স্ব দে শ : নদীভাঙ্গন
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক মাস ধরে ঘটছে ব্যাপক নদীভাঙ্গনের ঘটনা। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে নড়িয়ার কেদারপুর, মোক্তারের চর ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এপর্যন্ত সেখানে পাঁচ হাজার একাশিটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে আছে আরো আট হাজার পরিবার। দেশের উত্তরাঞ্চলেও বেশ কয়েকটি এলাকায় নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়ায় বহু মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছে।
নদীভাঙ্গন আমাদের এ ভ‚খণ্ডের এক প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৮০ ভাগই নদ-নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। আমাদের ছোট-বড় নদীর সংখ্যা প্রায় ৩০০। এসব নদ-নদীর তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার ১৪ কিলোমিটার, যার অর্ধেকই অর্থাৎ প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার ভাঙ্গনপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৫ হাজার একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ৬০ থেকে ৮০ লক্ষ মানুষ নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক তথ্য থেকে জানা যায়, সারা দেশে বর্তমানে গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ।
এই গৃহহীন পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ধারা যে অব্যাহত নেই তা নয়, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। মিডিয়াসূত্রে জানা গেছে যে, ১৯৭২ সাল থেকে ২০১৭ঈ. পর্যন্ত ৪৬ বছরে ১৭৬১টি গুচ্ছগ্রামে আশ্রয় পেয়েছে ৮১ হাজার ৭৩৫টি গৃহহীন পরিবার। ৫০ লাখ গৃহহীন পরিবারের মধ্যে বাকি ৪৯ লাখ ১৮ হাজার ২৬৫ পরিবারের এখনো কোনো আশ্রয় মেলেনি। (নয়া দিগন্ত, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, পৃ. ৯)
রাষ্ট্রের দায়িত্ব, এইসব গৃহহীন মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার হলে এইসব গৃহহীন মানুষের শুধু নয়, চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যও নিঃসন্দেহে দূর হতে পারে।
আমাদের দেশে একদিকে যেমন আছে লাখ লাখ গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষ অন্যদিকে আছে অসংখ্য মিলিয়নিয়ার ও বিলিয়নিয়ার। রয়েছে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের বিপুল অপচয়ের ধারা।
কিন্তু কেন এই ভয়াবহ বৈষম্য? এই মর্মান্তিক অপচয়? আমাদের অর্থ-ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার কোথায় কোথায় গলদ আছে তা আমাদের খুব ভালো করে ভেবে দেখতে হবে? রাষ্ট্র কিছুতেই এই গৃহহীন মানুষগুলোর দায় এড়াতে পারে না।
দেশের বিত্তবান মানুষজনেরও কর্তব্য, নিজেদের জীবনধারার দিকে একটু পর্যালোচনার দৃষ্টিতে তাকানো। এদেশে এমন বিত্তশালীর সংখ্যা কম নয়, যারা একেক জনই শত শত গৃহহীনের পুনর্বাসনের ক্ষমতা রাখেন। ভারতের আওরাঙ্গবাদের এক ব্যবসায়ী তার মেয়ের বিয়ের খরচ বাঁচিয়ে সেই টাকায় ৯০ টি গৃহহীন পরিবারকে নতুন বাড়ি বানিয়ে দিয়ে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এরকম দৃষ্টান্ত কি এদেশের বিত্তবানেরাও স্থাপন করতে পারেন না? নিশ্চয়ই পারেন। তবে সদিচ্ছার প্রয়োজন।
কুরআন মাজীদে কারুনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। কারুনকে লক্ষ্য করে যে পয়গাম ওই যামানায় উচ্চারিত হয়েছিল তা সর্বযুগের বিত্তবানদের জন্য প্রযোজ্য। ইরশাদ হয়েছে-
اِذْ قَالَ لَهٗ قَوْمُهٗ لَا تَفْرَحْ اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ الْفَرِحِیْنَ، وَ ابْتَغِ فِیْمَاۤ اٰتٰىكَ اللهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ وَ لَا تَنْسَ نَصِیْبَكَ مِنَ الدُّنْیَا، وَ اَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللهُ اِلَیْكَ وَ لَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِی الْاَرْضِ، اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ الْمُفْسِدِیْنَ.
একটা সময় ছিল, যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, বড়াই করো না। যারা বড়াই করে আল্লাহ তাদের পসন্দ করেন না। আল্লাহ তোমাকে যা কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখেরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা কর এবং দুনিয়া হতেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন তেমন তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ কর। আর পৃথিবীতে ফ্যাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। নিশ্চিত জেনো, আল্লাহ ফ্যাসাদ বিস্তারকারীদের পসন্দ করেন না। -সূরা কাসাস (২৮) : ৭৬-৭৭
যাদের আল্লাহ বিত্ত দিয়েছেন তাদের একথা বলা হচ্ছে না যে, তুমি তোমার সবই বিলিয়ে দাও; বরং তাদের বলা হচ্ছে, তুমি নিজেও তা যুক্তিসঙ্গতভাবে ভোগ কর। একইসাথে অন্যদের প্রয়োজনও পূরণ কর। অর্থ-সম্পদকে আল্লাহ তাআলার বিধান মোতাবেক খরচ কর। এটা হবে আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন তার শোকরগোযারি। এই শোকরগোযারির বিনিময় তুমি আল্লাহর কাছে পাবে। আখেরাতে পরম শান্তির জান্নাতী-নিবাসে পৌঁছতে পারবে।
দুনিয়াতে মানুষ যে অর্থ-সম্পদ লাভ করে এর প্রকৃত মালিক তো আল্লাহ তাআলা। তিনি অনুগ্রহ করে তা দান করেছেন। কাজেই মানুষের কর্তব্য, আল্লাহ তাআলা যখন তাকে এভাবে অনুগ্রহ করেছেন সে-ও আল্লাহর বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করবে এবং আল্লাহ-প্রদত্ত অর্থ-সম্পদে তাদেরকে শরীক করবে।
মনে রাখতে হবে, যে অন্যের প্রতি রহম করবে আল্লাহ তার প্রতি রহম করবেন। যে অন্যের মুখে হাসি ফোটাবে আল্লাহও তার মুখে হাসি ফোটাবেন।