرَبُّكَ اللهُ.
(মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৩৯৭; মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদীস ৬৬১; আলমুনতাখাব মিন মুসনাদি আবদ ইবনু হুমাইদ, হাদীস ১০৩; কিতাবুদ দুআ, তবারানী, হাদীস ৯০৩)
ছাদ থেকে নেমে সবাই মসজিদে গেল। জামাতের সাথে মাগরিবের নামায আদায় করল।
মাগরিবের পর আব্বুকে ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখে সা‘দ বলল, আব্বু কোথায় যাচ্ছেন? বাবা বললেন, বাজারে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ, ফেরার সময় তোমার জন্য নতুন কাপড়-জুতা নিয়ে আসব। সা‘দ তো শুনে মহা খুশি। আব্বু আমার জন্য নতুন জামা আনবে, নতুন জামা আনবে- বলে খুশিতে লাফাতে লাগল। খুশির সংবাদটা দাদুকে জানানোর জন্য এক দৌড়ে দাদুর ঘরে গেল। দাদুও শুনে খুব খুশি হলেন। তারপর বললেন, দাদুভাই, শরীফ তো তোমার খুব ভালো বন্ধু, তাই না! সা‘দ বলল, জ¦ী দাদু। ওকে আমি অনেক পছন্দ করি। আমার সবকিছু ওর সাথে ভাগাভাগি করি। দাদু তখন বললেন, তাহলে ঈদের দিন যদি এমন হয়, তোমার গায়ে নতুন কাপড় আর ওর গায়ে পুরাতন কাপড়, তখন তোমার কেমন লাগবে!
সা‘দ যেন হঠাৎ এমন প্রশ্নে থমকে গেল। কী উত্তর দিবে সে ভেবে পাচ্ছে না। তারপর বলল, কেন দাদু, ও পুরাতন কাপড় পরবে কেন! দাদু বললেন, ওর আব্বুর তো নতুন কাপড় কেনার পয়সা নেই। তাই ওর নতুন জামা হবে না। একথা শুনে সা‘দের খুব কান্না এল। দৌড়ে আব্বুর কাছে গিয়ে বলল, আব্বু নতুন জামা না পরলে কি ঈদ হবে না! ছেলের হঠাৎ এমন প্রশ্নে আব্বু তো অবাক! নিজেকে সামলে বললেন, অবশ্যই, কেন হবে না। ভালো উত্তম পোশাক দিয়েও ঈদ করা যায়। নতুন কাপড় শর্ত না। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন বাবা?
সা‘দ তখন বলল, আব্বু, শরীফ আমার কত্ত ভালো বন্ধু! ওকে ছাড়া আমি কিচ্ছু করি না। সবকিছুতে আমরা দুজন এক থাকি। কিন্তু আমি যদি নতুন জামা কিনি, তাহলে ওর সাথে এবার আমার মিল হবে না। কারণ, দাদু বললেন, ওর আব্বুর নাকি ঈদের জামা কেনার পয়সা নেই। ও তো নতুন জামা কিনতে পারবে না। তাই আমিও নতুন জামা কিনব না। আমার বন্ধুর নতুন জামা হবে না, আমিও নতুন জামা কিনব না। আমার তো কত্ত জামা। ওগুলো থেকে ভালো একটা পরব! ছেলের এমন কথা শুনে আনন্দে বুকটা ভরে গেল সা‘দের বাবার। মনে মনে বললেন, আলহামদু লিল্লাহ। খুশিতে সা‘দকে তিনি কোলে তুলে নিলেন। আদর করে কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ঠিক আছে বাবা।
বাজার থেকে ফেরার সময় তিনি সা‘দের জন্য জামা কিনলেন, সাথে শরীফের জন্যও কিনলেন। এনে রেখে দিলেন আলমারিতে।
সকাল হল, ঘুম থেকে চোখ মেলতেই সা‘দের মনে পড়ল আজ ঈদের দিন। মুহূর্তেই তার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। ঘুম থেকে ওঠার দুআ পড়ল-
الحَمْدُ لِلهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ.
ফজরের নামায পড়ে সা‘দ কুরআন তিলাওয়াত করতে বসেছে। হাঠাৎ আব্বু সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। বললেন, বাবা সা‘দ! এদিকে আসো। আব্বু সা‘দের হাতে নতুন জামা তুলে দিলেন, সাথে আরেকটা জামা। বললেন, এটা তোমার বন্ধু শরীফের জন্য। এ দেখে সা‘দ একেবারে নির্বাক হয়ে গেল। খুশিতে সে কোনো কথা বলতে পারছে না। বলল, আলহামদু লিল্লাহ। তারপর, আব্বুকে জড়িয়ে ধরে জাযাকাল্লাহ বলে দৌড় দিল শরীফদের বাসায়। সব খুলে বলল তাকে। বন্ধুর মহানুভবতায় শরীফ যারপরনাই আবেগআপ্লুত হল। তার দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
ঈদের নতুন জামা পেয়ে দুই বন্ধুর খুশি যেন আর ধরে না। পুকুরে গেল গোসল করতে। দুজনে গোসল করে ঈদের নতুন জামা পরে ভাইয়ার কাছে গেল। ভাইয়া দুজনকে আতর লাগিয়ে দিলেন। তারপর আম্মুর কাছে রান্নাঘরে গেল। রান্নাঘরের কাছে আসতেই ভেসে এল খাবারের সুবাস। দাদু তাদেরকে দেখে মুচকি হেসে বললেন, বসো দাদুভাই। সেমাই খাও। ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে যাওয়া সুন্নত।
সা‘দ একটু ভাবল, বলল, একটু আসছি দাদু! পাশের বাড়ির কামালদেরকে ডেকে আনি। ওদের বাড়িতে নিশ্চয়ই আজ সেমাই রান্না হয়নি। দাদু শুনে খুশি হলেন। তাকে অনেক দুআ দিয়ে বললেন, যাও দাদুভাই ওদেরকে নিয়ে এসে একসাথে খাও।
খাওয়া শেষ করে সবাই একসাথে ঈদগাহের দিকে চলল। দাদু বললেন, ঈদগাহে যাওয়ার সময় তাকবীর বলা সুন্নত। সবাই ঈদগাহে যেতে যেতে তাকবীর বলল-
اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، لَا إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ، وَلِلهِ الْحَمْدُ.
সা‘দের আব্বু ঈদের নামায পড়ালেন। সা‘দ যখন দূর থেকে দেখল, আব্বু মিম্বরে বসে খুতবা দিচ্ছেন, ওর তখন কী যে ভালো লাগল! আব্বুকে নিয়ে খুব গর্ব হল তার। সেও বড়দের মতো বসে পড়ল খুতবা শুনতে। তার বন্ধুরাও বসল।
আশেপাশে ছোটরা খেলা করছে, নানান জিনিস কিনছে, খাচ্ছে। ফেরিওয়ালারা বিভিন্ন খাবার, খেলনা বিক্রি করছে। সা‘দের বন্ধুরা বলল, চলো আমরাও উঠি। খুতবা শেষ হতে তো অনেক সময় লাগবে। দেখছ না, সবাই খেলছে, কত কিছু কিনছে। সা‘দেরও বসে থাকতে ভালো লাগছে, তা নয়, প্রচ- গরম। তারও কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সে ভাইয়ার দিকে তাকাল অনুমতির জন্য। সে খুব ভালো ছেলে। বড়দের অনুমতি ছাড়া কিছু করে না। তার উপর আম্মু যে বারবার বলে দিয়েছেন, ভাইয়ার কথা মতো চলতে। ভাইয়ার সাথে সাথে থাকতে।
ভাইয়া বললেন, আরেকটু সবর কর সা‘দ। খুতবা পুরোটা শুনতে হয়। তুমি না জান, যত কষ্ট তত সওয়াব। তাই যত কষ্ট করে চুপচাপ খুতবা শুনবে, তত সওয়াব পাবে। সাথে সাথে সা‘দের সব কষ্ট যেন দূর হয়ে গেল। সে ঠিক করল যত কষ্টই হোক না কেন, সে পুরো খুতবা শুনে তারপর উঠবে। তার আগে নয়। সা‘দের বন্ধুরাও তাকে দেখাদেখি তাই করল। সবাই একসাথে খুতবা শুনল।
নামায শেষে সবাই একে অন্যকে ঈদ মোবারক বলতে লাগল। ভাইয়া বললেন, আমরা ঈদ মোবারক বলি, সাহাবায়ে কেরাম কী বলতেন জানো? তাঁরা বলতেন-
تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُمْ.
(ফাতহুল বারী ২/৫১৭)
এতে সম্ভাষণ যেমন জানানো হত, দুআর ফায়েদাও হত। সাথে সাথে সওয়াবও হত। তাহলে, আমাদের ঈদ মোবারকের চেয়ে এই সম্ভাষণ বেশি উত্তম না! সা‘দের খুব ভালো লাগল সাহাবায়ে কেরামের সম্ভাষণ। বলল, এখন থেকে আমিও تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكُمْ বলব।
সা‘দদেরকে দেখে আব্বু এগিয়ে এলেন। আব্বুর সাথে অনেক লোকও আছে। কেউ সা‘দের দাদা হয়, কেউ চাচ্চু হয়, কেউ বা ভাইয়া। ওরা সবাইকে সালাম দিল। সবাই সালামের জবাব দিলেন। ওদেরকে আদর করলেন। অনেকে ঈদ-সালামীও দিলেন। আব্বুও সা‘দের ভাইয়াসহ সবাইকে ঈদ-সালামী দিলেন।
এতগুলো টাকা পেয়ে সা‘দ ভাবছে- কী কিনবে? খেলনা কিনবে, নাকি আইসক্রীম? এসব ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ল দাদুর কথা। দাদু বলেছিলেন, অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে টাকা অপচয় করা অনেক গুনাহের কাজ। কত মানুষ টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে না। আমাদের উচিত টাকা অপচয় না করে ওদেরকে সাহায্য করা। তাহলে ওদের যেমন অভাব দূর হবে, তেমনি ওদের মুখে হাসি ফোটালে আল্লাহও অনেক খুশি হবেন। বান্দাকে অনেক সওয়াব দান করবেন।
তাই সা‘দ ভাবল, এগুলো দিয়ে সে অপ্রয়োজনীয় কিছু কিনবে না। অল্প কিছু টাকা নিজের কাছে রেখে বাকি সব টাকা ওখানের কিছু গরীব শিশুদের মাঝে বিলিয়ে দিল। ওরা অনেক খুশি হল। ওদের মুখের হাসি দেখে সা‘দের খুব ভালো লাগল। তার মনে হল, এই না ঈদের আসল আনন্দ! বাকি টাকা দিয়ে নিজের জন্য একটা হাতঘড়ি আর একটা কলম কিনল। এগুলো তার পড়াশোনার কাজে লাগবে। তারপর আব্বু আর ভাইয়ার হাত ধরে বাসায় চলে এল।
ফেরার সময় আব্বু বললেন, আসার সময় আমরা এ পথ দিয়ে এসেছি। চলো আমরা ঐ পথ দিয়ে ফিরি। কারণ, এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া আর ভিন্ন পথ দিয়ে ফেরা ঈদের দিনের সুন্নত।
বিকেলে ওর খুব ইচ্ছে হল নানার বাড়িতে যেতে। কিন্তু আম্মুকে বলতেই আম্মু বললেন, বাবা, সারাদিন কাজ করে আমি ভীষণ ক্লান্ত। আজ একটু বিশ্রাম নিই। অন্যদিন যাব ইনশাআল্লাহ! আম্মুর কথা শুনে সা‘দ আর পীড়াপীড়ি করল না। কারণ, আম্মু তার অনেক প্রিয়। সে আম্মুকে কষ্ট দিতে চায় না।
আম্মুর আগে বিশ্রাম হোক। তারপর সবকিছু। কিন্তু ঘরে বসে থাকতেও যে তার ভালো লাগছে না। তাই আম্মুর অনুমতি নিয়ে সে বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলতে গেল। মাগরিবের আযান দিতেই খেলা বন্ধ করে নামায পড়ে বাসায় চলে এল। এভাবেই সা‘দের ঈদের দিন কাটল। রাতে শুয়ে শুয়ে সে সারাদিনের কথা ভাবছে। তার চোখে বারবার ভাসছিল টাকা পেয়ে গরীব বাচ্চাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো। সে মনে মনে ভাবল, শুধু আজ নয়, সবসময় সে সবার মুখে হাসি ফোটাবে।