একটি কিনলে একটি ফ্রি! প্রতারিত যেন না হই
ছোট বেলায় ফার্সী সাহিত্যে শেখ সা‘দী রাহ.-এর একটি নীতিবাক্য পড়েছিলাম-
خوردن براۓ زيستن ست، نہ زيستن براۓ خوردن.
অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য আহার, আহারের জন্য বেঁচে থাকা নয়।
বক্তব্যটি সম্ভবত অনেকেরই জানা, অন্যান্য ভাষাতেও তা থাকবে। নীতিগতভাবে এই বক্তব্যের সাথে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়, দ্বিমত থাকলেও সেটা নিজের ভেতর পুষে রাখাটাই শ্রেয় মনে করার কথা, কিন্তু এখন আমাদের চারপাশের পরিবেশে এই নীতিবাক্য যেন সেকেলে হয়ে পড়েছে। খাবার-দাবার নিয়ে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি, নানা প্রসঙ্গে ফোর স্টার, ফাইভ স্টার হোটেলগুলোর হেন অফার, তেন অফার দৃষ্টে মনে হয় এখন যেন খাওয়ার জন্যই মানুষের বেঁচে থাকা!
এই কথাগুলো আমার সাধারণত মনে পড়ে পবিত্র রমযান মাসে। দেশের নামকরা হোটেলগুলো থেকে সাহরি-ইফতারের নানা ক্যাটাগরির অফারের ছড়াছড়ি দেখে প্রতিবারই মনে হয় কিছু লিখি। কিন্তু যখন মনে পড়ে তখন আর সময় থাকে না, রমযানের পত্রিকা প্রেসে চলে যায়। তাই এবার এ বিষয়ে দুটি কথা একটু আগেভাগেই বলার ইচ্ছা করেছি।
আগেভাগে বলার পিছনে আরেকটি কারণও অবশ্য আছে। এজাতীয় অফার আগে দেখা যেত সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি নবআবিষ্কৃত ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষেও দেখা গেল এইসব অফারের ছড়াছড়ি। ফুর্তিবাজ প্রকৃতির লোকদের জন্য এইসব অফার লোভনীয় হয়ে থাকে। ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান’ ধরনের অফারে যার পেটে ক্ষিধে নেই তারও জিভে জল আসে! অথচ এসব যে পুঁজিবাদের নানা অপকৌশল তা সচেতন ব্যক্তিদের কাছে অস্পষ্ট নয়।
এখানে স্বভাবতই এই প্রশ্নটি সামনে এসে যায় যে, তাহলে নানাবিধ দিবস উদ্ভাবন ও তার প্রচার-প্রতিষ্ঠার পেছনে কি একশ্রেণির লোকের মুনাফা হাসিলের পরিকল্পনাই কার্যকর। দিবসের নামে নানা প্রকারের অনাচার-অশ্লীলতা বিস্তারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের গাঁটের টাকা খসানো ছাড়া আর কিছু তো এসব ক্ষেত্রে নজরে পড়ে না। একেকটি দিবস বা উৎসবকে কেন্দ্র করে খাবার-দাবার, পোষাক-আশাক, ফ্যাশন-বিনোদনের যেন ঝড় বয়ে যায়। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজের মধ্যবিত্ত নামে আখ্যায়িত শ্রেণিটি। একটি শ্রেণি তো আছে, যারা অর্থ ঢালার জায়গা খুঁজে পায় না। বৈধ-অবৈধ, হালাল-হারামের বাছ-বিচার ছাড়া যারা বিত্তের পাহাড় গড়েছেন তাদের জন্য এইসব আয়োজনে অর্থ ব্যয় খাবারের পর মিষ্টিমুখের মতো প্রীতিকর হলেও সমাজের বৃহত্তর মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্যে এইসব অফার-আয়োজন কতটা উপযুক্ত তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বৈ কি। অপরিমেয় বিত্তের অধিকারী না হওয়ায় এই শ্রেণিটিকে দুই পথের যে কোনো একটি অবলম্বন করতে হয়; হয়তো নিজের ও পরিবার-পরিজনের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়াদিতে কাটছাঁট করে এইসব অপচয়ের জন্য অর্থ-সংস্থান করতে হয়, কিংবা অন্যায়-অবৈধ পথে অতিরিক্ত উপার্জন খোঁজ করতে হয়। বলা বাহুল্য যে, এর কুফল শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বৃহত্তর সমাজকেও তা অনৈতিকতার পথে ধাবিত করে। পুঁজিবাদী অর্থ ও সমাজ-ব্যবস্থার এই সুদূরপ্রসারী কুফল সম্পর্কে সচেতন হওয়া অতি প্রয়োজন।
ইফতার-সাহরি
কথা শুরু হয়েছিল সাহরি-ইফতারি নিয়ে। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও প্রসঙ্গটি শুধু ইফতারিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। চকবাজার ও পুরান ঢাকার ইফতার-সামগ্রী ও ইফতার-আয়োজন ছিল বেশ আলোচিত। কিন্তু এখন তা আর ইফতারির মধ্যে সীমবদ্ধ নেই। এখন সাহরি নিয়েও আছে ব্যাপক মাতামাতি। বড় বড় হোটেলগুলোতে এখন সাহরি-ইফতারির নানা আয়োজন থাকে। আয়োজনের সাথে থাকে বিস্তর প্রচার-প্রচারণা। যেন রমযান মাসটি শুধুই সাহরি আর ইফতারির জন্য। রমযানের মূল করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে আলোচনার পরিবর্তে সাহরি-ইফতারিতে কোথায় কী মেনু, কোথায় কী অফার তা-ই হয়ে ওঠে মুখ্য। পুঁজিবাদের এই সর্বগ্রাসী বিজ্ঞাপনের মাঝেই বিজ্ঞাপনের স্বার্থে উচ্চারিত হয় ‘সংযম’ কথাটিও! পরিহাসের ব্যাপার হল মূল্য ছাড় বা অফারের ঘোষণা আসে শুধু খাবার ও পোশাক-প্রসাধনীর ক্ষেত্রে। যেসব জায়গায় মূলত স্বল্প সংখ্যক ধনাঢ্য শ্রেণির লোকদেরই প্রবেশাধিকার থাকে। অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় ও আম জনতার ভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে তা করা হয় আকাশচুম্বি। যার দরুন সাধারণ মানুষের জীবন যাপন হয়ে ওঠে কঠিন থেকে কঠিনতর।
এভাবে রোযা ও রমযানের মূল শিক্ষা ও আবেদন যেমন চাপা পড়ে যায় তেমনি খরচও বেড়ে যায়। যা জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। মোবাইল ফোনে-ইমেইলে নানা প্রকারের অফার এত বেশি আসতে থাকে যে, সেগুলো পরিষ্কার করতেও উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় হয়।
ফ্রি আসলে কি ফ্রি?
কুরবানীর গরুর হাটে মাঝে মাঝে বিশালাকারের গরুগুলোর সাথে ছাগলও ফ্রি দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে আমাকে কেউ একজন প্রশ্ন করেছিল ঐ ফ্রি ছাগলটি দিয়ে ওয়াজিব কুরবানী দেয়া যাবে কি না? উত্তরে আমি বলেছিলাম ফ্রি দিতে যাবে কেন? সে কি আপনার আত্নীয় হয়? এটিকে ফ্রি নাম দেয়া হলেও মূলত দুটি পশুর একত্রে দাম নেয়া হয়েছে। আপনি যে মূল্য পরিশোধ করেছেন তাতে উভয় পশুর মূল্যই রয়েছে। আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য কেবল ফ্রি নাম দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বড় বড় ডিসকাউন্ট ও এটা ফ্রি ওটা ফ্রি জাতীয় অফারগুলোও একই প্রকৃতির। সামান্য বিবেক খাটালেই বুঝে আসবে যে, এসবই তাদের নিজের স্বার্থে। একেকটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তাদের বিক্রির পরিমাণ বহু গুণ বাড়িয়ে নেয়ার স্বার্থেই তারা এ কৌশল অবলম্বন করে। আর এক শ্রেণির অবুঝ ক্রেতা প্রয়োজন না থাকলেও তথাকথিত ‘ফ্রি’ বা ডিসকাউন্ট পাওয়ার আশায় তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিষয়টি অনেক বিস্তৃত। পুঁজিবাদের এজাতীয় ব্যাপারগুলোর কু প্রভাব এবং তাদেরই মালিকানাধীন মিডিয়া তথা টেলিভিশন, পেপার-পত্রিকা এবং বর্তমানের সোশ্যাল মিডিয়ায় ওগুলোর বিজ্ঞাপনের অত্যাচার নিয়ে বলার আছে অনেক কিছুই। আজ আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, পবিত্র রমযানে যেন আমরা অপ্রয়োজনে এসবের পিছে না ছুটি।
আমরা হয়তো পুঁজিবাদের এই বিশ্বব্যাপী আগ্রাসনকে ঠেকাতে পারব না কিন্তু নিজেকে তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
নানা উপলক্ষে এইসব অফারের ফাঁদে পা না দিয়ে আসুন আমরা স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হই। হালাল উপার্জনে মিতব্যয়ী জীবন যাপন করি। তাহলে আমাদের দুনিয়াও সুন্দর হবে, আখিরাতও সুন্দর হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন- আমীন।