নারী : কথার দ্বারা কষ্ট না দেই
বিশ্বব্যাপী নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত দিবসগুলোর একটি হচ্ছে- ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’। আমাদের দেশেও দিবসটি উদ্যাপিত হয়েছে বিভিন্ন বাণী, আলোচনা ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। যে কোনো দিবস উপলক্ষে সামনে আসে নানামুখী আলোচনা-পর্যালোচনা, ব্যাখ্যা ও সমীকরণ; তার সবটা গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত না হলেও কিছু কিছু বিষয় থাকে, যা মনোযোগ ও মূল্যায়নের দাবিদার। এবারের নারী দিবসে একটি প্রতিষ্ঠানের আয়োজিত অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘শব্দে জব্দ নারী’।
ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত এক গবেষণায় যে তথ্য উঠে আসে তা হচ্ছে, দেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ চালক ও চালকের সহকারী দ্বারা এবং শতকরা ৬৯ জন দোকানদার ও বিক্রেতার দ্বারা শব্দ-নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৭ মার্চ, ২০১৯)
আপাতদৃষ্টিতে শব্দ-ব্যবহারের বিষয়টি ক্ষুদ্র মনে হলেও মোটেই তা ক্ষুদ্র নয়। তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেকে বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়ে থাকেন। কে না বুঝবেন যে, বাকশক্তি মানুষের এক অনন্য শক্তি, যার দ্বারা মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। এই শক্তির দ্বারা জীবন ও সমাজের একেবারে ছোট থেকে শুরু করে বড় বড় বিষয়ও সম্পাদিত হয়ে থাকে। এই শক্তি আল্লাহ তাআলার অতি বড় দান, যে দানের কথা কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে। কাজেই এই শক্তির ব্যবহার কোনো অন্যায় কাজে কীভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে?
পৃথিবীতে কত পবিত্র কর্ম বাকশক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়। এর দ্বারা মানুষ ঈমানের কালেমা উচ্চারণ করে, আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পবিত্র বন্ধন স্থাপিত হয়, মায়ের মমতা, বাবার বাৎসল্য প্রকাশিত হয়, সত্য-ন্যায়ের বাণী উচ্চারিত হয়- এমন সব পবিত্র ও নির্মল কাজ যে শক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয় সেই শক্তিকে অন্যায়-অপবিত্র উচ্চারণে দূষিত করা কীভাবে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে?
বলা বাহুল্য হবে না যে, অন্যায়, অশালীন উচ্চারণে বাকশক্তির ব্যবহার আল্লাহপ্রদত্ত এই মহা নিআমতের না-শোকরি। কাজেই অবশ্যই এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।
প্রভাব ও ফলাফলের দিক থেকেও বাকশক্তির ব্যবহার অতি সংবেদনশীল। কথার প্রভাব পড়ে মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কে। একারণে ক্ষেত্রবিশেষে অস্ত্রের আঘাতের চেয়ে শব্দ-বাক্যের আঘাত বেশি ক্ষতিকর। অস্ত্রের আঘাতে দেহের রক্ত ঝরে, কিন্তু শব্দের আঘাতে রক্ত ঝরে হৃদয়ে। একটি আরবী পংক্তিতে বলা হয়েছে-
جراحات السنان لها الالتيام
ولا يلتام ما جرح اللسان
তীরের আঘাত একসময় শুকিয়ে যায়, কিন্তু জিহ্বার আঘাত কখনো শুকায় না।
শব্দ-বাক্যের ব্যবহার দ্বারা যেমন একজন মানুষকে ধীরে ধীরে উজ্জীবিত করে তোলা যায় তেমনি তাকে তিলে তিলে বিমর্ষ ও হতাশাগ্রস্তও করে ফেলা যায়। মনস্তত্ববিদগণ বিষয়টি তত্ত্ব ও যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবেন, কিন্তু মূল বিষয়টি সাধারণ মানবীয় বোধ দ্বারাও উপলব্ধিযোগ্য। এর বিচিত্র দৃষ্টান্ত আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও পেয়ে যেতে পারি। উপমা হিসেবে একটি ছোট ঘটনা বলছি।
আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে একজন বুযুর্গ ব্যক্তির ব্যাপারে শুনেছি যে, তার পুত্রবধু যখন তার জন্য চা বানিয়ে আনতেন তিনি সে চায়ের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। অথচ তার বানানো চা যে খুব উপাদেয় হত এমন নয়। কাঁচা হাতের বানানো চায়ের স্বাদ কাঁচাই হত। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল, সত্যি সত্যি তার চায়ের স্বাদ অপূর্ব। কীভাবে এই পরিবর্তন এল? এটা কি কোনো যাদু-মন্ত্রের জোরে হয়েছে? না। এটা হয়েছে প্রশংসায় উজ্জীবিত মেয়েটির আরো চেষ্টা ও যতেœর দ্বারা। পাঠক নিশ্চয়ই বিষয়টির মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারছেন।
এর বিপরীতে সম্ভাবনাময় অনেক জীবনকে শুধু কথা বলে বলে হতাশাগ্রস্ত করার দৃষ্টান্তও আমাদের সমাজে-পরিবারে একেবারে দুর্লভ নয়।
আমাদের বৃহৎ পরিবার অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রে তো বটেই, ছোট পরিবারগুলোতেও কথা-বার্তায় শালীন ও সংযত হওয়ার চর্চা করা প্রয়োজন। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর ভদ্র ভাষায় কথা বলা, ছেলে-মেয়েকে স্নেহের সাথে সম্বোধন করা, বউ-শাশুড়ি, ননদ-ভাবীর মধ্যে স্নেহ ও শ্রদ্ধা, ভদ্রতা ও শালীনতার প্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়।
কথা শুধু মনের ভাবই প্রকাশ করে না, স্বভাব-চরিত্রেরও পরিচয় দান করে। কথার মধ্য দিয়ে যেমন প্রকাশিত হয় মানুষের সদগুণাবলি তেমনি প্রকাশিত হয় ক্ষুদ্রতা ও সীমাবদ্ধতাগুলোও। কথার মধ্যেই ফুটে ওঠে মানুষের রুচি, ভদ্রতা, সৌজন্য, মমতা, প্রীতি ও বাৎসল্য। তেমনি কথার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়ে পড়ে রুক্ষতা, হিংস্রতা, নির্বুদ্ধিতা ও পরশ্রীকাতরতার মতো ঘৃণ্য স্বভাবগুলোও।
বস্তুত মুখের ভাষা আর স্বভাব-চরিত্র একটি অপরটির সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। আর তাই ভাষার সংশোধনের জন্যে যেমন স্বভাব-চরিত্রের সংশোধন জরুরি তেমনি স্বভাব-চরিত্রের সংশোধনের জন্যও জরুরি মুখের ভাষার সংশোধন।
কুরআন মাজীদে যবানের ব্যবহার সম্পর্কে অনেক বিধান দেওয়া হয়েছে। মুসলিমমাত্রেরই কর্তব্য, সেই বিধানগুলো জানা এবং পালন করার চেষ্টা করা। সূরা হুজুরাতের (৪৯) ১১-১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا یَسْخَرْ قَوْمٌ مِّنْ قَوْمٍ عَسٰۤی اَنْ یَّكُوْنُوْا خَیْرًا مِّنْهُمْ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنْ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنْ یَّكُنَّ خَیْرًا مِّنْهُنَّ، وَ لَا تَلْمِزُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ لَا تَنَابَزُوْا بِالْاَلْقَابِ، بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوْقُ بَعْدَ الْاِیْمَانِ، وَ مَنْ لَّمْ یَتُبْ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الظّٰلِمُوْنَ.
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِیْرًا مِّنَ الظَّنِّ، اِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ اِثْمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوْا وَ لَا یَغْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضًا، اَیُحِبُّ اَحَدُكُمْ اَنْ یَّاْكُلَ لَحْمَ اَخِیْهِ مَیْتًا فَكَرِهْتُمُوْهُ ، وَ اتَّقُوا اللهَ ، اِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَّحِیْمٌ.
হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে। কারণ, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। এবং কোনো নারী যেন অপর কোনো নারীকে উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; (এতে তোমরা ফাসিক নামে আখ্যায়িত হবে।) আর ঈমানের পর ফাসিক উপাধী কতই না মন্দ। যারা তওবা না করে তারাই যালিম।
হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। (সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১১-১২)
যখন সাধারণ অবস্থায় সব সময়ের জন্যেই এই বিধান তখন মা-বোনকে কষ্ট দেওয়া তাদের সম্মানহানী ঘটানো কত বড় অপরাধ তা তো বলাই বাহুল্য।
কুরআন মাজীদের এই বিধানগুলো আমাদের পালন করা প্রয়োজন। এর অনুশীলন শুরু করতে হবে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক জীবন থেকে। তাহলে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কও হয়ে উঠবে শান্তি ও স্বস্তিপূর্ণ। এরপর সমাজ-জীবনেও তা অনুসরণ করা আমাদের জন্য সহজ হবে। সমাজ-জীবনের জন্যও কুরআন-সুন্নাহয় রয়েছে যথার্থ নির্দেশনা।
যে গবেষণা-তথ্য থেকে কথা শুরু করেছিলাম অর্থাৎ চলার পথে নারীদের নানাভাবে শব্দ-নির্যাতনের শিকার হওয়া- দেখুন হাদীস শরীফে বিশেষভাবে এই জাতীয় অনাচার থেকে মুক্ত থাকার বিধান কত স্পষ্ট ভাষায় দেওয়া হয়েছে।
এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
إِيّاكُمْ وَالجُلُوسَ بِالطّرُقَاتِ فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، مَا لَنَا مِنْ مَجَالِسِنَا بُدّ نَتَحَدّثُ فِيهَا، فَقَالَ: إِذْ أَبَيْتُمْ إِلّا المَجْلِسَ، فَأَعْطُوا الطّرِيقَ حَقّهُ، قَالُوا: وَمَا حَقّ الطّرِيقِ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: غَضّ البَصَرِ، وَكَفّ الأَذَى، وَرَدّ السّلاَمِ، وَالأَمْرُ بِالْمَعْرُوفِ، وَالنّهْيُ عَنِ المُنْكَرِ.
তোমরা রাস্তা-ঘাটে বসা ছেড়ে দাও। সাহাবায়ে কেরাম নিবেদন করলেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের তো কথাবার্তার জন্য বসতেই হয়। তিনি বললেন, যখন বসতেই হয় তাহলে পথের হক আদায় করবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর রাসূল! পথের হক কী? তিনি বললেন, দৃষ্টি অবনত রাখা, কষ্টদান থেকে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, ভালো কাজের আদেশ করা এবং মন্দ কাজে বাধা দেওয়া।
-সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২২৯
তো রাস্তায় যারা থাকবে তাদের অবশ্যকর্তব্য নজরের হেফাযত করা এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা।
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার প্রচার ও প্রয়োগ সঠিকভাবে না থাকার ফলেই আমাদের জীবনের নানা অঙ্গনে অশান্তি নেমে এসেছে। আমরা যদি শান্তি চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই ফিরে আসতে হবে কুরআন-সুন্নাহর দিকেই। এর মাধ্যমেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পাবেন শান্তি, ফিরে পাবেন নিজ নিজ অধিকার।