মুতালাআয় বিস্তৃতি ও গভীরতা কাম্য
بسم الله الرحمن الرحيم
আজ শুধু দিরাসাতে উলইয়ার তালিবুল ইলম ভাইদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা আরয করছি। আমাদের পড়াশোনা দিরাসাতে উলইয়ার মানের হয় কি না -সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে এটা তো বাস্তবতা যে, দেশের বহু প্রতিষ্ঠানে এখন দাওরায়ে হাদীস সম্পন্নকারী তালিবুল ইলম ভাইদেরকে দিরাসাতে উলইয়ার অনুশীলন করানো হয়। সেখানে অনুশীলন গ্রহণকারী তালিবুল ইলমদের সংখ্যাও অনেক।
দিরাসাতে উলইয়ার যে অনুশীলনকে এখন নির্দ্বিধায় ‘তাখাসসুস’ নাম দেওয়া হয় তার বুনিয়াদি রোকন তো এই যে, তালিবুল ইলম ভাইয়েরা তাতে আহলে দিল ও আহলে ফন রিজালের সোহবত হাসিল করবে। এই বুনিয়াদি রোকনের পর সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মুতালাআর বিস্তৃতি। আর মুতালাআ ঐ সময়ই মুফীদ হয় যখন তাতে গভীরতা থাকে। মুতালাআর সঙ্গে সঙ্গে মুতালাআ ‘হজম’ করতে পারার বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম বুনিয়াদী রোকনটি তো ‘আনকা’ পাখির মতোই। আফসোস! আজকাল মুতালাআর বিস্তৃতি ও মুতালাআর গভীরতা এই গুণদুটিও হারিয়ে যাচ্ছে। ঐ যে বলা হয়-
آ ں قدح بشكست وآں ساقى نہ ماند
না আছে সেই সাকী। না সেই পানপাত্র।[1]
বর্তমান অবস্থা তার চেয়েও করুণ। কারণ সেই শারাবান তাহূরার অন্বেষীও তো এখন দুর্লভ। এজন্য আমি তলাবায়ে কেরামের কাছে আরয করছি, তারা যেন নিজেদের অবস্থার দিকে একটু দৃষ্টি দেন। নিজেদেরকে সালাফের সাচ্চা ওয়ারিস হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।
অসম্পূর্ণ মুতালাআ ও ভাসাভাসা মুতালাআর নানান হালাত দেখে পেরেশান হওয়ার সিলসিলা তো অব্যাহত থাকেই। গত এক দেড় মাস ধরে যে ঘটনাটি সামনে আসছে সেটা হল, দাওরা ফারেগ এবং দিরাসাতে উলইয়ার বহু তালিবুল ইলম ভাইয়ের পক্ষ থেকে খুব শক্ত ভাষায় এবং অন্যকে অজ্ঞ মনে করে কথা বলার ঢঙয়ে একটি আপত্তি আমার কাছে আসছে। আপত্তিটি হল, আপনারা মানসূখ আয়াত নির্ভর একটি প্রবন্ধ কীভাবে ছেপে দিলেন!
বিস্তারিত জানতে চাওয়ার পর বলা হল, وَ دَعْ اَذٰىهُمْ এই আয়াতাংশটুকু মানসূখ। অমুক অমুক মুফাসসির একে মানসূখ বলেছেন। অথচ ‘মাসিক আলকাউসার’-এর যিলকদ ১৪৩৯ হিজরী সংখ্যায় ছাপা একটি প্রবন্ধে ঐ হুকুম অনুযায়ী আমল করতে বলা হয়েছে!!
এই আপত্তি শুনে আমি খুব পেরেশান হয়েছি। কারণ আপত্তিকারী তালিবুল ইলম ভাইয়েরা কেবল এটুকুই দেখলেন যে, অমুক অমুক একে মানসূখ বলেছেন। কিন্তু এটুকু দেখলেন না যে, কত মুফাসসির তাকে মানসূখ বলেননি। একথাও দেখলেন না যে, কোনো কোনো মুফাসসির স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন যে, এই আয়াতাংশ মানসূখ নয়!
এরপর তারা একথাও চিন্তা করেননি যে, মানসূখ শব্দের মধ্যে কত পরিভাষা? আর যদি কোনো মুফাসসির কোথাও কোনো আয়াত বা আয়াতাংশকে মানসূখ হওয়ার মত ব্যক্ত করেন তাহলে কি একথা আবশ্যক হয়ে যায় যে, তাঁর তাহকীকই শেষকথা এবং মুজমা আলাইহি বা সর্বসম্মত মত? কিংবা একথা কি আবশ্যক হয়ে যায় যে, তাঁর উদ্দেশ্য- তা সর্বদিক থেকে মানসূখ?
আপত্তিকারী ভাইয়েরা একথাও ভাবেননি যে, যারা এই আয়াতাংশকে মানসূখ বলেছেন তারা তো আয়াতের মাফহুম বলেছেন- اترك إيذاءهم يعني لا تؤذهم এই মাফহুম যদিও মুহতামাল তবে ফাসাহাতে কালামের দাবি এই যে, এর মাফহুম হবে-
أعرض عن أذاهم إياك ولا تلتفت إليه
আল্লামা আবুল হাসান আলী ইবনুল হুসাইন বাক‚লী (৫৪৩ হি.) রাহ. লিখেছেন-
التقدير: ودع الخوف من أذاهم، وليس المعنى : لاتؤذهم، لأن "لا تؤذهم" أفصح من "دع أذاهم" إذا أردت : لا تؤذهم.
(কাশফুল মুশকিলাত ওয়া ইযাহুল মুযিলাত, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১০৮৩, প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৫ ঈসাব্দ, মাজমাউল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ, দিমাশক)।
আল্লামা আলূসী রাহ.-ও লিখেছেন- والأول أولى অর্থাৎ إعراض ও عدم التفات -এর মাফহুমই বেশি নিকটবর্তী। [রূহুল মাআনী, খ. ১২ পৃ. ৪৬, সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৮]
বয়ানুল কুরআন, তাফসীরে উসমানী ইত্যাদি কিতাবে আকাবির উলামায়ে কেরাম এই মাফহুমই বর্ণনা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এদেশে লিখিত শানদার তাফসীরের কিতাবেও একথাই লেখা হয়েছে। দেখুন- হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম বিরচিত কিতাব ‘আত তারীকু ইলা তাফসীরিল কুরআনিল কারীম’ খণ্ড : ৩ পৃষ্ঠা : ১৪৩। এখানে লেখা হয়েছে-
"ودع أذاهم" لا تكترث بإيذائهم لك، وصَدِّهم الناس عنك.
এরপর لا تؤذهم যদি دع أذاهم -এর প্রথম মাফহুম বা প্রধান মাফহুম প্রমাণিত হয় তবুও এতে সুস্পষ্টভাবে তরকে জিহাদের নির্দেশ নেই যে, কিতালের আয়াতের মাধ্যমে এটি মানসূখ হওয়ার বিষয়টি নির্দিষ্ট হয়ে যাবে।
আল্লামা ইবনে আশূর রাহ. লিখেছেন-
وقوله : "دع أذاهم" يجوز أن يكون فعل "دع" مرادا به أن لا يعاقبهم فيكون "دع" مستعملا في حقيقته وتكون إضافة أذاهم من إضافة المصدر إلى مفعوله، أي دع أذاك إياهم. ويجوز أن يكون "دع" مستعملا مجازا في عدم الاكتراث وعدم الاغتمام، مما يقولونه مما يؤذي ويكون إضافة المصدر إلى فاعله، أي لا تكترث بما يصدر منهم من أذى إليك فإنك أجلّ من الاهتمام بذلك، وهذا من استعمال اللفظ في حقيقته ومجازه. وأكثر المفسرين اقتصروا على هذا الاحتمال الأخير. والوجه : الحمل على كلا المعنيين، فيكون الأمر بترك أذاهم صادقا بالإعراض عما يؤذون به النبي ‘ من أقوالهم، وصادقا بالكف عن الإضرار بهم، أي أن يترفع النبي عن مؤاخذتهم على ما يصدر منهم في شأنه، وهذا إعراض عن أذى خاص لا عموم له، فهو بمنزلة المعرف بلام العهد، فليست آيات القتال بناسخة له.
তাফসীরে ইবনে আশূর-আততাহরীর ওয়াত তানবীর, খণ্ড : ২১ পৃষ্ঠা : ২৮৫
আল্লামা ইবনে আশূর রাহ.-এর এই তাহকীকের যথার্থতা এর দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, সূরা আহযাব মাদানী সূরা। আহযাবের ঘটনা কিতালের হুকুম নাযিল হওয়ার অনেক পরে। এজন্য এই সূরার কোনো আয়াতাংশকে কিতালের আয়াতের কারণে মানসূখ বলাও আপত্তিকর।
তালাবায়ে কেরামের কাছে দরখাস্ত, তারা যখন কারও লেখায় পড়বেন- অমুক আয়াত মানসূখ তখন কমপক্ষে ইমাম তাবারী রাহ.-এর এই আলোচনাকে সামনে রাখবেন, যা তিনি সূরা আনফালের প্রথম আয়াতের অধীনে করেছেন। তিনি লিখেছেন-
وليس في الآية دليل على أن حكمها منسوخ، لاحتمالها ما ذكرتُ من المعنى الذي وصفت. وغير جائز أن يحكم بحكم قد نزل به القرآن أنه منسوخ، إلا بحجة يجب التسليم لها، فقد دللنا في غير موضع من كتبنا على أن لا منسوخ إلا ما أبطل حكمه حادثُ حكمٍ بخلافه، ينفيه من كل معانيه، أو يأتي خبرٌ يوجب الحجةَ أن أحدهما ناسخٌ الآخرَ.
(তাফসীরে তাবারী-জামিউল বায়ান আন তাবীলি আয়িল কুরআন, খণ্ড : ৯, পৃষ্ঠা : ১৭৬, তৃতীয় প্রকাশ : ১৩৮৮ হিজরী/১৯৬৮ ঈসাব্দ, প্রকাশক : মুস্তফা আল-বাবী আল-হালাবী) আরো দেখুন- তাফসীরে তাবারী, খণ্ড : ১০, পৃষ্ঠা : ৮১ সূরা তাওবা, আয়াত : ৫ ও ৬-এর পূর্ণ আলোচনা। এমনিভাবে খণ্ড : ১০, পৃষ্ঠা : ১৩৫, সূরা তাওবা, আয়াত ৩৯-এর তাফসীর। আরও দেখুন খণ্ড : ১১, পৃষ্ঠা : ৬৫, সূরা তাওবা, আয়াত ১২০-এর তাফসীর।
ইমাম আবু জাফর তাবারী রাহ. (৩১০ হিজরী)-এর উক্ত আলোচনার সাথে সাথে ইমাম আবু জাফর নাহহাস রাহ. (৩৩৮হি.)-এর কিতাব ‘আন-নাসিখু ওয়াল মানসূখ ফিল কুরআনিল কারীম’ মুতালাআও ইনশাআল্লাহ মুফীদ হবে।
ইমাম নাহহাস রাহ. সূরা বাকারার ১১৫ নম্বর আয়াতের আলোচনায় লিখেছেন-
والصواب أن يقال: أن الآية ليست بناسخة ولا منسوخة لأن العلماء قد تنازعوا القول فيها، وهي محتملة لغير النسخ، وما كان محتملا لغير النسخ لم يقل فيه ناسخ ولا منسوخ إلا بحجة يجب التسليم لها.
فأما ما كان يحتمل المجمل والمفسر والعموم والخصوص فعن النسخ بمعزل، لا سيما مع هذا الاختلاف.
(আন-নাসিখু ওয়াল মানসূখ ফিল কুরআনিল কারীম, আবু জাফর নাহহাস, পৃষ্ঠা : ১৯, আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যাহ বৈরুত, প্রকাশকাল : ১৪২৫ হিজরী)
ইমাম আলামুদ্দীন সাখাবী রাহ. (৫৫৮-৬৪৩হি.) ‘জামালুল কুররা ওয়া কামালুল ইকরা’ কিতাবে (খণ্ড ১ পৃষ্ঠা ৩৪৯, মাকতাবাতুত তুরাছ, মক্কা মুকাররমা, প্রথম সংস্করণ ১৪০৮ হিজরী, ১৯৮৭ ঈসায়ী) লেখেন-
سورة الأحزاب ليس فيها نسخ.
و (بعضهم) قالوا: نسخ قوله عز وجل: (وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَالْمُنَافِقِينَ وَدَعْ أَذَاهُمْ) بآية السيف، وليس كذلك، وقد تقدم القول في مثله. قال الراقم : ينظر مما تقدم قوله في سورة السجدة، والعنكبوت و الفرقان و الأعراف و الأنعام.
এই আলোচনার মাকসাদ হল, কোনো বিষয়ে কিছু লেখা বা বলার আগে ওই বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ ও গভীর মুতালাআ জরুরি। মুজতাহাদ ফীহ ও মুখতালাফ ফীহ বিষয়ের ক্ষেত্রে কেবল এক দিকের মুতলাআ করা থেকে সবসময় বেঁচে থাকতে হবে। এক দিকের মুতালাআ তো আম মানুষের কাজ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের তালিবুল ইলমদের জন্যও সেটা মুনাসিব। তবে দিরাসাতে উলইয়ার তালিবুল ইলমদের জন্য এটা বড় ত্রæটি। মুখতালাফ ফীহ ও মুজতাহাদ ফীহ বিষয়ের ক্ষেত্রে কেবল একতরফা মুতালাআ তালিবুল ইলমদের মাঝে বাড়াবাড়ি ও প্রান্তিকতা তৈরি করে। এর মাধ্যমে কখনো অন্যায় পক্ষপাতের ঘটনাও ঘটে। তাই তাদের মুতালাআ হতে হবে بما له وما عليه। তবে অবশ্যই নিজ মুশরিফদের তত্ত¡াবধানে হতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রুসূখ ফিল ইলম, তাফাক্কুহ ফিদ্দীন, ইতিদাল ও ইকতিসাদ এবং তাকওয়া ও তাহারাত নসীব করুন- আমীন।
-বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক গুফিরা লাহু
২৯ যিলহজ্ব, ১৪৩৯ হিজরী
১০-০৯-২০১৮ ঈসায়ী
সোমবার, বাদ যোহর
টীকা
[1]. মর্মসমৃদ্ধ এই সুন্দর পংক্তিটি সর্বপ্রথম আমি শুনেছি, হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের উসিলায় তাঁর উস্তায আল্লামা মুহাম্মাদ হারুন ছাহেব রাহ. থেকে। আল্লাহ তাআলা উভয়কে উভয় জাহানে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন।