হল্যান্ড! এই তোমার পরিচয়?
ঈমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সবচেয়ে বড় নিআমত। আমাদের দুনিয়ার জীবনেও ঈমানের প্রভাব সম্পর্কে যদি চিন্তা করি তাহলে উপলব্ধি করতে পারব যে, ঈমান নামক এই নিআমতই সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিআমত।
এই নিআমতের কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের দুনিয়ার জীবনকেও অনেক সুন্দর করেছেন এবং ইনশাআল্লাহ আখেরাতের জীবনেও আমাদেরকে নাজাত দান করবেন।
এটা ঠিক যে, ঈমানের সকল দাবি আমরা পূরণ করতে পারি না। আমাদের গোটা জীবন আল্লাহ পাকের বিধান মোতাবেক পরিচালিত করতে পারি না। আমাদের ভুলত্রুটি হয়, গোনাহ হয়, কিন্তু এর পরও চারপাশের বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনার সাথে যখন আমরা আমাদের জীবনকে মিলিয়ে দেখি তখন পরিষ্কার চোখে পড়ে, ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কত কিছু থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এমন কত কর্ম ও আচরণ থেকে মুক্ত ও পবিত্র রেখেছেন, যে সকল কর্ম ও আচরণে সভ্যতার দাবিদার অনেক জাতি-গোষ্ঠী আক্রান্ত। এমন সব কর্মকাণ্ড, যা একজন সাধারণ মানুষও চিন্তা করলে বুঝতে পারে যে, এগুলো অন্যায় এবং অনাচার। কিন্তু ঐসকল অন্যায়-অনাচার থেকে কীভাবে আমরা মুক্ত-পবিত্র থাকছি এই প্রশ্ন যদি একজন মুসলিম নিজেকে করে তাহলে তার ভিতর থেকে এই জবাবই আসবে যে, শুধু ঈমানের কারণে, ইসলামের কারণে, ইসলামের সাথে যার সম্পর্ক যতটুকু তার জীবন অন্যায়-অনাচার থেকে ঐ পরিমাণ মুক্ত ও পবিত্র। এটা তো একেবারে বাস্তব। এজন্য আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কত নিআমত দান করেছেন।
এই দৌলত থেকে বঞ্চিত মানুষের নানা অন্যায়-অপকর্ম যখন প্রকাশিত হয় তখন মুসলিমের কর্তব্য, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে শোকরগোযারি করা।
الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِیْ هَدٰىنَا لِهٰذَا وَ مَا كُنَّا لِنَهْتَدِیَ لَوْ لَاۤ اَنْ هَدٰىنَا اللهُ لَقَدْ جَآءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ .
জান্নাতিগণ জান্নাতে যাওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা করে বলবে, الْحَمْدُ لِلهِ الَّذِیْ هَدٰىنَا لِهٰذَا সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। وَ مَا كُنَّا لِنَهْتَدِیَ لَوْ لَاۤ اَنْ هَدٰىنَا اللهُ আল্লাহ যদি আমাদের নিয়ে না আসতেন তাহলে আমাদের পক্ষে এখানে আসা, এই গন্তব্যে পৌঁছা কিছুতেই সম্ভব হতো না।
لَقَدْ جَآءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ আমাদের রবের পয়গম্বরগণ আমাদের কাছে সত্য ও বাস্তব কথাই নিয়ে এসেছিলেন।
হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শিখিয়েছেন, কোনো অসুস্থ মানুষ, বিপদগ্রস্ত মানুষকে দেখলে নিজেকে লক্ষ্য করে মুমিনের যে দুআ পড়তে হয়-
الْحَمْدُ لِلهِ الّذِي عَافَانِي مِمّا ابْتَلَاكَ بِهِ، وَفَضّلَنِي عَلَى كَثِيرٍ مِمّنْ خَلَقَ تَفْضِيلًا.
সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এই বিপদ থেকে মুক্ত রেখেছেন, যাতে তুমি আক্রান্ত এবং যিনি আমাকে তাঁর অনেক সৃষ্টির চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
ইসলামের এক শিক্ষা তো হল অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি সহানুভ‚তি ও কল্যাণকামিতার, অসুস্থের সেবা, খোঁজখবর, সান্ত¡না ইত্যাদির। আরেক শিক্ষা নিজের সুস্থতা ও বিপদমুক্ততার শোকরগোযারির। ব্যাধিগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত মানুষের অবস্থা দেখে নিজের প্রতি আল্লাহ পাকের যে ইহসান-অনুগ্রহ তা স্মরণ করা এবং আল্লাহর শোকরগোযারি করা কর্তব্য। দৈহিক ব্যাধিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত মানুষের অবস্থা থেকে যখন নিজের সুস্থতা ও নিরাপত্তার কৃতার্থ উপলব্ধি কাম্য তখন আদর্শিক ব্যাধি ও বিপদে আক্রান্ত মানুষের অবস্থা দেখলে তো আল্লাহর নিআমতের উপলব্ধি ও শোকরগোযারি আরো বেশি কাম্য।
পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর মানুষ কত অসুন্দর কার্যকলাপে আক্রান্ত! তাদের বাইরের সৌন্দর্যের সাথে কর্মের ও রুচির কোনো মিল নেই। এই অবস্থাটা দেখলে সূরা তীনে আল্লাহ তাআলা যা বলেছেন তা যেন চোখের সামনে একেবারে বাস্তব হয়ে ওঠে।
لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِیْۤ اَحْسَنِ تَقْوِیْمٍ، ثُمَّ رَدَدْنٰهُ اَسْفَلَ سٰفِلِیْنَ ، اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ.
আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম আকৃতিতে। এরপর আমি তাদেরকে পরিণত করি হীনদের হীনতমে। শুধু তারা বাদে, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে। -সূরা তীন (৯৫) : ৪-৬
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের দুটি বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ, যা এখানে উল্লেখিত হয়েছে। প্রথম বৈশিষ্ট্য, মানুষের বিশেষ গঠন। মুফাসসিরগণ বলেছেন, এখানে গঠন বলতে শুধু দৈহিক গঠন নয়, দৈহিক, মানসিক সবরকমের গঠনই উদ্দেশ্য। মানুষ দেখতেও সুন্দর, বিদ্যা-বুদ্ধিতেও উন্নত।
মানুষের আছে চিন্তা করার যোগ্যতা, উদ্ভাবনের যোগ্যতা, ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য করার যোগ্যতা এবং আরো অনেক যোগ্যতা। যা অন্যান্য পশু-পাখিকে এভাবে দান করা হয়নি। কিন্তু শুধু এই গঠনগত শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়ে যায় না। মানুষ তখনই শ্রেষ্ঠ হয় যখন সে ঈমান ও আমলে সালেহের অধিকারী হয়। ঐ সময় সে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়। প্রকৃত মানুষ হয়। তার মানবজন্ম সার্থক হয়। পক্ষান্তরে ঈমান ও আমলে সালেহ থেকে বঞ্চিত মানুষ দেখতে শুনতে সুন্দর হয়েও বাকপটুতা ও কর্মকুশলতায় অগ্রগামী হয়েও অবলা প্রাণীরও অধম হয়ে যায়। বন্য পশুর দ্বারাও মানুষ যে পরিমাণ আক্রান্ত হয় না এই মানুষটার দ্বারা মানুষ ঐ পরিমাণ আক্রান্ত হতে থাকে।
এ হচ্ছে মানুষের পরিচয়। আমরা যখন কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করি এবং চারপাশের জগতের বিভিন্ন ঘটনার সাথে মেলাতে থাকি তখন কুরআনের সত্যতা, কুরআনের বর্ণনার সজীবতা আমাদের সামনে একেবারে বাস্তব হয়ে ওঠে।
সম্প্রতি হল্যান্ডের একটি প্রতিযোগিতার ঘোষণা অনেকেই জেনেছেন। সেই কার্টুন! সেই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ! কাকে নিয়ে? জগতের শ্রেষ্ঠতম মানুষ হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে! কে না জানে, এই জায়গাটা আমাদের সবচেয়ে আবেগের জায়গা, সবচেয়ে ভালবাসার জায়গা। এখানে যখন কেউ হাত দেয়, তখন আমরা সবচেয়ে বেশি আহত হই। কিন্তু এরপরও ওরা এই কাজটা করে। জগতের শ্রেষ্ঠতম মানুষের সাথে যখন ওরা এই আচরণ করে তখন কি তারা নিজেদের সাথেও সুবিচার করে? এই সহজ বিষয়টিও তারা উপলব্ধি করে না। ঈমানের নূর যখন থাকে না তখন সে উপলব্ধি করতে পারে না যে, আসলে সে নিজের পরিচয়ই উন্মোচিত করে দিচ্ছে। সে নিজেকে চূড়ান্ত রকমের মূর্খ ও অসভ্য বলে পরিচিত করছে।
সাধারণত দেখা যায়, একজন চোরও সমাজে চোর হিসেবে পরিচিত হতে পছন্দ করে না। একজন দুর্নীতিবাজও পছন্দ করে না সে সমাজে দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রসিদ্ধ হোক। সুদখোর ঘুষখোরেরাও চায় না চারপাশের সবাই তাকে সুদখোর-ঘুষখোর হিসেবে চিনুক। নিজেদের কর্ম ও স্বভাবের এই অন্ধকার দিকগুলোকে মানুষ আড়াল করে রাখতে চায়। এটা মানুষের সাধারণ প্রবণতা। অথচ দেখুন, সভ্যতার দাবিদার, শিক্ষা, প্রগতি, প্রযুক্তির দাবিদার এই লোকগুলো কীভাবে নিজেদের রুচি ও স্বভাবের অন্ধকার দিক দুনিয়াবাসীর সামনে মেলে ধরছে। আমাদের এই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও বোঝে যে, সন্তান যদি বাবাকে গালি দেয়, তাহলে সে বাবার ক্ষতি করে না, নিজেরই ক্ষতি করে, নিজেকে অসভ্য ও অভদ্র বলে পরিচিত করে। সম্মানিত কারো সাথে কেউ যখন অসম্মানজনক আচরণ করে তখন সবাই তাকে অসভ্য-অভদ্র বলে চিনে ফেলে। তখন তার শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে, বংশ-পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। তো জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সম্পর্কে কিছু লোক যখন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার সাহস দেখায় তখন প্রমাণ হয়ে যায় যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতির সকল দাবির মধ্যে এখনো এরা অন্ধকারগ্রস্ত। এরা এদের মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাদের সেই অন্ধকার যুগ, ডার্কএজেরই কিছু নমুনা আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে। জ্ঞানের পথে, বিজ্ঞানের পথে, প্রযুক্তির পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েও চিন্তাগতভাবে এখনো ডার্কএজেই অবস্থান করছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন-
وَ لَقَدْ ذَرَاْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِیْرًا مِّنَ الْجِنِّ وَ الْاِنْسِ، لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا یَفْقَهُوْنَ بِهَا ، وَ لَهُمْ اَعْیُنٌ لَّا یُبْصِرُوْنَ بِهَا، وَ لَهُمْ اٰذَانٌ لَّا یَسْمَعُوْنَ بِهَا، اُولٰٓىِٕكَ كَالْاَنْعَامِ بَلْ هُمْ اَضَلُّ، اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْغٰفِلُوْن.
অনেক মানুষ এবং অনেক জিনকে আমি জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি।
কাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে আর কাকে হাজান্নামের জন্য এটা তো পরিষ্কারভাবে দেখা যাবে আখিরাতে। তবে জাহান্নামীদের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরের আয়াতে উল্লেখ করেছেন, لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا یَفْقَهُوْنَ بِهَا তাদের হৃদয় আছে কিন্তু সে হৃদয় দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, وَ لَهُمْ اٰذَانٌ لَّا یَسْمَعُوْنَ بِهَا কান আছে কিন্তু সে কান দ্বারা তারা শোনে না। وَ لَهُمْ اَعْیُنٌ لَّا یُبْصِرُوْنَ بِهَا চোখ আছে কিন্তু সে চোখ দ্বারা দেখে না। اُولٰٓىِٕكَ كَالْاَنْعَامِ এরাই তো পশুর মত بَلْ هُمْ اَضَلُّ বরং পশুর চেয়েও অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত। اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْغٰفِلُوْن এরাই হল গাফেল সম্প্রদায়। এদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি, চোখ, কান, হৃদয় আছে। দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তি, চিন্তা শক্তি আছে কিন্তু এই সকল বৈশিষ্ট্যের দ্বারা তারা উপকৃত হতে পারে না, এই সকল বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে তাদের যেখানে পৌঁছা উচিত ছিল, তাদের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ, স্বভাব-প্রকৃতির যে উন্নতি হওয়া উচিত ছিল তা হয় না। কুরআন মাজীদে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একশ্রেণির মানুষের এই পরিচয় বর্ণনা করেছেন এরা তো এই পৃথিবীরই মানুষ। আল্লাহর মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মতো অনাচারে যারা লিপ্ত হতে পারে, তাদের ব্যাপারে তো আশংকা হয়, এরাই কি ঐ সকল লোক, যাদের পরিচয় কুরআন মাজীদের পূর্বোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছে? এটা তো কারো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলা যায় না। আমরা তো মুসলিম হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনাও করি এবং আন্তরিকভাবে কামনাও করি, আল্লাহ পাক যেন তাদেরকে হিদায়াত দান করেন। আমরা আমাদের চরম শত্রæর জন্যও জাহান্নাম কামনা করি না। জাহান্নাম অতি ভয়াবহ জায়গা, জাহান্নামের আযাব সহ্য করার ক্ষমতা কারো নেই। এ কারণে চরম শত্রæর জন্যও আমরা জাহান্নাম কামনা করি না। জগতের সকল মানুষের জন্য আমরা জান্নাত কামনা করি। সবার জন্য হিদায়াত কামনা করি। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাহমাতুল লিল আলামীনরূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। এটা তাঁর শিক্ষা, তাঁর আদর্শ। তাঁর জীবদ্দশায় অনেক মানুষ তাকে অনেকভাবে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু তাদের সবার জন্যই তিনি জান্নাত কামনা করেছেন। হিদায়াতের প্রত্যাশা করেছেন।
তায়েফের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা সবাই জানেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফে গিয়েছেন, ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু তায়েফবাসী সত্যের দাওয়াত তো কবুল করলই না, তাঁর পেছনে মহল্লার বখাটে ছেলেদের লেলিয়ে দিল। ওরা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করল, কটূক্তি করল, এমনকি পাথর ছুড়ে তাকে রক্তাক্ত করল। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এইসকল বখাটে মানুষ থেকে কিছুটা দূরে এলেন, এক জায়গায় বসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দুআ করলেন। তাঁর সেই মর্মস্পর্শী দুআ হাদীসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। ঐ সময় আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে পাহাড়সমূহের ফেরেশতা হাজির হলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিয়ে তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পাহাড়সূমহের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। আপনি আদেশ করলে দুই পাশের পাহাড়কে মিশিয়ে দেওয়া হবে এবং এই অবাধ্য লোকগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। সীরাতের কিতাবে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, না আমি এটা পছন্দ করি না। হতে পারে এদের বংশধরদের থেকে এমন লোক পয়দা হবে, যারা আল্লাহ পাকের উপর ঈমান আনবে, ইসলাম কবুল করবে।
ঐ কঠিন পরিস্থিতিতেও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফবাসীদের জন্য হিদায়াতের প্রত্যাশা করেছেন। তাঁর সেই প্রত্যাশা সত্য হয়েছে। একসময় তায়েফ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। এখানের অধিবাসী ও তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ পয়দা হয়েছে, যারা ইসলামের দাওয়াত কবুল করেছেন এবং ইসলামের ঝাণ্ডা বিভিন্ন অঞ্চলে উড্ডীন করেছেন। এই ছিলেন আমাদের রাসূল। এই ছিল তাঁর মহানুভবতা। তাঁর মহানুভবতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। জগদ্বাসীর উপর তাঁর অবদান গুণে শেষ করা যাবে না। তাঁর ঋণ কখনো শেষ হবে না। এজন্য আমরা বলি, যারা তাঁর সাথে বেআদবী করে তারা আসলে তাদের নিজেদের দীনতা, হীনতা, অজ্ঞতা ও অসভ্যতাকেই জগদ্বাসীর সামনে ফাঁস করে। এদের কেউ জিজ্ঞেস করুক, হে হল্যান্ডবাসী! এই তোমাদের পরিচয়? তোমাদের মা-বাবা, শিক্ষক-গুরুজন তোমাদের এই শিক্ষা দান করেছেন? ইসলাম তো আমাদের শিখিয়েছে যে, আল্লাহর কোনো নবীর সাথে বেআদবী করা যাবে না। যদিও আমরা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তের অনুসরণ করি, কিন্তু ঈমান রাখি আল্লাহ তাআলার সকল নবী-রাসূলের উপর। হযরত মূসা আ.-এর উপরও ঈমান রাখি। হযরত ঈসা আ.-এর উপরও ঈমান রাখি। আল্লাহর সকল নবীর প্রতি আমরা ঈমান রাখি। আমরা বিশ্বাস করি, হযরত আদম আ. থেকে নিয়ে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত যত নবী-রাসূল এসেছেন সবাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা , মানুষের কল্যাণের জন্যই তাঁরা প্রেরিত হয়েছিলেন এবং জীবনভর আল্লাহর হুকুম মোতাবেক মানুষের কল্যাণ-চিন্তা ও কল্যাণ-প্রয়াসে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁরা অবশ্যই মানুষের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা পাবার হকদার। তাঁদের শানে সামান্যতম বেআদবীও ঈমান বিনষ্ট হওয়ার এবং আল্লাহ তাআলার রোষানলে পতিত হওয়ার কারণ। ইসলাম তো আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে। এদিকে ইহুদীরা হযরত মূসা আ.-এর অনুসারী বলে দাবি করে, খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা আ.-এর অনুসারী বলে দাবি করে। কিন্তু তাঁদের প্রকৃত শিক্ষা এরা হারিয়ে ফেলেছে। বিশ্বাস ও কর্ম উভয় ক্ষেত্রে তারা নবীগণের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
লন্ডনে একবার এক ঘটনা ঘটল; দেখুন ঈমান ও ইসলাম যদি না থাকে তাহলে মানুষের সাধারণ বোধ-বুদ্ধির উপরও যে পর্দা পড়ে যায় এর অসংখ্য নজীর আছে। পশ্চিমে তো হযরত ঈসা আ.-এর জীবনী নিয়ে হরদম সিনেমা তৈরি হচ্ছে। তো লন্ডনে এই রকম একটা সিনেমার পোস্টার বিভিন্ন জায়গায় সাঁটানো হল, যাতে -আল্লাহ মাফ করুন, মুখে উচ্চারণ করতেও ভয় লাগে, কিন্তু বাস্তবতার বর্ণনার জন্য বলতে হচ্ছে, আল্লাহ পাক তো বাস্তবতার প্রকাশের জন্য ভাষাকেই মাধ্যম বানিয়েছেন- হযরত ঈসা আ.-এর সাথে এক ভ্রষ্টা নারীর ছবি। এইসবের পিছনে খ্রিস্ট সমাজে হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে প্রচলিত নানা মিথ্যা বর্ণনার প্রভাব আছে। ইহুদীদের মাধ্যমে হযরত ঈসা আ. সম্পর্কে অসংখ্য ভিত্তিহীন বর্ণনা ইহুদী ও খ্রিস্টান সমাজে বিস্তার লাভ করেছে। ঐ আপত্তিকর ছবি সম্বলিত বিরাট বিরাট পোস্টার লন্ডনের বিভিন্ন জায়গায় সাঁটানো হয়েছে। এই পোস্টার এবং এই সিনেমার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম কারা প্রতিবাদ করেছেন? খ্রিস্টানরা? না। সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করেছেন মুসলমানরা। কয়েকজন দায়িত্বশীল মুসলিম হযরত ঈসা আ.-এর এই মানহানীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেন। মুসলমানদের এই প্রতিবাদের পর খ্রিস্টানদেরও মনে পড়ল, আমাদেরও তো প্রতিবাদ করা দরকার। ঈসা (আ.) তো আমাদের। এই সিনেমার মাধ্যমে তো আমাদের যীশুর মানহানী হচ্ছে, চরিত্র হনন হচ্ছে, তো তারাও প্রতিবাদ করলেন। এরকমের অনেক ঘটনা।
আমরা যে ঈমান ও ইসলাম পেয়েছি এর শুকরিয়া আদায় করে কীভাবে শেষ করব! ঈমান ও ইসলামের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে যে বিশ্বাস ও সভ্যতা এবং শালীনতা ও মানবতা দান করেছেন এবং যে উন্নত আদর্শিক বৈশিষ্ট্যসমূহের অধিকারী করেছেন মৃত্যু পর্যন্ত সিজদায় পড়ে থাকলেও তো এর শোকর আদায় করে শেষ করা যাবে না। আমাদের সকল মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহর শোকরগোযারি করা এবং এইসকল মানুষের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা। শিক্ষা-দীক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ঝলকানির পেছনে ওদের স্বভাব-চরিত্রের অবক্ষয়, চিন্তা ও বিশ্বাসের দৈন্য যে কী ভয়াবহ- এই সকল আচরণ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় বিষয়, যেটা আমাদের চিন্তা করা দরকার তা হল, দুশমনরা এসকল কাজ করে আমাদের কষ্ট দেয়ার জন্য। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা আহত হই, আক্রান্ত বোধ করি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আল্লাহ পাকের কাছে ঐ মর্যাদার অধিকারী যে, এই নীচ লোকদের অনাচারে তাঁর কিছুই যায় আসে না। চৌদ্দশ বছর পর্যন্ত তাঁর নাম গোটা পৃথিবীর দেশে দেশে দরূদ ও সালাম সহকারে উচ্চারিত হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত উচ্চারিত হবে। তাঁর পবিত্র বাণী ও কর্মের সংরক্ষণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে অসংখ্য মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে। তাঁর আনীত দ্বীন ও শরীয়তের পঠন-পাঠন, বিস্তার ও বাস্তবায়ন ছিল প্রত্যেক প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর শ্রেষ্ঠ কর্ম এবং কিয়ামত পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত থাকবে। জগতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে উচ্চারিত হচ্ছে-
أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاّ اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ.
স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন মাজীদে বলেছেন-
وَ رَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ.
আমি আপনার স্মরণকে উচ্চকিত করেছি। -সূরা আলাম নাশরাহ (৯৪) : ৪
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যার নামকে উচ্চ করেছেন কেউ তাকে বাতিল করতে পারবে না। কিয়ামত পর্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হতেই থাকবে, কেউ তা বন্ধ করতে পারবে না। এই কূপমণ্ডূকের দল কীভাবে তাঁর ক্ষতি করতে পারে? আসলে এসবের মাধ্যমে তারা আমাদেরকে আক্রান্ত করে। আমাদের চিন্তা করা উচিত, আমাদের উপর এই আযাব কেন এসে গেল, কেন আমাদের দুশমনরা প্রকাশ্যে এইসব কাজ করার সাহস পেয়ে গেল, যেসব কাজে আমরা কষ্ট পাই, আমরা আক্রান্ত হই? ঈমান ও ইসলামের সাথে আমাদের যে সম্বন্ধ এর শোকরগোযারির পাশাপাশি আজ আমাদের নিজেদের মুহাসাবাও প্রয়োজন। আমরা তো জীবনের নানা ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি। আমাদের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, আমাদের লেনদেন, স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার, আমাদের বেশভ‚ষা, সামাজিকতা, পর্ব-উৎসব, আমাদের আনন্দ-বেদনা, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভ‚তি, সকল ক্ষেত্রে আমরা তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছি। এই দূরে সরে পড়াই আমাদের আক্রান্ত হওয়ার কারণ। এটা আমাদের জন্য এক প্রকারের শাস্তি। যাদেরকে আল্লাহ পাক এই শাস্তির উপায় বানিয়েছেন তাদের পরিণাম যে কী হবে তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু এদের মাধ্যমে, এই নিকৃষ্ট লোকগুলোর মাধ্যমে আমাদেরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, শাসন করা হচ্ছে। কাজেই আমাদের কর্তব্য, আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর দিকে ফিরে আসা। তাঁর সুন্নাহ, তাঁর আনীত দ্বীন ও শরীয়তের অনুসরণ, বিস্তার ও প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ হওয়া। এটাই হবে এই অনাচারের সবচেয়ে বড় জবাব। আমরা যদি এই সংকল্প করি যে, আজ থেকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক চলার চেষ্টা করব। তাঁর দ্বীন আমি নিজেও শিখব আমার সন্তানদেরকেও শিখাব, আমার পরিবার-পরিজনকে শেখাব, আমার পরিবারে, আমার সমাজে হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত দ্বীন ও শরীয়ত বাস্তবায়নে আমি আমার সর্বস্ব বিলিয়ে দেব। এই সংকল্প যদি আমরা করতে পারি, এটা হবে সবচেয়ে বড় জবাব। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাদেরকে শক্তি-সামর্থ্য দান করেছেন তাদের কর্তব্য হল এই অন্যায় অপরাধের প্রতিবাদ করা। যদি সকল মুসলিম দেশ থেকে মুসলিম শাসকগণ একথা বলতে থাকেন যে, তোমাদের এই কাজটা অন্যায়। এটা বন্ধ কর। না হয় আমরাও ব্যবস্থা নিব। আমরা আর কিছু না পারি তোমাদের পণ্য তো বর্জন করতে পারব। আজ গোটা বিশ্ব সন্ত্রাসের সমালোচনায় মুখর, ‘সন্ত্রাস’ নির্মূলে নানা পদক্ষেপ, নানা পরিকল্পনা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এইসকল অনাচার বন্ধ করা ছাড়া ‘সন্ত্রাস’ বন্ধের চিন্তা বাতুলতা মাত্র।
যাই হোক এইসকল পরিস্থিতিতে আমাদের বিশ্বাস ও সংকল্পকে শাণিত করতে হবে। আমাদের এই সংকল্পে বলীয়ান হতে হবে যে, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ আমরা শিখব এবং নিজের জীবনকে সেই সুন্নাহর আলোয় আলোকিত করব। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।