আলোর মিনার
[শহীদ মাওলানা মুহাম্মাদ আসলাম শেখুপুরী রাহ.। পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন। সাপ্তাহিক ‘যরবে মুমিন’-এ নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি।
তাঁর শাহাদাতের পর সাপ্তাহিক যরবে মুমিন ‘দাঈয়ে কুরআন নাম্বার, ব-ইয়াদে হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আসলাম শেখুপুরী শহীদ’ নামে তাঁর স্মরণে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। তাতে হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন-
“যে সকল আলেমেদ্বীন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সহীহ-সালেম ফিকির নিয়ে দ্বীনের খেদমত করে গেছেন মাওলানা মুহাম্মাদ আসলাম শেখুপুরী শহীদ রাহ. ছিলেন তাদের একজন। আল্লাহ পাক তাকে লিখনী ও বাগ্মিতায় অসাধারণ যোগ্যতা দান করেছিলেন।
...শেষ দিকে এসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর মাঝে তাফসীরুল কুরআনের বিশেষ যওক দান করেছিলেন। ফলে তার ‘দরসে কুরআন’ বেশ জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়ে আসছিল এবং এতে উম্মতের বহুত ফায়দাও হচ্ছিল।
মাওলানার বয়স খুব বেশি ছিল না। কোনো রাজনীতি-দলাদলির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন না। বাহ্যিকভাবে তার দ্বারা কারো কোনো ক্ষতি হত, এমন কিছু নজরেও আসে না। তবুও না-জানি কোন যালিমদের চোখের শূল হলেন আর তারা তাকে শহীদ করে দিল!...”
(নুক‚শে রফতেগাঁ, পৃ. ৬৮১-৬৮২)
‘যরবে মুমিন’-এ প্রকাশিত মাওলানার কলামের এক ভক্ত পাঠক এহসান সারোয়ার। একবার টেলিফোনে তার সাথে কথা হয় এ পাঠকের। কথার এক পর্যায়ে আলোচনা হয় তার ব্যক্তিগত হালত নিয়ে। ক্ষুদ্র জীবনে তিনি পার করেন বহু চড়াই-উৎরাই। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে তিনি ‘শয্যাশায়ী’। বিছানায় পড়ে থাকা এহসান সারোয়ারের জীবনে রয়েছে ‘রেযা বিল কাযা’-এর আদর্শ নমুনা। আল্লাহ পাক যে হালতে রেখেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকার দরুন তার শরীর অবশ হলেও তার জীবন অলস নয়। যিন্দেগীর সংক্ষিপ্ত সফরে ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত অনেক মুসাফিরের জন্যই আলো রয়েছে তার জীবনের ভাঁজে ভাঁজে।
মাওলানা আসলাম শেখুপুরী রাহ. সেই ফোনালাপটি প্রকাশ করেন ‘রোশনী কে মীনার’ শিরোনামে। সাপ্তাহিক ‘যরবে মুমিনে’ ২৭ যিলহজ্ব ১৪২৬ হিজরী মোতাবেক ৩১ ডিসেম্বর ২০০৫ ঈসাব্দতে প্রকাশিত সেই উর্দূ লেখাটি মাওলানার কলামসমগ্র ‘গরীবে শহর কী ইলতেজা’ থেকে বাংলাভাষী পাঠকের জন্য আলকাউসারে পরিবেশিত হল।]
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
-জালালপুর থেকে এহসান সারোয়ার বলছি।
-মনে হয় প্রথমবার নাম শুনছি।
-জী হাঁ, আপনি আমাকে চেনার কথা না। তবে আমি আপনাকে ভালোভাবেই চিনি। প্রতি সপ্তাহে আপনার সাথে মোলাকাত হয়।
-তাই নাকি! মোলাকাত!! তা কোথায়, কীভাবে?
-‘যরবে মুমিন’-এর পাতায়। আপনার প্রকাশিত কলামগুলো আগ্রহভরে পড়ি। লেখাগুলো লেখকের সাথে কথা বলতে তাগাদা দিয়েছে। আপনার সাথে কথা বলতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে।
-আচ্ছা, আমি আপনার কী খেদমত করতে পারি?
-আরে, কী বলছেন! আমাদের তো উচিত আপনার খেদমত করে যাওয়া। আল্লাহ তাআলা যেন ঈমানী যিন্দেগী নসিব করেন এবং ঈমানী মউত দান করেন- ব্যস এতটুকু দুআ চাই।
-আপনার কাছেও আমার একই দুআর দরখাস্ত।
আচ্ছা, বলবেন কি- আপনি কী করেন?
-কী আর করব! বিগত সাড়ে নয় বছর যাবৎ বিছানায় পড়ে আছি।
-কেন?
-এটা শুনে আর কী করবেন?
-কিছু তো বলুন। হতে পারে তাতে আমাদের জন্য কিছু সবক-নসিহতও থাকবে।
-আজ থেকে তের-চৌদ্দ বছর আগের কথা। জীবিকার তাগিদে ওমানের রাজধানী মাস্কাতে গিয়েছিলাম। সম্মানজনক একটি চাকরি পেয়েছিলাম। বেতন-ভাতাও ভালো ছিল। ডিউটির সময় নির্দিষ্ট ছিল। পার্টটাইমও করতাম। কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল না। টেনশন ছিল না। রোগ-শোক ছিল না। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো ছিল। ভালো খেতাম। ভালো পরতাম। খরচ-টরচের পর যা বাঁচত, বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম। আব্বা-আম্মাও খুশি ছিলেন আমার প্রতি।
ছেলে বড় হলে আর কিছু আয়রোযগার থাকলে রিশতা-সম্বন্ধ খুব আসতে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। কিন্তু খান্দানী ঐতিহ্য রক্ষার্থে খান্দানেই আমার সম্বন্ধ ঠিক হল। আল্লাহর মেহেরবানী, ‘শরীকে সফর’ ভালো মিলল। সুখে-দুঃখে যে আমার সঙ্গী হল। ওফাদারী ও আনুগত্যে যেন প্রাচ্য-রমণীদের আদর্শ ছবি!
সত্যি বলতে কী, প্রাচুর্য ও প্রশান্তি যেন আমাকে তাদের ঘরে তুলে রেখেছিল। অঢেল পয়সা, টগবগে যৌবন, মাতা-পিতার ¯স্নেহের ছায়া, স্বামীভক্ত প্রেয়সী স্ত্রী, ঘর উজালা করে আগত ফুটফুটে কন্যা, যেন সুবাসিত প্রস্ফুটিত গোলাব...! তারপর কী থেকে কী হয়ে গেল!
এহসান সারোয়ারের আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এল। একটি দীর্ঘশ্বাস!
-কী হল?
-বিয়ের দেড় বছর পর মাস্কাতে রাস্তা পারাপারের সময় একটি গাড়ির ধাক্কা লাগে। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। বেহুঁশ অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারি- জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে পড়েছি। মেরুদÐের হাড্ডিতে চোট লাগার কারণে বুক থেকে নীচ পর্যন্ত পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। হাসপাতালের বেডে পড়ে রইলাম দশ মাস।
চেষ্টা-তদবীর ও ডাক্তার-মেডিসিনে কোনো কসুর করিনি। কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা ছিল ভিন্ন। তদবীরকে তকদীর পিছনে ফেলে দিল। আমি আর সুস্থ হয়ে উঠলাম না।
মাস্কাত থেকে পাকিস্তানে চলে আসি। এখানে আসার পর ডাক্তার-কবিরাজ, হাসপাতাল-ক্লিনিক, এক্সরে-অপারেশন, ওষুধ-বড়ি, তাবিজ-তুমার, ঝাড়-ফুঁক কোনোকিছুই বাদ রইল না। একটার পর একটা চলতেই থাকল। কিন্তু যা হবার ছিল না, হয়নি। তাই মাথা পেতে আল্লাহর ফয়সালা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আমি অসুস্থই পড়ে রইলাম। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পরিজনসহ খান্দানের কেউই এই দুর্ঘটনাকে সহজে বরদাশত করতে পারছিল না। উচ্ছল ও প্রাণবন্ত টগবগে এক যুবক এভাবে নিথর পড়ে থাকবে- এটা তারা মেনে নিতে পারছিল না।...
কিন্তু অবশেষে বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হয়। চোখ বন্ধ করে মানতে না চাইলেই বাস্তবতা অবাস্তব হয়ে যায় না। এখন আমার হালত হল- আমি আর আমার বিছানা। আল্লাহ পাকের দেওয়া জীবনের একুশটি বসন্ত চলে ফিরে খেলাম আর সাড়ে নয় বছর বিছানায় পড়ে পড়ে কাটিয়ে দিলাম। বাকি জীবনও পার হয়ে যাবে।
-তাহলে রুটি-রুজির ব্যবস্থা কীভাবে হয়?
-চাকরি ছাড়ার সময় কোম্পানি বেশ কিছু অর্থ দিয়েছিল। ব্যাংকে তা ফিক্সড-ডিপোজিট করে রেখেছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা দ্বীনের সমঝ দান করেছেন। ব্যাংক থেকে দ্রুত সেগুলো বের করে ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছি। ওখান থেকে এখন এ পরিমাণ লাভ আসে যে, স্বাচ্ছন্দে জীবন চলে যায়; বরং খরচপাতি করার পরও কিছু উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
-আপনার সেবা শুশ্রূষা করে কে?
-আব্বাজান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। অবসরের পর ভালো জায়গা থেকে আকর্ষণীয় চাকরির অফার এসেছিল। বেতনভাতা ছাড়া বসবাসের জন্য বাংলোরও ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আমার জন্য তিনি এতসব অফার বর্জন করেন। আব্বাজান আমার খুব খেয়াল রাখেন। এছাড়া বিবি ছাহেবাও খেদমতে কোনো ত্রুটি করেন না।
-আপনার পঙ্গুত্বের পর স্ত্রীর আচরণে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? সে কি বিচ্ছেদের কোনো প্রসঙ্গ তুলেছে?
-বিলকুল না। সে প্রাচ্যের এক আদর্শ রমণী। যে কিনা ‘ইজাব-কবুলের’ মাধ্যমে নিজেকে স্বামীর হাতে সোপর্দ করে দেওয়ার পর ফিরে যাওয়ার দরজায় নিজ হাতে তালা লাগিয়ে দেয়। আমি অসুস্থ বলে সে আমাকে অবজ্ঞা করেনা, নিজেও কোনরূপ হীনম্মন্যতা বোধ করে না।
এ কথা শুনতেই আমার স্মৃতিপটে ভেসে আসতে লাগল একরাশ ছবি, এক স্তূপ ঘটনা- যেখানে কোনো নারী নিজেকে ‘মুক্ত’ করার জন্য আপন স্বামীকে বিষ প্রয়োগ করছে। কেউ কেউ অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।
কেউবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে ডিভোর্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে আজকের আদালতপাড়ায় সর্বাধিক মামলার শুনানি চলছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহের।
প্রাচ্যের রমণীগণ গতকালও আনুগত্য ও লজ্জাবোধে অতুলনীয় ছিল এবং আজও তারা ‘ওফা ও হায়া’ গুণে (আনুগত্য ও লজ্জায়) বে-নজীর। কিন্তু আমরা আজ তাদেরকে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার ফানুস দেখিয়ে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে ঘর-গৃহস্থালীর কাজ থেকে বের করে এনেছি। স্বাবলম্বিতার নামে সোশাল ওয়ার্কার, বিমানবালা, খেলোয়াড়-ফুটবলার বানিয়ে ‘ওফা ও হায়া’ তাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। আনুগত্য ও ত্যাগের এ দৃষ্টান্ত যদি আজ ইউরোপের কোনো নারী প্রকাশ করত তাহলে পশ্চিমা দুনিয়া মিডিয়ার মাধ্যমে পুরো দুনিয়ায় তাকে মডেল হিসেবে পেশ করত। এনজিও ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো তার জন্য উপহার উপঢৌকনের টাল করে দিত। কিন্তু মহতি এ আচরণ যেহেতু আজ এক প্রাচ্য নারী থেকে প্রকাশ পেয়েছে তাই এখানে কেউ কেউ তাদের কালো চশমায় ‘ওফা ও হায়া’র পরিবর্তে সামাজিক সীমাবদ্ধতা, অপারগতা ও মজলুমিয়ত খুঁজে পাবে।
উপরন্তু এ ‘মজলুমিয়তকে’ ইসলামের খাতে প্রবাহিত করে আসমানী তালীমকে বিদ্বেষ ও সমালোচনার নিশানা বানালেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। মানুষ যখন রবের গোলামীর পরিবর্তে নফস ও খাহেশাতের পূজা শুরু করে তখন তার আকলের রোখও পরিবর্তন হতে থাকে। স্বচ্ছ দিবালোকে সে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখতে পায়- অমাবস্যার কালো রাতে সে সবদিকে আলো দেখে!
-আহার-নিদ্রা ঠিকমত হয়?
-বলেন কি! খুব আরামের ঘুম হয়। সকল অবসাদ দূর হয়ে মন মেজাজ একেবারে ফুরফুরে হয়ে যায়। (অচল ব্যক্তির এ হাল থেকে ইবরত গ্রহণ করুক ঐ সকল সচল ব্যক্তিবর্গ, প্রাচুর্যের সরোবরে ডুবে থেকেও ওষুধ-বড়ি খাওয়া ছাড়া যাদের ঘুম হয় না।)
-দিনের বেলা কী করেন?
-আমার কাছে কুতুবে সিত্তা আছে। মিশকাত শরীফ আছে। নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদাত, হেদায়াত ও বাণীসমূহে আমি প্রশান্তি অনুভব করি। এছাড়া কুরআনে কারীম তিলাওয়াত ও মুতালাআ-পড়াশোনা ব্যতীত আমার কোনোদিন অতিবাহিত হয় না। আল্লাহ তাআলা তাঁর কালামকে আমার দিলের খোরাক বানিয়ে দিয়েছেন। কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া আমার ভালোই লাগে না।
উর্দূ তাফসীরসমূহের সাহায্যে কুরআনুল কারীম কিছুটা বুঝে বুঝে পড়ার চেষ্টা করি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের এহতেমাম করি। বাকি সময় দুআ-যিকির, ঘরের লোকজন ও মেহমানদের সাথে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা এবং দৈনিক ‘ইসলাম’ ও সাপ্তাহিক ‘যরবে মুমিন’ পড়ে পড়ে দিন পার করি।
-কোন্ যিকির কতবার করেন?
-কালিমা তায়্যিবার যিকির করি। আর সোয়া লাখবার দরূদ শরীফের আমলও হয়ে যায়।
-আপনার কোনো পেরেশানী নেই তো?
-মোটেও না। আমার উপর আমার আল্লাহর বহুত করম ও এহসান। এমন কোন নিআমত আছে, যা তিনি আমাকে দান করেননি! দয়ার্দ্র বাবা, মমতাময়ী মা, সেবায় উৎসর্গিত আহলিয়া, চোখের তারা কন্যা, হালাল রিযিক, শোকর আদায়কারী দিল, যিকিরকারী যবান, সর্বোপরি ঈমানের মত মহা দৌলত! আর কী চাই!!
আল্লাহর কসম, ঈমানের নিআমতই সবচে’ বড় নিআমত। আল্লাহর শুকরিয়া যে কীভাবে আদায় করি, না চাইতেই তিনি এ মহান নিআমতে আমায় ভ‚ষিত করেছেন! এ নিআমতই আজ আমার জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। এ নিআমত না হলে এতদিনে হয়ত হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতাম। কিংবা ঈমান ও আমলের নূর ও সৌরভ থেকে বঞ্চিত হয়ে নিথর এক মাংসপিÐ হয়ে পড়ে থাকতাম। ঈমান আমার হৃদয়ে বেঁচে থাকার উদ্যম জাগিয়েছে। আমি এখন লক্ষ্য সামনে রেখে জীবন চলছি। উদ্দেশ্যহীন সময় পার করছি না।
এরপর এহসান সারোয়ার কথার মোড় ঘুরিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে বসে-
-শুনেছি আপনিও নাকি...?
-না ভাই, আপনি ভুল শুনেছেন। আমি মাযুর নই। মাযুরী বা পঙ্গুত্ব তো দেহের নয়, দিলের রোগ। আপনি তো কয়েকটি নিআমতের কথা উল্লেখ করলেন। আর আমার অবস্থা হল, আমার যাহেরী-বাতেনী অস্তিত্বের উপর প্রতিনিয়ত রহমান-রহীমের এহসান-অনুগ্রহের যে অবারিত বর্ষণ তার হিসাব আমার পক্ষে কোনোদিনই করা সম্ভব নয়। শুনুন ভাই, যে ব্যক্তি নিজের হিম্মত ও উদ্যমকে কাজে লাগায় সে কখনো মাযুর নয়। হোক তার হাত-পা অবশ। মাযুর ও পঙ্গু তো সে- যার হাত-পা ও শক্তি-সামর্থ্য থাকার পরও অন্যের দুয়ারে কড়া নাড়ে। অনাথ-এতীম, অসহায়-নিঃসম্বল, অসুস্থ-পঙ্গু ব্যক্তির অবলম্বন হওয়ার পরিবর্তে সেই কারো হাত ধরার অপেক্ষায় থাকে। আরো আগে বেড়ে দুর্বলের রক্ত শোষণ করতে ওঁৎ পেতে থাকে। মসজিদের মিনার থেকে حي على الصلاة (এসো নামাযের দিকে) মোবারক ধ্বনি তার কান পর্যন্ত পৌঁছলেও আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে তার কদম অগ্রসর হয় না।
ভাই, অসহায়-পঙ্গু তো সেই, যে গুনাহের ডাক আসলে সাড়া দেয়, কিন্তু নেকীর পথে তার কদম অবশ হয়ে আসে। অন্ধ তো সে, যে চোখ খুলে খুলে সবকিছু দেখে, কিন্তু আল্লাহ পাকের আয়াত তার নযরে পড়ে না। মূক তো সে, যে মিথ্যা, গীবত, গালি-গালাজ, চোগলখুরী, অপবাদ সবকিছু করতে পারে, কিন্তু যিকরে এলাহীতে তার যবান সতেজ হয় না। উন্মাদ তো সে, যে বস্তুবাদের মরুতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘোরে, কিন্তু কুরআনের বাগানে বিচরণ করতে পারে না। মুর্দা তো সে, যার দিলে হাড়-মাংসের শরীর, ইট-সুরকির ঘর, কাগজের মুদ্রা, লোহার ম্যাশিনারিজ, পচনশীল খাবার-দাবার ও ধ্বংসশীল আসবাব-উপকরণের কদর তো রয়েছে, কিন্তু নেই ঈমানের কদর। সত্য কথা জিজ্ঞাসা করলে আমাকে বলতে হবে, আমরা আজ এসকল মাযুর-মুর্দার দুনিয়ায় বেঁচে আছি; এমনই মাযুর-মুর্দা, নিজেদের মাযুরী ও মউতের অনুভ‚তিটুকু যাদের লোপ পেয়ে বসেছে। দেড়শ কোটি মুসলমানের মাঝে অন্তত এক কোটি মুসলমানও যদি ‘সুস্থ ও জীবিত’ থাকত তাহলে মুসলিমসমাজের আজ এ যিল্লতি হত না। পট পরিবর্তনের জন্য তো ‘তিনশ তেরই’ যথেষ্ট হতে পারে।
এহসান সাহেব! আপনি, আপনার আহলিয়া, আপনার শ্রদ্ধেয় পিতা তো আজ এমন আলোর মিনার হয়ে জ্বলজ্বল করছেন, যা শুনে ও দেখে ঈমানের তাকাযা ও জীবন যাপনের প্রকৃত অর্থ বুঝে আসে। নয় বছর যাবৎ আপনি শয্যাশায়ী। করাচীতে আমাদের এক বন্ধু পনের বছর যাবৎ বিছানায় পড়ে আছে। তার না আছে বিবি, না কোনো সন্তান। একমাত্র সম্বল হিসেবে রয়েছে তার বা-হিম্মত এক ভাই। তার কোনো নামায কাযা নেই। নফল রোযারও এহতেমাম করেন। এ হালতে ওমরাও করে এসেছেন।
আজ প্রয়োজন হল, আলোর এ মিনারগুলোকে জাতির সামনে নিয়ে আসা। হতে পারে এগুলো দেখে কোনো ‘মুর্দা’ নবজীবন লাভ করবে, কোনো ‘পঙ্গু’ চলা আরম্ভ করবে, কোনো ‘অন্ধ’ দৃষ্টি ফিরে পাবে!
ভাষান্তর :
মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর