সীরাত ও সুন্নাহ : সঠিক অন্বেষণ, সঠিক অনুসরণ
মানুষের জন্য প্রয়োজন আদর্শ ও নমুনা। আল্লাহ তাআলা মানুষের স্বভাবের মাঝে একটি শূন্যতা যেমন রেখেছেন তেমনি রেখেছেন পূর্ণতার একটি উপকরণ। শূন্যতাটি হচ্ছে, কোনো নমুনা ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। আর পূর্ণতার উপকরণটি হচ্ছে অনুকরণের যোগ্যতা। স্বভাবগতভাবেই মানুষ অনুকরণপ্রিয়। অনুকরণের তার প্রয়োজনও আছে। স্বভাবের এই চাহিদা ও প্রয়োজনটি তখনই যথার্থরূপে পূরণ হয় যখন মানুষ জীবন ও কর্মের একটি উত্তম নমুনা খুঁজে পায় এবং তার অনুকরণ ও অনুসরণের তাওফীক-প্রাপ্ত হয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য সেই নমুনা বানিয়েছেন শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তাঁর জীবন ও কর্ম, শিক্ষা ও আদর্শ মানবজাতির জন্য আসমানী নমুনা, যার অনুসরণ-অনুকরণের মধ্যেই মানুষের দো’জাহানের মুক্তি ও সাফল্য।
আল্লাহ তাআলা মানবজাতির হেদায়েতের জন্য যেমন আলকুরআনুল কারীম নাযিল করেছেন তেমনি কুরআনের শিক্ষা ও বিধানের বাস্তব রূপ হিসেবে দান করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও উসওয়া। কুরআন মাজীদের শিক্ষা ও বিধানকে যখন সুন্নাহ ও উসওয়ার আলোকে জানা হবে ও মানা হবে তখন সেটাই হবে আল্লাহ তাআলার যথার্থ ফরমাবরদারী। এ ফরমাবরদারীর মাধ্যমেই মানুষের জীবন হয়ে উঠতে পারে সফল ও সুন্দর, নির্মল ও জ্যোতির্ময়।
জীবনের কোনো ক্ষেত্রই এই অন্বেষণ-অনুসরণের গণ্ডির বাইরে নয়। আমাদের চেতনা-বিশ্বাস, জীবন-দর্শন, জীবন বোধ, উৎসব-উপাসনা, পারস্পরিক সম্পর্ক, বিয়ে-শাদী, লেনদেন, নীতি-নৈতিকতা, আইন-বিচার, সবকিছুই এই অন্বেষণ-অনুসরণের গণ্ডির ভিতরে। এইসকল ক্ষেত্রে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। আমাদের ঈমানের কালেমা- ‘আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’-এর দাবির মাঝেই রয়েছে এই অন্বেষণ ও অনুসরণের অঙ্গিকার। সুন্নাহ ও উসওয়ার এই ইলম সেই ইলমেরই অন্তর্ভুক্ত, যার কথা বলা হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত হাদীসে- ‘তলাবুল ইলমি ফারিযাতুন আলা কুল্লি মুসলিম’। ইলম অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয।
সুন্নাহ ও উসওয়ার অন্বেষণ ও অনুসরণের ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব বুঝে এলে খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারব যে, এটি শুধু রবীউল আওয়াল মাসকেন্দ্রিক কোনো ব্যাপার নয়, নয় কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালনের মধ্য দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার মতো বিষয়। এটি তো জীবনব্যাপী মগ্নতার বিষয়, যা খুব যত্নের সাথে অর্জন করতে হয় আর নিষ্ঠার সাথে পালন করে যেতে হয়।
সুন্নাহ ও উসওয়ার অর্জন ও অন্বেষণের প্রসঙ্গে দুটো বিষয় খুব মনোযোগের দাবিদার। প্রথমটি হচ্ছে সঠিক সূত্র থেকে সঠিক বিষয়টি গ্রহণ করা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সঠিক বিষয়টি সঠিকভাবে উপলব্ধি করা। এ দুটো শর্ত পূরণ হলেই তো অনুসরণটি সুন্নাহর অনুসরণ হবে। নতুবা সেটি হবে সুন্নাহর নামে ও শিরোনামে অন্য কিছুর অনুসরণ। কোনো রেওয়ায়েত বা বর্ণনা যখন সামনে আসে তখন প্রথমে দেখতে হয় তা বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত কি না। যে কোনো বইপত্রে যে কোনো বর্ণনা পাওয়ামাত্রই তা গ্রহণ করে ফেলার সুযোগ নেই। বিশেষত যে সকল বর্ণনায় কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী উলামা-সুলাহার যুগযুগ ধরে চলে আসা নীতি ও কর্মের বিপরীত কিছু প্রতীয়মান হয়। সেক্ষেত্রে বর্ণনার বিচার-বিশ্লেষণ অতি জরুরি। বিচার-বিশ্লেষণ করলেই বর্ণনাটির স্বরূপ প্রকাশিত হবে। অথচ এক্ষেত্রে মর্মান্তিক ও লজ্জাকর অসচেতনতার নজির দেখা যায়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে রেওয়ায়েতের অর্থ-মর্ম, প্রয়োগক্ষেত্র ও প্রয়োগ-পদ্ধতি সঠিকভাবে বোঝা। কারণ বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝার পর যে অনুসরণ হবে সেটিই হবে প্রকৃত অনুসরণ। অন্যথায় তা প্রকৃত অনুসরণ হবে না। কোনো বর্ণনার ভুল অর্থ বুঝে কেউ যদি তা পালন করে তাহলে সেটিকে ঐ ব্যক্তির বুঝের অনুসরণ বলা যেতে পারে, ঐ বর্ণনার অনুসরণ বলা যায় না। কারণ ঐ বর্ণনায় তো এই কথা বলাই হয়নি। এক্ষেত্রেও লজ্জাকর ও মর্মান্তিক সব উদাহরণ রয়েছে। ব্যক্তি সুন্নাহ ও সীরাতের কোনো বর্ণনা ভুলভাবে বুঝছে, যে কারণে এমন কিছু সিদ্ধান্ত দিয়ে বসছে, যা কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের সিদ্ধান্তের বিপরীত। এক্ষেত্রে তো প্রয়োজন ছিল নিজের চিন্তা ও বুঝের দিকে পর্যালোচনার দৃষ্টিতে তাকানো। নিশ্চয়ই আমার বুঝতে ভুল হয়েছে; নতুবা কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী ব্যক্তিবর্গের বুঝের সাথে আমার বুঝের অমিল হচ্ছে কেন? কিন্তু এভাবে বিষয়টিকে মূল্যায়ন না করে বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও বুঝকেই ‘নতুন উদ্ভাবন’ ধরে নিয়ে উল্লসিত হওয়ার নজিরও রয়েছে।
সারকথা এই যে, আমাদের অন্বেষণটিও সঠিক ও যথার্থ হতে হবে। কারণ তা হচ্ছে সঠিক অনুসরণের পূর্বশর্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এক্ষেত্রে সীরাত-সুন্নাহর মাহির উলামায়ে কেরামের সাহচর্যের কোনো বিকল্প নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ সঠিকভাবে বোঝার এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন।