Rajab 1431   ||   July 2010

বাজেট আসে বাজেট যায়, গরীবের ভাগ্য বদল হয় না

দেশে নতুন অর্থবছর শুরু হয়ে গেছে এবং দেশের জনগণ যথারীতি বিশাল আকারের একটি বাজেট উপহার পেয়েছে। গত ১১ জুন সংসদে ২০১০-২০১১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহীত। এবারের বাজেটের আকার হচ্ছে এক লক্ষ ৩২ হাজার এক শত সত্তর কোটি টাকা। আর রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯২ হাজার ৮ শত ৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজেটে ঘাটতি থাকছে ৩৯ হাজার ৩ শত ২৩ কোটি টাকা। আগে অনেক মানুষ গুরুত্বের সাথে বাজেট-বক্তৃতা শ্রবণ করত, এরপর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হত এবং পক্ষে বিপক্ষে মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানাত। এখন তা খুব একটা লক্ষ করা যায় না। গত কয়েক বছর ধরেই বাজেট নিয়ে গণমানুষের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। এবছর সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার পর প্রায় ২০ দিন অতিবাহিত হলেও সংসদে মহাজোট এমপিদের বক্তৃতা ছাড়া এ নিয়ে ব্যাপক কোনো আগ্রহ বা মাতামাতি নেই বললেই চলে। দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও বাজেট নিয়ে ফিচার-প্রবন্ধ এবার খুবই কম ছাপা হয়েছে। কয়েকজন বর্ষীয়ান প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্টও উপরের কথাগুলো উল্লেখ করে জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখেছেন। কিন্তু এমন কেন হবে? বাজেট নিয়ে গণমানুষের আগ্রহে ভাটা পড়ার কারণ কী? বাজেট যেহেতু একটি রাষ্ট্রের নতুন অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের আগাম প্রাক্কলন এবং খাতওয়ারি বরাদ্দের ও আগামী এক বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনার দলীল তাই এটি নিয়ে নাগরিকদের আগ্রহ তুঙ্গে থাকার কথা। তা না হয়ে উল্টোটা কেন হচ্ছে? দেশের লোকজনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শ্রেণীবিশেষে এর বিভিন্ন জওয়াব পাওয়া যাবে। তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ নাগরিকদেরকে (যাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি) বাজেট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সোজাসাপ্‌টা জবাব পাওয়া যাবে যে, এ নিয়ে ভেবে আমাদের কী লাভ, এ তো মন্ত্রী-এমপি ও ব্যবসায়ীদের বিষয়, আমরা শুধু এইটুকু জানি যে, প্রতি বছর এই সময় দ্রব্যমূল্য নতুন করে বাড়ে এবং জনদুর্ভোগ পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। আর দল-নিরপেক্ষ শিক্ষিত সমাজকে প্রশ্ন করা হলে তারা হয়তো বলবেন, বাজেট তো এখন গতানুগতিক একটি বিষয়। প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় বাজেটের আকার অনেক বড় হবে, জনগণের উপর নতুন করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বহু রকমের কর আরোপিত হবে, জনগণের নামে হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লাইসেন্স সংসদ থেকে নেওয়া হবে এবং এর সুদও পরিশোধিত হবে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দ্বারাই। এরপর সাধারণ জনগণকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধির খতিয়ান শোনানো হবে এবং ১৫/১৬ দিন এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক বাহাছের পর অথবা ক্ষেত্রবিশেষে একতরফা আলোচনার মাধ্যমে গরীববান্ধব ও উন্নয়নের বিশাল দলীল আখ্যা দিয়ে জুনের শেষাশেষি তা পাস হয়ে যাবে। এটি তো আমাদের কাছে অতি পরিচিত বিষয়, সুতরাং এ নিয়ে আগ্রহ দেখাবার কী আছে! এভাবেই ধীরে ধীরে অনেক কিছু আমাদের গাসওয়া হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নেতা-নেত্রীদের মিথ্যাচার ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, আমলাদের দৌরাত্ম এসব কিছুই মানুষ এখন স্বাভাবিকভাবে হজম করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ধরে নিচ্ছে, এটিই আমাদের নিয়তি। আর নতুন প্রজন্ম হয়তো এটাকেই আদর্শ সমাজব্যবস্থা ভেবে বড় হয়ে উঠছে। ঘুনেধরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা, মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে ধনতান্ত্রিক প্রতারণামূলক অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থা, নৈতিকতাহীন ভোগবাদী শিক্ষাব্যবস্থা এবং অবক্ষয়মান সমাজব্যবস্থায় এখন অনেকট অভ্যস্থ হয়ে ওঠছে এদেশের মানুষ। জাতীয় বাজেট সম্পর্কে বলছিলাম। রাষ্ট্র্রের আয় ও ব্যয়ের খতিয়ান ও প্রাক্কলনের শুরুতেই সম্ভাব্য আয়ের চেয়ে ৩০% বেশি ব্যয় করার চিন্তা করা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য নিয়মিত এমন একটি বাজেট করে যে, সে আগামী বছর খরচ করবে ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা, অথচ তার আয় হবে এক লক্ষ টাকা। অবশিষ্ট ৩০ হাজার টাকা সে ঋণ নিবে অথবা কিছু টাকা বন্ধুদের থেকে অনুদান হিসাবে চেয়ে নিবে। ঋণের টাকার বিপরীতে সে নিয়মিত সুদ আদায় করবে এবং সুদ পরিশোধ করাই হবে তার মাসিক খরচের অন্যতম বড় খাত। আর অনুদানের জন্য হয়তো বন্ধুরা তাকে দু’চার কথা বলবে, মাসে মাসে উপদেশ শোনাবে, কখনোবা কড়া শর্তারোপ করবে তবুও সে ঋণ ও অনুদান নিতে পিছপা হবে না এবং তার খরচের লাগামও টেনে ধরবে না। তা হলে সে লোকটিকে মানুষ কী বলবে? নিশ্চয়ই ভালো কিছু নয়। অথচ এ কাজটিই নিয়মিত করে যাচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার। সাধারণ নিয়মে আয় অনুপাতে ব্যয় করার কথা থাকলেও বাজেটের ক্ষেত্রে হয় এর উল্টোটা। প্রথমেই বিশাল অংকের খরচের পরিকল্পনা, এরপর সে খরচ নির্বাহের জন্য সাধারণ জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা চাপানো, উপরন্তু বড় অংকের ঋণ নিয়ে জনগণের টাকায় তার সুদ আদায় এবং বিদেশীদের থেকে অনুদান নিয়ে জাতিকে হেয়প্রতিপন্ন করা এখন আমাদের বাজেটের নিয়মিত চিত্র। ২০১০-২০১১ অর্থবছরের বাজেটেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে ৩৯ হাজার তিন শত ২৩ কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি পূরণের জন্য নির্ভর করা হয়েছে ব্যাংকিং ঋণ, অব্যাংকিং ঋণ ও বৈদেশিক অনুদানের উপর। অথচ উচিত ছিল খরচের পরিকল্পনাটা এমনভাবে করা যেন ঋণ ও অনুদানের মুখাপেক্ষী না হতে হয়। কিন্তু তা না করে প্রতি বছর ইচ্ছেমতো ঋণ করতে গিয়ে এখন প্রতিটি নাগরিকের ঘাড়ে বিশাল ঋণের বোঝা। আর সে ঋণের সুদ নিজের অজান্তেই আদায় করে যাচ্ছে ধনী-গরীব নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিক। এবারও বাজেটের ২য় সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ আদায়ের জন্য, পুরো বাজেটের ১১.১% সুদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে। টাকার অংকে যার পরিমাণ ১৪ হাজার ৬ শত ৭১ কোটি টাকা প্রায়। ইসলামে সুদ নিকৃষ্টতম হারাম হওয়ায় অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমান তা থেকে বিরত থাকলেও তাদের রাষ্ট্র ও সরকার তাদের নামে অহরহ সুদী ঋণ নিচ্ছে এবং তাদের টাকায় এর সুদ আদায় করছে। ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য দেশীয় ঋণ ছাড়া এ বছর বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তি ও বৈদেশিক অনুদানের প্রাক্কলন করা হয়েছে যথাক্রমে ৮.২% ও ৩.৬% (মোট ১১.৮%)। আর এ ঋণ ও অনুদানের জন্য বিদেশীদেরকে সুদ দেওয়া ছাড়াও রয়েছে তাদের কটুকথা, অযাচিত উপদেশ ও মুরুব্বিয়ানা এবং বিভিন্ন মানহানীকর শর্ত মেনে নেওয়ার মতো অসংখ্য লাঞ্ছনার বিষয়। কিন্তু যদি ১১-১২% কম খরচের চিন্তা করা হত তাহলে এমনটি হত না। কর বা শুল্কনীতি ও কাঠামো নিয়ে লেখাটা অরণ্যে রোদন। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকেই জালেম রাজা-বাদশা ও একনায়কদের শোষণ বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু পুঁজিবাদী তথা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির কল্যাণে (!) সাধারণ মানুষ পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি জিম্মি হয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর ইচ্ছার কাছে। যদি তাই না হবে তাহলে কেন এ ব্যবস্থায় একজন নিম্ন আয়ের ব্যক্তি, এমনকি রাস্তার ভিখারীকেও প্রতিনিয়ত করের বোঝা বহন করতে হচ্ছে? মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট নামের এই কর দিয়ে যাচ্ছি আমরা ঔষধ বড়ি ও সাধারণ কেনা-কাটা থেকে আরম্ভ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এমনকি ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও হাসপাতালের বিলের সাথেও। এ করটি মূল্যের সাথে সংযোজিত হওয়ায় অনেকের জানাও নেই যে, তারা নিজেদের অজান্তেই তা আদায় করে যাচ্ছে। ক’দিন আগে একজন সাংবাদিক খুব আফসোসের সাথে বলছিলেন যে, ‘ডাক্তারের পরামর্শে তার শিশুসন্তানের কিছু পরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গেছেন আর সেখানে বড় বিলের সাথে তার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ভ্যাট বাবদ আরো ১০০ টাকা। সীমিত আয়ের লোকটি যা দিতে গিয়ে মনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তাঁকে বলছিলাম যে, ‘এধরনের ভ্যাট আমরা প্রতিনিয়ত আদায় করে যাচ্ছি। আপনি মোবাইলে ১ টাকার কথা বললে ১৫ পয়সা কর পরিশোধ করছেন যদিও আপনার কলটি অতি প্রয়োজনীয় এবং আপনি অতি দরিদ্র বা উপার্জনহীন একজন ব্যক্তি। হাসপাতালের বিলে ভ্যাট পৃথক করে দেখানোর কারণে তা আপনার চোখে পড়েছে।’ যেখানে রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা করা সেখানে কি না রাষ্ট্র সে খরচের বোঝাকে আরো ভারি করছে করারোপের মাধ্যমে। এবারের বাজেটে ২৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি ভ্যাট আদায়ের কথা বলা হয়েছে এবং ছোট ব্যবসায়ীদেরকেও ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ভ্যাট নামক করটি আদায় হবে ধনী-গরীব, উচ্চ আয়ী, নিম্ন আয়ী সকল মানুষ থেকে। এ ছাড়া বড় লোকদের উপর আরোপিত করের বোঝাও যে পরোক্ষভাবে সাধারণ জনগণই আদায় করে থাকে তা তো অভিজ্ঞ মহলের অজানা নয়। বাজেটে বিলাসসামগ্রী ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানীতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কোটি কোটি টাকার গাড়ি আমদানীতেও কোনো বাধা নেই। শুধু কর পরিশোধ করলেই হল। অথচ এসব ব্যয়বহুল পণ্য আমদানী করা হয় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণে তৈরি হওয়া দ্রব্যাদি রপ্তানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। বাজেটে বরাবরই এডিপি বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য যে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয় তা পুরো খরচ হয় না বা উন্নয়ন খাতে বেশি নজর দেওয়ার মতো সময় রাষ্ট্রের হয় না। কিন্তু তারপরও বছরের শুরুতে বড় বরাদ্দ রেখে পরে তা কাটছাঁট করা হয়। অথচ অনুন্নয়ন খাতের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়ে বেশি খরচ হয়ে থাকে প্রায় প্রতিবছর। নতুন বছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা-খাত ও কৃষি-খাতে বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা সাধারণ দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়। কিন্তু অভিজ্ঞ মহল তাকে বলছেন উচ্চাভিলাষী এবং তাদের মতে সরকারের জন্য তা বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ যাদের জন্য এ বরাদ্দ, সে প্রান্তিক কৃষক এবং হতদরিদ্রের হাতে এসব টাকা কমই পৌঁছে থাকে। সুতরাং বরাদ্দের চেয়ে বেশি জোর দিতে হবে তা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তার উপর। ধর্মীয় খাতে এ বছর কত বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি তবে তা নিশ্চয়ই ১% এরও কম। কারণ সংস্কৃতি, বিনোদন ও ধর্ম এ তিন খাতের সম্মিলিত বরাদ্দ ১.২%। অথচ ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া মানষের মাঝে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা প্রায় অসম্ভব। আর নৈতিকতার উন্নতি ছাড়া ঘুষ, দুর্নীতি, ছিনতাই, চুরি, টেণ্ডারবাজি ও কালোবাজারীর মতো রোগগুলো দূর করার চিন্তা তো ইতিমধ্যেই অসার প্রমাণিত হয়েছে। মোটকথা, দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণমূলক বাজেটের চিন্তা করলে অবশ্যই পুঁজিবাদের গলিত নীতির গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং ফিরে যেতে হবে ইসলামের শাশ্বত ইনসাফভিত্তিক অর্থব্যবস্থার দিকে। তখনই প্রকৃত অর্থে বলা যাবে এটি গরীববান্ধব ও কল্যাণকর বাজেট। দোয়ায়ে মাগফিরাতের আবেদন গত ১৮ জুন শুক্রবার সড়কদুর্ঘটনায় মাওলানা আইনুদ্দীন আলআজাদ ইন্তেকাল করেন। পাঠকবৃন্দের নিকট তাঁর জন্য দোয়ায়ে মাগফিরাতের আবেদন করা হচ্ছে।

 

advertisement