মর্মান্তিক : খাশুকজি-হত্যা ও পশ্চিম
জামাল খাশুকজি। সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত একটি নাম। গত মাসের বিভিন্ন দৈনিকের আন্তর্জাতিক পাতার প্রধান সংবাদ ছিল খাশুকজিকে নিয়ে। সৌদি নাগরিক ও দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক এ সাংবাদিক গত অক্টোবর মাসের ২ তারিখে তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন। এরপর নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। এ থেকেই সন্দেহ ও রহস্যের ডালপালা বিস্তৃত হতে থাকে। পৃথিবীর মানুষ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে তাকে নিয়ে। অবশেষে তুর্কি গোয়েন্দাদের নিরলস পরিশ্রমে ধীরে ধীরে ঘটনার জট খুলতে থাকে। একটু একটু করে বেরিয়ে আসে রহস্য। অবশেষে এখন দিনের আলোর মতই সবকিছু পরিষ্কার।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে তুরস্কে আসার আগে স্বেচ্ছানির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন এই সাংবাদিক। সৌদি যুবরাজের কঠোর সমালোচক জামাল খাশুকজি মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টে কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতেন। সেখানে নিজের লেখায় তিনি সৌদি জোটের কাতারবিরোধী অবরোধের কঠোর সমালোচনা করতেন। ইয়ামেনে সৌদি জোটের সামরিক অভিযান এবং নিজ দেশে ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর ধরপাকড়ের কঠোর সমালোচক ছিলেন এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার। একসময় সৌদি রাজপরিবারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা খাশুকজি গত বছর দেশ ছেড়ে যান। এমবিএস নামে পরিচিত সৌদি যুবরাজ সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর ব্যাপক ধরপাকড় শুরুর পর দেশ ছাড়েন তিনি। গত মার্চে আল-জাযিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরবে বিতর্কের কোনো জায়গা নেই। সরকারের নীতিকে প্রশ্ন করলেই নাগরিকদের কারাগারে আটকে রাখা হচ্ছে।
গত দুই অক্টোবর বেলা একটার দিকে ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন খাশুকজি। এরপরই নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। শুরু থেকেই তুরস্ক সরকার সৌদি কনস্যুলেটে তার হত্যার কথা বলে আসছিল। তবে বরাবরই তা অস্বীকার করে যাচ্ছিল সৌদি সরকার। অবশেষে নিখোঁজের সতের দিন পর প্রথমবারের মতো দেশটি স্বীকার করে- খাশুকজিকে হত্যা করা হয়েছে।
খাশুকজির নির্মম হত্যার বিবরণ পড়ে যে কোনো মানুষের হৃদয় কাঁদবে। এটাই স্বাভাবিক। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব থেকেই এ সহানুভূতি সৃষ্টি হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা জঘন্য অপরাধ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِناً مُتَعَمِّداً فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِداً فِيهَا وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَاباً عَظِيماً.
যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে তার শাস্তি জাহান্নাম। যাতে সে সর্বদা থাকবে। এবং আল্লাহ তার প্রতি গযব নাযিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য মহা শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। -সূরা নিসা (৪) : ৯৩
مِنْ أَجْلِ ذَلِكَ كَتَبْنَا عَلَى بَنِي إِسْرائيلَ أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْساً بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعاً.
এ কারণেই আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি ফরমান লিখে দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয় তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করে সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩২
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كل ذنب عسى الله أن يغفره، إلا الرجل يموت كافرا، أو الرجل يقتل مؤمنا متعمدا.
সব গুনাহই আল্লাহ হয়ত ক্ষমা করবেন। তবে যে ব্যক্তি কাফের অবস্থায় মারা গেছে বা কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃত হত্যা করেছে তাদেরকে নয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯০৭
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন-
لَزَوَالُ الدّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ، عَزّ وَجَلّ، مِنْ قَتْلِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ.
কোনো মুসলমানকে হত্যা করার তুলনায় পৃথিবী ধ্বংস হওয়া আল্লাহর কাছে কম গুরুতর। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৫০
খাশুকজির এ হত্যাকা-ে আন্তর্জাতিক বিশ্বও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ হত্যাকা-কে ভয়ানক কার্যক্রম উল্লেখ করে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানিয়েছে। (প্রথম আলো, ২১ অক্টোবর)
জার্মান অর্থমন্ত্রী বলেছেন, খাশুকজির ঘটনায় সৌদি আরব এ পর্যন্ত যেসব ব্যাখ্যা দিয়েছে তা সন্তোষজনক নয়। তিনি বলেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর সবাই মিলে একটি যৌথ পদক্ষেপ নেয়াটা আমার মতে জরুরি। কারণ সব ইউরোপীয় দেশ এক হলে রিয়াদ সরকারের উপর এর প্রভাব পড়বে। (নয়া দিগন্ত, ২৩ অক্টোবর)
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, ও অষ্ট্রেলিয়া সৌদি আরবে অনুষ্ঠেয় বিনিয়োগ সম্মেলন বয়কট করার ঘোষণা দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের এ প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়াকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। তবে প্রশ্ন জাগে যে, এখানে কি আসলেই হত্যার প্রতিবাদ করা উদ্দেশ্য, না অন্য কোনো কিছু লুকিয়ে আছে।
কোনো ঘুষখোর অফিসারকে যখন ঘুষের বিরুদ্ধে বলতে দেখা যায় তখন খুব হাসি পায়। দুর্নীতিবাজ কোনো নেতা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাইকে সৎ ও নীতিবান হওয়ার উপদেশ বিতরণ করেন, তখন শ্রোতারা খুব মজা পায়। এলাকার সবচে বড় সন্ত্রাসী যখন চুরি ডাকাতি ও লুটতরাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তখন গুরুজনদের কথা মনে পড়ে- ‘বাঘের হাসি দেখে খুশি হয়ো না’। বিশ্ব নাটকের মঞ্চে রক্তপিপাসুদের যখন মানবাধিকারের বুলি আউড়াতে দেখি তখন মনে হয়, স্বার্থ মানুষকে কতটা অন্ধ করে দিতে পারে। ওরা আমাদেরকে কত নির্বোধ মনে করে! যে পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকা খাশুকজি হত্যার জন্য তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ জানিয়েছে তাদের অতীত ও বর্তমানের কর্মকা- কি তাদের মনে আছে?
৯/১১-এর টুইন টাওয়ারের উপর আক্রমণের পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নানা সংস্থা ও দেশ যে কর্মকা- পরিচালনা করেছে, এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাতে ৩২ মিলিয়ন (তিন কোটি বিশ লাখ) মুসলমানের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু আফগানিস্তান ও আশপাশের দেশগুলোতে মারা যায় ২৭ মিলিয়ন (দুই কোটি ৭০ লাখ) মানুষ।
তিনটি চিকিৎসক সংস্থা- (১) ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়ার (২) ফিজিশিয়ানস ফর সোসিয়াল রেসপনসিবিলিটি (৩) ফিজিশিয়ানস ফর গ্লোবাল সার্ভাইভাল ২০১৫ সালে ‘পশ্চিমা যুদ্ধে মুসলিমদের মৃত্যু’ শিরোনামে এক সমীক্ষা প্রকাশ করে। এই সমীক্ষায় বলা হয়, মৃতের সংখ্যা যদি সর্বনি¤œ রক্ষণশীল দৃষ্টি থেকে দেখা হয় তবুও দেখা যায় ৯/১১-এর পর থেকে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বিশ লাখ।
চেঞ্জমেকার মিডিয়ার ডেভিড ডিগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান যুদ্ধের উপর এক অনুসন্ধান চালান। জর্জ বুশকে ওয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে ডিগ্র লেখেন, বুশ এক ইরাকেই সত্তর হাজার বোমা নিক্ষেপ করেছেন। মার্কিন এয়ারফোর্সের এক গোপন নথি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ট্রাম্প সরকার বোমা বর্ষণে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। এখানে দেখা যায় বুশ সরকার প্রতিদিন চব্বিশটি বোমা বর্ষণ করত (বছরে ৮৭৫০ টি)। আর ওবামা বর্ষণ করত দৈনিক ৩৪টি এবং বছরে ১২৫০০টি। অথচ ট্রাম্পের প্রথম বছরই বর্ষণ করা হয়েছে ৪৪০৯৬টি বোমা। অর্থাৎ প্রতিদিন ১২১ টি বোমা। অন্য কথায় ট্রাম্প যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় ৫টি করে বোমা বর্ষণ করছেন।
সাংবাদিক হুইটনি ওয়েব সিআই-এর প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেছেন, এখন বোমা বর্ষণের মাত্রা বুশের সময়ের চেয়ে ৮০গুণ বেড়েছে এবং তারা জানে না, কাদের তারা হত্যা করছে। শুধু তারা তাদের বোমা বর্ষণের জন্য এলাকা নির্দিষ্ট করে ঘোষণা দেয়, এটি শত্রু এলাকা। তারা কাদের শত্রু বলছে তাও তারা জানে না বলে ডেভিড ডিগ্র উল্লেখ করেছে। (নয়া দিগন্ত, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
খাশুকজি হত্যাকা-ে পশ্চিমা দেশগুলোর কপটতা তো প্রকাশিত হয়েছে । এখন এই হত্যাকা-ের পিছনে আরো কার কী এজেন্ডা আছে তা হয়ত ভবিষ্যতে কখনো উন্মোচিত হবে।
আমরা মনে করি, খাশুকজি হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত এবং এর পরিকল্পনাকারী সকলের যথোপযুক্ত শাস্তি হওয়া যেমন দরকার তেমনি দেশে দেশে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা তাদের বিরুদ্ধ মতাদর্শের লোকদের গুম-হত্যা এবং জেল-যুলুমও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হওয়া দরকার।