Rabiul Akhir 1440   ||   January 2019

দৃষ্টান্ত : টঙ্গির ময়দানের মজলুমান ও আমাদের করণীয়

আব্দুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ

গত ১ ডিসেম্বর শনিবার টঙ্গির ময়দানে তাবলীগের সাধারণ সাথী ও উলামা-তলাবার উপর এতাআতী গোষ্ঠীর নৃশংস হামলার ঘটনা আবারো প্রমাণ করল যে, এই গোষ্ঠী গোমরাহীর দিকে চলে গেছে। এরা এখন ধর্মের নামে প্রকাশ্য অধর্মে লিপ্ত হয়েছে। বাস্তবে বৈধ-অবৈধ জায়েয-নাজায়েযের কোনো পরোয়াই এখন এদের মাঝে দেখা যাচ্ছে না। চিন্তা-চেতনাগত গোমরাহী যে এদেরকে কর্ম ও আমলগত মারাত্মক গোমরাহীরও শিকার করেছে- টঙ্গির ময়দানে হামলার ঘটনা এর একটি ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত।

একজন সাধারণ মুসলিমেরও অজানা নয় যে, সুনির্দিষ্ট শরঈ কারণ ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ ছাড়া কারো প্রাণহানী ঘটানো মারাত্মক কবীরা গোনাহ। এক মুসলিমের জান-মালে অন্যায় হস্তক্ষেপ অন্য মুসলিমের উপর হারাম। এই একটি গোনাহই কারো জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাবলীগের কাজ কি জাহান্নামে যাওয়ার জন্য? তা যদি না হয় তাহলে ‘তাবলীগ রক্ষা’র নামে টঙ্গি ময়দানের এই কাজ কীভাবে করা হল?

যে কেউ কোনো নাজায়েয কাজের আদেশ করলেই কি তা করা জায়েয হয়ে যায়? কিয়ামতের দিন কি একথা বলে নাজাত পাওয়া যাবে যে, অমুক ব্যক্তি এই নাজায়েয কাজের আদেশ করেছিল? না। নাজাত পাওয়া যাবে না। প্রত্যেককেই আল্লাহ বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন। ভালো-মন্দ চিন্তা-ভাবনা করার দায়িত্ব প্রত্যেকেরই আছে। তাহলে এতদিন পর্যন্ত যারা বুঝে না বুঝে এতাআতীদের সঙ্গে ছিলেন, যাদেরকে দ্বীনের কথা বলে, জোড়ের কথা বলে টঙ্গির ময়দানে আনা হয়েছিল তাদের কি কর্তব্য নয়, এই ঘটনার পর ওদের সঙ্গ ত্যাগ করা?

ঐদিন এই ঘটনার সাথে যে কোনোভাবে যারা জড়িয়ে পড়েছিলেন, নিজের তাবলীগী সাথী ভাই ও উলামা-তলাবার উপর হামলা করেছিলেন বা হামলাকারীদের সহায়তা করেছিলেন তারা একান্তে নিজের এই কাজটি সম্পর্কে চিন্তা করুন। আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে, আখিরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত করে শান্ত মনে নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন, এই দ্বীনদার মানুষগুলোর উপর হামলা করে তাদের আহত-নিহত করা উচিত হয়েছে কি না? যারা আপনাদেরকে বুঝিয়েছে,  প্ররোচিত করেছে তারা ঠিক বুঝিয়েছে কি না? অন্তরে যদি আল্লাহর ভয় থাকে, গোনাহের প্রতি ঘৃণা থাকে তাহলে আশা করা যায়, আপনার অন্তরই আপনাকে জবাব দিবে।

সেদিন মাঠে থাকা অসংখ্য সাথী এখন মারাত্মক আহত অবস্থায় রয়েছেন। উপরন্তু ঘটনার দিন প্রশাসনের ভূমিকাও ছিল রহস্যজনক। এ অবস্থায় আমাদের সর্বস্তরের দ্বীনদার মানুষের দুটি করণীয়ের ব্যাপারে এ লেখায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

এক. এ ঘটনায় এক-দু’জন নয়, শতশত মানুষ আহত হয়েছেন। কাজেই আহতদের সুচিকিৎসার জন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এর পদ্ধতি এই হতে পারে যে, প্রত্যেক হালকা/মহল্লার তাবলীগের সাথী তাদের যিম্মাদারের নেতৃত্বে একটি খিদমত ফান্ড (সেবা তহবিল) গঠন করবেন এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবেন। মাদরাসার সম্মানিত মুহতামিম ছাহেবানের সাথে যোগাযোগ করে তাদের কাছে খেদমতের সুযোগ দানের আবেদন করা উচিত। এটা যেমন শরাফত ও ভদ্রতার পরিচায়ক হবে তেমনি ইখলাস ও দ্বীনী মেযাজের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ হবে। এই খেদমতকে এখন মনে করতে হবে দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ দাবি ও তাকাযা। শত শত দ্বীনদার, বিশেষত উলামা-তলাবার খেদমতে কিছু সময় ও সম্পদ ব্যয় করার সুবর্ণ সুযোগ।

দুই. সচেতন মহলের অজানা নয় যে, বর্তমানে মজলুমদের উপরই জুলুম বেশি হয়ে থাকে; বিশেষত তারা যদি হন সহজ-সরল, বর্তমান সমাজের ধূর্ততা ও কূটচাল সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। আল্লাহ হেফাযত করুন, টঙ্গীর ময়দানের ঘটনাতেও এই আশংকা বড় হয়ে সামনে আসছে। ঘটনার ভিডিও ক্লিপগুলোতে স্পষ্ট দেখা গেছে যে, প্রশাসনের নাকের ডগার উপর এতাআতীরা গেট ভেঙ্গে দলে দলে ভিতরে ঢুকেছে এবং সংঘবদ্ধভাবে ভিতরের লোকদের উপর চড়াও হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণেও বারবার এসেছে প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকার কথা। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের কর্তব্য, কোনো মহল যেন এই আহত মাজলুম তাবলীগের সাথী ও উলামা-তলাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দ্বিতীয়বার নাজেহাল করতে না পারে সেই ব্যবস্থা এখনই  গ্রহণ করা। প্রত্যেক হালকার প্রভাবশালী সাথীদের কর্তব্য, সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে বার্তা পৌঁছানো। প্রশাসনেও তো আছেন অনেক ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়নিষ্ঠ চেতনার ব্যক্তি। তারা নিশ্চয়ই বোঝেন যে, মাজলুমের উপর জুলুম দ্বিগুণ অন্যায়। তাছাড়া টঙ্গির ময়দানে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই হচ্ছেন এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তাবলীগের সাথী ও উলামা-তলাবা। গোটা দেশের মানুষের সহানুভূতি এদেরই সাথে। কাজেই এই ঘটনাটা যেমন বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটা প্রভাবক ঘটনা হয়ে যেতে পারে তেমনি ভবিষ্যতের জন্যও একটি দিক নির্ধারণী ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। গুটিকতেক বিচ্ছিন্ন এতাআতীকে খুশি করতে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বীনদার জনতার বিরাগভাজন হওয়াকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বলা যাবে না। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এই বার্তা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি আইনী লড়াইয়ের  প্রস্তুতি  গ্রহণ করাও কর্তব্য।

এই ঘটনাতেও কওমী মাদরাসার উলামা-তলাবার সরলতা ও শান্তিপ্রিয়তার দৃষ্টান্তই ফুটে উঠেছে। মাঠে তারা শুধু আক্রান্তই হয়েছেন, আক্রমণে যাননি। এমনকি আক্রমণের কোনো রকম প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। তারা যদি এতাআতীদের মতো আগে থেকেই আক্রমণের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন তাহলে হামলাকারীদের আহত-নিহতের সংখ্যা তাদের আহত-নিহতের চেয়ে কম হত না। কিন্তু তারা ওই পথে যাননি। আল্লাহ তাদের মাজলুম বানিয়েছেন, জালিম বানাননি। মাঠের ভিতরের সাথীরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হামলা না করার, কারো গায়ে হাত না তোলার সিদ্ধান্তেই অবিচল ছিলেন। নানা প্রচার-প্রপাগাণ্ডার মধ্যেও কওমী উলামা-তলাবার প্রকৃত পরিচয় বুঝতে ও মনে রাখতে আশা করি কারো অসুবিধা হবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমরা যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমাদের মজলুম সাথীদের সহায়তায় এগিয়ে আসি। মনে রাখবেন, ‘আল্লাহ ঐ পর্যন্ত বান্দার মদদ করেন যে পর্যন্ত সে তার ভাইয়ের নুসরত করে।’

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

 

advertisement