Rabiul Auwal 1440   ||   December 2018

শোকরানা মাহফিল : পর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনা

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

কওমী সনদের স্বীকৃতি-পরবর্তী শোকরানা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ৪ নভেম্বর। সংশ্লিষ্ট মহল ও অংশীজনদের মাঝে এ মাহফিল জন্ম দিয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার।

ঐ মাহফিলের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পূর্বেই একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে আমি এ ধরনের অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য ক্ষতির কিছু দিক তুলে ধরেছিলাম। এ ধরনের সভা না করতে অনুরোধ করেছেন আরো অনেকে। শেষ পর্যন্ত ঐ অনুষ্ঠান হয়েছে। তবে সংবর্ধনা সভার বদলে নাম দেওয়া হয়েছে শোকরানা মাহফিল।

দাওরায়ে হাদীসের সনদকে এমএ (ইসলামিয়াত ও এ্যারাবিক)-এর মান দিয়ে সম্প্রতি আইন পাশ করেছে বিদায়ী সরকার। সামনেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন। মেয়াদের একেবারে  শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেন এর জন্য অপেক্ষা করা হল এ নিয়েও নানা কথা বলছেন অনেকে। আগামী নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার জন্য এমনটি করা হয়েছে বলে অনেকে বলছেন। আমরা মনে করি, সময়ের বিতর্কে না গিয়েও কাজটির জন্য সরকার মোবারকবাদ পেতে পারে। কোনো ইতিবাচক কাজ দেরীতে হলেও তা ভালো বলেই গণ্য হয়। তাই উক্ত আইন পাশের পর পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে অথবা নেতৃবৃন্দের সরকারপ্রধানের সাথে দেখা করে শুকরিয়া আদায় করা ইতিবাচক পদক্ষেপই বটে। যদিও আরবীতে একটি প্রবাদ আছে- لا شكر على الواجب অর্থাৎ অবশ্যপালনীয় দায়িত্বকার্য সম্পাদনের জন্য কৃতজ্ঞতা হয় না।

এ কথা কার অজানা যে, কওমী সনদের এ স্বীকৃতি বহু আগেই প্রাপ্য ছিল। পাকিস্তানের কওমী মাদরাসাগুলো কয়েক দশক পূর্বেই এ স্বীকৃতি পেয়েছে। খোদ ভারতেও সরকারি-বেসরকারি বহু ক্ষেত্রে এ ধারার সনদ স্বীকৃত ও কার্যকর। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল যুগ যুগ ধরে। অথচ অভিজ্ঞ মহল অবশ্যই অবগত আছেন যে, যে ‘ইসলামিক স্টাডিজ ও এ্যারাবিক’-এর মান এ সনদকে দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সে স্তরের দ্বীনিয়াতের পাঠ্য কারিকুলাম (সিলেবাস)-এর চেয়ে কওমী মাদরাসার মিশকাত-দাওরার নেসাব অনেক বড় ও বিস্তৃত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখানকার এ স্তরের শিক্ষকগণও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকম-লীর তুলনায় অনেক বেশি যোগ্য ও দক্ষ। সুতরাং দাওরায়ে হাদীসকে এমএ-এর সমান মেনে নিলে তা বেশি কিছু করা হয়েছে বলে ভাবার অবকাশ নেই। এটি কওমীওয়ালাদের অধিকারই ছিল। তা স্বীকার করে নিয়ে কেউ তাদের প্রতি কোনো করুণা করেননি।

স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের পর আরো দুটি দল একাধিক মেয়াদে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিল। জেনারেল এরশাদ প্রায় ৯ বছর এবং বিএনপি ৩ মেয়াদে ক্ষমতার মসনদে আসীন ছিল। কিন্তু তারা এ দায়িত্ব পালন করেনি। বিএনপি জোট সরকারের আমলে বিষয়টি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও তাদের সিদ্ধান্তহীনতা, অন্যদল ও গোষ্ঠীনির্ভরতা রাষ্ট্রের আরো কিছু বিষয়ের মত এক্ষেত্রেও তাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে। দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এদেশের একটি বৃহৎ ধর্মপ্রাণ গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে পুরনো আচরণ  দেখে বারবার বিএনপিকে ভোট দিয়েছে। ১৯৯০ পরবর্তী বিএনপি নেতৃত্ব ফ্রি ফ্রি সে নীরব শক্তির সমর্থন পেয়ে এর মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বহু পানি ঘোলা করার পর আওয়ামী লীগের বর্তমান দলীয় প্রধান বিগত দুই-তিন বছর থেকে তা উপলব্ধি করছেন বলে প্রতীয়মান হয়। দলীয় রাজনীতির বাইরে থাকা এ  দেশের লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ লোকজন বিগত নির্বাচনগুলোতে বিএনপি বা তার জোটকে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে আসছিলেন মূলতঃ দুটি কারণে ১. সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় করে মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন ও সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লেখা। ২. স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া ইসলামী দল ও রাজনীতি পুনরায় চালু করা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমান এ দুটি কাজ করেছিলেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মন-মেযাজ বুঝতে পেরেই। মানুষও তা মনে রেখেছে বহু দিন। কিন্তু বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব দুই মেয়াদে এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে তেমন কিছুই করেনি। তাদের সময়েই বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ ছুড়ে ফেলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু বিএনপি এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছুই করেনি। তারা যদি বিষয়গুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে আপিল বিভাগ থেকে এর সুষ্ঠু সমাধান নেওয়ার চেষ্টা করত তাহলে যেমনিভাবে তা দেশ ও জনগণের জন্য ভালো হত তেমনি এর ভালো ফল তারাও ভোগ করত।

ফতোয়া-বিরোধী হাইকোর্টের রায় নিয়েও মাথা ঘামায়নি বিএনপি। ২০০১-এ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার (যাদের সাথে ইসলামী দলগুলোও ছিল) ইচ্ছা করলেই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’টি সংশোধন করতে পারত।  (যেমনিভাবে তা সংশোধিত হয়েছে এ আইনের প্রণেতা আইউব খানের দেশে) সরলমনা মুসলমানদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ঈমান ছিনিয়ে নেওয়া কাদিয়ানী গোষ্ঠীর ব্যাপারেও কিছু করেনি জোট সরকার।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগে শুরু থেকেই ভর করেছিল কিছুসংখ্যক ধর্ম-বিদ্বেষী গোষ্ঠী; যারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষজনকে দলটির বিরাগভাজন করেছে বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পর ধর্মীয় রাজনীতি ও দল নিষিদ্ধ করা ও সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে স্থান দেওয়া ছিল এর প্রথম পদক্ষেপ। স্বাধীনতার পর বহু মাদরাসা বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন পর্যন্ত। নির্যাতিত-হতাহত হয়েছেন অসংখ্য আলেম ও দ্বীনদার মানুষ। এগুলো বন্ধে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এর বহু বছর পর ১৯৯৬ সনে যখন আওয়ামী লীগ তাদের অতীত কর্মকা-ের জন্য ক্ষমা চেয়ে নির্বাচিত হল তখনও সে ধর্মবিদ্বেষী গোষ্ঠীটি ঐ সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করল। হামলা-মামলায় জর্জরিত হল মাদরাসা ও মাদরাসাসংশ্লিষ্ট উলামায়ে কেরাম। মাদরাসাগুলোর স্টোরে থাকা কুরবানীর গরু জবাইয়ের ছুরির ছবিযুক্ত পোস্টার ছাপিয়ে প্রচার করা হল, মাদরাসাওয়ালারা মানুষ হত্যাকারী সন্ত্রাসী। দেশের শীর্ষ আলেমদের অনেককে জেলে নিক্ষেপ করা হল। ২০০১ সনের নির্বাচনে দলটি এর পরিণামও দেখেছে। (যদিও সে নির্বাচনে বিজয়ী জোট ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে)।

২০০৮ সনে পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কিছু লোক আবার ভুল পথে হাঁটা শুরু করলেন। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, কওমী মাদরাসাগুলো হচ্ছে জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু কিছু কর্তাব্যক্তিদের এই আচরণের ফায়দা নিল কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী একশ্রেণির ব্লগার ও লেখক। তারা ইসলাম, কুরআন ও মুমিনকুলের আম্মাজানের (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নামে বিষোদ্গার করেই থামল না, শুরু করল তাউহীনে রিসালাত তথা রাহমাতুল লিল আলামীন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবমাননাও। আর সরকার সমর্থক এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী এগুলোকে বাক স্বাধীনতার লেবাস পরিয়ে বৈধতার সার্টিফিকেট দিল। নবী অবমাননাকারীকে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদের খেতাবও দেওয়া হল।

এসব দেখে হৃদয়ে আগুন জ্বলে উঠল এদেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের। এরপর তৌহীদী জনতার জেগে ওঠা এবং শাপলা চত্বর ট্রাজেডির ইতিহাস বেশি পুরনো নয়। মনে হয় না- এ অধ্যায় নিয়ে লেখার প্রয়োজন আছে। কেউ শত বার মিথ্যা বলেও বর্তমান প্রজন্মকে তা গেলাতে পারবে বলে মনে হয় না।

যাহোক আশার কথা হল, বিগত কয়েক বছর থেকে আওয়ামী লীগ প্রধান ও তাঁর কয়েকজন মন্ত্রী ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁরা আলেম-উলামা ও মাদরাসাগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রসর হয়েছেন (যদিও সরকারের জোটভুক্ত কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি আলেমদের কটূক্তির পুরনো চরিত্র বদলাতে পারেনি) এবং এর সুফলও তারা পেয়েছেন। এ সম্পর্ক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থেকেই স্বীকৃতি এসেছে কওমী সনদের। সন্দেহ নেই, এটি আওয়ামী লীগ নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক সাহসী একটি পদক্ষেপ। যে দায়িত্ব অন্যেরা আদায় করেনি বিলম্বে হলেও তিনি সেটি আদায় করেছেন নিজ উদ্যোগে। সঙ্গত কারণেই তিনি ধন্যবাদ, মোবারকবাদ পেয়েছেন কওমী ঘরানার সকলের এবং সাথে সাথে ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর। কিন্তু এ ইতিবাচক কাজটিকেই বিতর্কিত করে ফেলেছে কিছু লোকের অতিউৎসাহী বা মতলবী কর্মকা-। এই শ্রেণিটি নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন তারা বড় কোনো কেল্লা ফতেহ করে ফেলেছেন। যেন এ স্বীকৃতির অভাবে এতদিন কওমী আলেমগণ কর্মহীন বা অন্নহীন ছিলেন। এখন তাদের জন্য সকল দরজা খুলে গেছে। অথচ... (আজ থাক সেদিক)

সনদের স্বীকৃতির বিষয়টিকে আরো বিতর্কিত করেছে শোকরানা মাহফিলের কথা-বার্তা ও আচার-আচরণ। দুঃখজনক হলেও এদেশের দ্বীনদার লোকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হল, এ ধরনের বড় অনুষ্ঠান সবদিক থেকে সামলে রাখা বরাবরই মুশকিল হয়েছে। কিছু মুখ বেসামাল হয়ে যায় অনাকাক্সিক্ষতভাবেই।

বলা হয়েছিল, শোকরানা মাহফিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক থাকবে। বাস্তবে কি তা রাখা হয়েছে? কেউ কেউ তো নিজ এমপি পদে নির্বাচনের বিজ্ঞাপনী জার্সি পরিয়ে এনেছেন তার কর্মীদেরকে।

পুরো দেশের মাদরাসাগুলোর দরস (ক্লাস) বন্ধ রেখে হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষককে হাজির করা হয়েছে। যদিও মঞ্চের এবং ময়দানের অনেকের উপস্থিতিই হয়ত স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। অনেকেই গিয়েছেন বিভিন্ন চাপে ও ভিন্ন কারণে। তাই সে ‘মাহফিলে’ সকল উপস্থিতির ব্যাপারে ঢালাও কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তবে উপস্থিতি যেভাবে বা যে কারণেই হোক তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনেছেন শুধু প্রশংসা  আর প্রশংসা। কয়েকজন বক্তা স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের এমনভাবে প্রশংসা করেছেন, যেন তারা ছিলেন দ্বীনের বড় কোনো খাদেম। অথচ সে আমলে ইসলামের অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল। প্রধান অতিথি ও অন্যান্য মন্ত্রী-আমলাদের উপস্থিতিতে তাদের সীমাহীন প্রশংসা করে উলামা-তলাবাদের কোন্ শিক্ষাটি দেওয়া হয়েছে- তা নিয়ে ভাবছেন অনেকে। এসব একতরফা ও অতিরঞ্জিত প্রশংসা ভুল বার্তা দিয়েছে সাধারণ মুসলমানদের কাছে। যে আলেম সমাজকে তারা অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করে আসছে তাদের ব্যাপারে ভিন্ন বিরূপ ধারণা জন্মেছে তাদের অন্তরে। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে ও কর্মস্থলে অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্ন ও মন্তব্যের সম্মুখীন হচ্ছেন উলামা ও দ্বীনদার সমাজ।

অনুষ্ঠানে একজন ব্যক্তিকর্তৃক প্রধান মন্ত্রীকে বিশেষ খেতাব প্রদান এবং আরো কারো কারো পক্ষ থেকে তার বিশ্লেষণ বিব্রতকর পরিস্থিতির তৈরি করেছে পুরো দেশে। সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ায় অনেকেই তা দেখছিল ও শুনছিল। গণমাধ্যম এসব উক্তিকে প্রচার করেছে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাদের চিরাচরিত বাঁকা ভঙ্গিতে। কিন্তু এতে কার লাভ হল? অনেকেই বলছেন, কেউ নৌকার মনোনয়ন নিতে চাইলে নিবেন; কিন্তু এজন্য পুরো আলেমসমাজকে তো আর কারো সন্তান বানিয়ে দিতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, এতে বরং সরকার প্রধান হয়ত নাখোশই হয়েছেন। জানা কথা, এত সস্তা বুলি দিয়ে তো আর এত বড় একটি দলের মনোনয়ন পাওয়া যায় না। আবার পুরনোরা স্মরণ করেছেন হযরত সদর ছাহেব (মাওলানা শামছুল হক ফরীদপুরী রাহ.)-এর কথা। যাঁর দৃঢ়তার সামনে এমনকি লৌহ মানব আইউব খানও হার মানতে বাধ্য হত।

শোকরানা মাহফিলের মুরব্বীগণ হয়ত ইচ্ছা করেই হেফাজতের শাপলা চত্বর ট্রাজেডির কথা উঠাননি। যেন আনন্দের পরিবেশ ভারী না হয়ে উঠে। কিন্তু একজন বড় সরকারি অফিসারের “ঐদিন কোনো হতাহত হয়নি”- এমন বক্তব্য দেওয়ার পরও বড় থেকে ছোট সকলের নীরব থাকা এ মাহফিলকে শুধু প্রশ্নের সম্মুখীনই করেনি; বরং জখম তাজা করে দিয়েছে কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের ব্যথিত হৃদয়ের। কোনো একজনও কি এর ভদ্রোচিত প্রতিবাদও করতে পারতেন না? আল্লাহ তাআলা (অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত) মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর ভালো করুন। তাঁকে ইস্তিকামাতের নিআমতে ধন্য করুন। তিনি বিবৃতি প্রদান করে জখমী অন্তরগুলোতে কিছুটা হলেও মলম দিয়েছেন।

সারকথা হল, ‘শোকরানা মাহফিল’ ও এর কিছু কিছু কার্যক্রম ভুল বার্তা দিয়েছে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজকে। মানুষ এটিকে আলেম সমাজের অবমাননা হিসেবে দেখেছে। বিশেষত মাত্র কয়েক বছর আগের হেফাজত ট্রাজেডির বিষয়টি আয়োজকগণ বেমালুম ভুলে থাকলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু তা ভোলেনি, তাই ঐ দলটির সাবেক ও বর্তমান নেতৃত্বের এত প্রশংসার ব্যাঙ্গাত্মক ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে এখনও মানুষজন। এ মাহফিল ব্যথিত করেছে কওমী মাদরাসার স্টেক হোল্ডার তথা অংশীজনদেরকে।

সকলেই অবগত আছেন যে, কওমী মাদরাসাগুলো পুরো জাতির সম্পদ। এর অংশীজন শুধু উলামা-তলাবা নন; বরং যাদের অনুদানে এ প্রতিষ্ঠানগুলো চলে তাঁরা এবং কওমী আলেমদের রাহনুমায়ীতে চলা মুসলমানগণ, তাদের ইমামতিতে নামায পড়া মুসল্লীগণ, তাদের হেদায়েতে চলা তাবলীগী হালকাসহ পুরো জাতির বৃহৎ অংশই কওমীর স্টেক হোল্ডার। এদের মধ্যে যেমন রয়েছেন দল-নিরপেক্ষ লোকজন, তেমনি আছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থকও। তাদের আশা থাকে, কওমী মাদরাসাগুলো রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে থেকে দ্বীনী কার্যক্রম পরিচালনা করুক। যেন দল-মত নির্বিশেষে সকল মহলে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া তাদের জন্য সহজ হয়। সরকার আসবে-যাবে, ক্ষমতার মসনদে নতুন-পুরাতন লোকগণ আসীন হবেন। কওমী মাদরাসা তার খেদমত দিয়ে যাবে একই ধারায়। হাদীসের ভাষা অনুযায়ী সকলের প্রতি النصيحة-হিতাকাক্সক্ষা নিয়ে। কারো প্রতি বৈরিতা নয়, সকলের প্রতি কল্যাণকামিতা। কারো মন্দ কাজে সমর্থন নয়, হক কথায় পিছপা হওয়া নয়, কারো লেজুড়বৃত্তিও নয় এবং বিনা কারণে কারো সাথে দুশমনীও নয়; এ সবই ছিল কওমীওয়ালাদের মেযাজ ও বৈশিষ্ট্য। দেশের মানুষ এখনো তেমনটিই আশা করে এধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।

আচ্ছা, শোকরানা মাহফিলের এ দীর্ঘ সময়ে কি উপস্থিত লোকজনের সামনে অন্যদের প্রশংসা কিছুটা কম করে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা যেত না? হক প্রতিষ্ঠা ও বাতিলের বিরুদ্ধে আকাবির-পূর্বসূরিগণের দু-চারটি গল্পও শোনানো যেত না? আল্লামা আহমদ শফীদামাত বারাকাতুহুম-এর নামে লেখা বক্তৃতায় সরকারপ্রধানের কাছে কি ধর্মনিরপেক্ষতাসহ কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী অন্যান্য আইন বাতিলের আহ্বান যোগ করা যেত না? তবুও তো দূর-দূরান্ত থেকে আগত উলামা-তলাবা কিছু নিয়ে বাড়ী ফিরতে পারতেন। কিন্তু...

আরেকটা কথা, সনদের এ স্বীকৃতি কী কী কাজে আসবে তা খোলাসা করা দরকার। কোন্ কোন্ নতুন কর্মক্ষেত্র এর দ্বারা তৈরি হল। মেট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট ও অনার্সবিহীন মাস্টার্সের সনদ দিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যাবে কি না? অথবা কোনো সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্রে আর কোন কোন খেদমতের দ্বার উন্মোচিত হল? এ সনদ দিয়ে দেশ-বিদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরাসরি পিএইচডি করা যাবে কি না এসব প্রশ্নও এখন ব্যাপকভাবে আসছে।

প্রিয় তালিবুল ইলম ও নওজোয়ান আলেমদের প্রতি আমাদের আরয, আমি আপনি যাদেরকে আকাবির বলি তাদের দেড়-দুইশ বছরের ইতিহাস এবং তাঁরা যাদের অনুসারী সে আসলাফের হাজার বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে সার্টিফিকেট কোনো মুখ্য বিষয় ছিল না। ‘সানাদুল ফাযীলাহ’ নামে তাঁদেরকে কখনো কখনো যেটি দেওয়া হত তাঁরা সেটি বরাবর খুলে দেখার সময়ও পেতেন না। প্রয়োজনও অনুভব করতেন না। এ ধারার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইখলাস ও ইতকান দিয়ে। ইখলাসুন নিয়্যাহ ও ইতকানুল আমল। আপনি এমন একটি সিলসিলার সাথে যুক্ত দুনিয়ার সম্মানের পিছনে না হেঁটেও যারা পেয়েছেন মর্যাদার আসন। কারো স্বীকৃতি লাভের জন্য যারা কাজ করেনি কিন্তু যামানা তাদের কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছে নিজেদের প্রয়োজনে। সুতরাং কোনো হীনম্মন্যতা নয়, নয় কোনো অতিউৎসাহ বা সহজে দামী কিছু পেয়ে যাওয়ার আনন্দ। আপনার কাজের ধারা তর্কাতীতভাবে শ্রেষ্ঠ ধারা। এখন শুধু প্রয়োজন ইলম ও আমলের পিছনে নিরলস মেহনত করে নিজেকে সে ধারার যোগ্য সদস্য হিসেবে গড়ে তোলা। পরীক্ষা কেন্দ্রিক বা গাইড নির্ভর পড়াশোনার দ্বারা কিছু নম্বর হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু আমলী জীবনে পদার্পণের পর সাময়িক সে আনন্দ ফিকে হয়ে যাবে বাস্তব যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে।

 

সবশেষে আরেকটি কথা। কোনোক্রমেই বিশেষ কাউকে খাটো করার জন্য নয়, বরং হিকায়াতে হাল ও মনের দুঃখের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে পেশ করছি। তা হল, আমরা কি আমাদের শ্রেষ্ঠ মুরুব্বীদের এভাবেই কদর করে যাব? আরযালুল উমরে পৌঁছার পর এসে তাদেরকে কোনো না কোনোভাবে বিতর্কিত না করলেই কি হয় না? প্রায় শত বছর পার করে আসা ক্লান্ত-শ্রান্ত একজন ব্যক্তিত্বকে এত কষ্ট না দিলে কি হত না? যিনি মঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ছিলেন বারবার। এ মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে আরো দু’জন মহান কা-ারী হযরত হাফেজ্জী হুযূর রাহ. ও হযরত শাইখুল হাদীস রাহ.-এর কথা। শেষ জীবনে আমরা কি তাঁদের সঠিক কদর করতে পেরেছি?

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা আমাদের হেফাজত করুন। নিজেদের কাজ ও কর্মক্ষেত্রের যথাযথ মর্যাদা অনুধাবনের তাওফীক দিন। বয়সের একটি স্তরে উপনীত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই মানুষ অনেক কিছুতে পরনির্ভরশীল হয়ে উঠেন, তখন যেন আমরা মুরুব্বীদের সঠিক খাদেম হতে পারি। নিজেদের ব্যক্তিউদ্দেশ্যে যেন তাদেরকে ব্যবহার করার চিন্তা না করি- এ আকুতি জানিয়ে  এবং কারো মনে অনিচ্ছাকৃত ব্যথা দিয়ে থাকলে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে ইতি টানছি।

 

advertisement