আমার উস্তাযে মুকাউয়িম : হযরত মাওলানা শামছুল হক রাহ.
[বাবাজান রাহ. সম্পর্কে এখনো কিছু লিখতে পারিনি। না ভাইজান, না আমি। খুশির কথা যে, বাবাজান রাহ.-এর খুবই প্রিয় ও আস্থাভাজন শাগরিদ হযরত মাওলানা মুফতী দিলাওয়ার হুসাইন দামাত বারাকাতুহুম একটি বিশদ লেখা আলকাউসারের জন্য পাঠিয়েছেন। এই লেখাটিতে তিনি তার অনুভূতিগুলো তার নিজস্ব ভঙ্গিতে আলোচনা করেছেন। আব্বাজান রাহ.-এর সাথে তার সম্পর্ক এবং সম্পর্কের সেই আবেগময় প্রকাশের দাবি ছিল লেখাটি হুবহু ছেপে দেয়া। আমরা তা-ই করেছি। আল্লাহ তাআলা বাবাজান রাহ.-কে ভরপুর মাগফিরাত নছীব করুন। তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন এবং সম্মানিত নিবন্ধকারকে আমাদের পক্ষ থেকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। তাকে সুস্থ ও সুদীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। তিনি বাবাজান রাহ.-এর মতো সকল উস্তাযেরই প্রিয়ভাজন ও স্নেহধন্য এবং অত্যন্ত আস্থাভাজন শাগরিদ। আজকাল ছাত্রদের মধ্যে যার অভাব শুধু বেড়েই চলেছে। আল্লাহই পারেন আমাদের রক্ষা করতে। -বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক।]
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله الذي خلق الإنسان و كرم، وعلمه بلطفه ما لم يعلم، وزينه بالخبرة والحكم، والصلاة والسلام على سيدنا ومولانا محمد سيد الرسل والأمم، الذي أوتي جوامع الكلم، وكرائم الحكم، ومكارم الشيم، وعلى آله وأصحابه نجوم الطريق الأمم.
قرنہا باید کہ تا صاحب دلے پیدا شود
با یزید اندر خراساں یا اویس اندر قرن
অর্থ : খোরাসানের বায়েজীদ বোস্তামী আর ইয়ামানের উয়াইস আলকারনীর ন্যায় সাহেবে দিল মহামনীষী জন্ম নিতে শত সহ¯্র বছরের প্রয়োজন হয়।
এমন মহামনীষীদেরই একজন আমার উস্তায হযরত মাওলানা শামছুল হক রাহ.। তিনি বিগত ১৭ রবিউস সানী ১৪৪০ হিজরী, ১২ পৌষ, ১৪২৫ বাংলা মোতাবেক ২৫ শে ডিসেম্বর ২০১৮ ঈসায়ী মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ইন্তেকাল করেন।
إنا لله وإنا إليه راجعون.
আমার মামাত শ্যালক জনাব হাফেজ মাওলানা মোরশেদ আলহোসাইনীর মাধ্যমে সর্বপ্রথম সংবাদটি পেয়ে ভেঙ্গে পড়ি। কোমর ব্যথা সত্ত্বেও স্থির করলাম জানাযায় যেতেই হবে। তাঁর বড় ছাহেবজাদা আমার বন্ধুবর ও বাল্যদিনের পড়ার সাথী জনাব মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাহেবকে ফোন করলাম। ধরলেন প্রসিদ্ধ ওয়ায়েজ আমার ¯েœহাস্পদ মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবী সাল্লামাহুল্লাহ। বললেন, আব্দুল্লাহ্ ছাহেব বেহুঁশ প্রায়। কথাও বলতে পারছেন না। হুঁশ রাখবেনই বা কীভাবে? তার তো রূহানী ও জেসমানী উভয় ধরনের পিতা তাকে ও মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবকে পাখির ন্যায় পাশে রেখে লালন করেছেন।
বেলা দুইটায় খেড়িহর মাদ্রাসায় জানাযা হবে। কোমরে ব্যথা, রাস্তাও খুব খারাপ, যাই হোক যেতেই হবে। একটি গাড়ি ঠিক করলাম, ফজরের পরপরই রওয়ানা হব। এর মধ্যেই বর্তমান মারকাযুদ দাওয়াহ্র উস্তায আমার অত্যন্ত ¯েœহাস্পদ ছাত্র জনাব মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া আনুমানিক সকাল ৬টার দিকে ফোন করে বললেন, আমরা রাত ২টায় রওয়ানা হয়ে এখনো মেঘনা ব্রীজ অতিক্রম করতে পারিনি। রাস্তায় প্রচ- জ্যাম। মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব বললেন, আপনি ঢাকা থেকে দোয়া করতে থাকুন। জ্যামের কারণে সময় মত পৌঁছাতে পারবেন না, কিন্তু মনকে বুঝাতে পারছিলাম না। তাই গাড়িওয়ালাকে বললাম, ভাই! রোডে যাওয়া যাবে না। আমাকে সদরঘাট নিয়ে চলুন। আলহামদু লিল্লাহ সদরঘাট থেকে লঞ্চযোগে চাঁদপুর হয়ে সময়মত কাঁটায় কাঁটায় আল্লাহ পাক পৌঁছে দিলেন তার প্রিয় বান্দার জানাযায়। দেখার সৌভাগ্য হল শেষবারের মত তাঁর মায়াময় চেহারা।
তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা
মুন্সিরহাট ইসলামিয়া হোসাইনিয়া মাদ্রাসায় আমার হেদায়াতুন্নাহু জামাত শেষ হল। এ মাদরাসায় আর জামাত নেই। অন্য কোনো মাদরাসায় যেতে হবে। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা দিলাওয়ার হোসাইন রাহ. (খলীফায়ে আজাল্ল, শায়খুল আরবে ওয়াল আজম, হযরত সায়্যিদ হোসাইন আহমাদ মাদানী রাহ.) তার বড় ছাহেবজাদা আমার উস্তায হযরত মাওলানা আছেম বিল্লাহ্ রাহ.-কে বললেন, দিলাওয়ারকে জামিআ ইমদাদিয়া ফরিদাবাদ মাদরাসায় ভর্তি হতে বলবে। তিনি যে আব্বাজান হযরত মাওলানা দ্বীন মুহাম্মাদ রাহ.-এর খালাত ভাই তা আমি জানতাম না। কিন্তু আমি যে তার খালাত ভাইয়ের ছেলে তা তিনি জানতেন। কিছুদিন পর পুনরায় বললেন, দিলাওয়ারের ফরিদাবাদ মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে গ্রামের কোনো মাদ্রাসায় ভর্তি হলে ভালো হবে। এত ছোট বেলায় শহরে যাওয়া ঠিক হবে না।
ইস্তেখারা আরম্ভ করলাম। এর মধ্যেই স্বপ্নে দেখি কুসুমী রংয়ের দক্ষিণমুখী একটি দ্বিতল মাদ্রাসা। উপরের তলার বারান্দায় ছাত্ররা হাঁটছে খুব নূরানী ও সুন্দর দেখা যাচ্ছে। মাদরাসাটি জামি‘আ ইসলামিয়া আরাবিয়া খেড়িহর মাদরাসা। কিন্তু কোথায় খেড়িহর তা তো চিনি না! এর মধ্যে আমার জেঠাতো বোনজামাই হযরত ক্বারী রজব আলী ছাহেব রাহ., (কাশিপুর ইসলামিয়া মাদরাসার উস্তায) আমাদের বাড়ি আসলেন এবং আমাকে কাশিপুর মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার জন্য বললেন। আমি আমার ইস্তেখারার কথা বলে খেড়িহর মাদরাসা কোথায় জানতে চাইলাম।
তিনি খেড়িহর এভাবে চেনালেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটবেন। ৪/৫ কিলোমিটার পর একটি বাজার পাবেন, নাম মনোহরগঞ্জ, সেখান থেকেও পশ্চিমে হাঁটবেন, ৪/৫ কিলোমিটার পর আরেকটি বাজার আসবে, নাম পোমগাঁও। সেখান থেকেও পশ্চিমে হাঁটতে থাকবেন, ৪ কিলোমিটার পর আরেকটি বাজার আসবে নাম চিতোষী বাজার। সেখানে একটি নদী পাবেন, নাম ডাকাতিয়া নদী। খেয়া নৌকায় নদী পার হয়ে এবারও পশ্চিম দিকে হাঁটবেন, ৪ কিলোমিটার পর আরেকটি বাজার আসবে নাম উঘারিয়া বাজার। সেখানে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন, খেড়িহর কোথায়? মানুষ বলে দিলে সেখান থেকে আনুমানিক ৩ কিলোমিটার পর খেড়িহর মাদরাসা পাবেন।
সকালে মা আমাকে খানা খাইয়ে একটি ছালার ব্যাগে কিছু কাপড় ও চিড়া মুড়ি দিয়ে দুআ করে খেড়িহর মাদরাসার উদ্দেশে রওয়ানা করে দিলেন। আমি দুলাভাইয়ের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী হাঁটতে আরম্ভ করলাম। ২০/২১ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ঠিকঠাক খেড়িহর মাদরাসায় পৌঁছলাম। তখন পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। রাস্তাটি রিক্সা চলার মতোও ছিল না।
গ্রামের বাড়ির ফাঁকে ফাঁকে রাস্তায় দু-চারজন তালিবুল ইলমকে হাঁটতে দেখা গেল। বড়ই নূরানী। মাদরাসায় পৌঁছে দেখি স্বপ্নে দেখা কুসুমী রংয়ের সেই দ্বিতল বিল্ডিং। বারান্দায় ঐ ছাত্রগুলোই হাঁটছে। যাদেরকে স্বপ্নে হাঁটতে দেখেছি। বড়ই নূরানী পরিবেশ। প্রথম দেখাতেই মন বসে গেল। দেখা করলাম উক্ত মাদরাসার শিক্ষাসচিব আমার আরেক জেঠাতো বোনজামাই হযরত মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান ছাহেবের সাথে এবং মুহতামিম হযরত মাওলানা শামছুল হক রাহ.-এর সাথে। তাঁর সাথে জীবনের প্রথম দেখা। তিনি আমার পরিচয় জেনে নিয়ে নাযেম সাহেবকে ফরম দিয়ে ভর্তি করে নিতে বললেন।
আমাদের বংশ এর আগেও তাঁর কাছে পরিচিত ছিল। কারণ তিনি প্রথমে আমাদের বাড়ীর কাছে কাশিপুর মাদরাসায় খেদমত করেছিলেন। সে মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন আমার জেঠাজী হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুর রহমান রাহ.।
ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই আমাকে ভর্তি করা হল। ইতিপূর্বে বোর্ডিংওয়ালা মাদরাসা দেখিনি, তাই ভর্তির পর বোর্ডিংয়ে যে খানা জারী করতে হয় তা জানতাম না। যার কারণে খানা জারী করা হল না। উপবাসই রয়ে গেলাম। মাদরাসা ছুটির পর মাওলানা আব্দুল হালীম বরল্লা নিবাসী (যিনি এখানে আসার পূর্বে মুন্সিরহাট মাদরাসায় আমার এক জামাত নিচে লেখা-পড়া করেছিলেন।) তিনি আমাকে তার সাথে তার জায়গীর বাড়িতে নিয়ে যান। রাতে মিষ্টি কুমড়ার তরকারী দিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম। অনেক স্বাদ লেগেছিল ঐ খাবার। (আল্লাহ পাক তাকে রহমতের পরশে স্থান দেন।) পরদিন তার জায়গীর থেকেই খাওয়া দাওয়া সেরে মাদরাসায় চলে আসি ও ক্লাসে অংশগ্রহণ করি।
যোহরের ছুটিতে হযরত মুহতামিম ছাহেব ঢিলা হাতে নিয়ে ইস্তেঞ্জায় যাচ্ছেন, আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, খানা জারী করেছ? উত্তর দিলাম, জী না। কারণ আমি এত বোকা ছিলাম যে, বোর্ডিং থেকে খানা জারি করতে হয় তা আমার জানা ছিল না। (সে বোকা তো আজও রয়েই গেলাম।) হযরত এমন একটি ভাব দেখালেন যে, এতে তিনি আশ্চর্য। আর আমি বোকা! আমাদের জামাতের আরেকজন ছাত্র ভাই আবুল কাশেম, তাকে আমার খানা জারী করে দিতে বললেন। খানা জারী হয়ে গেল। তখন থেকেই তাঁর শফকত, মহব্বত ও ¯েœহ-ভালবাসা পাওয়া শুরু হল। ইন্তেকাল পর্যন্ত রইল এবং দিন দিন বাড়তেই থাকল।
ছাত্রের প্রতি অসাধারণ ভালোবাসা
এক. জীবনের প্রথম হযরতের সাথে ঢাকা আসা হয় টঙ্গি বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে। সাথে তারই বড় ছাহেবজাদা বিদগ্ধ আলেমেদ্বীন মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র মুদীর, জনাব মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ (আমি তাঁর সাথে কাফিয়া জামাত থেকে নিয়ে মেশকাত জামাত পর্যন্ত পড়েছি) আর ভাই আবুল কাশেম। এর পূর্বে দূরের কোনো সফর হয়নি। তাই সফরে যে টাকা-পয়সা রাখতে হয় তাও অভিজ্ঞতায় ছিল না। ঢাকা আসব, ইজতেমায় আসব উল্লাসে উল্লাসে চলে এসেছি। সাথে কোনো টাকা-পয়সা নেই। বোকা তো তখনো বোকা, এখনো বোকা। প্রায় ১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে দোয়াভাঙ্গা স্টেশন পৌঁছলাম। সকলের বাস ভাড়া হযরতই দিলেন। ইজতেমা শেষে বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা হযরত নিজেই দেখালেন। ধানম-ি ১৫ নম্বর থেকে পায়ে হেঁটে ফার্মগেট ব্রীজের উপর দিয়ে তেজগাঁও তার নেসবতি বড় ভাইয়ের দোকানে। এখানে এসে বুরিন্দা ও পরোটা দিয়ে নাস্তা খাওয়া হল।
কোনো কোনো জায়গায় নিজেরাই দেখতে যাব। হযরত মাদরাসার কাজে ব্যস্ত। আমার টাকার প্রয়োজন তাই বললাম, হুযূর! পয়সা লাগবে। তখন হযরত নিজের পকেট দুই হাতে ফাঁক করে দিয়ে আমার সামনে এনে বললেন, নিয়ে নাও। আমি তো পুরোই বোকা। নিজ হাত হযরতের পকেটে ঢুকিয়ে প্রয়োজন মত পয়সা নিয়ে নিলাম। হযরত জিজ্ঞেসও করলেন না, কত নিয়েছ? এভাবে যতবার প্রয়োজন হয়েছে, তত বারই তিনি নিজ পকেট ফাঁক করে আমার সামনে ধরতেন; আর আমি স্বাধীনভাবে পয়সা নিয়ে নিতাম। তবে হিসাব রাখতাম কত নিয়েছি।
দেশে এসে বাড়ী থেকে পয়সা নিয়ে মাদরাসায় গিয়ে হযরতের পয়সাগুলো দিতে গেলে হযরত জিজ্ঞেস করলেন, কিসের পয়সা? বললাম, ঐ যে ঢাকার সফরে নিয়েছিলাম। হযরত বললেন, আমি কি তোমাকে পয়সা দিয়েছি? আরো বড় বোকা সেজে গেলাম। বোকামী থেকে তো আজও উদ্ধার হতে পারিনি। বললাম, হুযূর! আমি তো আপনার কাছ থেকে নিয়েছি এবং কখন কত নিয়েছি হিসাবও রেখেছি। হযরত বললেন, তুমি নিয়েছ, আমি তো দেইনি! ফেরত নেয়ার নিয়ত থাকলে তো আমিই দিতাম। পয়সাগুলো আর ফেরত নিলেন না। ছাত্রকে আর কীভাবে মহব্বত করবেন !!
দুই. একবার আমার হাম উঠেছিল। হযরত নিজেই ডাক্তার আনলেন, নিজ খরচে চিকিৎসা করালেন। আমার এক জামাত উপরের ছাত্র মাওলানা ফয়জুল্লাহ সাহেবকে দিয়ে করল্লা রান্না করিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। কারণ এ রোগে করল্লা খুব উপকারী।
তিন. মাদরাসার সালানা জলসায় বড় বড় আলেম ও ওয়ায়েজের জন্য উর্দূ ও ফারসী কবিতার মাধ্যমে তাহনিয়া তথা প্রশংসাপত্র পাঠ করতাম। তখন কবিতা আবৃত্তি করার খুব শখ ছিল। এগুলোর পাশে ফুল এঁকে সুন্দর করার জন্য রঙ্গের প্রয়োজন হতো। প্রাইমারীতে পড়ার সময় স্কুল থেকে যে রং-পেন্সিল পেয়েছিলাম বাড়ীতে সেগুলোর কিছু অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। তা আনতে বাড়ি যাব। হযরত বললেন, আমার থেকে পয়সা নিয়ে নাও, রং কিনে নাও। বাড়ি থেকে আনতে গেলে ২০/২১ কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হাঁটতে হবে, এতে তোমার অনেক কষ্ট হবে।
চার. ১৯৯০ সনের কথা, করাচী থেকে দেশে ফিরে খেড়িহর মাদরাসায় গেলাম সাক্ষাতে। গিয়ে দেখি হযরত মাদরাসায় নেই। মাদরাসার কাজে নোয়াখালী গেছেন। আমি রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। এখনো ঘুম আসেনি। হযরত এসেছেন। কে যেন হযরতকে জানিয়ে দিল, দিলাওয়ার এসেছে। জিজ্ঞেস করলেন, ওকে কী দিয়ে খানা খাইয়েছ? বলল, ডিম ভাজি আর ভেণ্ডি। শোনামাত্র একটি চিৎকার দিলেন, দিলাওয়ারের জন্য মুরগী জবাই করতে না পারলে আর কার জন্যে জবাই করবে?
পাঁচ. পরদিন সকালে আমার জায়গীর বাড়ির মরহুম ইবরাহীম মুন্সির ছেলে জনাব মরহুম মাওলানা আব্দুল কাদের ছাহেবের ঘরে গেলাম সাক্ষাৎ করতে। জানালা দিয়ে দেখি হযরত দ্রুত গতিতে কোথাও যাচ্ছেন। ভাবলাম হযরত চলে যাচ্ছেন, একটু পরে তো আমি চলে যাব, হযরত থেকে বিদায় নেব কীভাবে?
তাড়াহুড়া করে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হুযূর কোথায় যাচ্ছেন? একটু পর তো আমি চলে যাব। হযরত বললেন, আপনার খোঁজেই তো! আপনি আবার চলে গেলেন কি না? ইন্নালিল্লাহ্! হুযূর আপনার কাছে বলা ছাড়া কি আমি চলে যাব?!
ছয়. আমার বিদায়ের সময় আমার সাথে সাথে প্রায় অর্ধকিলো রাস্তা হেঁটে ‘রিক্সা স্ট্যান্ড’ পর্যন্ত আসলেন। তারপর একটি রিক্সা ঠিক করে নিজে ভাড়া দিয়ে দিলেন। বললাম, হুযূর আমার কাছে তো ভাড়া আছে। উত্তর দিলেন, তাহলে আমি এতটুকু পর্যন্ত আসলাম কেন? রিক্সাওয়ালাকে বললেন, ভাই আস্তে ধীরে দেখে শুনে চালাবে ও অনেক বড় আলেম। আল্লাহু আকবার! এত বড় একজন মনীষীর পক্ষে একজন নগণ্য ছাত্রের জন্য এতটুকু করা (যে নাকি তার পায়ের ধুলিকণার তুল্যও নয়) তার বড়ত্ব ও মহত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।
সাত. একবার মাদরাসার সালানা জলসা। আমি প্রথম দিন ছিলাম, দ্বিতীয় দিন অন্য কোথাও যেতে হবে। হযরত যখন শুনলেন যে, আমি থাকব না, সংবাদ পাঠালেন, দিলাওয়ারকে বল, সে চলে গেলে আজকে আর মাহফিল হবে না। মাহফিল হবে না- ঘোষণা করে দাও।
আট. মাহফিল শেষে হযরত আমাকে হাদিয়া দিচ্ছেন। বললাম, হুযূর এখানে আমি লেখাপড়া করেছি, এখান থেকে হাদিয়া নেব? হযরত বললেন, আপনাদেরকে হাদিয়া আরো বেশি দেয়া প্রয়োজন। আপনাদেরকে হাদিয়া না দিলে কাকে দেব?
নয়. মরহুম আব্দুল ওয়াদূদ খান সাব বললেন, যতদিন আল্লাহ পাক আপনাকে বাঁচিয়ে রাখেন, মাদরাসার মাহফিলে আসবেন এবং শুরার মিটিংয়েও আসবেন। আপনাকে শূরার সদস্য বানানো হল, এক দিনই দাওয়াত দিয়ে দিলাম।
দশ. জামি‘আ সুবহানিয়ার মুহাদ্দিস ও মুফতী জনাব মাওলানা মুফতী মহিউদ্দিন ছাহেব বলেছেন, একদিন হযরত বললেন, হাশরের মাঠে আল্লাহ পাক যদি জিজ্ঞেস করেন, শামছুল হক! কী নিয়ে এসেছ? তখন উত্তরে বলব, আল্লাহ! আর কোনো পুঁজি তো নেই তবে দিলাওয়ারকে পড়িয়ে এসেছি। সুবহানাল্লাহ্! ছাত্রকে কী পরিমাণ মহব্বত করলে, ছাত্রের মহব্বত কী পরিমাণ অন্তরে থাকলে এমন কথা বলতে পারেন!! আল্লাহ পাক হযরতকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন- আমীন
ছাত্র তারবিয়াত
হযরতকে কখনো লেখা-পড়ার জন্য কোনো ছাত্রকে পেটাতে দেখিনি। বেয়াদবী কিংবা গায়রে হাজিরীর জন্য পেটাতে দেখেছি।
কখনো কোনো কিছু নযরে পড়লে কালবিলম্ব না করে মসজিদেই নসীহতের মাধ্যমে সতর্ক করে দিতেন। আমি কখনো মাদরাসায় গেলে আমাকে দিয়ে ছাত্রদের উদ্দেশে বয়ান করাতেন, এমন কি মাঝেমধ্যে উস্তাযদের উদ্দেশেও। হযরত নিজেও বয়ানে বসতেন এবং কাঁদতেন। হযরতের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। পরবর্তীতে বয়ানগুলোর পুনরালোচনাও করতেন।
ক্লাসে বেত হাতে নিয়ে বসতেন না। মসজিদে তারবিয়াতের খাতিরে বেত ব্যবহার করতেন, আমাকে কখনো তার বেত খেতে হয়নি। আদব লেহাজ তো কখনো ছিল না, এখনো নেই। হয়ত মহব্বতের কারণেই এর নৌবাত আসেনি।
আকর্ষণীয় পাঠদান পদ্ধতি
হযরতের পাঠদান পদ্ধতি ছিল অসাধারণ। নাহব, ছরফ ও মানতেক বিষয়ে তাকে ইমাম মনে করা হতো। এ বিষয়ের সিলেবাসভুক্ত কিতাবগুলো যেন তার ঠোঁটস্থ ছিল; তথাপি পূর্ব মুতালাআ ব্যতীত ক্লাসে আসার অভ্যাস ছিল না।
পূর্বমুতালাআর নিয়ম ছিল, হাত নেড়ে নেড়ে এমনভাবে কিতাব দেখতেন, মনে হয় যেন এখন কাউকে পড়াচ্ছেন। হাত নেড়ে নেড়ে তাকে পড়া বুঝাচ্ছেন।
ক্লাসে ছাত্র কম হোক বা বেশি হোক জোরে জোরে আওয়াজ দিয়ে পড়াতেন। পাঠদান পদ্ধতি ছিল সহজ-সরল। কঠিন কঠিন কিতাবগুলো প্রায় তিনিই পড়াতেন। আমাদেরকে তিনি কাফিয়া, শরহে জামী, শরহে বেকায়া-২য় খ-, শরহে তাহযীব, কুতবী, সুল্লামুল উলূম, নাফহাতুল ইয়ামান ইত্যাদি কঠিন কিতাবগুলো পড়িয়েছেন। আল্লাহ পাক তাঁকে এর উত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন
ছাত্র গড়ার কারিগর
আরাম করলে তেমন কিছু বলতেন না। কিন্তু গল্প-গুজবে লিপ্ত হলে কিংবা বিনা কারণে সময় নষ্ট করাকে বরদাশত করতেন না। তাকরার তথা পাঠ পুনরাবৃত্তির প্রতি গুরুত্ব দিতেন অনেক বেশি।
আমাকে বয়ান করার ও শের-আশআর বানানোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন অসাধারণভাবে। এমনকি তিনি বলতেন যে, বহু আলেমের মুখে শে‘র শুনেছি, কিন্তু দিলাওয়ারের ন্যায় এমন সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কারো থেকে শুনিনি।
একবার মাদরাসার সালানা জলসা। নতুন মাইক খরীদ করা হল। আমি বিভিন্ন আলেমদের শানে মাহফিলে পড়ার জন্য যে উর্দূ ও ফারসী ভাষায় প্রশংসাপত্র লিখেছি সেগুলো হযরতের কামরায় বসেই নতুন মাইকে পড়া আরম্ভ করলাম। ছাত্ররা মাহফিলের কাজ ছেড়ে আমার পাশে জড়ো হতে লাগল। আমার উস্তায হযরত মাওলানা সাইফুল্লাহ ছাহেব দা. বা. এসে বললেন, দিলাওয়ার! হাত জোড় করে বলছি, আপনি এগুলো পড়া বন্ধ করুন। ছাত্রদেরকে কাজে ধরে রাখা যাচ্ছে না। সবাই এখানে এসে জড়ো হচ্ছে। কাজগুলো আজ শেষ করতে না পারলে কাল মাহফিল কীভাবে হবে? অথচ হযরত মুহতামিম ছাহেব হুযূরের কামরায় হুযূরের সামনেই পড়ছিলাম। হুযূর নিষেধ করছেন না। নিষেধ করবেনই বা কী, হুযূর তো নিজেই শুনছিলেন। আল্লাহু আকবার!
মাদরাসা থেকে বিদায় কীভাবে দিলেন?
হিদায়া জামাত পড়া শেষ। মাদরাসায় আর জামাত নেই, হঠাৎ নামাযের পর সবাইকে বসতে বললেন। এখন বিদায় অনুষ্ঠান হবে। এর আগে এ মাদরাসায় আর কখনো বিদায় অনুষ্ঠান হয়নি। বাহারবাড়ির মরহুম মাস্টার সাহেব বললেন, দিলাওয়ার কিছু বলো! সকল উস্তায ও ছাত্র ভাইয়েরা উপস্থিত। আমি একেবারেই অপ্রস্তুত। কারণ বিদায় অনুষ্ঠান হবে তা তো আগে জানতাম না। ইতিপূর্বে কখনো এমন অনুষ্ঠান দেখিনি। যাইহোক হুকুম আসলো, দাঁড়িয়ে গেলাম। আল্লাহ পাক অন্তরে ঢাললেন-
مادر قفائے رزق و اجل درقفائے ما
অর্থ : আমরা রিযিকের পেছনে দৌড়াচ্ছি আর মৃত্যু আমাদের পেছনে দৌড়াচ্ছে।
বুঝাতে চাইলাম, এখানে হয়ত আমার রিযিক শেষ হয়ে গেছে। কোথায় আছে জানি না। হয়তো সে অজানা জায়গাতেই আমাকে যেতে হবে। অতপর বললাম, উস্তাযগণ আমাদের রূহানী পিতা আর আমরা তাদের ছোট ছোট সন্তান। ছোটদের কাজ হল ভুল করা আর বড়দের কাজ হলো ক্ষমা করা। আমরা আমাদের কাজে কোনো ত্রুটি করিনি। এবার বড়দের কাজ বড়রা করবেন।
ছাত্রদের প্রতি কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকলে নিজেই বিদায় অনুষ্ঠান ডাকতে পারেন!!
খেড়িহর মাদরাসার বিশাল উন্নতি তাঁরই হাতে
দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা মাদরাসার ফিকির নিয়ে থাকতেন, তা আমাদের চোখের দেখা। যৌবনকালে কখনো কোনো শুক্রবারে বা মাদরাসা ছুটি হলে বাড়ি যেতেন। মাদরাসা থেকে বাড়ির দূরত্ব ১৫/১৬ কিলোমিটার হবে। পায়ে হেঁটে যাওয়া ব্যতীত আর কোনো পন্থা ছিল না। বৃহস্পতিবার মাদরাসার কাজ শেষ করে বাড়ি রওয়ানা হতেন। শনিবার সবক শুরু হওয়ার আগে মাদরাসায় পৌঁছে যেতেন।
হাঁটার দৃশ্য ছিল এরকম, তার থেকে ১৫/২০ হাত পেছনে তার বড় ছাহেবজাদা বিদগ্ধ ও বরেণ্য আলেম জনাব মাওলানা মুফতী আব্দুল্লাহ ছাহেব। এর ১৫/২০ হাত পেছনে বর্তমান বাংলাদেশের শুধু নয়; গোটা ভারতবর্ষের বললেও ভুল হবে না- সর্বশ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ, বিচক্ষণ ফকীহ, গবেষক ও লেখক জনাব মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব। সংসারের কাজকর্ম এ এক-আধ দিনে যতটুকু সম্ভব করতেন, কিন্তু মাদরাসার কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে- তা মোটেও বরদাশত করতেন না। এমন মহামনীষীদের ব্যাপারেই বলা যায়-
ہمیں دنیا سے کیا مطلب مدرسہ ہے وطن اپنا مرینگے ہم کتابوں پر ورق ہوگا کفن اپنا
অর্থ : আমরা দুনিয়া দিয়ে কী করব? মাদরাসাই তো আমাদের আসল বাড়ী। আমরা কিতাবের উপরই মারা যাব, আর কিতাবের পাতাই হবে আমাদের কাফন।
শেষ বয়সে এসে বহু বছর যাবৎ ঘর সংসার প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। মাদরাসাতেই পড়ে থাকতেন। তার মন মানসিকতা ও রগ-রেশায় মাদরাসা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
শূরার মিটিংয়ে তার অজীফা বৃদ্ধি করার কথা উঠলেই -তার শুরু জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত- অন্তর থেকে নিষেধ করতেন। হযরত বলতেন, আমার অজীফা বৃদ্ধি করবেন না। এমনকি আমাদের ওখানে থাকাকালীন হযরত মাওলানা মুফতী হাবীবুর রহমান রাহ.-কে ফরিদাবাদ মাদরাসা থেকে খেড়িহর মাদরাসায় নিয়ে আসলেন ৭০০/- টাকা অজীফা দিয়ে। অথচ তখন তার নিজের অজীফা ছিল মাত্র ৪০০/- টাকা। মুহতামিম থেকে অধিক অজীফা দিয়ে উস্তায রাখা আমার দৃষ্টিতে বিরল। এসব কিছু তাঁর মাদরাসা ও লেখা-পড়ার প্রতি স্বচ্ছ ইখলাসেরই বহিঃপ্রকাশ। বর্তমানে মাদরাসার এসব জাহেরী ও বাতেনী উন্নতি তাঁরই হাতে হয়েছে।
এরই ফল ও তাঁর সহধর্মিনীর বরকত, তাদের পরিবারে এমন কতগুলো সন্তান জন্ম নিয়েছেন, যাদের নযীর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আল্লাহ পাক তাদেরকে বরকতময় জীবন ও উভয় জাহানে কামিয়াবী দান করুন- আমীন
হযরতের হাতে গড়া আলেম
তেমনিভাবে মাদরাসা থেকে জন্মেছে একঝাঁক রূহানী সন্তান, যারা সারা দেশে বরেণ্য আলেম হিসাবে খ্যাত। তন্মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি। জনাব মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ, মুদীর মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা। মুহাদ্দিসে বে-বদল, উজুবায়ে রোযগার জনাব মাওলানা আবদুল মালেক, আমীনুত তালীম, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা। হযরত মাওলানা রশীদ আহমাদ, মুহাদ্দিস, উজানী জামিআ ইবরাহীমিয়া মাদরাসা। জনাব মাওলানা হোসাইন আহমাদ ছাহেব, নায়েবে মুহতামিম, খেড়িহর মাদরাসা। জনাব মাওলানা সাঈদ আহমাদ ছাহেব, মুহাদ্দিস, রাজফুলবাড়ীয়া মাদরাসা, সাভার, ঢাকা। আরো বহু আলেম উক্ত মাদরাসায় তাঁর হাতে জন্ম নিয়েছেন। আল্লাহ পাক তাঁকে এর উত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন
এলাকার পরিবর্তন
মাদরাসার প্রথম দিকে এলাকা মাদরাসার অনুকূলে ছিল না। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরকে ওয়াহাবী বলে আখ্যায়িত করা হতো। আমাদের সময় মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে বাংলাদেশের বরেণ্য আলেম ও ওয়ায়েজ তাশরীফ আনতেন। যেমন, খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমাদ রাহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক রাহ., হযরত মাওলানা মোবারক করীম রাহ., পীর সাহেব, উজানী। হযরত মাওলানা শরাফত করীম রাহ., মেজো পীর ছাহেব উজানী। পীর দুদুমিয়া রাহ., বাহাদুরপুর, মাদারীপুর। হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ মেসবাহ্ রাহ., নোয়াখালী। হযরত মাওলানা মোস্তফা আল হোসাইনী রাহ., ফেনুয়া, কুমিল্লা। হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান জামী রাহ., মোমেনশাহী। হযরত মাওলানা মুফতী ইউসুফ ছাহেব, ফতেহপুর, চট্টগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু শ্রোতা হতো দুই থেকে আড়াইশ মানুষ। তাও অনেকেই আমাদের লাকসাম মনোহরগঞ্জ এলাকা থেকে আসতেন। সে জায়গায় আজ মাহফিলে ওয়ায়েজ হিসাবে যাই আমরা! আমাদের তো উল্লেখিত আলেমদের ওয়াজ বুঝার মত যোগ্যতাও নেই। তথাপি এখন মাহফিলে লোক জায়গা দেয়া যায় না। এখন পুরা এলাকা হামওয়ার ও মাদরাসার অনুকূলে। এসব তারই ইখলাস ও ইস্তেখলাছের বরকত এবং হযরত মাওলানা আমীনুল্লাহ রাহ. বটতলী হুযূর ও হযরত মাওলানা নূরুযযামান রাহ. চিল্লার হুযূরের ইখলাস ও দু‘আর ফসল এবং হযরত মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান নাযেম ছাহেব হুযূরের হুসনে তাদবীরের ফল। اللهم زد فزد ।
মাদরাসা ও ছাত্রদের জন্য ফেদা আমাদের আসাতিযা কেরামের মধ্যে ঐ মাদরাসার তখনকার যে উস্তাযগণ এখনো বা-হায়াত রয়েছেন- হযরত মাওলানা সাইফুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম। আল্লাহ তাঁকে আফিয়াতের সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। আমাদের সকল মরহুম উস্তাযকে মাগফিরাত নছীব করুন এবং তাদের দারাজাত বুলন্দ করুন- আমীন।
কারামাত
এতক্ষণ যাবৎ যা কিছু বলা হল সবগুলোই তার কারামাত বললে চলে। এখানে ভিন্ন একটি কারামাতের কথা বলব আমার ¯েœহাস্পদ ছাত্র জনাব মাওলানা মুফতী আব্দুল আউয়াল ছাহেব (খেড়িহর মাদরাসায় পড়াকালীন হযরতের খেদমত করতেন) রমাযান মাসে সাহরীর সময় গিয়ে হযরতকে জাগাতেন।
একদিন ঘটনাক্রমে তার জাগাতে দেরি হয়ে যায়। এদিকে সাহরির সময় শেষ হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। তিনি বলেন, আমি তাড়াহুড়া করে তাঁর কক্ষের দরজা নাড়া দিলাম। তিনি জেগে দুয়ার খুললেন। ভয়ে ভয়ে বললাম, হুযূর! সময় আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে। হযরত নিজ গ্রামের ভাষায় বললেন, ‘কথা কইচ্ছা’। আমি ভাবলাম তাড়াহুড়া করে কিছু খেয়ে নিবেন। কিন্তু তিনি অন্যান্য দিনের ন্যায় হাম্মামে গেলেন। উযূ-ইস্তেঞ্জা সেরে দু’রাকাত নামায পড়লেন। ওষুধ সেবন করলেন, খাওয়া-দাওয়া সারলেন; কিন্তু সাহরীর সময়ের বাকি এ পাঁচ মিনিট তখনো শেষ হয়নি। সুবহানাল্লাহ্।
বিদায়কাল
জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ইলমের খেদমত করে অসংখ্য আলেম-উলামা তৈরি করে, বিশাল মাদরাসা গড়ে তুলে এবং এলাকার অসাধারণ পরিবর্তন ঘটিয়ে এ মহামনীষী আল্লাহ্র সান্নিধ্যে চলে গেলেন। কারো জন্য এ ধরায় চিরদিন থাকা না সম্ভব হয়েছে, না হবে। সকলকেই বিদায় নিতে হবে এ ধরা ত্যাগ করে। যদি জীবিত থাকা কারো জন্য শোভা পেত তাহলে সায়্যিদুল মুরসালীন খাতামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যই তা শোভা পেত।
بدنیا گر کسے پائندہ بودے
ابو القاسم محمد زندہ بودے
আমাদেরকেও একসময় বিদায় নিতে হবে এ নশ্বর জগত ছেড়ে। অতএব আল্লাহ পাক হযরতের ন্যায় আমাদেরকেও ইখলাসের সাথে দ্বীনের খেদমত করে আখেরাতের পুঁজি জোগাড়ের তাওফীক দান করুন। আমার উস্তাযের কবরকে জান্নাতের গোলযার বানিয়ে দিন এবং জান্নাতে দান করুন উচ্চ মর্যাদা- আমীন। ষ
سقا الله ثراه وجعل الجنة مثواه
فضل حق تیری لحد پر رحمت افشانی کرے دم بدم میرے خدا تیری نگہبانی کرے۔