বাবা রতন : একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন :
ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক পত্রিকায় কয়েক বছর আগে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। সেখানে রতন হিন্দিকে সাহাবী বলা হয়েছে এবং এ বিষয়ে সম্ভবত সায়্যিদ মানাযির আহসান গীলানী রাহ.-এর কোনো লেখার উদ্ধৃতিও দেওয়া হয়েছে। ইদানীং আরেকটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় (জুমাদাল উলা-জুমাদাল উখরা ১৪৩৯ হিজরী) এ বিষয়ে আরেকটি প্রবন্ধ দেখলাম। সেখানেও রতন হিন্দিকে সাহাবী বলা হয়েছে।
আমরা তো জানি, ‘রতন হিন্দি’ নামে কোনো লোক কখনো ছিল কি না এ বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। কিন্তু তার সাহাবী না হওয়ার বিষয়টি ‘ইলমু আসমাইর রিজাল’ ও ‘ইলমুল জারহি ওয়াত তাদীল’-এর প-িত মনীষী এবং মুহাক্কিক ঐতিহাসিকদের কাছে সর্বস্বীকৃত বাস্তবতা। দায়িত্বহীন লেখকেরা তো যা মনে চায় তাই লিখে দেয়, কিন্তু হযরত মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী রাহ.-এর উদ্ধৃতি দেখে আমি একটু অবাক হয়েছি। পরে আরো অবাক হয়েছি, যখন হযরতের সেই লেখা আমি নিজেই পড়লাম। ‘হিন্দুস্তানী সাহাবী’ নামে লেখাটি পুস্তিকা আকারেও ছাপা হয়েছে। তাই হুযুরের কাছে আবেদন, বিষয়টির উপর শাস্ত্রীয় দিক বিবেচনায় বিস্তারিত কিছু লিখবেন। যাতে আমার দ্বিধা কেটে যায় এবং সঠিক বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
ওয়াসসালাম
ইবনে আযহার
দারুত তাসনীফ
টাউনহল পাড়া, পাবনা
যিলহজ¦, ১৪৩৯ হিজরী
উত্তর :
بسم الله الرحمن الرحيم
الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، خاتم النبيين وسيد ولد آدم، صلى الله عليه وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العلمين. أما بعد :
আপনার কথা ঠিক যে, রতন হিন্দি সাহাবী না হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট ও সর্বসম্মত বাস্তবতা। এ বিষয়ে আসলেই কোনো ইখতিলাফ নেই। সপ্তম শতাব্দীর একজন হিন্দুস্তানি লোক দাবি করেছে, তার বয়স সাড়ে ছয়শ বা সাতশ বছর! এরপর সারাজীবন যে বিষয়ে কিছু বলেনি, সপ্তম শতাব্দীতে এসে হঠাৎ সেই বিষয়ে দাবি করে বলেছে, আমি আল্লাহর রাসূলের সাহাবী! এটা তার নিজের বক্তব্য হোক কিংবা তার সম্পর্কে অন্য কারো দাবি হোক, বিষয়টি যে অবাস্তব তা একেবারেই স্পষ্ট। উপরন্তু নাকেদ মুহাদ্দিস এবং নাকেদ মুআররিখ মনীষীদের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে যে, রতন হিন্দির সাহাবী হওয়ার দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ, কোনো ব্যক্তি সাহাবী সাব্যস্ত হওয়ার ন্যূনতম কোনো ভিত্তিও এখানে পাওয়া যায় না। এর বিপরীতে তার দাবি মিথ্যা হওয়ার বহু দলীল-প্রমাণ রয়েছে। এজন্য শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিদের মাঝে এ বিষয়ে না কোনো মতানৈক্য হয়েছে আর না এর কোনো সম্ভাবনা আছে।
যে মনীষীগণ এই দাবি বাতিল হওয়ার কথা বলেছেন, উদ্ধৃতিসহ তাঁদের বেশ কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হল। সংক্ষেপণের উদ্দেশ্যে প্রত্যেকের বক্তব্য উল্লেখ করা হল না।
১. ইমাম হাসান আস-সাগানী রাহ. (৬৫০ হি.)
দেখুন, তাঁর ‘রিসালাতুল মওযূআত’ পৃষ্ঠা : ৩-৪ এবং ‘নুযহাতুল খাওয়াতির’ খ- : ১, পৃষ্ঠা : ১৬৯।
২. ইমাম আলামুদ্দীন বিরযালী রাহ. (৭৩৯ হি.)
দেখুন, খলীল সফদীকৃত ‘আল-ওয়াফী বিল ওয়াফায়াত’ খ- : ১৪, পৃষ্ঠা : ৭০।
আরো দেখুন, সালাহুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে শাকির আল-কুতবীকৃত ‘ফাওয়াতুল ওয়াফায়াত’ খ- : ২, পৃষ্ঠা : ২৩ ও ইবনে তাগরী বারদীকৃত ‘আল-মানহালুস সাফী’ খ- : ৫, পৃষ্ঠা : ৩৪৭।
৩. ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. (৭৪৮ হি.)
তিনি লিখেছেন, সে কোনোভাবেই সাহাবী নয়। এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা। দেখুন তাঁর কিতাব ‘আত-তাজরীদ ফী আসমাইস সাহাবাহ’, হরফ : ‘রা’ (মাখতূত)। আরো দেখুন তাঁর নিম্নোক্ত কিতাবসমূহ-
ক. সিয়ারু আলামিন নুবালা। এখানে তিনি লিখেছেন-
أبو الطفيل عامر بن واثلة الليثي الكناني، خاتم من رأى رسول الله -صلى الله عليه وسلم- في الدنيا، واستمر الحال على ذلك في عصر التابعين وتابعيهم وهلم جرا، لا يقول آدمي: إنني رأيت رسول الله -صلى الله عليه وسلم- حتى نبغ بالهند بعد خمس مائة عام بابا رتن، فادعى الصحبة، وآذى نفسه، وكذبه العلماء، فمن صدقه في دعواه، فبارك الله في عقله، ونحن نحمد الله على العافية.
আবুত তুফাইল আমের ইবনে ওয়াসিলা লাইসী কিনানী রাযি.। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যারা দেখেছেন তাঁদের মধ্যে ইনি সর্বশেষ ব্যক্তি। (তাঁর ইন্তিকাল ১১০ হিজরী। এরপর এমন কেউ ছিল না, যে বলবে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি।) তাবিয়ী, তাবে তাবিয়ী ও তাঁদের পরবর্তী যুগে একই অবস্থা বিরাজমান। অর্থাৎ এরপর আর কোনো মানুষ বলছে না যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে দেখেছি। কিন্তু সর্বশেষ সাহাবীর ইন্তেকালের পাঁচশ বছর পর বাবা রতন নামে এক ব্যক্তি হিন্দুস্তানে আত্মপ্রকাশ করল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছে বলে দাবি করল। এতে সে নিজেকে শরমিন্দা করল। উলামায়ে কেরাম তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেন। এরপরও যে ব্যক্তি তাকে সত্য মনে করে আমরা শুধু তার আকল-বুদ্ধির জন্য দুআ করতে পারি! আল্লাহ যে আমাদেরকে (এ ধরনের উদ্ভট দাবি বিশ^াস করা থেকে) নিরাপদ রেখেছেন সেজন্য আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করি- আলহামদু লিল্লাহ। -খ- : ৩, পৃষ্ঠা : ৪৬৮, জীবনী নম্বর ৯৭
এই কিতাবে তিনি আরও লিখেছেন-
رتن الهندي، شيخ كبير، من أبناء التسعين. تجرأ على الله، وزعم بقلة حياء أنه من الصحابة، وأنه ابن ست مائة سنة وخمسين سنة، فراج أمره على من لا يدري. وقد أفردته في (جزء) ، وهتكت باطله، بلغني أنه توفي في حدود سنة اثنتين وثلاثين وست مائة، وأن ابنه محمودا بقي إلى سنة تسع وسبع مائة، فما أكثر الكذب وأروجه!
রতন হিন্দি। বয়োবৃদ্ধ এক ব্যক্তি। সে আল্লাহর সামনে দুঃসাহসিকতা প্রদর্শন করেছে। নির্লজ্জ হয়ে সে নিজেকে সাহাবী দাবি করেছে। দাবি করেছে, তার বয়স সাড়ে ছয়শ বছর। তার এই দাবি অজ্ঞ লোকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আমি একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা লিখেছি। তাতে তার বাতিল দাবিগুলো খ-ন করেছি। বলা হয়, তার মৃত্যু হয়েছে ৬৩২ হিজরীর দিকে। তার ছেলে মাহমুদ নাকি ৭০৯ হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিল। হায়! কী কঠিন মিথ্যা! এই মিথ্যার আবার কী প্রচার! -খ- : ২২, পৃষ্ঠা : ৩৬৭, জীবনী নম্বর ২৩১
খ. মীযানুল ইতিদাল, খ- : ২, পৃষ্ঠা : ৪৫, জীবনী নম্বর ২৭৫৯।
গ. তারীখুল ইসলাম, খ- : ১৪, পৃষ্ঠা : ৬৯, জীবনী নম্বর ৯০।
ঘ. আল-মুগনী ফিয যুয়াফা, খ- : ১, পৃষ্ঠা : ২৩০, জীবনী নম্বর ২১১০।
ইমাম যাহাবী রাহ. এ বিষয়ে যে পুস্তিকা লিখেছেন তার নাম ‘কাসরু ওয়াসানি রতন’। পুস্তিকাটির উল্লেখযোগ্য অংশ হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘আল-ইসাবাহ’-এ উদ্ধৃত করেছেন।
৪. খলীল সফদী রাহ. (৭৬৪ হি.)
দেখুন, তঁাঁর কিতাব ‘আল-ওয়াফী বিল ওয়াফায়াত খ- : ১৪, পৃষ্ঠা : ৬৮-৭০, জীবনী নম্বর ৪৩৭৭।
৫. মুহাদ্দিস বুরহানুদ্দীন ইবনে জামাআহ (৭৯০ হি.)
দেখুন, হাফেয ইবনে হাজার রাহ. কৃত ‘আল-ইসাবাহ ফী তাময়ীযিস সাহাবাহ’ খ- : ২, পৃষ্ঠা : ৫৩৮, হরফ : ‘রা’, আল-কিসমুর রাবে।
৬. ইমাম ইবনে কাসীর দিমাশকী রাহ. (৭৭৪ হি.)
তিনি তাঁর কিতাব ‘জামিউল মাসানীদি ওয়াস সুনান’-এ মুসনাদে রবীআ ও মুসনাদে রজা-এর মাঝে এই নোট লিখেছেন-
أما رتن الهندي فادعي له صحبة في حدود الستمائة، ورووا عنهُ نُسخة موضوعة لا أصل لها، ولا وجود لهذا المذكور بالكلية، بل هو شيء افتعله بعض الجهّالة، وقد جمع شيخنا أبو عبد الله الذهبي الحافظ جزءا فيه، سماهُ >كسر (وثن) رتن<، وقد حررته في >التكميل<، والله أعلم بالصواب.
ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে (বা সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে) রতন হিন্দি সম্পর্কে দাবি করা হয়েছে যে, সে নাকি সাহাবী। লোকেরা তার থেকে একটি জাল পুস্তিকাও বর্ণনা করেছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। বাস্তবে ঐ ব্যক্তিরই কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব কিছু মূর্খ লোকদের রটনা। আমাদের উস্তায আবু আবদুল্লাহ হাফেয যাহাবী রাহ. এ বিষয়ে একটি রিসালা সংকলন করেছেন। রিসালাটির নাম ‘কাসরু ওয়াসানি রতন’। আমি ‘তাকমীল’ কিতাবে সেই আলোচনা বিশ্লেষণসহ লিখেছি। -জামিউল মাসানীদি ওয়াস সুনান, খ- : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৭৬। প্রকাশক : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত। প্রকাশকাল : ১৪২৩ হিজরী।
৭. ইমাম সালাহুদ্দীন আলায়ী রাহ. (৭৬১ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব ‘তাহকীকু মুনীফির রুতবাহ লিমান ছাবাতা লাহু শারীফুস সোহবাহ’ পৃৃষ্ঠা : ৫৯। আরো দেখুন, তাঁর কিতাব ‘বুগইয়াতুল মুলতামিস...’ পৃষ্ঠা : ২১৭-২১৮। তাহকীক : হামদী আবদুল মাজীদ, প্রকাশক : আলামুল কুতুব, বৈরুত।
৮. ইতিহাসবিদ সালাহুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে শাকির আল-কুতবী রাহ. (৭৬৪ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব ‘ফাওয়াতুল ওয়াফায়াত’ খ- : ২, পৃষ্ঠা : ২১-২৩, দারু ছাদির, বৈরুত ১৯৭৪ ঈ.।
৯. বুরহানুদ্দীন আল-আবনাসী রাহ. (৮০২ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব ‘আশ-শাযাল ফাইয়াহ মিন উলূমি ইবনিস সালাহ’ খ- : ২, পৃষ্ঠা : ৪৯৮ (নওউ : ৩৯, মারিফাতুস সাহাবাহ)।
১০. ইমাম যাইনুদ্দীন ইরাকী রাহ. (৮০৬ হি.)
তিনি তাঁর কিতাব ‘আত-তাকয়ীদ ওয়াল ঈযাহ লিমা উতলিকা ওয়া উগলিকা মিন মুকাদ্দামাতি ইবনিস সালাহ’ পৃষ্ঠা : ২৫৯ ‘মারিফাতুস সাহাবাহ’ বিষয়ক আলোচনায় পরিষ্কার লিখেছেন যে, রতন ও এধরনের যারা নবুওতের যুগের বহু পরের, কিন্তু অস্বাভাবিক বয়সের দাবি করে নিজেদেরকে সাহাবী সাব্যস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে-
فقد أجمع أهل الحديث على تكذيبهم
হাদীস বিশারদ ইমামগণ তাদের মিথ্যুক হওয়ার বিষয়ে একমত।
১১. ইমাম বুরহানুদ্দীন হালাবী রাহ. (সিবতুবনুল আজমী) (৮৪১ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব ‘আল-কাশফুল হাছীছ আম্মান রুমিয়া বিওয়াযইল হাদীস’ পৃষ্ঠা : ১১৬, তাহকীক : সুবহী সামাররায়ী, প্রকাশক : আলামুল কুতুব, বৈরুত। প্রথম সংস্করণ, প্রকাশকাল : ১৪০৭ হিজরী।
তিনি লিখেছেন-
شيخ دجال بلا ريب، ظهر بعد الستمائة، فادعى الصحبة، والصحابة لا يكذبون، وهذا جريء على الله ورسوله، وقد ألف فيه جزءا الحافظ الذهبي سماه >كسر وثن رتن<، وقد قيل أنه مات سنة ৬৩২، ومع كونه كذابا فقد كذبوا عليه جملة كثيرة من أسمج الكذب والمحال.
১২. মুহাদ্দিস ইবনু নাসিরুদ্দীন দিমাশকী রাহ. (৮৪২ হি.)
তিনি তাঁর কিতাব ‘তাওযীহুল মুশতাবিহ’-এ লিখেছেন-
رتن...، ادّعى الصّحْبَة، فَلم يرُج أمره إِلّا على جاهلٍ لَا عقل له.
অর্থাৎ রতন নিজেকে সাহাবী বলে দাবি করেছে। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে কেবল কা-জ্ঞানহীন জাহেল কিছু লোক। -তাওযীহুল মুশতাবিহ খ- : ৪, পৃষ্ঠা : ১৩৪
আরো দেখুন, তাঁর কিতাব ‘মাজালিসু ফী তাফসীরি কওলিহী তাআলা لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلٰى الْمُؤْمِنِيْنَ পৃষ্ঠা : ২১২। এখানে তিনি এ বিষয়ে লিখিত তাঁর কিতাব ‘কাশফুল কিনা আন হালি মানিফতারাস সুহবাতা আউইল ইত্তিবা’-এর কথাও উল্লেখ করেছেন।
১৩. মাজদুদ্দীন ফাইরোযাবাদী রাহ. ‘আল-কামূসুল মুহীত’ গ্রন্থকার (৮১৭ হি.)
তিনি ‘আল-কামূসুল মুহীত’-এর ‘বাবুন নূন, ফছলুর রা’তে রতন হিন্দি সম্পর্কে বলেছেন, এই লোক সাহাবী নয়। তার সাহাবী হওয়ার দাবি মিথ্যা।
ফাইরোযাবাদী রাহ.-এর মূল বক্তব্য আরবীতে সামনে আসছে ইনশাআল্লাহ।
১৪. ইমাম শিহাবুদ্দীন ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (৮৫২ হি.)
তাঁর বক্তব্য দেখুন তাঁর নিম্নোক্ত কিতাবাদিতে-
ক. ‘আল-ইসাবাহ ফী তাময়ীযিস সাহাবাহ’ খ- : ২, পৃষ্ঠা : ৫২৩, হরফ : ‘রা’, আল-কিসমুর রাবে।
জানা কথা যে, ‘আল-ইসাবাহ’-এ নাম থাকে হরফের বিন্যাসে। অর্থাৎ আলিফ বা তা ছা এই ধারাবাহিকতায়। প্রত্যেক হরফে চারটি করে ‘ফসল’ থাকে। চতুর্থ ‘ফসল’-এ সেইসব লোকের আলোচনা করা হয়, যাদের সাহাবী হওয়া প্রমাণিত নয়। তবে কোনো মুসান্নিফ ভুলে তাকে সাহাবী বলে দিয়েছেন। এই ‘ফসল’-এ এমন কিছু ব্যক্তির আলোচনাও করা হয়েছে, যারা সাহাবী হওয়ার মিথ্যা দাবি করেছে, কিংবা অন্য কেউ তাদের জন্য এমন দাবি করেছে। তো হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘রা’ হরফের চতুর্থ ‘ফসল’-এ রতন হিন্দির নাম উল্লেখ করে বিস্তারিতভাবে একথা প্রমাণ করেছেন যে, সে সাহাবী নয়। এটি মিথ্যা দাবি।
খ. লিসানুল মীযান খ- : ৩, পৃষ্ঠা : ৪৫৭।
গ. ইনবাউল গুমর ফী আনবাইল উমর খ- : ৭, পৃষ্ঠা : ১৬১ (মাজদুদ্দীন ফাইরোযাবাদীর আলোচনা প্রসঙ্গে)।
১৫. ইতিহাসবিদ জামালুদ্দীন ইবনে তাগরী বারদী রাহ. (৮৭৪ হি.)
দেখুন তাঁর কিতাব ‘আল-মানহালুস সাফী ওয়াল মুসতাওফী বাদাল ওয়াফী’ খ- : ৫, পৃষ্ঠা : ৩৪৩-৩৪৭, কায়রো, ১৯৮৪ ঈসাব্দ। তিনি খলীল সফদী রাহ.-এর সূত্রে ইমাম যাহাবী ও ইমাম বিরযালী রাহ.-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে লিখেছেন-
ومعتقدي في رتن المذكور كمعتقد الذهبي - رحمه الله - ولولا أنه مشهور ما ذكرته في هذا التاريخ.
অর্থাৎ, লোকটি এই কিতাবে আলোচিত হবার মতো নয়। তবে আম জনসাধারণের মাঝে প্রসিদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার প্রয়োজনে তার আলোচনা করতে হচ্ছে। তার সম্পর্কে আমার বক্তব্য ইমাম যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যের মতোই। অর্থাৎ তার সাহাবী দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
১৬. শামসুদ্দীন সাখাবী রাহ. (৯০২ হি.)
দেখুন তাঁর কিতাব ‘ফাতহুল মুগীস শরহু আলফিয়াতিল হাদীস’ খ- : ৪, পৃষ্ঠা : ৯১
১৭. জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. (৯১১ হি.)
দেখুন, তাঁর নিম্নাক্ত তিন কিতাব :
ক. ‘তাদরীবুর রাবী’ খ- : ৫, পৃষ্ঠা : ১৭০-১৭১, প্রকাশক : দারুল মিনহাজ, তাহকীক : শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ।
খ. ‘আল-হাভী লিলফাতাভী’ খ- : ২, পৃষ্ঠা : ২৬৩।
গ. ‘আয-যিয়াদাত আলাল মাওযূআত’ খ- : ১, পৃষ্ঠা : ৩২০-৩৩২।
১৮. ইবনে আররাক আল-কিনানী রাহ. (৯৬৩ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব- ‘তানযীহুশ শারীআতিল মারফূআ আনিল আহাদিসিশ শানীআতিল মাউযূআহ’ খ- : ১, পৃষ্ঠা ৫৯ ও খ- : ২ পৃষ্ঠা : ৩৮-৪৪।
১৯. ইবনে হাজার হাইতামী মাক্কী রাহ. (৯৭৪ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব- ‘আলফাতাওয়াল হাদীসিয়্যাহ’ পৃষ্ঠা : ৩১৮। তিনি রতনের সাহাবী দাবি প্রসঙ্গে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইমাম যাহাবী, ইবনে হাজার ও অন্যান্য আইম্মায়ে হাদীসের ফায়সালার সাথে ঐকমত্য পোষণ করে লিখেছেন-
>لا صحة لذلك، كما بينته أئمة الحديث، منهم الذهبي في >الميزان<، وشيخ الإسلام الحافظ ابن حجر في >الإصابة<، وأفتى به غير مرة<.
২০. মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ তাহির পাটনী রাহ. (৯৮৬ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব- ‘তাযকিরাতুল মাওযূআত’ পৃষ্ঠা : ১০৩; মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার খ- : ৫, পৃষ্ঠা : ২৩৯ ‘নওউন ফী মানিদ্দাআস সুহবাতা মিনাল মুআম্মারীনা কাযিবান’।
২১. আল্লামা আমীর বাদশাহ (৯৮৭ হি.)
দেখুন তাঁর কিতাব- ‘তাইসীরুত তাহরীর’ খ- : ৩, পৃষ্ঠা : ৬৭।
২২. মোল্লা আলী কারী রাহ. (১০১৪ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব- ‘শরহু শরহি নুখবাতিল ফিকার’ পৃষ্ঠা : ৫৯৩।
২৩. আল্লামা আবদুর রউফ মুনাভী রাহ. (১০৩১ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব- ‘আল-ইয়াওয়াকীতু ওয়াদ্দুরার শরহু শরহি নুখবাতিল ফিকার’ খ- : ২, পৃষ্ঠা : ৫১৪, তুরুকু মারিফাতিস সাহাবাহ।
২৪. শিহাবুদ্দীন আজলূনী রাহ. (১১৬২ হি.)
দেখুন তাঁর কিতাব ‘কাশফুল খফা ওয়া মুযীলুল ইলবাস আম্মাশ তাহারা মিনাল আহাদীস আলা আলসিনাতিন নাস’ খ- : ২ পৃষ্ঠা : ৪৩১। এখানে তিনি نقطة من دواة عالم-এর অধীনে লিখেছেন-
قال في الذيل : موضوع وضعه رتن الهندي.
২৫. আল্লামা মুরতাযা যাবীদী হিন্দি রাহ. (১২০৫ হি.)
দেখুন, তাঁর আযীমুশ শান কিতাব ‘তাজুল আরূস মিন জাওয়াহিরিল কামূস’-এর হরফুন ‘নূন’, ফসলুর ‘রা’। খ- : ৩৫ পৃষ্ঠা : ৭৫।
২৬. আল্লামা শাওকানী মুহাম্মাদ ইবনে আলী (১২৫০ হি.)
দেখুন তাঁর কিতাব ‘আলফাওয়াইদুল মাজমূআ ফিল আহাদিসিল মওযূআ’ পৃষ্ঠা : ৪২২। আলোচনা-
فيمن ادعى الصحبة كذباً
২৭. আল্লামা শিহাবুদ্দীন আলূসী রাহ. (১২৭০ হি.) তিনি তাঁর বিখ্যাত তাফসীরের কিতাব ‘রূহুল মাআনী’তে সূরা কাহফের ৬৫ নম্বর আয়াতের তাফসীরে লিখেছেন-
نعم هو (أي حديث فإن على رأس مئة سنة لا يبقى ممن هو اليوم على ظهر الأرض أحد) نص في الرد على مدعي التعمير، كرتن الهندي، الذي ظهر في القرن السابع وادعى الصحبة وروى الأحاديث (الموضوعة، التي وضعها هو أو له أحد).
২৮. আল্লামা আবুল হাসানাত আবদুল হাই লখনভী রাহ. (১৩০৪ হি.)
দেখুন, তাঁর কিতাব- ‘যফারুল আমানী বিশারহি মুখতাসারিস সায়্যিদ শরীফ আল-জুরজানী ফী মুসতলাহিল হাদীস’ পৃষ্ঠা : ৫৩৮। এই কিতাবে তিনি লিখেছেন-
قال الحافظ الذهبي في >تجريد الصحابة< : إن رتنا الهندي كذاب دجال. وقال الحافظ السيوطي : إن رتنا الهندي المعمر كذاب ...
২৯. আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ. (১৩৫২ হি.)
দেখুন, ‘ফয়যুল বারী’ খ- : ১, পৃষ্ঠা : ২১৫। সেখানে তিনি বলেছেন-
ومن هاهنا قال المحدثون : إن دعوى الصحبة بعد تلك المدة باطلة، كما ادعى بابا رتن في بهتندا.
৩০. শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. (১৪১৭ হি.)
দেখুন, ‘আল-মাসনূ ফী মারিফাতিল হাদীসিল মাওযূ’-এর উপর তাঁর টিকা, পৃষ্ঠা : ১৭৮-১৮০ প্রকাশক : মাকতাবুল মাতবূআতিল ইসলামিয়া, হালাব। পঞ্চম মুদ্রণ : ১৪১৪ হিজরী।
৩১. মুহাদ্দিসে কাবীর হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান আজমী রাহ. (১৩১৮ হি.-১৪১২হি.)
হযরত রাহ. নিজ রিসালা ابطال عزادارى -এ কোনো এক শিয়া লেখকের রদ করতে গিয়ে লিখেছেন-
بابا رتن ہندی کی نسبت يہ لکھنا کہ ان کی صحابيت کی توثيق اکثر اکابر اہل سنت نے کی ہے (ص ২৯) سراسر غلط ہے، صحابیت کی تو اکثر کيا تمام محدثين اہل سنت نے تکذيب کی ہے (مثلا ذہبی، قاضی ابن جماعہ، ابن حجر وغيرہم ۔ ديکھولسان المیزان ص ৪৫০ تا ص৪৫৫ اور تقصار ص ২৬ اور حيات جليل ص ১৮৬ اور تاريخ محمدی قلمی اور مجمع البحار اور معارف نمبر ا ج ৪৯). ہاں اتنی بات کوبعض بعض حضرات نے صحيح تسليم کيا ہے کہ اس نام کا ايک شخص تھا، عمراس کی بہت تھی، ليکن نہ اتنی جتنی مشہورکی جاتی ہے، اور وہ شخص نہ صحابی تھا نہ تا بعی، اسی طرح حديثین جواس کے نام سے بيان کی جاتی ہیں، ان کو بھی سب محد ثين اہل سنت جعلی اور موضوع قراردیتے ہیں (ديکھو تذکرۃ الموضوعات)۔
مجد الدين فيروزآبادی صاحبِ قاموس كى نسبت يہ لكهنا كہ وه رتن كى صحابيت كى توثيق كرتے ہیں سفيد جهوٹ ہے، انهوں نے صرف رتن كے وجود كو تسليم كيا ہے (ديکھو تذکرۃ الموضوعات ص ১০৬ ومجمع البحار )۔
شيعہ مؤلف نے اس جهوٹ كو ص ৯৬ میں دہرايا ہے، اور صاحب قاموس كے ساتھ اور بهی کئ نام لكهىں ہیں ، مگر واقعہ يہ ہےكہ اكثر نام از راه فريب لكهىں ہیں ، اس لئےۓ كہ انہوں نے صحابیت كى توثيق نہیں كى ہے، بلكہ رتن كا صرف ذكر كيا ہے، اور بعض نے صاف طور سے نا قابل وثوق قرار ديا ہے، مثلا اقشہری (ديکھو تذکرۃ الموضوعات ص ১০৬)۔
شيعہ مؤلف كے دعوى كا جهوٹا ہونا بڑی آسانى سے ظاہر ہو جائىگا اگر وه ان لوگوں كى اصل عبارتيں پيش كردے، جن كے نام اس نے ص ৯৬ مىں لكهىں ہیں، كيا ہے كسی شيعہ ميں ہمت كہ مؤلف كو اس كے لئےۓ آماده كر سكے۔
-ইবতালে আযাদারী, মুহাদ্দিসে কাবীর হযরত মাওলানা আবুল মাআছির হাবীবুর রহমান আযমী রাহ., পৃ. ২১-২২, প্রকাশক : আলমাজমাউল ইলমী, মারকাযে তাহকীকাত ওয়া খাদামাতে ইলমিয়্যা, মউ, ইউপি, ইন্ডিয়া, প্রকাশকাল : ১৪২৬ হিজরী মোতাবেক ২০০৫ ঈসাব্দ
৩২. শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. (১৪০৪ হি.)
দেখুন, আপবীতী, হযরত শায়েখ, খ- : ৫, পৃষ্ঠা : ১৩২।
এখানে হযরত লিখেছেন-
رتن ہندى كى صحابيت محدثين كے نزديك ثابت نہيں۔
উল্লেখিত উদ্ধৃতিগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিলেও বুঝা যাবে, উসূলে হাদীস এবং উসূলে ফিকহের কিতাবাদিতেও স্পষ্টভাবে রয়েছে যে, রতন হিন্দি সাহাবী হওয়ার দাবি ভিত্তিহীন। মওযূআতের কিতাবগুলোতেও রতনের বানানো কিংবা রতনের নামে বানানো রেওয়ায়েতগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সাহাবীদের জীবনী বিষয়ে লিখিত কিতাবগুলোতেও রতনের সাহাবী হওয়ার দাবি মিথ্যা হওয়ার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তারীখ, তারাজিম ও তাবাকাতের কিতাবাদিতেও তার মিথ্যাবাদী হওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। এমনকি অভিধানের যে কিতাবগুলোতে ‘লুগাত’-এর সাথে ‘আলাম’ও উল্লেখ করা হয় সেগুলোতেও এই মিথ্যা দাবির খ-ন রয়েছে।
এছাড়া ইলমুল জারহি ওয়াত তাদীল, ইলমু আসমাইর রিজাল ও ইলমুল ইলালের বিদগ্ধ আইম্মায়ে হাদীসের ঐকমত্য তো রয়েছেই। উপরোক্ত তালিকাতে আমরা আরো দেখছি, রতন হিন্দির ব্যাপারে আকাবিরে দেওবন্দের ফয়সালা তা-ই, যা হাদীসের ইমামগণের ফয়সালা।
সারকথা হল, ইলমু আসমাইর রিজাল, ইলমুল জারহি ওয়াত তাদীল ও ইলমু ইলালিল হাদীস-এর অভিজ্ঞ প-িত এত মনীষী, এত মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক যে বিষয়ে একমত এবং যার বিপরীতে কোনো একজন নাকেদ মুহাদ্দিস থেকেও একটি কথা পর্যন্ত পাওয়া যায় না, সেখানে সন্দেহ করার কোনো বৈধতা থাকে না।
প্রসঙ্গ : মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী রাহ.
এখন প্রশ্ন হয়, হযরত মাওলানা মানাযির আহসান গিলানী রাহ. (১৩৭৫ হি.)-এর মতো ব্যক্তির কাছে বিষয়টি কীভাবে অস্পষ্ট হয়ে গেল? কীভাবে তিনি সপ্তম শতাব্দীর রতন হিন্দিকে সাহাবী বানিয়ে দিলেন?
এর উত্তরে বলতে হয়, হযরত গীলানী রাহ.-এর ইলমী ও আমলী মাকাম তো মাথার উপর, তাঁর দ্বীনী খেদমতসমূহও স্বীকৃত, তবে একটি বিষয় হল, হযরতের উঁচু মাকাম ও মর্যাদা সত্ত্বেও একথা বাস্তব যে, ইলমুর রিওয়ায়াহর ইসতিলাহাত এবং আসালীব-এর সাথে হযরতের বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। [1]১
এজন্য যখন তিনি ইসাবাহ ও লিসানুল মীযানে রতন হিন্দির আলোচনা পড়েছেন তখন সেখান থেকে যে সমাধানে -ওখানে খুব স্পষ্ট করে বলা বক্তব্যের দাবিতেই- পৌঁছানো দরকার ছিল সেই সমাধানে না পৌঁছে তিনি ওখান থেকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করলেন এমন এক কথা, যা আদৌ বলা হয়নি; বরং তার বিপরীত কথাটিকেই জোরালোভাবে প্রমাণ করা হয়েছে। আর এই ভুলবোঝাবুঝিটা হয়েছে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের ভাষা ও পরিভাষার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ পরিচয়ের অভাবে।
ইসাবাহ ও লিসানুল মীযানের বক্তব্য তো পরিষ্কার- রতন হিন্দি সাহাবী নয়- এটা সুনিশ্চিত এবং এতটুকু কথা সর্ববাদী সম্মত। ভিন্নমত শুধু এ নিয়ে যে, এটা কি কেবল কাল্পনিক কোনো নাম, না বাস্তবেই এ নামে কেউ ছিল। যদি বাস্তবেই থেকে থাকে এবং নিজেকে সে সাহাবী দাবি করে থাকে, তাহলে মিথ্যুক সে নিজে। আর যদি এই নামে বাস্তবে কারো অস্তিত্ব না থেকে থাকে, কিংবা থাকলেও সে এমন কোনো দাবি করে না থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে মিথ্যাবাদী হল সে সকল লোক, যারা তার ব্যাপারে এমনটা দাবি করেছে। এই তো ছিল ইসাবাহ এবং লিসানুল মীযানের বক্তব্য। এ থেকে কি রতন হিন্দির সাহাবী হওয়া প্রমাণিত হয়, না তার খ-ন হয়? এই সরল সমাধানে উপনীত না হয়ে তিনি বরং এখান থেকে খুঁজে বের করলেন রতনের সাহাবী হবার যুক্তি! অথচ ইসাবাহ ও লিসানে ঘুণাক্ষরেও এমনটি বলা হয়নি। সেখানে ঐকথাই বলা হয়েছে, যা হাফেয ইবনে হাজারের আগের ও পরের মুহাদ্দিসগণ বলেছেন।
মুহাদ্দিস সালাহুদ্দীন আলাঈ রাহ. (৭৬১ হিজরী)-এর ইবারতে-
كما قد أولع كثير في هذه الأزمان بحديث رتن الهندي الذي ادعى الصحبة وأنه عاش إلى نحو الستمائة والخمسين. ولعله لا وجود له البتة. ووضعت عليه هذه الأحاديث.
وإن كان له وجود وقد ادعى مثل ذلك، فهو كذاب قطعاً لا يستريب أحد من علماء أهل الأثر في ذلك.
বর্তমান সময়ের অনেকে রতন হিন্দির ঘটনাকে আলোচনার বিষয় বানিয়ে নিয়েছে; যে নাকি সাহাবী হওয়ার দাবি করেছে। আরো দাবি করেছে, সে নাকি সাড়ে ছয়শ বছর ধরে বেঁচে আছে। সম্ভবত বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্বই নেই। এসব ঘটনা তার সম্পর্কে বানানো হয়েছে। আর যদি বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব থেকে থাকে এবং সে এমন দাবি করে থাকে তাহলে তো সে নিশ্চিত মিথ্যুক। সুন্নাহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ কোনো আলেম এ বিষয়ে কোনো সন্দেহে পড়তে পারে না।
দেখুন, তাহকীকু মুনীফির রুতবাহ লিমান সাবাতা লাহু শারীফুস সোহবাহ, সালাহুদ্দীন আলাঈ পৃষ্ঠা : ৫৯
ইসাবা ও লিসানে এ বিষয়ে দলীলসমৃদ্ধ বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। কিন্তু সেটা একেবারেই শাস্ত্রীয় ধারায়। সেই ধারার সঙ্গে পরিচয় না থাকার কারণে হযরত গীলানী রাহ. আলোচনাটিকে শুধুই আকল-বিবেকের আলোকে পড়েছেন। সেজন্য তা থেকে তিনি ওই ফলাফল বের করেছেন, বাস্তবতার সঙ্গে যার কোনো মিল নেই।
এমনকি ইসাবাহ ও লিসানে রতনের বিষয়ে মিথ্যাচারিতার দলীল হিসাবে যেসব রেওয়ায়েত পেশ করা হয়েছে সেগুলোকে তিনি ঐতিহাসিক বাস্তবতা হিসাবে ধরে তরজমা করেছেন!
আল্লামা গীলানী রাহ. যে লিখেছেন-
بعد كی ساتويں صديوں ميں جتنے ائمۂ حديث يا علماء تاريخ آئے، بعضوں نے تغليط كے لئے اور بعضوں نے توثيق كے لئے اپنی اپنی كتابوں ميں ان كا تذكره كيا ہے.
‘পরবর্তীতে সপ্তম শতকে হাদীসের যেসকল ইমাম ও ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরাম এসেছেন তাদের কেউ তার (রতনের বিষয়ের) অসত্যতা প্রকাশের জন্য, কেউ তাকে নির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করার জন্য নিজ নিজ কিতাবে রতন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।’
এ কথা একেবারেই অবাস্তব। হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণ এবং ইতিহাসবিদ উলামায়ে কেরামের একজনও রতনকে নির্ভরযোগ্য সাব্যস্ত করেননি। এবং তার সাহাবী হওয়ার দাবিকে ন্যূনতম বাস্তবতার মধ্যে গণ্য করেননি।
গীলানী রাহ.-এর ভুল বুঝের ভিত্তি ছিল এই যে, তিনি রতনের অস্তিত্ব ও তার সাহাবী হওয়া- এই দুটি বিষয়কে এক কথা মনে করেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ইসাবাহতে লিখেছেন যে, আমাদের উস্তায মাজদুদ্দীন ফাইরোযাবাদী রাহ. (৮১৭) আমাকে বলেছেন, আমি হিন্দুস্তানের সফরে রতন হিন্দির এলাকাতে গিয়েছি। সে এলাকায় রতন হিন্দির প্রসিদ্ধি আছে।
ফাইরোযাবাদী রাহ. শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ.-এর উপর আপত্তি করেছেন এই বলে যে, ‘কীভাবে তিনি রতন হিন্দির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করলেন! অথচ সে তার এলাকায় প্রসিদ্ধ।’
ইবনে হাজার রাহ. তাঁর উস্তাযকে বলেছেনও, যাহাবী রাহ. একেবারে দৃঢ়ভাবে তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করেননি। তার অস্তিত্বের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মাত্র। এক্ষেত্রে তার সন্দেহ কিন্তু যৌক্তিক।
ইবনে হাজার রাহ.-এর উদ্দেশ্য হল, যাহাবী রাহ. দৃঢ়তার সঙ্গে যা বলেছেন তা হচ্ছে, তার সাহাবী হওয়ার দাবি মিথ্যা। কেননা তার সাহাবী হওয়ার ন্যূনতম কোনো প্রমাণ নেই। বরং সাহাবী না হওয়ার বহু দলীল-প্রমাণ বিদ্যমান। আরেকটি বিষয় হল, তার অস্তিত্ব। সেটা তো ইতিহাস সংক্রান্ত বিষয়। যদি ইতিহাস তার অস্তিত্ব স্বীকার করে তাহলে ঠিক আছে। তা না হলে তার অস্তিত্বের বিষয়টিও সংশয়পূর্ণ।
এখানে ফাইরোযাবাদী রাহ. রতনের অস্তিত্বের যে প্রসিদ্ধির কথা বলেছেন সেটা লোকমুখের প্রসিদ্ধি। শুধু এই ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে কারো অস্তিত্ব কীভাবে সাব্যস্ত হয়? দুনিয়ায় কত মাযার এমন বুযুর্গ ব্যক্তিদের নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে, এইসব মাজারের সঙ্গে যাঁদের ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। কিন্তু জনসাধারণের মাঝে খুব প্রসিদ্ধ, এটা অমুকের মাজার, সেটা অমুকের!!
আশ্চর্যের বিষয় হল, গীলানী রাহ. একজন খোঁজ-খবরওয়ালা ঐতিহাসিক হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাসের কোনো কিতাব থেকে রতন হিন্দির বিবরণ পেশ করতে পারেননি। আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, গীলানী রাহ. নিজেও হিন্দুস্তানী। রতনও হিন্দুস্তানের লোক। এরপরও হিন্দ ও সিন্দের ইতিহাস বিষয়ক কোনো কিতাব থেকে কেন রতনের আলোচনা পেশ করতে পারলেন না? যিনি সাতশ বছর বয়স পেয়েছেন (?), আবার তিনি সাহাবী (?) হওয়ার মর্যাদা লাভ করেছেন, এমন ব্যক্তির আলোচনা ইতিহাসের কোনো কিতাবে থাকবে না কেন?
তবে হাঁ, তিনি আবুল ফযলের মতো মানুষের ‘আইনে আকবরী’ কিতাবের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন, যার উপর তাঁর নিজেরই আস্থা নেই। এক জায়গায় তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘ইতিহাস শাস্ত্রে আবুল ফযল একেবারে অদক্ষ লোক!’
মনে রাখতে হবে, মুনকার ও মওযু ঘটনাবলী ছাড়া অন্য কোথাও ভিন্নভাবে রতনের আলোচনা পাওয়া যায় না। তার সাহাবী হওয়ার দাবিও কেবল ওইসব ঘটনাবলীর মধ্যেই থাকে। এসব ছাড়া রতনের জীবন ও ব্যক্তি-পরিচয়ের জন্য অন্য কোনো সহীহ, মুত্তাসিল প্রমাণ-ডকুমেন্ট কেউ পেশ করতে পারেনি।
যাহাবী রাহ. কর্তৃক রচিত ‘কাসরু ওসানি রতন’ খুবই মূল্যবান একটি পুস্তিকা। আফসোস, পুস্তিকাটি আমাদের সংগ্রহে নেই। তবে আল্লাহর শোকর, সেই পুস্তিকার গুরুত্বপূর্ণ চয়িত অংশ ইসাবাহ ও লিসানুল মীযানে রয়েছে। সেখানে যাহাবী রাহ.-এর দলীল-প্রমাণ খুবই শক্তিশালী। তবে সেই শক্তি অনুধাবন করার জন্য শাস্ত্রীয় মেযাজ ও দক্ষতা তো লাগবেই।
যাইহোক, কথা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ইসাবাহ, লিসানুল মীযান, ইনবাউল গুমর ইত্যাদি প্রত্যেক কিতাবেই হাফেয ইবনে হাজার রাহ. শুধু এতটুকুই লিখেছেন যে, ফাইরোযাবাদী রাহ. রতন হিন্দির অস্তিত্ব দৃঢ়তার সাথে বলতেন। [2]২
আর যাহাবী রাহ. তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন। ফাইরোযাবাদী রাহ. তাঁর এই অস্বীকারকে আপত্তিকর মনে করেছেন। কিন্তু মাওলানা গীলানী রাহ. এখান থেকে ধরে নিয়েছেন যে, ফাইরোযাবাদী রাহ. রতন হিন্দিকে সাহাবীও মনে করতেন!!
অথচ ফাইরোযাবাদী রাহ. ‘আল-কামূসুল মুহীতে’ স্পষ্ট লিখেছেন-
ورَتَنٌ، محركاً: ابنُ كِرْبالِ بنِ رَتَنٍ البَتْرَنْدِيِّ، ليس بصحابيٍّ، وإنّما هو كذّابٌ ظَهَرَ بالهِنْدِ بعدَ السِّتِّمِئَةِ، فادّعَى الصُحْبَةَ، وصُدِّقَ، ورَوَى أحاديثَ سَمِعْناها من أصْحابِ أصْحابِهِ.
অর্থাৎ, রতন (رَتَنٌ তা হরফে যবর) যে কিরবাল ইবনে রতনের ছেলে। নিসবত- ‘বাতরানদী’। সে সাহাবী নয়। সে চরম মিথ্যুক এক ব্যক্তি। সপ্তম শতাব্দীতে হিন্দুস্তানে তার আত্মপ্রকাশ। সে নিজেকে সাহাবী বলে দাবি করেছে। (জাহেল আওয়ামের অনেকে) তাকে বিশ^াসও করে বসেছে। সে (সাহাবী হওয়ার মিথ্যা দাবির সঙ্গে সঙ্গে) বহু মওযূ হাদীসও বর্ণনা করেছে। সেগুলো আমরা ওইসব লোকদের কাছ থেকে শুনেছি, যাদেরকে কিছু লোক এই বলে তা শুনিয়েছে যে, তারা নাকি তা রতনের কাছ থেকে শুনেছে। -আলকামূসুল মুহীত, খ- : ৪, পৃষ্ঠা : ২২৮
আশ্চর্যের কথা, আলকামূসের ইবারত মাওলানা গীলানী রাহ.-এর সামনেও ছিল। এরপরও তিনি বাস্তব বিষয়টি ধরতে পারেননি। তিনি তার প্রবন্ধে লিখেছেন, “মাজদুদ্দীন ফাইরোযাবাদী কাযীউল কুযাত (প্রধান বিচারপতি) ছিলেন। সেইসঙ্গে ছিলেন মুহাদ্দিস। অথচ তাঁর কথায় বৈপরিত্য দেখা যায়। ‘আলকামূস’-এ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই লিখেছেন- সঠিক কথা এই যে, রতন সাহাবী নয়। বরং সে একজন মিথ্যুক।
কিন্তু হাফেয ইবনে হাজার বলেন, আমি যখন তাঁর সঙ্গে ইয়ামানের ‘যাবীদ’ শহরে সাক্ষাৎ করলাম তিনি আমাকে বললেন, যাহাবী রাহ. যে বাবা রতনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন- এটা ঠিক না। কারণ আমি যখন হিন্দুস্তানে সফর করেছি তখন বাবা রতনের এলাকাতেও গিয়েছি। হিন্দুস্তানে বহু মানুষ বাবা রতনের ঘটনা আলোচনা করে এবং প্রজন্ম পরম্পরায় তার অস্তিত্বের কথা বলে।
এখন কী করা যাবে? দেখা যাচ্ছে কামূসের বক্তব্য এই কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা একথাও বলতে পারছি না যে, হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ভুল বলেছেন, আবার এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, আলকামূস ফাইরোযাবাদী রাহ.-এরই রচনা।
তবে হাঁ, বক্তব্য দুটিকে এভাবে সমন্বয় করা যায় যে, ফাইরোযাবাদী রাহ. তাঁর আলকামূস রচনা করেছেন হিন্দুস্তান সফরের আগে। সেসময় যাহাবী রাহ.-এর অনুসরণ করে তিনিও বাবা রতনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু যখন হিন্দুস্তান সফর করলেন এবং বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন তখন আগের বক্তব্য থেকে ফিরে আসলেন। যেহেতু স্বয়ং তার উপস্থাপনা থেকেই বুঝা যায়, তিনি হিন্দুস্তান সফর করে প্রভাবিত হয়েছেন।[3] ৩ আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।” -মাওলানা গীলানী রাহ. কর্তৃক রচিত প্রবন্ধ ‘বাবা রতন হিন্দী’
তালিবুল ইলম ভাইয়েরা নিজেরাই বুঝতে পারছেন, মাওলানা গীলানী রাহ. কী সাংঘাতিকভাবে বিষয়টি একাকার করে ফেলেছেন!
আসলে ফাইরোযাবাদী রাহ. থেকে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন আর ‘আলকামূসে’ যে বক্তব্য আছে, দুয়ের মাঝে কোনো বৈপরিত্যই নেই। সেজন্য মাওলানা গীলানী রাহ.-এর এই অর্থহীন সমন্বয়েরও কোনো প্রয়োজন ছিল না।
‘কামূসে’র বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, ফাইরোযাবাদী রাহ. রতনের অবস্থাদি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি রতনের ‘আসহাবুল আসহাব’ যারা, তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাদের থেকে ওইসব রেওয়ায়েতও শুনেছেন, যেগুলো, তাদের দাবি অনুযায়ী, রতন বর্ণনা করত। এজন্য ফাইরোযাবাদী রাহ. পূর্ণ বাসীরত ও শরহে সদরের সাথে রতনের অস্তিত্বের প্রবক্তা ছিলেন। সেইসঙ্গে পূর্ণ বাসীরত ও শরহে সদরের সাথে তার সাহাবী না হওয়া এবং তার চরম মিথ্যুক হওয়ারও প্রবক্তা ছিলেন। যাহাবী রাহ.-এর প্রতি তাঁর আপত্তি শুধু এইটুকু যে, তিনি কেন রতন নামের কোনো ব্যক্তির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন? কেন বলেন, এটা মিথ্যুকদের আবিষ্কৃত নাম? তাই এক্ষেত্রে তিনি তাঁর হিন্দুস্তান সফরের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
হাফেয ইবনে হাজার রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে গীলানী রাহ. ফাইরোযাবাদীর যে বক্তব্য উল্লেখ করেছেন সেখানে রতনের সাহাবী হওয়ার বা নেক ও সৎ লোক হওয়ার কোনো স্বীকারোক্তি নেই। সেখানে আছে কেবল রতনের অস্তিত্বের কথা। এজন্য শুধু তার অস্তিত্বের স্বীকারোক্তির কারণে কীভাবে কামূসের সুস্পষ্ট বক্তব্য বাতিল হয়ে যাবে?! কারো অস্তিত্ব স্বীকার করা আর তাকে মিথ্যাবাদী বলার মাঝে কী বৈপরীত্য যে, একটার কারণে আরেকটা বাদ পড়বে?!
আরেক আশ্চর্যের বিষয় হল, মাওলানা গীলানী রাহ. রতন হিন্দির ব্যাপারে ইতিহাসবিদ আল্লামা সফদী রাহ.-কে তাঁর উস্তায ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ.-এর প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। গীলানী রাহ.-এর দাবি হল, সফদী রাহ. রতনকে সাহাবী মনে করতেন। আর এ বিষয়ে তিনি তাঁর উস্তায ইমাম যাহাবী রাহ.-এর মতকে খ-ন করেছেন!
আফসোস! এ বিষয়ে মাওলানা গীলানী রাহ.-এর পুঁজি কেবল ‘ইসাবাহ’-এর এই ইবারত, যেখানে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. লিখেছেন-
وقد تكلم الصّلاح الصفديّ في >تذكرته< في تقوية وجود رتن، وأنكر على من ينكر وجوده، وعوّل في ذلك على مجرد التجويز العقلي، وليس النزاع فيه، إنما النزاع في تجويز ذلك من قبل الشرع بعد ثبوت حديث المئة في الصّحيحين والاستبعاد الّذي عوّل عليه الذهبي.
وتعقّب القاضي برهان الدين بن جماعة في حاشية كتبها في >تذكرة الصفديّ<، فقال: قول شيخنا الذّهبي هو الحقّ، وتجويز الصّفدي الوقوع لا يستلزم الوقوع، إذ ليس كلّ جائز بواقع. انتهى.
এই ইবারতে শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, সফদী রাহ. তাঁর কিতাব ‘আত-তাযকিরা’-এ রতনের অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। যারা রতনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন তিনি তাদের উপর ঐ কিতাবে আপত্তি তুলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি ‘হতে পারে, অসম্ভব তো নয়’ ছাড়া আর কোনো দলীল পেশ করতে পারেননি।
এরপর হাফেয ইবনে হাজার রাহ. নিজেই বুরহানুদ্দীন ইবনে জামাআহ রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে এ কথা স্পষ্ট করেছেন যে, কেবল ‘হতে পারে, অসম্ভব তো নয়’ দ্বারা কোনো কিছু প্রমাণিত হয় না। রতনের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য সুনির্দিষ্ট দলীলের প্রয়োজন। অথচ সফদী রাহ. এমন কোনো দলীল পেশ করতে পারেননি। আর এমন দলীল কেউ পেশ করতে পারবেও না।
এই সবগুলো বিষয় মাওলানা গীলানী রাহ.-এর সামনে ছিল। অথচ সফদী রাহ.-এর কিতাব ‘আত-তাযকিরাহ’ তাঁর সামনে ছিল না। খোদ মাওলানা গীলানী রাহ.-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকেই জানা যায় যে, সফদী রাহ. তার সেই কিতাবে কী লিখেছেন তা তার জানা ছিল না। তিনি শুধু ইসাবাহর সূত্রে এইটুকু জানতে পেরেছেন যে, সফদী রাহ. রতনের অস্তিত্বকে সাব্যস্ত করার জন্য চেষ্টা-কোশেশ করেছেন।
ব্যস, কেবল এইটুকু কথা থেকে তিনি এই ফলাফল বের করেছেন যে, সফদী রাহ. রতনকে সাহাবীও সাব্যস্ত করেছেন। এবং রতনের বিরুদ্ধে ইমাম যাহাবী রাহ. যা কিছু লিখেছেন সেই সবকিছুর উত্তরও দিয়েছেন। সেজন্য গীলানী রাহ. দীর্ঘ দুই-আড়াই পৃষ্ঠায় সফদী রাহ.-এর নাম ব্যবহার করে যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যকে খ-ন করেছেন। এবং ‘কাসরু ওয়াসানি রাতান’ পুস্তিকায় রতনের অস্তিত্ব সন্দেহযুক্ত এবং সাহাবী হওয়া অসম্ভব- এ বিষয়ে ইমাম যাহাবী রাহ. যেসব দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন, সেসব দলীল-প্রমাণের জবাব দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। এই জবাব তিনি দিয়েছেন নিছক অনুমানের ভিত্তিতে। তাও আবার সফদী রাহ.-এর নামে!!
শাস্ত্রের বাইরের কোনো ব্যক্তি যদি নিজের বুঝ মোতাবেক শাস্ত্রবিদ গবেষকের শাস্ত্রীয় আলোচনা বিশ্লেষণ করতে শুরু করে তাহলে কী অদ্ভুত কা- ঘটে, এটি তারই এক উজ্জ্বল নমুনা। এমনিতে শাস্ত্রের বাইরের লোকদের দৃষ্টিতে শাস্ত্রের বিদগ্ধ মনীষীদের শাস্ত্রীয় ইসতিদলাল কোনো কোনো সময় নিছক যুক্তির মতো মনে হয়ে থাকে। কিন্তু প্রত্যেক শাস্ত্র এবং ইসলামী শরীয়তেরও সর্বসম্মত-স্বীকৃত নীতি এই যে, শাস্ত্রবিদদের শাস্ত্রীয় ইসতিদলালের বিশ্লেষণ করার অধিকার একমাত্র শাস্ত্রজ্ঞদেরই। এক্ষেত্রে শাস্ত্রের বাইরের লোকদের কোনো মন্তব্য করা অনধিকার চর্চার শামিল এবং ইলম ও তাহকীকের আদালতে এই ধরনের মন্তব্যের কোনো এতেবার নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য লম্বা সময় প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় হল, গীলানী রাহ. নিজের সমস্ত ধারণা-অনুমানকে সফদী রাহ.-এর দিকে সম্বন্ধ করেছেন এবং অযথাই সফদী রাহ.-কে তাঁর উস্তাযের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। অথচ সফদী রাহ. তার কিতাব ‘তাযকিরাহ’-এ কী লিখেছেন তার একটি শব্দও গীলানী রাহ.-এর সামনে ছিল না! গীলানী রাহ.-এর পুরো আলোচনাই ধারণা, অনুমান ও যুক্তিনির্ভর। এজাতীয় ক্ষেত্রেই হাফেয ইবনে হাজার রাহ.-এর সেই মূল্যবান কায়েদা প্রযোজ্য, যা তিনি ‘ফাতহুল বারী’র কয়েক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। কায়েদাটি তাঁর ভাষায়-
وهذا أمر يتعلق بالنقل المحض فلا يلتفت إلى ما عداه...، والاحتمالات العقلية المجردة لا مدخل لها في هذا الفن.
এটি এমন বিষয়, যা একান্তই ‘নকল’ ও বর্ণনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ নেই...। আর এই শাস্ত্রে নিছক আকল-নির্ভর সম্ভাব্যতার কোনো দখল নেই। -ফাতহুল বারী, খ- : ১, পৃষ্ঠা : ৫৯ ‘বাদউল ওহী’ অধ্যায়ের শেষ অংশ
এই গুরুত্বপূর্ণ কায়েদাটি তালিবুল ইলম ভাইদের সবসময় মনে রাখা দরকার। এই কায়েদার সারকথা হল, যে বিষয় প্রমাণ করার জন্য নকলী দলীল প্রয়োজন সেখানে নিছক আকলী সম্ভাবনার মাধ্যমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা নীতিগত ভুল। আর এটাই বিদআত ও গোমরাহীর ভিত্তি। যে তাহকীকের মূলে এই গলত থাকবে, নির্ঘাত তার ফলাফল ভুল হবে। রতন হিন্দি বিষয়ে হযরত মাওলানা গীলানী রাহ.-এর তাহকীকও একই কারণে ভুল ফলাফলে গিয়ে পৌঁছেছে।
মাওলানা গীলানী রাহ. প্রথমত : এখানে নকল-এর জায়গায় আকলের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
দ্বিতীয়ত : নিজের যুক্তি, ধারণা ও কল্পনাকে কেবল অনুমানের ভিত্তিতে সফদী রাহ.-এর দিকে সম্বন্ধ করেছেন।
তৃতীয়ত : তিনি সফদী রাহ.-কে তাঁর উস্তায ইমাম যাহাবী রাহ.-এর প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন। অথচ বাস্তবে সফদী রাহ. তাঁর উস্তাযের সাথে একমত।
যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, সফদী রাহ. তাঁর ‘তাযকিরাহ’ কিতাবে ইমাম যাহাবী রাহ. থেকে ভিন্ন মতের কথা লিখেছেন এবং যুক্তির ভিত্তিতে যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যকে খ-ন করেছেন, তবুও সফদী রাহ.-কে যাহাবী রাহ.-এর বিপরীতে পেশ করা ঠিক হত না। কারণ, রতন সাহাবী না হওয়ার বিষয়টি ‘ইলমু আসমাইর রিজাল’ ও ‘ইলমুল জারহি ওয়াত তাদীলে’র সাথে সম্পৃক্ত। আর যাহাবী রাহ. এই উভয় শাস্ত্রের ইমাম ও সিপাহসালার। রিজাল-শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে একথা অস্পষ্ট নয় যে, কোনোভাবেই সফদী রাহ.-এর সেই মাকাম নেই।
চতুর্থত : একেবারে বাস্তবধর্মী একটি মূলনীতি হল-
ثَبِّت العرش ثم انقش.
গীলানী রাহ. তাঁর পুরো আলোচনায় এই মূলনীতির দিকে একবারও খেয়াল করেননি। এই মূলনীতির দাবি ছিল, আগে তিনি রতনের অস্তিত্ব ও তার বিশ^স্ত হওয়া দলীল প্রমাণের আলোকে সাব্যস্ত করবেন। এরপর সহীহ সনদে প্রমাণ করবেন যে, রতন নিজেকে সাহাবী বলে দাবি করেছে।
এই তিন বিষয় সাব্যস্ত করার পর যাহাবী রাহ.-এর আপত্তিসমূহের জবাব দেওয়ার প্রসঙ্গ আসবে। কেননা, যাহাবী রাহ.-এর দালীলিক আলোচনায় উত্থাপিত আপত্তিসমূহ পাঠের আগে শাস্ত্রীয় ধারায় যে বিষয়টি লক্ষণীয়, বক্তব্যে অনুক্ত থাকলেও সেটা মনে রেখেই বক্তব্যকে পাঠ করা কর্তব্য, তা হল, রতনের অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়। তার বিশ^স্ততা প্রমাণিত নয়। সে যে নিজেকে সাহাবী বলে দাবি করেছে সেকথাও সহীহ সনদে প্রমাণিত নয়। শাস্ত্রের যে কোনো তালিবুল ইলম যাহাবী রাহ.-এর আলোচনা পড়লে ইবারতে অনুল্লেখিত কিন্তু লক্ষ্যণীয় এই কথাগুলো খেয়াল করেই পড়বে।
যাহাবী রাহ.-এর মূল আপত্তি তো শুরু হয়েছে এর পর। সেখানে তিনি বলেছেন, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, বাহ্যিকভাবে সহীহ মনে হয় এমন কোনো সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, সপ্তম শতাব্দীর রতন নিজেকে সাহাবী বলে দাবি করেছে তবুও এই দাবি গ্রহণ করা হবে না। কারণ...
এজন্য যাহাবী রাহ. রতন সম্পর্কিত যেসব বিখ্যাত ঘটনা মিথ্যা হওয়ার বিষয়ে শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করেছেন সেই পর্যালোচনার জবাব দেওয়ার আগে ওইসব ঘটনার কমপক্ষে কোনো একটি ঘটনার সনদ সহীহ এবং মুত্তাসিল হওয়া সাব্যস্ত করা জরুরি ছিল। সাথে সাথে রতন হিন্দি সাহাবী দাবি করার পূর্বে তার আদেল/বিশ^স্ত ও সত্যবাদী হওয়ার বিষয়টি স্বীকৃত ছিল একথাও প্রমাণ করা জরুরি ছিল। কিন্তু সেই কাজ হযরত গীলানী করেননি। আর সেটা তাঁর পক্ষে কিংবা অন্য কারো পক্ষে সম্ভবও না। অবাস্তব কোনো বিষয় কেউ সাব্যস্ত করতে চাইলে কীভাবে তা করবে?
পঞ্চমত : তাহকীকের সম্ভাব্য পর্যায় পর্যন্ত হক আদায়ের চেষ্টার উদ্দেশ্যে আমরা সরাসরি সফদী রাহ.-এর ‘তাযকিরাহ’ কিতাবটি দেখার প্রয়োজন মনে করেছি। কিন্তু যতটুকু জানতে পেরেছি, সে কিতাব এখনো ছাপেনি। সেটা মোটামুটি ত্রিশ খ-ের কিতাব। তার মাখতূতাত বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন তুরাসী কুতুবখানায় বিদ্যমান। জানা যায় না, এই সবগুলো একত্রিত করা হলে পুরো কিতাবের মাখতূতা প্রস্তুত হবে কি না।
যাইহোক, রতন হিন্দি সম্পর্কে সফদী রাহ. ‘আত-তাযকিরাহ’-এ যা লিখেছেন আল্লাহর ফযলে তা সায়্যিদ আলী সদরুদ্দীন মাদানী-এর সফরনামা ‘রিহলাতু ইবনে মাসূম আল-মাদানী’ কিতাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এই সফরনামার নাম, ‘সালওয়াতুল গারীব ওয়া উসওয়াতুল আরীব’। সেটি ‘আদ-দারুল আরাবিয়্যাতু লিল মাউসূআত’ থেকে শাকির হাদী শাকির-এর তাহকীকে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের শাগরেদ মহিউদ্দিন মুনশী সেই কিতাব সম্পর্কিত তথ্য ও তার নুসখা আমাদের জন্য সংগ্রহ করেছে। আল্লাহ তাআলা তাকে উভয় জাহানে উত্তম বিনিময় দান করুন। সেই কিতাব থেকে আমি ‘আত-তাযকিরাহ’-এর পুরো আলোচনা গভীরভাবে মুতালাআ করেছি। সেখানে তিনি ইমাম যাহাবী রাহ.-এর কোনো বক্তব্য খ-ন করেননি; বরং তিনি নিজের আলোচনাও সমাপ্ত করেছেন যাহাবী রাহ.-এর ফায়সালা উদ্ধৃত করে। তবে তিনি এক জায়গায় শুধু একথা বলেছেন যে, কোনো মানুষের ছয় সাতশ বছর বয়স পাওয়া, আকলের বিচারে অসম্ভব নয়। এ বিষয়ে তিনি কট্টরপন্থী কোনো কোনো প্রকৃতিবিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গির খ-ন করেছেন। তিনি আবুর রায়হান আলবেরুনীর উদ্ধৃতিও উল্লেখ করেছেন।
মোটকথা, সফদী রাহ.-এর বক্তব্য হল, কেবল অস্বাভাবিক দীর্ঘ আয়ুর কথা শুনেই কোনো ঘটনাকে অস্বীকার না করা উচিত। অবশ্য রতনের ক্ষেত্রে কেউ এমনটি করেননি। যাহাবী রাহ. তো রতনের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কয়েক জায়গায় একথাও লিখেছেন যে, ইবলিসের বয়স রতনের চেয়েও বেশি। উদ্দেশ্য হল, কারো বয়স বেশি হওয়া যুক্তির নিরিখে অসম্ভব নয়। কিন্তু এটা কোন্ ধরনের কথা যে, কারো বয়স বেশি হলেই সে সাহাবী হবে!! আর রতনের বয়স বাস্তবে এত বেশি হওয়া তো দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। তার সাহাবী হওয়ার দলীল-প্রমাণ তো নেই-ই।
যাইহোক, সফদী রাহ.-এর উল্লেখকৃত মূলনীতি তো ঠিক আছে। কারণ খোদ কুরআন মাজীদ থেকেই পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতির দীর্ঘ বয়স প্রমাণিত। নূহ আলাইহিস সালামের দাওয়াতের সময়কাল-ই তো কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী সাড়ে নয়শ বছর। অকাট্য দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে একথাও প্রমাণিত যে, ইবলিস এখনও জীবিত এবং কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে। আর তার বয়স হযরত আদম আলাইহিস সালামের চেয়েও বেশি। এজন্য যুক্তির বিচারে এটা অসম্ভব নয় যে, কারো বয়স সাতশ বছর হবে। কিন্তু নিছক যুক্তিগত সম্ভাব্যতার কারণে বিশেষ কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা এই দাবি করতে পারি না যে, তার বয়স সাতশ বছর। এ দাবিও করতে পারি না যে, বয়স যখন এত বেশি তখন তো সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবশ্যই দেখে থাকবে। সুতরাং সে সাহাবী!
স্পষ্ট কথা যে, নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল ব্যতীত এমন দাবি করা গ্রহণযোগ্য নয়। নিশ্চিত জেনে রাখুন, রতনের বিষয়ে এমনই ঘটেছে। অর্থাৎ কোনো নির্ভরযোগ্য দলীল ছাড়া তার বেশি বয়স ও সাহাবী হওয়ার কথা কিছু আম মানুষ এবং ইলমহীন সুফীগণ মেনে নিয়েছেন। এ বিষয়ে তারা যা কিছু পেশ করেছেন তা ছিল কিছু জাল ও মনগড়া কিচ্ছা-কাহিনী, যা আলামুদ্দীন বিরযালী রাহ.-এর ভাষায় ‘আহাদিসুত তুরুকিয়্যাহ’ (অর্থাৎ ভবঘুরে লোকদের বানানো কথা)র অন্তর্ভুক্ত। সফদী রাহ.-এর তো এসব বিষয় জানা ছিল। এজন্য তিনি তার আলোচনাকে সমাপ্ত করেছেন ইমাম যাহাবী রাহ.-এর কথা উদ্ধৃত করে, যেখানে রতনের কিচ্ছা-কাহিনী মওযু হওয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
সফদী রাহ.-এর উদ্দেশ্য শুধু এটুকু যে, রতন সম্পর্কে আলোচিত কিচ্ছা-কাহিনীকে কেবল একথা বলে প্রত্যাখ্যান করা যায় না যে, কোনো মানুষের এত বেশি বয়স হওয়া অসম্ভব। বরং এসব কিচ্ছা-কাহিনীকে এজন্য প্রত্যাখ্যান করা হবে যে, এর কোনো নির্ভরযোগ্য সনদ নেই। এছাড়া তার সম্পর্কে যেসব ঘটনা বর্ণনা করা হয় সেগুলো শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিদের সুস্পষ্ট বক্তব্যানুযায়ী মওযু।
‘আত-তাযকিরা’ কিতাবে আলোচ্য বিষয়ের শেষ অংশটুকু দেখুন-
قلت৪ . :[4] وقد دعا رسول الله صلى الله عليه وسلم لجماعة من أصحابه بكثرة الولد، وطول العمر وغير ذلك، مثل أنس بن مالك وغيره، فبورك لهم في أولادهم وعمرهم...، فغير بدع لمن يدعو له ست مرات أن يعمر ست مئة سنة مع إمكان ذلك، غاية ما في الباب أن نحن لم نشاهد أحدا وصل ذلك، وعدمُ الدليل لا يدل على عدم المدلول.[5] ৫
সামনে গিয়ে সফদী রাহ. তাঁর আলোচনাকে ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে সমাপ্ত করেছেন।
সফদী রাহ. তাঁর সমকালীন এক মনীষী, ইমাম যাহাবী রাহ.-এর শাগরেদ মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-আনাফী রাহ.-এর সূত্রে যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। মুহাম্মাদ আল-আনাফী রাহ. বলেন, আমি আমার উস্তায হাফেয যাহাবী রাহ.-কে রতন হিন্দি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি বলেছেন-
هذا لا وجود له، بل هو اسم موضوع لأخبار مكذوبة، أو هو شيطان تبدى لهم بصورة إنسي، زعم في حدود الست مئة أنه صحب رسول الله صلى الله عليه وسلم فافتضح بتلك الأحاديث الموضوعة، وبكل حال إبليس أسن منه، وقد صنفتُ فيه جزءا سميته >كسر وثن بابا رتن<، ذكرت فيه طرق حديث رتن وضعفها.
এই আলোচনায় ইমাম যাহাবী রাহ. সুস্পষ্টভাবে রতনের সাহাবী হওয়া সম্পর্কিত ঘটনাবলিকে বাতিল ও ভিত্তিহীন বলেছেন। আর যাহাবী রাহ.-এর এই বক্তব্যকে উদ্ধৃত করেই সফদী রাহ. ‘আত-তাযকিরাহ’তে রতন সম্পর্কিত আলোচনা সমাপ্ত করেছেন। যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যের উপর তিনি সামান্যতম কোনো আপত্তিও পেশ করেননি। এজন্য হযরত মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী রাহ.-এর এই দাবি যে, সফদী রাহ. যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যকে খ-ন করেছেন কিংবা রতন সাহাবী হওয়া না হওয়ার বিষয়ে যাহাবী ও সফদী রাহ.-এর মধ্যে কোনো মতানৈক্য ঘটেছে- এই দাবি একেবারেই অবাস্তব। বাস্তবতা হল, সফদী রাহ. রতন হিন্দি সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রাহ. ও অন্যান্য আইম্মায়ে হাদীসের সঙ্গে একমত।
এর দ্বিতীয় আরেকটি স্পষ্ট প্রমাণ হল, সফদী রাহ. তাঁর কিতাব ‘আল-ওয়াফী বিল ওয়াফায়াত’ (খ- : ১৪, পৃষ্ঠা : ৬৮-৭০, জীবনী নম্বর ৪৩৭৭)-এ রতন হিন্দির পরিচিতিমূলক আলোচনা লিখেছেন। সেখানেও তিনি রতনের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন এবং যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যের মাধ্যমেই রতনের আলোচনা সমাপ্ত করেছেন।
সফদী রাহ. পরিষ্কার লিখেছেন-
قال الشيخ شمس الدين : من صدّق هذه الأعجوبة وآمن ببقاء رتن فما لنا فيه طب، فليعلم أني أول من كذّب بذلك، وأنني عاجز منقطع معه في المناظرة.৬[6] .
وما أبعد أن يكون جني تبدى بأرض الهند وادعى ما ادعى فصدّقوه! لا، بل هذا شيخ معثر دجال كذب كذبة ضخمة لكي تنصلح خائبة الضياع، وأتى بفضيحة كثيرة، والذي يحلف به أنه رتن الكذاب، قاتله الله أنى يؤفك.
وقد أفردت جزءًا فيه أخبار هذا الضال، سميته >كسر وثن رتن<. وقال لي الشيخ عَلَم الدين البِرْزالي، وقد سألته عن هذا الحديث، فقال لي : هو من أحاديث الطّرُقية.
এই আলোচনায় ইমাম যাহাবী রাহ. কত শক্তভাবে রতনের সাহাবী হওয়া সম্পর্কিত ঘটনাবলিকে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা আখ্যায়িত করেছেন! এবং আলামুদ্দীন বিরযালী রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে বলেছেন যে, এটা ভবঘুরে লোকদের বানানো কথা।
সফদী রাহ. এইসব কথা উদ্ধৃত করেছেন এবং এর উপর কোনো ধরনের আপত্তি করা ছাড়া রতনের আলোচনা সমাপ্ত করেছেন। এরপরও কি বলা হবে, সফদী রাহ. যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্য খ-ন করেছেন? কিংবা এমন বলা হবে যে, রতনের বিষয়ে তার বক্তব্য যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যের বিপরীত?!
ইমাম সাগানী রাহ.-এর বক্তব্য
ইমাম হাসান ইবনে মুহাম্মাদ সাগানী রাহ. মূলত লাহোরের অধিবাসী। ৫৭৭ হিজরীতে তিনি লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। লুগাতের বড় ইমাম ছিলেন তিনি। ইলমুল হাদীসেও অভিজ্ঞ ছিলেন। ইলমুল হাদীসে তাঁর কিতাব ‘মাশারিকুল আনওয়ার’ খুব প্রসিদ্ধ ও সর্বমহলে সমাদৃত। সপ্তম শতাব্দীর আকাবির মাশায়েখের তিনি অন্যতম বিশেষ ব্যক্তি। ৬৫০ হিজরীতে তাঁর ইনতিকাল। যেহেতু তিনি এই উপমহাদেশের লোক আবার সেই শতাব্দীর মাশায়েখে কেরামের অন্তর্ভুক্ত, যে শতাব্দীতে মানুষের মাঝে রতন হিন্দির চর্চা হয়েছে, তাই রতন সম্পর্কে কথা বলার সবচেয়ে বেশি অধিকার তাঁরই। তিনি মওযূ বর্ণনা চিহ্নিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে পুস্তিকা লিখেছেন তাতে রতন সম্পর্কে লিখেছেন-
وأحاديث رتن الهندي موضوعة، وما يحكى عن بعض الجهال من أنه اجتمع بالنبي صلى الله عليه وسلم، وسمع منه، ودعا له بقوله: " عمرك الله "، ليس له أصل عند أئمة الحديث وعلماء السنة، وكلها موضوعة.
ولم يعش من الصحابة ممن لقي النبي صلى الله عليه وسلم أكثر من خمس وتسعين سنة، وهو أبو الطفيل، فبكوا عليه، وقالوا: هذا آخر من لقي النبي صلى الله عليه وسلم، واجتمع به.
وهذا هو الصحيح، لقوله عليه الصلاة السلام في آخر عمره حين صلى العشاء الآخرة ليلة : أرأيتم ليلتكم هذه، فإن على رأس مائة سنة لا يبقى ممن هو على وجه الأرض أحد.
وما ينطق عن الهوى إن هو إلا وحي يوحى.
وأحاديث رتن الهندي المنقولة عنه من جنس الأحاديث التي تنسب إلى الحكيم الترمذي بزعمهم أنه سمعها من أبي العباس الخضر عليه السلام. وكل هذا ليس له أصل يعتمد ولا قاعدة تعتقد، بل ينقله الفقراء في زواياهم ويسبكون الرواية من رواياتهم، ودين الإسلام أشرف من أن يؤخذ من كل جاهل عامي، أو يثبت بقول كل غافل غبي.
لقوله عليه السلام: ذروني ما تركتكم، وإني تركتكم على البيضاء النقية، ليلها كنهارها، إن تمسكتم بها لن تضلوا بعدي: كتاب الله وعترتي، واتباع أصحابي وسنتي.
ইমাম হাসান ইবনে মুহাম্মাদ সাগানী রাহ.-এর এই পুরো বক্তব্য তাঁর পুস্তিকা ‘আল-মওযূআত’-এর ৩-৪ পৃষ্ঠায় রয়েছে। আমার কাছে পুস্তিকাটির যে সংস্করণ আছে সেটি اللؤلؤ المرصوع فيما قيل لا أصل له أو بأصله موضوع -এর সঙ্গে যুক্ত। প্রায় একশ বছর আগে এটি মিসরের ‘মাতবাআতুল বারুনিয়্যা’ থেকে ছাপা হয়েছে। খুশির কথা হল, সাগানী রাহ.-এর এই বক্তব্য আল্লামা আবদুল হাই হাসানী লখনভী রাহ. (১৩৪১ হি.)-এর ‘নুযহাতুল খাওয়াতির’ কিতাবের প্রথম খণ্ডের ১৬৯ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হয়েছে।
ঈমানী গায়রত ও ফিকহী বাসীরতে পূর্ণ এই নূরানী বক্তব্যে আল্লামা সাগানী রাহ. পরিষ্কার বলেছেন যে, রতনের সাহাবী হওয়ার বিষয়টি মূলত কিছু জাহেল লোকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এই দাবি ইলমে হাদীসের ইমাম ও সুন্নাহর বিদগ্ধ উলামায়ে কেরামের নিকট সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তিনি আরো বলেছেন, ‘রাতানিয়্যাত’ নামে প্রসিদ্ধ রতন হিন্দির যেসব বর্ণনা রয়েছে সবগুলো মওযূ বা জাল।
সাগানী রাহ. বলেছেন, এই বর্ণনাগুলো সেই ধরনের, যে সম্পর্কে দাবি করা হয় যে, এগুলো হাকীম তিরমিযী রাহ. হযরত খাযির আলাইহিস সালাম থেকে শুনেছেন!
তিনি আরো বলেছেন, এই সবই ভিত্তিহীন এবং শরীয়তের নীতিমালা-বিরোধী। এগুলো তো ইলমহীন দরবেশ লোকেরা খানকায় বসে বসে তৈরি করেছে। এরপর তাদের সূত্রেই এগুলো প্রসার লাভ করেছে।[7] ৭ মনে রাখতে হবে, ইলমহীন এবং গাফেল মানুষদের থেকে আল্লাহর দ্বীন গ্রহণ করা যাবে না। (সেটা কেমন ইলম, যার সম্পর্কে ইলমের ধারক-বাহক ব্যক্তিগণ অবগত নন। যা কেবল ইলমহীন দরবেশদেরই জানা আছে? দ্বীনের ইলম তো সুস্পষ্ট এবং প্রসিদ্ধ। এখানে শায, মুনকারের কোনো দখল নেই।) [8]৮.
কোনো ব্যক্তি যদি বাস্তব অবস্থা জানতে চায় তাহলে তার জন্যে আল্লামা সাগানী রাহ.-এর এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যই যথেষ্ট।
এখানে একথাও জেনে রাখা ভালো যে, রতন হিন্দির নামে চালানো মওযূ রেওয়ায়েতের সংকলন ‘রাতানিয়্যাত’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে মোটামুটি ৩০০ রেওয়ায়েত আছে। ইলমহীন কোনো সূফী এই সংকলনকে সংক্ষিপ্ত করে ‘আল-আরবাউনাল মুনতাখাবাত মিনাল মুনতাখাবাতির রাতানিয়্যাত’ (রতনী চল্লিশ হাদীস) প্রস্তুত করেছে। এই সংকলকদের জাহালাত এই পর্যায়ের যে, তারা রতনকে সাহাবী হিসাবে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এই বাহানার আশ্রয় নিয়েছে যে, হাদীস রেওয়ায়েতের যুগে যেহেতু হিন্দুস্তান ইসলামের ঝা-াতলে আসেনি তাই মাশায়েখে হাদীস মনীষীগণ রতনকে চিনতেন না বা রতন সম্পর্কে কিছু জানতেন না।
আর রাতানিয়্যাতকে প্রমাণ করার জন্যে এই বাহানার আশ্রয় নিয়েছে যে, কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসসমূহ রাতানিয়্যাতের বর্ণনাগুলোর অর্থ-মর্ম সঠিক হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে।
কিন্তু ইলমহীন সেই দরবেশদের এই হুঁশ হয়নি যে, তারা গাফেল হওয়া সত্ত্বেও খোঁজ পেয়ে গেল! অথচ মাশায়েখে হাদীস (হাদীস শাস্ত্রের মনীষীগণ) কেন খোঁজ পেলেন না?
তোমরা যেই যামানায় রতনের খোঁজ পেয়েছ সেই যামানায়ও তো মাশায়েখে হাদীস ছিলেন। রতন সম্পর্কে সেই মাশায়েখের কী মতামত? নাকি তাঁরাও রতনের খোঁজ পাননি। আর সপ্তম শতাব্দীর রতনের খোঁজ ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম কীভাবে পাবেন? তার খোঁজ তো পাবেন ইমাম সাগানী ও ইমাম যাহাবী রাহ.। তো এই মাশায়েখে হাদীস তোমাদের রতন সম্পর্কে কী বলেছেন?
ওই দরবেশ বেচারাদের এই হুঁশও নেই যে, কোনো কথা সঠিক হওয়ার অর্থই এটা নয় যে, তা অবশ্যই সহীহ হাদীস। হাদীস জালকারী কত লোক প্রজ্ঞাপূর্ণ কোনো বক্তব্যকে, সহীহ অর্থের কোনো বাক্যকে কিংবা নসীহতমূলক কোনো কথাকে হাদীসে নববী বলে দিয়েছে! আবার হাদীস জালকারী কোনো কোনো ব্যক্তি এমনও ছিল, যারা মুনকার, বাতিল ও আপত্তিকর মনগড়া, কল্প-কাহিনীকেও হাদীস বানিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে!
‘রাতানিয়্যাত’ প্রস্তুতকারী লোকেরা এই উভয় পন্থা অবলম্বন করেছে। সেজন্য তাতে সঠিক অর্থপূর্ণ বর্ণনাও আছে, আবার নাচ-গান করা ইত্যাদির মতো মুনকার বর্ণনাও আছে। পুরো পুস্তিকাটি আগাগোড়া জাল। তার সামান্য অংশও প্রমাণিত নয়।
বিশেষ সংখ্যাওয়ালা কী করেছেন?
ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি পত্রিকার যে দুটি প্রবন্ধের দিকে আপনি ইশারা করেছেন সেগুলোর উপর আমি কোনো পর্যালোচনা করতে চাচ্ছি না। কারণ উপরোল্লেখিত আলোচনায় ইনশাআল্লাহ মূল বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে ‘হিন্দুস্তানে ইসলামের আগমন ও ভারতীয় সাহাবী হযরত বাবা রতন লাল হিন্দি রা.’ শিরোনামে যে প্রবন্ধটি প্রায় ছয় মাস আগে আপনার উল্লেখিত দ্বিতীয় পত্রিকাটির বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে, সে সম্পর্কে শুধু একটি কথা পেশ করতে চাই।
এই প্রবন্ধকার তাঁর তথ্যসূত্রে পাঁচটি কিতাবের নাম লিখেছেন। যথা- ক. সায়্যিদ সুলাইমান নদভী রাহ. রচিত ‘আরবোঁ কি জাহাজরানী’। খ. শায়খ যাইনুদ্দীন মালীবারী রাহ. রচিত ‘তুহফাতুল মোজাহেদীন’। গ. ‘লিসানুল মীযান’। ঘ. ‘ইসাবা’ (প্রবন্ধকার লিখেছেন ‘আসাবা’)।
ঙ. ‘হিন্দ ও পাক নিগাহে নবুওয়াত মেঁ’ (প্রবন্ধকার এই কিতাবের লেখকের নাম উল্লেখ করেননি)।
এই পাঁচ কিতাবের প্রথম দুটিতে রতন হিন্দিকে সাহাবী বলা তো দূরের কথা, তার নামই আসেনি।
‘লিসানুল মীযান’ ও ‘ইসাবাহ’ দুটোই হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর কিতাব। সেখানে রতন হিন্দির সাহাবী দাবি করাকে কেবল বাতিল বলা হয়েছে তাই নয়, বরং খোদ রতন হিন্দিকেই ‘কাযযাব’ বা চরম মিথ্যুক বলা হয়েছে। এখন যদি এই দুই কিতাবকে তথ্যসূত্রে উল্লেখ করে রতন হিন্দিকে সাহাবী হিসেবে পেশ করা হয় তাহলে কাজটা কেমন হল বলুন?
‘হিন্দ ও পাক নিগাহে নবুওয়াত মে’ পুস্তিকাটির লেখকের নাম প্রবন্ধকার উল্লেখ করেননি। বলা যায় তিনি রতন সম্পর্কিত পুরো আলোচনাই এই পুস্তিকা থেকে অনুবাদ করে দিয়েছেন। পুস্তিকাটি মূলত বেরেলভী আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ ফয়েয আহমদ ওয়েসী রেজভীর। এই রেজভী মাওলানা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আলীমুল গাইব’ এবং অতীত ও ভবিষ্যতের সবকিছু জানেন-এই আকীদা সাব্যস্ত করার জন্য পুস্তিকাটি লিখেছেন। একটি শিরকী আকীদার পক্ষাবলম্বন করে লিখিত এই পুস্তিকাটি প্রবন্ধকারের পছন্দ হয়ে গেছে। ওখান থেকে তিনি রতন হিন্দি সম্পর্কে জাল ও মিথ্যা ঘটনাবলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে পাঠকদের সামনে পেশ করেছেন। গাফলতের একটা সীমা তো থাকা দরকার! ব্যস, আল্লাহই রক্ষা করার মালিক।
وما علينا إلا البلاغ، وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
২৯/০১/১৪৪০ হিজরী
বুধবার রাত
অনুবাদ : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব
[1] ১. এটা তো রতন সম্পর্কে লিখিত তাঁর এই প্রবন্ধ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে রতন সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রাহ.-এর ‘আত-তাজরীদ’-এর ইবারতের মাফহূম বয়ান করতে গিয়ে তাঁর যে কঠিন তাসামুহ প্রকাশিত হয়েছে, যা এই বাংলা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়নি; সেটাই একথার সুস্পষ্ট দলীল। এছাড়াও এর একটি ছোট দৃষ্টান্ত হল, হযরত গীলানী রাহ. তাঁর শানদার কিতাব ‘তাদভীনে হাদীস’-এ এক রেওয়ায়েত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ.-এর বক্তব্যকে রেওয়ায়েতের অংশ বানিয়ে দিয়েছেন। তাযকিরাতুল হুফফাযের একেবারে শুরুতে ইমাম যাহাবী রাহ. একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করে তার সনদগত অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, فهذا لا يصح অর্থাৎ রেওয়ায়েতটি সহীহ নয়। কিন্তু মাওলানা গীলানী রাহ. فهذا لا يصح -কে ঐ রেওয়ায়েতের অংশ ধরে তরজমা করেছেন, ايسا كرنا درست نه ہوگا (এমন করা ঠিক হবে না)। দেখুন, তাদভীনে হাদীস, পৃষ্ঠা : ২৮০-২৮১ এবং তাযকিরাতুল হুফফায, খ- : ১, পৃষ্ঠা : ৫।
ومن العجائب أن الشيخ الدكتور حميد الله تلميذ العلامة الكيلاني، قد تبعه في هذا الوهم، في كتابه “دنيا كا سب سے قديم مجموعۂ احاديث (صحيفۂ همام بن منبۂ)” صـ ৫৫-৫৪. ولم يسر هذا الوهم إلى الدكتور مصطفى الأعظمي، حينما تكلم على هذه الرواية في كتابه >دراسات في الحديث النبوي وتاريخ تدوينه< ج ১ ص৯৩-৯২
وأغرب من ذلك أن بعض المصنفين المعاصرين في تاريخ كتابة الحديث جعل مفهوم هذا الكلام مختلفا فيه بين العلماء، من أجل ما صنعه الكيلاني رحمه الله تعالى في >تدوين حديث< ولم يدر أن هذا وهم محض من العلامة الكيلاني رحمه الله تعالى، وتلك الرواية مخرجة في الكتب بالأسانيد، وليس فيها كلمة "فهذا لا يصح"، فإن هذه الكلمة إنما قالها الذهبي تعليقا، لبيان حكم الرواية، والأمر واضح لا ينبغي أن يشتبه.
ثم راجعت الترجمة العربية لكتاب الكيلاني هذا>تدوين الحديث<، التي قام بها الدكتور عبد الرزاق إسكندر حفظه الله تعالى ورعاه، فرأيت مُراجِعها الدكتور بشار نبه على وهم الكيلاني رحمه الله تعالى هنا، نقلا عن الشيخ محمد عوامة و تنبيها من عنده أيضا، فجزاهما الله خيرا. ينظر صـ ২৩২ و ২৩৫.
[2] . وإتماما للبحث لا بد من الإشارة هنا أن الحافظ ابن حجر رحمه الله تعالى ما كان واقفا على عبارة >القاموس< تلك قبل لقاء الفيروزآبادي ولا عند لقائه، (أو نقول : إنه لم يكن مستحضرا تلك العبارة)، وإنما وقف عليها أو استحضرها بعد وقت، فمن أجل عدم وقوفه أو عدم استحضاره قول الفيروزآبادي التام المفصل، المذكور في القاموس، كان ظن فيه أنه يميل إلى تصديق دعاوي الناس في رتن، وكأن الحافظ تخيل ذلك من شدة إنكاره على الذهبي وإثباته تواتر وجود رتن، فمن هنا قال الحافظ في كتابه >المجمع المؤسس للمعجم المفهرس< جـ ২ صـ ৫৫২ في ترجمة الفيروزآبادي : ما لفظه : >وأخبرني لفظا أنه دخل بلدة رتن الهندي، ورأى في قريته خلقا كثيرا يخبرون خبره ويثبتون أمره، ورأيت الشيخ (كأنه) قد أصغى إليهم وصُدّق ما لديهم، وكان يشدد النكير على قول الذهبي إنه لا وجود له في الخارج، ويقول : كيف ساغ له الجزم بما لا علم له به، ووجود هذا الرجل لا ينكره إلا من لم
يبلغه أخباره على وجهها.
قلت : والذهبي ما جزم بذلك، بل تردد، وعبارته في كتابه >كسر وثن رتن< معروفة، وكذلك في >الميزان<، وهو معذور (في تردده في وجود رتن، لعدم دليل يثبت وجوده، كما أنه على الحق المبين في نفيه دعوى صحبة رتن، لأدلة كثيرة، و) لأنا معشر أهل الحديث نقطع بكذب من ادعى الصحبة بعد أبي الطفيل عامر بن واثلة، والله الهادي إلى الصواب.
متمسكين بالحديث الصحيح المتواتر عنه صلى الله عليه وسلم : أن على رأس مئة سنة -من حين مقاله- لا يبقى على وجه الأرض ممن هو إذ ذاك عليها أحد، فدخل في العموم رتن، على تقدير أن لو كان موجودا، حسبك.
فمن ادعى أنه كان موجودا إذ ذاك وعاش إلى بعد الست مئة، قطعيا يكفر به، ولا نبالي بمن لا يقطع بذلك ممن لم يحصل له العلم القطعي بذلك. انتهى كلام الحافظ في >المجمع المؤسس<
قال عبد المالك : وما بين الهلالين في موضعين من زيادتي أنا، لإتمام الكلام وإيضاح البيان، وقوله : >قطعيا يكفر به< معناه : ينكر دعواه ويُرَدُّ قطعا، وقوله : المتواتر لا يريد به المتواتر السندي، وإنما أراد به هنا المتلقى بالقبول الذي يفيد العلم القطعي النظري عند ابن حجر، وهذا هو المراد من هاتين الكلمتين إن شاء الله تعالى، وإن استشكلهما شيخنا الشيخ محمد عوامة في حاشية >تدريب الراوي<، فعلق عليهما بما يراجع من هناك.
قال عبد المالك : ثم إن الحافظ كتب في حاشية نسخته من هذا الكتاب ما يلي : >قلت : قد صرح في >القاموس< بأنه كذاب بالهند، وليس بصحابي، فلعله رَجَع للصواب<.
قال عبد المالك : كان الفيروزآبادي على الصواب في أمر رتن سابقا ولاحقا، وإنما إنكاره على الذهبي كان منحصرا في إنكاره وجود رتن، وكان الفيروزآبادي يظن بالذهبي أنه جزم بنفي وجوده، فاشتد نكيره عليه كما سبق، مع أن الذهبي ما كان جزم بنفي وجوده، وإنما جزم بكون دعوى صحبته كاذبة، وهذا أمر يقيني مجمع عليه لا يشك فيه أحد، لا الفيروزآبادي ولا غيره. كما سبق وسيأتي إن شاء الله تعالى.
[3] ৩. এই আলোচনার সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা তো সামনে আসছে। এখানে শুধু এইটুকু বলে দেওয়া প্রয়োজন মনে হচ্ছে যে, মুহাক্কিক মুসান্নিফদের অভ্যাস হল তারা জীবনের শেষ পর্যন্ত নিজেদের তাসনীফ-রচনায় সংশোধন ও পরিমার্জন অব্যাহত রাখেন। এজন্য ‘আলকামূস’ হিন্দুস্তান সফরের আগে রচনা হলেই এটা আবশ্যক হয় না যে, রতন সম্পর্কিত বক্তব্যও আগের। খুবই সম্ভব যে, রতন সম্পর্কিত বক্তব্য তিনি হিন্দুস্তান সফরের পরে যখন রতন সম্পর্কে তাঁর তাহকীক পূর্ণ হয়েছে তখন ‘কামূস’-এ তার আলোচনা যুক্ত করেছেন। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, এটা আগের লেখা তাহলেও এতে তঁাঁর সম্পাদনা করার সুযোগ ছিল। কমপক্ষে কোনো টীকা সংযুক্ত করতে তো পারতেন। কারণ হিন্দুস্তান সফরের পরেও তিনি কয়েক বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু কোথায় কামুসের কোনো নুসখায় এজাতীয় কোনো টীকা বা নোট? Ñআবদুল মালেক
[4] . في بعض نسخ الرحلة بعد قلت زيادة : >وبقاء رتن المحكي عنه هذا العمر معجز لرسول الله صلى الله عليه وسلم< فإن صحت هذه الزيادة في كتاب التذكرة فالمراد : أي إن صحت القصة. ومعلوم أنها لم تصح، كما نبه على ذلك الصفدي نفسه في آخر كلامه نقلا عن الذهبي. و قوله : "فغير بدع لمن يدعو له ست مرات" يقال عليه : متى ثبت أنه صلى الله عليه وسلم دعا لرتن؟ لم يأت ذكر ذلك إلا في روايات هي على تعبير البرزالي من أحاديث الطرقية. ذكر كلامه الصفدي نفسه في "الوافي بالوفيات" جـ ১৪، صـ ৭০
[5] قال الراقم : كما أن عدم الدليل لا يدل بالأولى على ثبوت المدلول، بل الدليل الناص على الثبوت هو الذي يدل على ثبوت المدلول، ثم إن عدم الدليل وإن كان لا يدل على عدم المدلول مباشرة، ولكنه يلزم منه ذلك لزوما بينا، فإن الأصل العدم، والواجب استصحاب هذا الأصل ما لم يأت دليل على خلافه، فافهم ذلك جيدا.
قال الراقم : ومن أجل استعمال الصفدي هذه القاعدة من غير تنقيحها، وفي غير محلها، ومخالفا لما ذهب إليه نفسه في آخر كلامه؛ أنكر عليه صنيعه هذا المحدث برهان الدين ابن جماعة (৭৯০هـ)، فعلق عند كلام الذهبي الذي ختم به الصفدي بحثه في >التذكرة< ما نصه : >هذا الذي ذكره شيخنا الذهبي هو الحق، وما صدّر به الصفدي من تجويز الوقوع لا يقتضي الوقوع، فكم من جائز ليس بواقع، وأما إنكار التردد فيه والشك فخبط لا يلتفت إليه، والصواب عدمُ التردد في بطلانه، وليس الصفدي من رجال هذا المقام. انتهى.
نقل تعليقة البرهان هذه السيد علي صدر الدين المدني في رحلته المذكورة ص ২৪৯، عن نسخة >التذكرة< للصفدي، التي نقل منها بحثه عن رتن، قال السيد : >وفي هامش النسخة المذكورة أيضا منقول عن خط برهان الدين بن جماعة ما مثاله<، فذكر التعليقة المذكورة بعينها.
وهذه التعليقة ذكرها الحافظ أيضا في >الإصابة<، ولكنه اختصر آخرها، مع أنه كان مهما جدا.
[6] قال الراقم : وذلك لأنه مِنْ شِبْه المحال أن يفهم العوام أو من هم في حكمهم على الجهابذة دقائق علمهم، ومن هنا قال من قال من السلف : علمنا هذا كهانة عند الجهال.
[7] ৭. সহীহ খানকাহ সেটিই যার ভিত্তি সহীহ ইলম ও ইত্তিবায়ে শরীয়ত। যেখানে কোনো বিদআতের স্থান নেই এবং রসম-রেওয়াজের পরিবর্তে হাকীকতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ।
[8] ৮. قال الراقم : لعل الذهبي رحمه الله تعالى لم يقف على كلام الصغاني أو لم يستحضره لما قال : >...، فليعلم أنني أول من كذب بذلك<، أو أنه أراد بذلك التكذيب المفصل ببسط الأدلة والشواهد.