Jumadal Ula 1440   ||   February 2019

পরিযায়ী পাখি : শুধুই উপভোগ নয়

ইবনে নসীব

শীতকালে আমাদের দেশের হাওড়, বিল, জলাশয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায় রং বে-রংয়ের পাখি। এদের আমরা আদর করে বলি ‘অতিথি পাখী’। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা মুখরিত হয়ে ওঠে পাখির কলকাকলিতে। ঢাকার জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক ও জলাশয়, নিলফামারী জেলার নীলসাগর দিঘি, দেশের সর্ববৃহৎ হাওড় হাকালুকি ও বৃহত্তর সিলেটের বাইক্কা বিলসহ দেশের বিভিন্ন জলাশয় এখন হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখরিত। আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট এই প্রকৃতির অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য দেখার জন্য নিসর্গ-প্রিয় মানুষ ঐসকল স্থান ভ্রমণ করেন এবং বিনোদনের তৃষ্ণা মেটান।

আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে আনন্দ ও সৌন্দর্যের কত কিছুই না আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এতে যেমন দর্শকের চোখ জুড়ায় তেমনি আত্মা ও হৃদয়ও উদ্বেলিত হয় গভীর উপলব্ধিতে।

‘পরিযায়ী পাখী’- এই শব্দদুটির মধ্যে আছে অনেক কথা। কাকে বলে পরিযায়ী পাখি? বিজ্ঞানের ভাষায় নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতি বছর বা কয়েক বছর পরপর একটি নির্দিষ্ট সময় বা ঋতুতে অন্তত দুটো অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়াকে পাখি পরিযান বলে। এখান থেকেই ‘পরিযায়ী পাখী’। পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতিই (প্রায় ১৯%) পরিযায়ী।

এদের মধ্যে আবার রকমফের আছে। দূরত্বের বিচারে পরিযানকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় : স্বল্পদৈর্ঘ্য পরিযান, মধ্যদৈর্ঘ্য পরিযান ও দীর্ঘদৈর্ঘ্য পরিযান।

প্রথমোক্ত প্রজাতির পরিযায়ী পাখিগুলো প্রধানত স্থায়ী। তবে খাদ্যাভাব দেখা দিলে এরা তাদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের আশেপাশে অন্য অঞ্চলে গমন করে। চাতক, পাপিয়া, খয়েরিডানা পাপিয়া স্বল্প দৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখি। দ্বিতীয় প্রজাতির পাখির পরিযান প্রথমোক্ত প্রকারের তুলনায় অনেক দীর্ঘ এবং এরা মাঝে মাঝেই পরিযান ঘটায়। আর তৃতীয় প্রকারের পাখির পরিযান ঘটে বিপুল বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। এধরনের পাখি সপ্তাহকাল বা সপ্তাহের পর সপ্তাহ পরিযান করে। এ সময় এরা পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল। নীলশির, লালশির, ক্ষুদে গাংচিল প্রভৃতি দীর্ঘদৈর্ঘ্যরে পরিযায়ী পাখি।

পাখির এই পরিযান এক বিস্ময়কর ব্যাপার। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এরা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এক্ষেত্রে পাখিরা উপকূল রেখা, পাহাড় শ্রেণি, চাঁদ-তারা, নদী-সূর্য ইত্যাদির মাধ্যমে পথ খুঁজে নেয়। এমনও দেখা গেছে, জীবনে প্রথমবার গ্রীষ্ম ম-লীয় এলাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেও তারা ঠিক ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।

পাখি পরিযানের অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে, খাদ্যের সহজলভ্যতা ও বংশবৃদ্ধি। উত্তর গোলার্ধের অধিকাংশ পাখি বসন্তকালে উত্তরে আসে প্রচুর পোকামাকড় আর নতুন জন্ম নেয়া উদ্ভিদ ও উদ্ভিদাংশ খাওয়ার জন্য। এসময় এরা ঘর বাঁধে ও বংশবৃদ্ধি ঘটায়। শীতকালে বরফ জমার কারণে  বা অন্য কোনো সময় খাবারের অভাব দেখা দিলে এরা দক্ষিণে রওয়ানা হয়। আবহাওয়াকেও পরিযানের আরেকটি কারণ ধরা হয়। শীতের প্রকোপে অনেক পাখিই পরিযায়ী হয়।

বসন্তের সময় মানে মার্চ-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে বরফ গলতে শুরু করে। কিছু কিছু গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। ঠিক এইরকম সময়ে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ফিরে গিয়ে তারা নিজ বাড়িটিই চিনে নেয়।

সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে, এই পাখিদের দেহে সেরকম বা তার চেয়েও উন্নত কিছু সৃষ্টিগতভাবেই আছে। কে এই ছোট ছোট পাখিকে দান করেছেন এই অদ্ভুত শক্তি?

কথা আরো আছে, শুধু এই শক্তি দিয়েই কিন্তু পাখির গন্তব্যে পৌঁছা নিশ্চিত হয় না। নিশ্চিত হয় তখনই, যখন প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা তার পৌঁছার ব্যবস্থা করে  দেন। গবেষকদের বক্তব্য হচ্ছে, পরিযানে এই পাখিরা নির্ভর করে সূর্য-তারার অবস্থানের উপরও! পরিষ্কার মেঘমুক্ত রাত্রে যখন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় তখন পাখিরা নির্বিঘেœ পথ চলতে পারে বলে প্রমাণ আছে। কিন্তু মেঘলা আকাশে নক্ষত্র ঢাকা পড়ে গেলে পাখিরা নিচে কোনো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু নিচে যদি নিরাপদ কোনো জায়গা না থাকে যেমন সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলা পাখিরা এক্ষেত্রে দিকভ্রান্ত হয়। এসময় এরা পথ ভুলে চলে আসে অনেক দূরের কোনো লাইট হাউসের শক্তিশালী আলোর দিকে । মেঘলা কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে লাইট হাউসের গ্লাসে আঘাত পেয়ে হাজার হাজার পাখি মারা যায়।

ছোট ছোট পরিযায়ী পাখির পরিযান  নিয়ে চিন্তা করলেও হৃদয় ও চিন্তায় জেগে ওঠে মহান আল্লাহর নিপুণ সৃষ্টি-কুশলতা ও সর্বময় ক্ষমতার উদ্ভাস।

এখানে কিন্তু আরেকটি দিকও আছে। অনিন্দ্যসুন্দর এই পাখির ঝাঁক আল্লাহ তাআলার বাহিনীরও অংশ। আবাবিল পাখির কথা কি মনে আছে?

বিজ্ঞানীরা বলেন, পরিযায়ী পাখিরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করে বিপজ্জনক রোগের জীবাণু। জীবাণু বহন করলেও ওরা নিজেরা আক্রান্ত হয় না কেন? ঐ পাখিদের শরীরে আছে বিশেষ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ফলে এরা ঐ জীবাণু নির্বিঘেœ বহন করে। এতে ওদের কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু অন্য কোনো প্রজাতি এদের সংস্পর্শে এলে সাথে সাথে আক্রান্ত হয়। পশ্চিম নীল ভাইরাস (west nile virus) এবং এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, যার কারণে বার্ড ফ্লু রোগ হয়, এমনই দুটি জীবাণু।

আধুনিক বিজ্ঞানের এই তথ্যগুলোর সাথে কুরআনের এই আয়াত পড়ুন-

وَ لِلهِ جُنُوْدُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ  وَ كَانَ اللهُ عَزِیْزًا حَكِیْمًا.

আকাশম-লী ও পৃথিবীর বাহিনীসমূহ আল্লাহরই। এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। -সূরা ফাত্হ (৪৮) : ৭

প্রিয় পাঠক! বলুন তো শীতকালের পরিযায়ী পাখি কি শুধুই উপভোগের, না উপলব্ধিরও?

 

advertisement