ইজতিমা : আল্লাহুম্মা লাকাল হামদ্ ওয়ালাকাশ শুকর!
অবশেষে আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবানীতে সুসম্পন্ন হয়েছে এবারের ৫৪ তম টঙ্গির ইজতিমা। শনিবার বেলা এগারটায় আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে ইজতিমা সমাপ্ত হয়। অন্যান্য বছরের ইজতিমার তুলনায় এবারের ইজতিমায় উপস্থিতি কম ছিল না; বরং প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের অনুভূতি- উপস্থিতি ছিল অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার জুমার জামাত ছিল স্মরণকালের অন্যতম বৃহত্তম জামাত। সাম্প্রতিক নানা পরিস্থিতির কারণে ১৬ ফেব্রুয়ারির আখেরী মুনাজাতও ছিল গভীর আবেগ ও রোনাজারিতে পূর্ণ। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় যেখানে ইজতিমা-অনুষ্ঠিত হওয়াই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল সেখানে এভাবে ব্যাপক উপস্থিতির পাশাপাশি শান্তি-শৃঙ্খলা, দাওয়াতের কাজের সহীহ রাহনুমায়ী, আল্লাহমুখিতা ও আল্লাহর দরবারে রোনাযারির মধ্য দিয়ে ইজতিমা সম্পন্ন হওয়া, আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলার কাছে মাকবূলিয়ত এবং তাঁর খাস মেহেরবানী ও তাওফীকেরই ফল।
দ্বীনী মূল্যায়নের মূল মানদ- হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহ। আর যুগে যুগে কুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী জামাতটির নাম ও পরিচয় হাদীস শরীফের ঘোষণার আলোকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’। কাজেই কিয়ামত পর্যন্তের জন্য মূল্যায়নের মানদ- এটিই যে, যে কাজ কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হবে এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মাসলাক অনুসারে হবে তা-ই সহীহ। আর যে কাজ বা যাদের কাজ কুরআন-সুন্নাহর মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবে না, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর চিন্তা-চেতনা, কর্ম ও আচরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না তা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত। যে বা যারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর চেতনা ও কর্ম থেকে যত দূরে সরবে সে এবং তারা তত বড় ভ্রান্তি ও গোমরাহীর শিকার বলে চিহ্নিত হবে।
আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী যে, তাবলীগ-জামাআতের বর্তমান বিবাদ-বিসংবাদে কারা সঠিক দ্বীনী পথে রয়েছেন তা দ্বীনী ইলমের ধারক-বাহক উলামায়ে কেরাম দলীল-প্রমাণের আলোকে সুস্পষ্টভাবে জাতিকে জানিয়ে তাদের দ্বীনী কর্তব্য পালন করেছেন।
নীতিগতভাবে ও দালীলিকভাবে ন্যায় ও সত্য প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি এতাতী নামে পরিচিত লোকদের নিজেদের কর্মকা-ের মাধ্যমেও তাদের বিপথগামিতা উন্মোচিত হয়েছে। গত বছরের ১লা ডিসেম্বর টঙ্গির ময়দানে বাইরে থেকে এসে ভিতরে অবস্থানরত উলামা-তলাবা ও তাবলীগের সাথীদের উপর নৃশংস হামলার ঘটনাটি তাদের চেতনা-বিশ্বাস এবং স্বভাব ও কর্মের কদর্যতা তো ন্যক্কারজনকভাবে উন্মোচিত করে দিয়েছে। কাজেই কারা এখন হকের পথে আর কারা বাতিলের পথে তা একেবারেই স্পষ্ট।
শরয়ী মানদ-ে হকপন্থীদের পরিচয় স্পষ্ট হওয়ার পর যখন তারা সকলে মিলে ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই মোবারক ইজতিমাটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন তখন একে হকপন্থীদের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবেই মূল্যায়ন করতে হবে এবং আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারি করতে হবে। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে এই ইজতিমায় অন্যান্য মুরব্বীদের পাশাপাশি হযরত মাওলানা ইবরাহীম দেওলা ছাহেব ও হযরত মাওলানা আহমদ লাট ছাহেবও ছিলেন।
আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারির এক উপায়- সর্ব সাধারণের মাঝে দ্বীনী চেতনা ও জাগরণ তৈরির এই কাজটিকে পূর্ববর্তী হক্কানী বুযুর্গানে দ্বীনের সঠিক পথ ও পন্থার উপর ধরে রাখা এবং চিন্তা ও কর্ম কোনো দিক থেকেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মাসলাক থেকে বিচ্যুত হতে না দেয়া।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই মেহনতের সাথে উলামায়ে কেরামের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা যেমন অতি প্রয়োজন ছিল তেমনি এর সুফলও আল্লাহর রহমতে স্পষ্ট। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, উলামায়ে কেরামের খিদমতের অন্যতম প্রধান অঙ্গন তা‘লীম ও তাদরীস। এই অঙ্গনটি অন্য সকল দ্বীনী মেহনতের প্রাণস্বরূপ। কাজেই ঐ অঙ্গনের খিদমতের ক্ষেত্রেও উলামায়ে কেরামের সহযোগী হওয়া প্রয়োজন। যাতে উভয় অঙ্গনের কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যেতে পারে। এর একটি উপায় এই হতে পারে যে, আমাদের যোগ্য ফারেগীনের একটি জামাত দাওয়াত ও তাবলীগের এই মেহনতের জন্যে নিজেদেরকে ফারিগ করবেন এবং এই মেহনতকেই জীবনের মূল দ্বীনী কাজ হিসেবে গ্রহণ করবেন। তখন একদিকে যেমন এই মেহনতের গুরুত্বপূর্ণ তাকাযাগুলো তাদের মাধ্যমে পূরণ হতে পারবে অন্যদিকে উলামায়ে কেরামের যে জামাত মৌলিকভাবে তালীম ও তাদরীসের খিদমতে নিয়োজিত তাঁরাও তাদের মূল কাজে একাগ্রতার সাথে নিয়োজিত থাকতে পারবেন। অন্যদিকে দাওয়াত ও তাবলীগের এই মেহনতটিও উলামায়ে কেরামের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুফল ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে না। মোটকথা এই বরকতময় মেহনতের সংরক্ষণ ও বিস্তারে আগের চেয়ে বেশি চিন্তাশীলতা ও তৎপরতা সময়ের দাবি।
বর্তমান ইজতিমা থেকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে যেমন সুস্পষ্ট হয়েছে যে, দাওয়াত ও তাবলীগের মূল ধারা কোন্টি তেমনি অনেক প্রচার-প্রচারণা ও মিথ্যাচারেরও জবাব হয়েছে। মাওলানা সা‘দ সাহেব ছাড়াও যে ইজতিমা-তাবলীগ চলতে পারে- এই স্পষ্ট বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে এই ইজতিমায়। দেশের সর্বস্তরের হক্কানী উলামায়ে কেরামই শুধু নন গোটা দেশের তাবলীগের সাথীরাও যে দাওয়াত ও তাবলীগের মূল ধারা ও সঠিক ধারার সাথেই তা-ও সবাই চাক্ষুস দেখতে পেয়েছেন।
দেশের যেসব সরলপ্রাণ তাবলীগের সাথী বুঝে না বুঝে রবিবার থেকে ইজতিমার মাঠে জমায়েত হয়েছিলেন তারা তো নিজেরাই প্রত্যক্ষ করেছেন মাঠের পরিস্থিতি। ওখানে তো নামাযের কাতারের ইত্তিসাল রক্ষার জন্য তাদেরকে খিত্তাওয়ারী অবস্থান ত্যাগ করে মিম্বরের কাছে এসে জামায়েত হতে হয়েছে। তাছাড়া ঐ জমায়েতে বয়ান ও অনুবাদে কারা ছিলেন আর শুক্রবার-শনিবারের ইজিতমায় বয়ান-অনুবাদে কারা ছিলেন। তারা কি একটুও উপলব্ধি করছেন না, কোত্থেকে কোথায় তারা নেমে এসেছেন? দেশের হক্কানী উলামায়ে কেরাম ও সিংহভাগ তাবলীগের সাথীদের বিপরীতে তারা যে বিচ্যুতি ও বিচ্ছিন্নতার পথে চলেছেন তার একটি প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত ছিল ইজতিমার ময়দানে রবিবারের জমায়েত। বিষয়টি নিয়ে তাদের একান্তে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন।
এতাআতী নামে পরিচিত জামাতটির মুখপত্র পর্যায়ের একজন ব্যক্তি প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘উভয় দলের আদর্শ ভিন্ন।’ এখন এই জামাতের বন্ধুদের চিন্তা করা উচিত, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর চিন্তা ও বিশ্বাস লালনকারী এবং বিপরীত চিন্তা-চেতনার খ-নকারী হক্কানী উলামায়ে কেরামের বিপরীত আদর্শ অবলম্বন করে তারা কি হকপন্থী থাকছেন, না আদর্শিকভাবে বিচ্যুত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন?
মুসলিম হিসেবে সবার কর্তব্য, আল্লাহকে ভয় করা, আখিরাতের জবাবদিহিতাকে ভয় করা। আর সেজন্যই দরকার সত্য-ন্যায়ের পথে অটল-অবিচল থাকা এবং সত্যকে বোঝার জন্য আল্লাহ তাআলা যেসকল দলীল ও দৃষ্টান্ত উন্মোচিত করেন সেগুলো থেকে সত্যকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা। সর্বোপরি আল্লাহর কাছে হেদায়েতের প্রত্যাশা ও প্রার্থনা করা। আল্লাহ তাআলা সকলকে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করুন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেই পথেই অটল-অবিচল রাখুন, আমীন।