Jumadal Akhirah-Rajab 1440   ||   March 2019

মি টু আন্দোলন : সব কিছুই অরণ্যে রোদন

মুহাম্মাদ শাহাদাত সাকিব

মি টু। মাত্র দুটি শব্দ। তবে এ শব্দদুটিই পৃথিবীব্যাপি ঝড় তোলা আন্দোলনের শিরোনাম হয়ে গেছে। পশ্চিমে শুরু হওয়া এ ঝড় ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এরপর এ জোয়ার লেগেছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। আর সে জোয়ারে ভেসে গিয়েছে রাঘব-বোয়ালেরা। ‘মি ট’ু আন্দোলন মূলত যৌন নিপীড়ন বিরোধী অনলাইন প্রচারণা। সাধারণত মি টু শিরোনামে নারীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে নিজেদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো তুলে ধরেন।

দৈনিক প্রথম আলোর ভাষ্য অনুযায়ী মি টু আন্দোলনের শুরুটা ছিল মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানোর দ্বারা। হলিউডের মুভি মুঘল হার্ভে উইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির খবর ফাঁসের প্রতিক্রিয়ায় তাঁর এই উদ্যোগ। অ্যালিসা ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে টুইট করেন, ‘যারা যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তারা মি টু লিখে টুইটের রিপ্লাই দিন।’ অ্যালিসার টুইটের মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ তাতে কমেন্ট করেন। হাজার হাজার নারী মি টু লিখে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। টুইটার বলছে, দুই দিনে ১০ লাখের বেশিবার এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইট করা হয়েছে। পিছিয়ে নেই ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে, অ্যালিসার এই প্রচার শুরুর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বিষয়টি নিয়ে পোস্ট দিয়েছে এবং কমেন্ট করেছে। এত বিপুল মানুষের সাড়া পেয়ে বিস্মিত অ্যালিসা মিলানো। মার্কিন সাপ্তাহিক ভ্যারাইটিকে তিনি বলেন, ‘জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া মানুষের সংখ্যাটা আমাকে অবাক করেনি। আমি অবাক হয়েছি, কত লাখ লাখ মানুষ লজ্জায়, সংকোচে কিংবা ভয়ে এসব কথা প্রকাশ করতে পারেনি। পাছে যদি তাদের গায়েই খারাপের তকমা লাগে!’ (দৈনিক প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১৭)

পশ্চিমের এ ঢেউ কিছুদিন পর ভারতে এসে আছড়ে পড়ল। ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবরের মাধ্যমে এর সূচনা। পেশাজীবনের দীর্ঘ সময় এশিয়ান এজ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এ ভদ্রলোক। সে সময় এক নারী সাংবাদিককে যৌন হয়রানী করেছিলেন। এ নিয়ে তখন উচ্চবাচ্য না হলেও এত বছর পর এসে সে নারী বোমা ফাটাল। কষ্টের দাস্তান তুলে ধরল মিডিয়ার সামনে। গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর আরো কিছু মহিলাকণ্ঠ উচ্চারিত হল আকবরের বিরুদ্ধে। অভিযোগ একই- যৌন হয়রানী। অবশেষে ক্ষমতার সর্বোচ্চস্তরের এ ভদ্রলোককে পদত্যাগ করতে হল এমন স্পর্শকাতর অভিযোগ মাথায় নিয়ে। যদিও বরাবরের মত তিনি নিজেকে ‘ফুলের মত পবিত্র’ দাবি করেছেন।

এর পরই ভারতজুড়ে সরব হয়ে ওঠে নারী সমাজ। একের পর এক যৌননির্যাতনের কাহিনী ফাঁস হতে থাকে বিভিন্ন গুণীজনদের(?) বিরুদ্ধে- সমাজে যারা সাদামনের মানুষ হিসেবে সুনাম কামিয়েছেন। দেখা গেল শুধু বিনোদনের অন্ধকার জগতেই নয় করপোরেট দুনিয়া, ক্রীড়া, সংবাদপত্র, শিল্প-সাহিত্য, অথবা রাজনীতি সবখানেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে অভিযোগের তালিকা। ক্ষমতার রাঘব-বোয়াল, সংবাদপত্রের প-িতজনসহ অনেকেই এ কর্মে জড়িত। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে শুরু হয় ‘মি টু ইন্ডিয়া’ আন্দোলন।

নারীর উপর যৌন নির্যাতন আগেও হয়েছে। বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে পরিসংখ্যানও বেরিয়েছে। তবে মি টু আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হল, এতে সমাজের উঁচু শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের হাতে নারী কী পরিমাণ নিপীড়িত ও নির্যাতিত সেই ভয়াবহ চিত্র দুপুরের সূর্যের মত স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। শুধু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নন, ভারতের আরো নামীদামি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছেন হিন্দুস্তান টাইমসের রাজনৈতিক সম্পাদক, টাইমস অব ইন্ডিয়ার হায়দ্রাবাদ আবাসিক সম্পাদক, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার প্রিন্সিপাল করসপনডেন্ট, ডিএনএর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। শুধু সাংবাদিক নন ভারতের পদ্মভূষণ খেতাবে ভূষিত শিল্পীর বিরুদ্ধেও যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে এসেছে। মজার ব্যাপার হল, প্রবীণ এই শিল্পীর কন্যা একজন অভিনেত্রী ও নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার কর্মী।

মি টু আন্দোলনে ভারতের প্রগতিশীল মানুষদের যেন মুখোশ খুলে পড়েছে। এরা সবাই শিক্ষিত গুণীজন। নিজ নিজ পত্রিকায় নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকারের পক্ষে এবং ইভটিজিং ও যৌনহয়রানির বিরুদ্ধে কলমের কালি  ঢেলে দিয়ে অনেক সাদা পৃষ্ঠা কালো করেছেন। আর এই হল তাদের আসল চিত্র ও চরিত্র।

শুধু প্রাচ্যেই নয় পশ্চিমের ক্ষমতার সর্বোচ্চকেন্দ্রে থাকা নারীরাও নিপীড়িত হচ্ছে পুরুষদের হাতে। গত ২৫ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে প্রথম আলো ‘ইইউ পার্লামেন্ট যৌন হয়রানির আখড়া’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে বলা হয়, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টের পুরুষ সদস্যদের কাছে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পুরুষ সাংসদদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন বেশ কয়েকজন নারী। তাঁদের একজন বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্ট যেন ‘যৌন হয়রানির আখড়া’ হয়ে উঠেছে।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ইইউ পার্লামেন্টের কাঠামোকে দায়ী করে নির্যাতনের শিকার নারীরা জানান, ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়েই সুন্দরী নারীদের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের সাংসদেরা। এরপর নানা ছলে তাঁদের শরীরে হাত দেওয়া থেকে শুরু করে জোর করে  বাধ্য করা হয়। চাকরি হারানোর ভয়ে অনেকেই মুখ বুজে সহ্য করেন। তাই অবাধে চলছে এসব ঘটনা। এসব বিষয়ে অভিযোগ করলেও প্রশাসনিক জটে তা আটকে থাকে। ফলে ন্যায্য বিচার পাওয়ার পথও কার্যত বন্ধ। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রভাব বিস্তার করে এসব মামলা ধামাচাপা দিয়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে অভিযোগ জানানোর সাহস হারিয়ে ফেলছেন অনেকে।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ২৫ অক্টোবর ২০১৭)

বিবিসির এক জরিপে উঠে এসেছে, কর্মক্ষেত্রে বা পড়াশুনার জায়গায় অর্ধেক ব্রিটিশ নারীই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হলিউডের অন্যতম প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পরই এই জরিপ চালানো হয়। যৌন হয়রানির শিকার প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী বিবিসিকে জানিয়েছেন, ঘটনার পর তারা এ বিষয়ে রিপোর্ট করেননি বা কাউকে জানাননি। জরিপে উঠে এসেছে প্রতি ১০ জনে একজন নারী যৌন হয়রানির কারণে শিক্ষাক্ষেত্র বা কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করেছেন। বিবিসির এই জরিপ ছাড়াও গত বছর প্রকাশিত টিইউসির জরিপেও উঠে আসে যে, ব্রিটেনে অর্ধেকেরও বেশি নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়, যার বেশিরভাগই খবরে আসে না।

আমাদের দেশও এদের থেকে খুব ব্যতিক্রম নয়। ২০১৬ সালে কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ সিএইচআরআই-এর গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের ১০ শতাংশের বেশি সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হন। আর উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শকদের শতকরা তিন ভাগ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন। ক্যাডার পর্যায়ের নারী পুলিশরাও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বাইরে নন।

পুলিশের মধ্যে যদি এই চিত্র হয় তাহলে অন্য পেশার অবস্থাটা কেমন হবে তা সহজে অনুমান করা যায়।

যৌন নির্যাতনের এ চিত্র ও পরিসংখ্যান পুরনো দিনের কোনো গল্প বা কেচ্ছা-কাহিনী নয়। সবগুলোই হাল নাগাদ প্রকাশিত। যাতে বুঝে আসে, নারী উন্নয়নের (!) এ যুগেও নারী কত নির্যাতিত।

প্রশ্ন জাগতে পারে, এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী? যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে তো অনেক বলা হয়েছে, টকশোগুলোতে আলোচনা-পর্যালোচনাও কম হয়নি। এ ব্যাধি নির্মূলের জন্য বিভিন্নজনের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নিত্য-নতুন ফর্মুলা উদ্গিরিত হয়েছে। কিন্তু ফলাফল? সবকিছুই যেন অরণ্যে রোদন। আসলে এসব কিছু হল বাঁধ না দিয়ে খাল সেচার মত। পানি প্রবাহের পথ বন্ধ না করে যতই পানি সেচা হোক দিন শেষে দেখা যাবে যে-ই সে-ই।

একটা গল্প শুনেছিলাম। একবার এক লোকের নাকি শখ জেগেছিল ছাগলকে শিক্ষাদানের। আহা! কিছু না শিখেই আদরের ছাগলটার জীবন পার হয়ে যাচ্ছে! তাই সিদ্ধান্ত নিল, ওকে শিক্ষাদান করতেই হবে আমাকে। যেই ভাবা সেই কাজ। কোমর বেঁধে নেমে পড়ল ছাগলকে পাঠ দানে। কান ধরে অনেকক্ষণ ছাগলকে অক্ষরজ্ঞান দিত। তখন ছাগল চুপ করে সব শুনত। ছেড়ে দিলেই কান দুটো ঝাড়া দিত। লোকটি ভাবত, নাহ্ কিছু বুঝে আসেনি। তাই আবার কান ধরে শুরু করত ছাগল-শিক্ষাদান। পাঠ শেষে ছাগল আবার মাথা ঝাড়া দিত। এভাবেই ছাগল শিক্ষাদানের মহৎ উদ্দেশ্যে নিজের শ্রম প- করল লোকটি। শেষ পর্যন্ত ছাগলও কিছু শিখল না লোকটিরও শখ পূরণ হল না। মূল থেকে সমস্যার সমাধান না করে এভাবে মি টু সহ অন্যান্য আন্দোলন হল কান ধরে ছাগল শিক্ষাদানের মত। এমনটাই মনে করেন অনেকে । যতক্ষণ আন্দোলন চলবে সাময়িকভাবে কিছু কিছু অপরাধী হয়ত ঘাপটি মেরে থাকবে। কিন্তু আন্দোলন থামতেই আবার জেগে উঠবে অপরাধীরা। এভাবে আন্দোলনে আন্দোলনে সময় নষ্ট হবে। শ্রম প- হবে। সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।

একমাত্র ইসলামই আমাদেরকে এ সমস্যাগুলোর মূল কারণ চিহ্নিত করে সহজ সুন্দর সমাধান দিয়েছে।

নারীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টি পরম আন্তরিকতায় ¯œাত। নারী জাতি মায়ের জাতি। মাতৃত্বের মহান সম্মান আল্লাহ তাদের দান করেছেন। মা হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বোন হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে তাদের রয়েছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থান। নারীর যথার্থ মূল্যায়ন ও পরিচর্যায় ইসলাম যে নির্দেশনা দিয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাসে তার তুলনা নেই।

আল্লাহবিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ নারীর সাথে উত্তম আচরণ করতে বাধ্য এবং আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট। নারীকে নিরাপদ রাখার জন্য, সব ধরনের যৌন হয়রানী থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের উপরই কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধু পুরুষ বা শুধু নারীর উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং নারী-পুরুষ উভয়ের সমান সচেতনতায় আমাদের সমাজটা অনেক বেশি সুন্দর ও নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।

পুরুষকে সতর্ক করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ.

মুমিন পুরুষদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উৎকৃষ্ট পন্থা। -সূরা নূর, (২৪) : ৩০

নবীজী ইরশাদ করেছেন-

يَا عَلِيّ لَا تُتْبِعِ النّظْرَةَ النّظْرَةَ فَإِنّ لَكَ الأُولَى وَلَيْسَتْ لَكَ الآخِرَةُ.

হে আলী! (পর নারীর প্রতি অনিচ্ছায়) চোখ পড়ে গেলে আবার তাকিও না। কারণ প্রথমবারের দৃষ্টি তোমাকে মাফ করা হবে। কিন্তু দ্বিতীয়বার এ ছাড় থাকবে না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৪৯

আর নারীকে বলা হয়েছে ঘরের শান্ত ছায়াঘেরা নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে। অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হতে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ قَرْنَ فِیْ بُیُوْتِكُنَّ وَ لَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِیَّةِ الْاُوْلٰی.

নিজ গৃহে অবস্থান কর। (পর-পুরুষকে) সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহেলী যুগে প্রদর্শন করা হত। -সূরা আহযাব  (৩৩): ৩৩

নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায় মানব সভ্যতার ভিত গড়ে উঠেছে। ইসলাম বলে, পুরুষ সংগ্রামমুখর জীবনে ঘাম ঝরিয়ে জীবিকা উপার্জন করবে। আর স্ত্রী মনের মাধুরী মিশিয়ে পরম যতেœ সংসার দেখা-শোনা করবে। সংসার নারীর রাজ্য। সে এর মুকুটহীন রাণী। উপার্জনের কঠিন দায়িত্ব ইসলাম নারীর কাঁধে চাপায়নি। বরং জীবনের প্রতিটি ধাপে তার সমস্ত প্রয়োজন, শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য কর্তব্যপরায়ণ, হৃদয়বান দায়িত্বশীল স্থির করে রেখেছে।

পশ্চিমারা নারীদের বাইরে থাকার কুফল অনুধাবন করে আবার ইসলামের স্বভাবসম্মত নীতির দিকেই ফিরে আসছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভ তার ঢ়বৎবংঃৎড়রশধ : হবি ঃযরহশরহম ভড়ৎ ড়ঁৎ পড়ঁহঃৎু ধহফ ঃযব ড়িৎষফ গ্রন্থে ১১৬-১১৮ নং পৃষ্ঠায়   ড়িসবহ ধহফ ঃযব ভধসরষু শিরোনামে লেখেন-

‘বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যস্ত থেকে, নির্মাণ, উৎপাদনসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে এবং সৃজনশীল কাজকর্মে ব্যাপৃত থেকে নারী যথেষ্ট সময় পায় না গৃহের প্রাত্যহিক দায়দায়িত্ব পালন করার; শিশুদের শিক্ষাদীক্ষার এবং সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করার। আমরা আবিষ্কার করেছি যে, শিশু ও যুবকদের চারিত্রিক সমস্যা, আমাদের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও উৎপাদনসমস্যাসহ আরো অনেক সমস্যার অংশত কারণ হল, পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতা এবং পারিবারিক পরিবেশের প্রতি শিথিল দৃষ্টিভঙ্গি। নারীকে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান বানাবার এই হল নির্মম পরিণতি। এখন, ‘প্রেসট্রোয়কা’র প্রক্রিয়ায় আমরা এই ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছি। একারণেই এখন আমরা সংবাদ সম্মেলনে, গণসমাবেশে, কর্মস্থলে, বাসাবাড়িতে এ বিষয়ে উত্তপ্ত বিতর্কের অবতারণা করছি যে, নারীদেরকে তাদের সঠিক নারীসুলভ কাজকর্মে ফিরিয়ে আনাটা সম্ভব করতে আমাদের কী করা উচিত।’

১৯-০৪-১৭ তারিখে বিবিসি এ্যারাবিক-এ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটির শুরুতেই আছে, ‘আমেরিকার ক্রমবর্ধমান সংখ্যক নারীরা গৃহে অবস্থান করাকে প্রাধান্য দিচ্ছে’। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘খ্রিস্টিয়ান সাইন্স মনিটরে’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘গত দশ বছরে এই চিন্তার সমর্থকদের হার বেড়েছে যে, পিতা বাহিরে কাজ করবে। আর মা গৃহে অবস্থান করবে।’

হাঁ, বিভিন্ন সময় নারীদেরও বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে। এটা খুব স্বাভাবিক। ইসলাম প্রয়োজনে নারীদের বাইরে যাওয়ার অনুমতিও দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হল, পর্দার সাথে বাইরে যেতে হবে। পর্দা হল নারীর রক্ষাকবচ। একজন বলেছেন এবং বড় সুন্দর বলেছেন-

‘পুরুষের অশ্লীল দৃষ্টি থেকে নিরাপদে থাকার জন্য মুসলিম নারী হিজাব ও বোরকায় শরীর ও মুখ ঢাকলে উদ্ভট ও কিম্ভুতকিমাকার বলে উপহাস করা হয়। তুষারপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ওভার কোট ও মাঙ্কি ক্যাপ পরলে তো তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না! তারা যেমন ঠা-া থেকে বাঁচার জন্য এগুলো পরেন, তেমনি একজন সুশীল নারী নিজের আপাদমস্তক বখাটে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্য ও আল্লাহর হুকুম পালনার্থে বোরকা পরেন। এ কারণে তাকে হেয় করা হবে কেন? তেমনি বাইকচালকের হেলমেটে সমস্যা নেই। ধুলোবালি থেকে বাঁচার জন্য মাস্কে সমস্যা নেই। এসবই তো করা হয় নিজেকে সেভ করার জন্য। তাহলে একজন নারী পরপুরুষের কুদৃষ্টি থেকে, ইভটিজিং থেকে বাঁচতে নেকাবে মুখ ঢাকলে, খোলামেলা চলাফেরা থেকে বিরত থাকলে কেন তাকে সেকেলে বলা হবে? নেকাবে চোখ ঢাকলে অস্বস্তি আর রোদ-চশমায় ঢাকলে ফ্যাশন! ফ্যাশনদুরস্ত মেয়েরা স্কিনটাইট মোজা পরলে হয়ে যান মডার্ন, আর একজন পর্দানশীন নারী হাতমোজা পরলেই ব্যাকডেটেড! বুঝতে পারি না, জাগতিক এই দেহটাকে রোদ, শীত, ধুলো, জীবাণু থেকে বাঁচাবার জন্য এইসব প্রশংসনীয় হলে পরজগতে এই দেহটাকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে পর্দার প্রতি তাদের এত আপত্তি কেন?’

ড. মুহাম্মাদ আলী আলহাশেমী বলেন, দামেস্ক ইউনিভার্সিটির এক মুসলিম পর্দানশীন তরুণীকে একজন অতিথি সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, “এই প্রচ- গ্রীষ্মের গরমে আপনি কীভাবে বোরকাবৃত থাকেন? আপনার কি গরম লাগে না? তরুণীটি এর উত্তরে কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করলেন-

قُلْ نَارُ جَهَنّمَ أَشَدّ حَرّا.

বলে দিন, জাহান্নামের আগুন এর চেয়েও অনেক বেশি উত্তপ্ত। [সূরা তাওবা (৯) : ৮১] -শাখসিয়্যাতুল মারআতিল মুসলিমা, পৃ. ৫১-৫২

শুধু পর্দা করতেই গরম সহ্য করতে হয়- এমন কিন্তু নয়; ফ্যাশন করতেও গরম সহ্য করতে হয়। পার্থক্য শুধু তাকওয়া ও প্রবৃত্তি-তাড়িত দৃষ্টিভঙ্গির। একজন আল্লাহর আদেশ পালনে ও অনন্তজীবনের ‘গরম’ থেকে বাঁচার জন্য দুনিয়ার গরমকে তুচ্ছ জ্ঞান করছে। আরেকজন ফ্যাশন রক্ষার্থে অনন্ত জীবনের আগুন ও দুনিয়ার গরম মেনে নিচ্ছে।

বর্তমানে নারীর প্রতি যেই যৌন সহিংসতা তার জন্য পুরুষের অন্যায় মানসিকতার পাশাপাশি নারীর উগ্র বেশ-ভূষা ও নগ্ন চলাফেরাকেও বহুলাংশে দায়ী মনে করেন অনেক গুণীজন। এ বিষয়টিকে কেন এড়িয়ে যাওয়া হয় যৌননিপীড়নের সকল আলোচনায়? পুরুষ যেমন নারীর প্রতি কামুক হাত বাড়ানো অন্যায় তেমনি অশ্লীলতার দ্বারা পুরুষকে প্রলুব্ধ করাও কি অন্যায় নয়? নারীর প্রতি অমূলক সিমপ্যাথি দেখিয়ে সব দোষ শুধু পুরুষের উপর চাপিয়ে নারীকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে লাভ কী? তাকেও একটু সচেতন হতে দিন। যাতে সে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সচেতন হতে পারে।

চূড়ান্ত ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যে নারীরও কিছু করণীয় আছে, তারও যে কিছু দায় আছে- তা এড়িয়ে গিয়ে লাভ কী? বাস্তবতা কি আর সুন্দর সুন্দর বুলির অনুগামী। তরুণীদের নৃত্যময় অঙ্গভঙ্গি, উগ্রপোষাক ও নগ্ন চলাফেরা তরুণদের সকল নৈতিকতা ও নীতিবাক্যগুলো ভুলিয়ে দেয়। শুধু বখাটে তরুণ নয় কখনো কখনো একেবারে সভ্য-ভদ্র তরুণকেও টলিয়ে দেয় নারীর নৃত্যময় অঙ্গভঙ্গি আর কথার সুরমূর্ছনা।

হযরত থানভী রাহ. একটা ঘটনা বলেছেন। এক রাজা তার পোষা বিড়ালকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। রাজা যখন রাতের বেলা কাজ করত বেড়াল তখন মাথায় প্রদীপ নিয়ে বসে থাকত। একদিন মন্ত্রী এসে এ বিচিত্র দৃশ্য দেখে রাজাকে বলল, বেশ প্রশিক্ষণ পেয়েছে মনে হয় বেড়ালটি। তবে এর পরীক্ষা হওয়া দরকার। এক রাতে রাজা কাজ করছিল আর বেড়ালটিও চুপ করে বসে ছিল মাথায় প্রদীপ নিয়ে। এমন সময় মন্ত্রী একটা ইঁদুর নিয়ে এসে বেড়ালের সামনে ছেড়ে দিল। ইঁদুর দেখতেই বেড়ালের চোখ দুটো চক চক করে উঠল। সেইসাথে ভুলে গেল এতদিনের সমস্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। প্রদীপ ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকার ধরতে আর এদিকে রাজার সরকারি কাগজপত্র সব পুড়ে ছাই।

নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ স্বাভাবিক ও স্বভাবজাত একটা বিষয়; তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ইসলাম একে নিয়ন্ত্রণ করতে বলে। তবে নারী যদি নিজেই শিকারের বেশে আসে পুরুষের সামনে তখন সমস্ত নীতি নৈতিকতা ভুলে পুরুষ যদি বেড়ালের মত ছুটে যায় শিকার ধরার নেশায় তখন অপরাধের দায় একা শুধু পুরুষের উপর দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক?

রমণী সৌন্দর্যের সামনে নৈতিকতার পরাজয়ের তিক্ত বাস্তবতা মি টু আন্দোলন আরো স্পষ্ট করে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেল। কারণ যেসকল নায়ক ও খলনায়কেরা এ আন্দোলনের বলি হয়েছেন তারা সবাই শিক্ষিত গুণীজন। নিজ নিজ পত্রিকায় নারী অধিকার ও যৌন সহিংসতা নিয়েও কম বলেননি। কিন্তু শিকার কাছে পেয়ে নীতি-নৈতিকতা কিছুই আর মনে রাখতে পারেননি।

আরেকটা কথা, বিনোদনের অন্ধকার জগতের নারীরাই যৌন সহিংসতার শিকার বেশি হয়ে থাকে। যাদের মাধ্যমে মি টু আন্দোলনের জোয়ার এসেছে তারা এ জগতেরই বাসিন্দা। আর বিনোদনের নামে ছবির রুপালী পর্দায় নারীর নগ্নদেহ প্রদর্শন এবং উগ্র পোশাকের বিষয়টি তো সবারই জানা। কপোত-কপোতীদের যুগল দৃশ্য আর বিশ্রী সব অঙ্গভঙ্গী দেখে দর্শকদের মনে কুবাসনা না এসে পারে না। এসব কিছুর অবশ্যম্ভাবী ফল হচ্ছে যৌন নির্যাতন। এসব ছবি সমাজের উপর যেমন প্রভাব ফেলে, যুবকদের মন-মস্তিষ্ক নষ্ট করে, তেমনি এর গুরুদের জীবনও হুমকির মাঝে ফেলে।

এ জগৎ যে এক পঙ্কিল জগৎ- তা কি অস্বীকার করার উপায় আছে। জেনে-শুনে স্বেচ্ছায় এ অন্ধকার জগতে পা বাড়ানো কি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত নয়? ডাকাতের উপদ্রব আছে জেনেও নিরাপদ পথ ছেড়ে সেই বিপদসংকুল পথে হাঁটার পর যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে এর কিছুটা দায়ভার কি পথিকের উপরও পড়ে না?

তাই যৌন সহিংসতা থেকে বাঁচতে হলে নারীকে এ বিষয়গুলো নির্মোহ দৃষ্টিতে ভাবতে হবে। শুধু প্রবৃত্তি-অন্ধের মত সকল পঙ্কিলতার উপর সুন্দর সুন্দর বুলির প্রলেপ দিয়ে কি বাস্তবতা ঢাকা যাবে বা বাস্তব পরিণতি থেকে বাঁচা যাবে?

ঘরের নিরাপদ পরিবেশে থাকা, বাইরে বের হলে আকর্ষণ-প্রদর্শনের মানসিকতা পরিহার করা, শালীন পোশাক পরা ও পর্দা রক্ষা করে চলা- নারীকে অনেক বিপদের হাত থেকেই রক্ষা করতে পারে। আমরা নারীদের কাছে এই কামনাই করি।

তবে এর অর্থ এই নয় যে, কোনো নারী পর্দাহীনভাবে বের হলেই তার দিকে কুদৃষ্টিতে তাকানো ও তাকে উত্যক্ত করা বৈধ হয়ে যাবে।

অশ্লীলতামুক্ত সুস্থ সুন্দর ও নিরাপদ সমাজ গড়ার দায়িত্ব নারী পুরুষ উভয়ের উপরই বর্তায়। নারীর দায়িত্ব যেমন পর্দা করে চলাফেরা করা তেমনি পুরুষের দায়িত্ব পরনারীর দিকে না তাকিয়ে দৃষ্টিকে নত করা এবং নিজের মন ও আত্মাকে পবিত্র রাখা। নারী তার দায়িত্ব পালন না করলে পুরুষ তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পায় না। নিজের ঈমানের হেফাযত ও পরকালীন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্যই পুরুষকে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। হযরত জাবের রা. একবার নবীজীকে পরনারীর উপর হঠাত দৃষ্টি পড়ে গেলে করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। নবীজী বলেন- اصرف بصرك

তুমি তখন (সাথে সাথে) দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৫৯, জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮১, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৪৮)

এ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার সাওয়াব ও প্রতিদান আল্লাহর কাছে অনেক। নবীজী ইরশাদ করেন-

ثلاثة لا ترى أعينهم النار، عين حرست في سبيل الله، وعين بكت من خشية الله، وعين غضت عن محارم الله.

তিনটি চোখ জাহান্নামের আগুনে জ¦লবে না। । ১. যে চোখ আল্লাহর পথে জাগ্রত থেকেছে। ২. যে চোখ আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে। ৩. যে চোখ হারাম জিনিস দেখা থেকে বিরত থেকেছে। (আলমুজামুল কাবীর, তবারানী,  হাদীস ১০০৩, মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৪৩২)

তাই নারী ও পুরুষ উভয়ে যদি ইসলামে নির্দেশিত নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে তাহলেই আমাদের সমাজ সুন্দর ও নিরাপদ হয়ে উঠবে। এ দায়িত্ব পালন না করে শুধু এসব মি টু জাতীয় আন্দোলন অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

advertisement