সংস্কৃতি : র্যাগিং-প্রথা
কাউকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেওয়া ভালো নয়- নীতিগতভাবে এই কথায় কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু বাস্তব আচরণের কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই স্বীকৃত নীতিটির অন্যথা দেখা যায়। এমনকি সামাজিক ও সামষ্টিক জীবনে কিছু কিছু প্রথা এমন দেখা যায়, যা উপরোক্ত স্বীকৃত নীতিটির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এধরনের ক্ষেত্রগুলোতে সচেতন হওয়া কাম্য। আমাদের কলেজ-ভার্সিটিগুলোতে ‘র্যাগিং’ নামে প্রচলিত প্রথাটি এরকম একটি প্রথা।
র্যাগিং শব্দটির প্রচলিত অর্থ পরিচয় পর্ব। কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে পুরাতন শিক্ষার্থীদের সখ্য গড়ে তোলার প্রচলিত পদ্ধতিটি র্যাগিং নামে অভিহিত হয়।
কেউ কেউ বলেন, র্যাগিংয়ের শুরু প্রাচীন গ্রীসে। সেটা ছিল বড়দের ও ছোটদের পরিচয়পর্ব। ধীরে ধীরে এর রূপ পাল্টাতে থাকে। এখন কলেজ-ভার্সিটিতে এর যে রূপটি রয়েছে তাতে সিনিয়ররা বিভিন্নভাবে জুনিয়রদের যথেষ্ট শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
একজন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি ও আমার এক বন্ধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। এটা ২০১৪ সালের কথা। ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আমরা আমানত হলে উঠি। পরের দিন পরীক্ষা ছিল না। তাই দুই বন্ধু সেই রাতে প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত পড়াশোনা করি। ঘুমাতে যাব এমন সময় মনে হল কে যেন বাইরে থেকে দরজা ঠেলছে। দরজা খুলে দেখলাম চার বড় ভাই। তারা আমাদের উল্টাপাল্টা বিভিন্ন প্রশ্ন করল। ভয় পেয়ে গেলাম। একজন বলল, গান গাইতে জানিস? অন্য একজন বলল, নাচতে জানিস? আমি বলেছিলাম, গান গাইতে জানি না। সেজন্য আমাকে ১০ বার কান ধরে উঠবোস করতে হয়েছিল। আমার বন্ধু নাচতে জানে না- এজন্য তাকে শরীরের জামা কাপড় খুলে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পরের দিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠার আগেই আমার বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে গরীব ঘরের সন্তান ছিল। অনেক স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হয়নি।’ (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২ অক্টোবর ২০১৮)
র্যাগিংয়ের ভয়ে শুধু এই একটি ছেলেই পালিয়ে গেছে এমন নয়, ঐ লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী এরকম অনেক ছেলেই নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসেও পালিয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটা কোনোভাবেই সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। এটি পশ্চিমা আগ্রাসী সমাজব্যবস্থারই একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ।
ছোট ও নবীনের প্রতি আগ্রাসী আচরণ ও প্রভুত্বের মনোভাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বড়র কাছে ছোটর প্রাপ্য ¯েœহ ও মমতা। আর ছোটর কাছে বড়র প্রাপ্য শ্রদ্ধা ও মান্যতা। ইসলাম জগদ্বাসীকে এই শিক্ষাই দান করে। কাজেই মুসলিম-সমাজে ছোট-বড়র মাঝে ¯েœহ ও মমতা এবং শ্রদ্ধা ও মান্যতার সম্পর্কই বাঞ্ছিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী আমাদের স্মরণে জাগরূক থাকতে হবে-
لَيْسَ مِنّا مَنْ لَمْ يُجِلّ كَبِيرَنَا، وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا، وَ يَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقّه.
সে আমাদের নয়, যে আমাদের ছোটকে রহম করে না, আমাদের বড়কে তাজিম করে না আর আমাদের আলিমের হক আদায় করে না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৭৫৫; মুসতাদরাকে হাকেম ১/২১১, হাদীস ৪২১
নতুন কোনো জায়গায় বা প্রতিষ্ঠানে যারা আসে তারা কিছুটা নিঃসঙ্গতা ও অপরিচয়জনিত উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে। অনেকটা প্রবাস-জীবনের বন্ধু-স্বজনহীন অবস্থার মতো। এ অবস্থায় প্রয়োজন পুরনোদের হাসিমুখ ও সহযোগিতাপূর্ণ কোমল আচরণ। এর পরিবর্তে ঠাট্টা-বিদ্রƒপের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা নিঃসন্দেহে নির্দয়তা ও অমানবিকতা। এটা অবশ্যই পরিহারযোগ্য।
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এক হাদীসে পথিক-আগন্তুককে পথ দেখিয়ে দেওয়াকে ‘পথের হক’ সাব্যস্ত করেছেন। অর্থাৎ যারা পথের ধারে বসে আছে তারা যদি দেখে- একজন আগন্তুক গন্তব্যের হদিস করতে পারছে না তাহলে তাদের কর্তব্য হয়ে যায় তাকে গন্তব্যের পথ বলে দেওয়া। এটা ‘পথের হক’। তাহলে যারা কোনো স্থানের বা প্রতিষ্ঠানের পুরনো লোক তাদের উপর কি এই স্থান বা প্রতিষ্ঠানেরই হক হয়ে দাঁড়ায় না- নবীনদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া?
শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চাকারী বন্ধুরা তো এইসব মানবিক বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার বেশি হকদার। আমাদের মুসলিম ছাত্র-শিক্ষকের কর্তব্য, পশ্চিমা রীতিনীতিগুলোকে সাহসিকতার সাথে প্রশ্ন করা এবং শরাফত ও মানবিকতা পরিপন্থী বিষয়গুলোকে দৃঢ়তার সাথে বর্জন করা।