Shaban-Ramadan 1440   ||   April-May 2019

আদরের মেয়ে : দুনিয়ার পূর্ণতা আর পরকালের মুক্তির পয়গাম

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় দুলালী হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। নবীজীর চার মেয়ের মধ্যে বয়সে তিনি ছিলেন সবার ছোট। আবার মেয়েদের সকলেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেন। ব্যতিক্রম কেবলই হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তাই আদরের মেয়েদের প্রতি মনে কী পরিমাণ ভালোবাসা ও মমতা পুষতেন প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তার নমুনা আমরা সবচেয়ে বেশি লক্ষ করি হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার সঙ্গে তাঁর আচরণে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর বর্ণনা-

مَا رَأَيْتُ أَحَدًا كَانَ أَشْبَهَ حَدِيثًا وَكَلاَمًا بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ فَاطِمَةَ، وَكَانَتْ إِذَا دَخَلَتْ عَلَيْهِ قَامَ إِلَيْهَا، فَرَحّبَ بِهَا وَقَبّلَهَا، وَأَجْلَسَهَا فِي مَجْلِسِهِ، وَكَانَ إِذَا دَخَلَ عَلَيْهَا قَامَتْ إِلَيْهِ فَأَخَذَتْ بِيَدِهِ ، فَرَحّبَتْ بِهِ وَقَبّلَتْهُ، وَأَجْلَسَتْهُ فِي مَجْلِسِهَا.

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কথাবার্তায় ফাতেমার চেয়ে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকেই দেখিনি। সে যখন তাঁর কাছে আসত তখন তিনি উঠে দাঁড়াতেন, তাকে স্বাগত জানাতেন, চুমো খেতেন এবং নিজের আসনে তাকে বসাতেন। আবার যখন তিনি ফাতেমার কাছে যেতেন তখন সেও তাঁর জন্যে উঠে দাঁড়াত, তাঁর হাত ধরত, তাঁকে স্বাগত জানাত, চুমো খেত এবং নিজের আসনে তাঁকে বসাত। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৯৭১

হযরত উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহা। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাতনী। তিনি যখন শিশু, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন তাকে কাঁধে চড়িয়ে মসজিদে চলে এলেন। এরপর এভাবেই নামাযে দাঁড়ালেন। দাঁড়ানো থেকে যখন রুকুতে যাবেন তখন তাকে নামিয়ে নিলেন। এরপর দাঁড়িয়ে আবার তাকে কাঁধে চড়ালেন। এভাবেই তিনি পুরো নামায শেষ করলেন। -সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৭১১

শুধুই নিজের মেয়ে আর নাতনীদের নিয়ে নয়, এমন আদর আর ¯েœহের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে অন্য সাহাবীদের মেয়েদের ক্ষেত্রেও। একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু কাপড় এল। এর মধ্যে একটি ছোট কালো কাপড়ও ছিল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবীদের লক্ষ করে বললেন, এই কাপড়টি আমরা কাকে পরাতে পারি-বল দেখি! সকলেই চুপ করে রইল। এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা উম্মে খালেদকে আমার কাছে নিয়ে আস। তাকে তখন কোলে করে নিয়ে আসা হল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই কাপড়টি হাতে নিয়ে তাকে পরিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, أَبْلِي وَأَخْلِقِي অর্থাৎ তুমি তা পরে পুরনো করে ফেলো! কাপড়টিতে কিছু বিশেষ চিহ্ন ছিল। সেগুলো দেখিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দেখো, কী চমৎকার! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮২৩, ৫৮৪৫

হাদীসের কিতাবে, সীরাতের গ্রন্থাবলিতে এমন ঘটনা আরও অনেক বর্ণিত হয়েছে। মেয়েশিশুদের তিনি খুবই আদর করতেন। অবশ্য ছেলেরাও তাঁর এ অকৃত্রিম স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতো না। প্রিয় নাতিদ্বয় হযরত হাসান এবং হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে নিয়ে তো কত ঘটনা ছড়িয়ে আছে! কতভাবে তাদের আদর করেছেন! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছেলে ইবরাহীম রা. যখন দুগ্ধপোষ্য শিশু, ধাত্রীমায়ের কাছে থাকে, তখন ছেলেকে তিনি দেখতে যেতেন বলেও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ছেলের মৃত্যুতে তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রুও ঝরেছে। আসলে এসবই মানুষের স্বভাবজাত, অকৃত্রিম। নিজের ঔরসজাত ছেলেমেয়ের প্রতি, তাদের সন্তানাদি তথা নাতি-নাতনীর প্রতি মানুষমাত্রই অনুভব করে এক অকৃত্রিম টান, নিখাঁদ ভালোবাসা। এর কোনো তুলনা হয় না, এটা অমূল্য। মানবজীবনের এ স্বাভাবিক দিকটির ওপর পবিত্র কুরআনে এভাবে আলোকপাত করা হয়েছে-

زُیِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوٰتِ مِنَ النِّسَآءِ وَ الْبَنِیْنَ وَ الْقَنَاطِیْرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَ الْفِضَّةِ وَ الْخَیْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَ الْاَنْعَامِ وَ الْحَرْثِ ذٰلِكَ مَتَاعُ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا .

মানুষের জন্যে সুশোভিত করা হয়েছে চিত্তাকর্ষক বস্তুর আকর্ষণ, যেমন নারী, সন্তানাদি, পুঞ্জীভূত রাশি রাশি স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু আর ক্ষেতখামার। এসব পার্থিব জীবনের ভোগসামগ্রী। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৪

সন্তানকে দেখে বাবা-মায়ের চোখ জুড়ায়। তার যে কোনো সফলতা কিছু সময়ের জন্যে হলেও বাবা-মায়ের কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়। এর ব্যত্যয় যেন না ঘটে, পবিত্র কুরআনে তাই দুআ শিখিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের-

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّةَ اَعْیُنٍ وَّ اجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِیْنَ اِمَامًا.

হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের নয়নপ্রীতিকর; আর আমাদেরকে আপনি মুত্তাকিদের প্রধান করে দিন। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৪

নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে হলেও মানুষ সন্তানের জীবন রক্ষা করতে চায়। সন্তানের সুখময় ভবিষ্যতের চিন্তায় নিজের বর্তমানের সুখকেও ভুলে থাকতে চায়। সন্তানের প্রতি ভালবাসা এমনই। ছেলে-মেয়ে এখানে সমান। দুজনই সন্তান এবং বাবার হৃদয়ের ভালবাসা উভয়ে সমানভাবেই দখল করে নেয়। মেয়েশিশুদের মতো স্বাভাবিকভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেলেশিশুদেরও ভালবেসেছেন, আদর করেছেন, কোলে তুলে নিয়েছেন। তবে মানুষের স্বভাবজাত এ আকর্ষণের পাশাপাশি মেয়েশিশুদের লালনপালন, তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ, তাদের জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যে ফযিলত বর্ণনা করেছেন, সেখানে মেয়েরা অনন্য। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়েদের ভরণপোষণের জন্যে কোথাও বেহেশতের ওয়াদা করেছেন, কোথাও তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ কিংবা লালনপালনের জন্যে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির কথা বলেছেন। লক্ষ করুন-

مَنْ كُنّ لَهُ ثَلَاثُ بَنَاتٍ يُؤْوِيهِنّ، وَيَرْحَمُهُنّ، وَيَكْفُلُهُنّ، وَجَبَتْ لَهُ الْجَنّةُ الْبَتّةَ "، قَالَ: قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ: فَإِنْ كَانَتْ اثْنَتَيْنِ؟ قَالَ: " وَإِنْ كَانَتْ اثْنَتَيْنِ "، قَالَ: فَرَأَى بَعْضُ الْقَوْمِ، أَنْ لَوْ قَالُوا لَهُ وَاحِدَةً، لَقَالَ: " وَاحِدَةً ".

যার তিনজন কন্যা সন্তান হবে আর সে তাদের আবাসের ব্যবস্থা করবে, তাদের প্রতি মমতা প্রদর্শন করবে এবং তাদের ভার বহন করবে, তার জান্নাত নিশ্চিত। জিজ্ঞেস করা হল-ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি দুইজন হয়? বললেন, দুইজন হলেও। বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণের কারও কারও ধারণা-‘যদি কেউ বলত একজন হলে? তাহলে নবীজী বলতেন, একজন হলেও।’ -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪২৪৭; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৩৪৬

আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لاَ يَكُونُ لأَحَدِكُمْ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ فَيُحْسِنُ إِلَيْهِنّ إِلاّ دَخَلَ الجَنّة.

তোমাদের কারও যদি তিনটি মেয়ে কিংবা তিনজন বোন থাকে আর সে তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করে, তাহলে সে জান্নাতে যাবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১২

مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ أَوْ ابْنَتَانِ أَوْ أُخْتَانِ فَأَحْسَنَ صُحْبَتَهُنّ وَاتّقَى اللهَ فِيهِنّ فَلَهُ الجَنّةُ.

যার তিনটি মেয়ে কিংবা তিনজন বোন রয়েছে, অথবা দুইটি মেয়ে কিংবা দুইজন বোন রয়েছে আর তাদের সঙ্গে সে ভালো ব্যবহার করেছে এবং তাদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করেছে তাহলে তার জন্যে রয়েছে জান্নাত! -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৬

مَنْ ابْتُلِيَ بِشَيْءٍ مِنَ البَنَاتِ فَصَبَرَ عَلَيْهِنّ كُنّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النّار.

মেয়েদের লালনপালনের দায়িত্ব যার কাঁধে অর্পিত হয় আর তাদের বিষয়ে সে ধৈর্যধারণ করে তাহলে তারা তার জন্যে জাহান্নামের আগুন থেকে আড়াল হয়ে থাকবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৩

এই হল মেয়েশিশুকে লালনপালন করে তার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করে তাকে সঠিক দীক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার পুরস্কার-বেহেশতের নিআমত লাভ আর দোজখের আগুন থেকে মুক্তি! একজন পরকাল-বিশ্বাসী মুমিনের জন্যে এর চেয়ে বড় কোনো পুরস্কারের আর দরকার হয় না। কিন্তু হাদীস শরীফে মেয়ের অভিভাবকের জন্যে ঘোষিত হয়েছে এর চেয়েও বড় এক পুরস্কার! পড়–ন-

مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ دَخَلْتُ أَنَا وَهُوَ الجَنّةَ كَهَاتَيْنِ، وَأَشَارَ بِأصْبعَيْهِ.

যে দুটি মেয়েশিশুকে দেখাশোনা করল, লালনপালন করল, আমি এবং সে এভাবে জান্নাতে প্রবেশ করব। একথা বলে তিনি হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়েছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৪

পরকালে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ লাভ করা-একজন নবীপ্রেমিক এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করতে পারে! মেয়েরা তাই বাবা-মায়ের জান্নাত লাভের মাধ্যম, জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির মাধ্যম এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ লাভের মাধ্যম। এরা পরকালীন মুক্তির পয়গাম। এ মর্যাদা ও ফযিলত এককভাবে মেয়েদেরই, ছেলেদের ভরণপোষণে এমন কোনো অঙ্গীকার নেই। হাঁ, সন্তান যদি নেককার হয়, তাহলে তো তার দুআর ফল মৃত্যুর পর কবরে থেকেও ভোগ করা যাবে, সে ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কালে যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এ ফযিলতের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তা মোটেও এর অনুকূল ছিল না। বাবারা মেয়েশিশুকে নিজের জন্যে খুবই অপমানের বিষয় মনে করত। একটা সময় এসে তারা নিজহাতে নিজের মেয়েদের জীবন্ত দাফন করতে শুরু করল। পবিত্র কুরআনের একটি বর্ণনা-

وَ اِذَا بُشِّرَ اَحَدُهُمْ بِالْاُنْثٰی ظَلَّ وَجْهُهٗ مُسْوَدًّا وَّ هُوَ كَظِیْمٌ،  یَتَوَارٰی مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوْٓءِ مَا بُشِّرَ بِهٖ، اَیُمْسِكُهٗ عَلٰی هُوْنٍ اَمْ یَدُسُّهٗ فِی التُّرَابِ، اَلَا سَآءَ مَا یَحْكُمُوْنَ.

তাদের কাউকে যখন মেয়েশিশুর সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়, তার গøানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে-হীনতা সত্তে¡ও তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা কত নিকৃষ্ট! -সূরা নাহল (১৬) : ৫৮-৫৯

খোলা চোখে ছেলেসন্তানকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। এদের মাধ্যমে বংশধারা টিকে থাকবে, এরা বুড়ো বয়সে পাশে থাকবে, দুনিয়ার জীবনে এরা হবে একটা আশ্রয় ইত্যাদি চিন্তা মানুষ করে থাকে। কিন্তু ভবিষ্যতে আসলেই যে কী হবে-তা তো একমাত্র আলিমুল গায়েব আল্লাহ তাআলাই জানেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের মা হযরত মারইয়াম রা.। মারইয়ামের জন্মের আগেই তার মা মান্নত করেছিলেন-সন্তান জন্মের পর তাকে বাইতুল মুকাদ্দাসের খেদমতে নিয়োজিত করবেন। তার ধারণা ছিল-তিনি ছেলেসন্তান জন্ম দেবেন। কিন্তু তিনি যখন এক মেয়েসন্তান প্রসব করলেন তখন কিছুটা হতাশার সুরে বলেছিলেন-হায়! আমি তো এক মেয়ে জন্ম দিলাম! মেয়েরা মসজিদের খেদমতের জন্যে উপযুক্ত নয়। আল্লাহ তাআলা তখন তাকে বলেছিলেন-

وَ لَیْسَ الذَّكَرُ كَالْاُنْثٰی.

ছেলে তো মেয়ের মতো নয়। [সূরা আলে ইমরান, ৩৬ নং আয়াত দ্রষ্টব্য]

অর্থাৎ যে ছেলে তুমি চেয়েছিলে, সে ছেলে মর্যাদায় তোমাকে যে মেয়ে দান করা হয়েছে তার সমস্তরে পৌঁছতে পারবে না। তাই আর ভাবনা কীসের! পরবর্তীতে কী হয়েছে তা তো আমাদের জানা-ই। এই মেয়েকে আল্লাহ তাঁর কুদরতের এক নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছেন। কোনো পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়াই তার গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন নবী হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম!

মেয়েশিশুদেরকে নিয়ে সেকালের পাষণ্ডতার একটি উদ্ধৃতি দিই। এক সাহাবী ইসলাম গ্রহণ করার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে নিজের ঘটনা শুনিয়েছেন। তার ভাষ্য-আমার যখনই কোনো মেয়েশিশু জন্ম নিত আমি তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতাম। একবার আমি সফরে ছিলাম। তখন আমার এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার মা তাকে বাড়িতে না রেখে তার মামাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আমি যখন সফর থেকে ফিরে আসি তখন সন্তানের খবর নিই। সে আমাকে বলল-আমাদের এক মৃত শিশু জন্ম নেয়। এভাবে অনেক দিন কেটে যায়। আমার মেয়েটি তার মামার বাড়িতেই বড় হতে থাকে। একদিন সে তার মাকে দেখতে আসে। তার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হই। পরে আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি-সে আমারই মেয়ে। এরপর আমি তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। তার জন্যে মাটিতে একটি গর্ত খুঁড়ি। তাকে সেখানে ফেলে দিই। সে আমার কাছে জানতে চায়-বাবা, তুমি আমাকে কী করবে? আমি তার উপর মাটি ফেলতে থাকি আর সে বলতে থাকে-বাবা, তুমি কি আমাকে মাটিচাপা দিচ্ছ? আমাকে একাকী ছেড়ে দাও, আমি অন্য কোথাও চলে যাই। কিন্তু তার কোনো কথা না শুনে আমি তার উপর মাটি ফেলতেই থাকি, একপর্যায়ে তার সব আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যায়। এ বিবরণ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, এ তো নির্ঘাত এক পাষণ্ডতা! যে দয়া করে না, তাকেও দয়া করা হবে না! (আলওয়াফী বিল ওয়াফায়াত, কায়েস ইবনে আসেম এর জীবনী দ্রষ্টব্য)

এই পরিস্থিতি যখন সমাজে বিরাজ করছিল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়েশিশুদের ভরণ-পোষণের এমন অতুলনীয় ফযিলতের কথা ঘোষণা করেছেন। এর পাশাপাশি সুস্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছিল নারীদের বিভিন্ন অধিকারের কথাও। অথচ তখনকার সমাজে নারীদের কোনো অধিকার তো নয়ই, বরং তাদের মানুষ হিসেবেও স্বীকৃতি ছিল না।

প্রায় দেড় হাজার বছর আগের অন্ধকার পৃথিবীতে আলো জ্বালিয়েছিলেন প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অথচ এই আধুনিক যুগেও আমরা সেই অন্ধকারেই যেন ঘুরপাক খাচ্ছি। খুব ব্যাপকাকারে না হলেও, সমাজের মানুষের চোখে মেয়েশিশু ততটা কাক্সিক্ষত নয়। যদি কোনো নারীর পরপর দুটি মেয়েসন্তান হয় কিংবা ছেলেসন্তান কারও না-ই থাকে, অনেকের চোখে সে নিন্দার পাত্রে পরিণত হয়। মায়েরা ভয়ে থাকে-তাদেরকে কখন আবার কী শুনতে হয়! মেয়েশিশুর জন্মের সংবাদ কারও কারও জন্যে কোনো আনন্দই বয়ে আনে না, আবার কারও জন্যে তা হয়ে পড়ে কষ্টের বিষয়-ঠিক জাহেলি যুগের মতো! জীবন্ত পুঁতে ফেলার রেওয়াজ যদিও এখন নেই, কিন্তু মেয়েশিশুর প্রতি মানসিকতা যেন সেই অন্ধকার যুগের মতোই! তবে ব্যতিক্রমও আছে। আমাদের সমাজে যাদের কেবলই ছেলে, তাদের অনেককেই একটি মেয়েশিশুর জন্যে আক্ষেপ করতে দেখা যায়। মেয়েদের ছাড়া যেন সংসারের পূর্ণতা আসে না!

এ কথা তো অনস্বীকার্য-বাবা কিংবা মা, তাদের একজনের অনুপস্থিতিতে পরিবারে যেমন একধরনের শূন্যতা নেমে আসে, তেমনি ভাইকে ছাড়া বোন এবং বোনকে ছাড়া ভাইও একধরনের শূন্যতা অনুভব করে।

সন্তানাদি আমাদের পরিবারের প্রদীপ। এ প্রদীপ দুনিয়াতে জীবনকে আলোকিত করে রাখে। আবার পরকালের সফরেও এরা ‘পাথেয়’। তবে কোনো পরিবারে সন্তান যদি ছেলেও থাকে, মেয়েও থাকে, কেমন যেন আমরা সে পরিবারকে একরকমের পূর্ণ পরিবার মনে করি। ছেলে-মেয়ে উভয় প্রকারের সন্তানের প্রতি আকর্ষণ তাই মানুষের এক স্বভাবজাত বিষয়। কিন্তু আমরা সকলেই এ বিশ্বাসও করি-সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে, এ নিয়ে বাবার কিংবা মায়ের কিছুই করার নেই। এটা সম্পূর্ণই আল্লাহ তাআলার ইচ্ছানুসারে হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ বিষয়টিই স্পষ্ট করে দিয়েছেন :

لِلهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ  یَخْلُقُ مَا یَشَآءُ،  یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ الذُّكُوْرَ، اَوْ یُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّ اِنَاثًا،  وَ یَجْعَلُ مَنْ یَّشَآءُ عَقِیْمًا، اِنَّهٗ عَلِیْمٌ قَدِیْرٌ.

আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা তিনি কন্যাসন্তান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা দান করেন পুত্রসন্তান। অথবা দান করেন পুত্র-কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তিনি বন্ধ্যা করে রাখেন। তিনি সর্বজ্ঞ, শক্তিমান। -সূরা শূরা (৪২) : ৪৯-৫০

একজন আল্লাহ-বিশ্বাসী মুমিন হিসেবে চিন্তা-চেতনায় এবং কাজে-কর্মে এ বাণীর প্রতি পূর্ণ আস্থা আমাদের রাখতেই হবে।

 

advertisement