হজ্ব ও কুরবানী : জাগুক ঈমান, জ্বলুক ঈমানের প্রদীপ
হজ্ব ও কুরবানীর মওসুম মুসলমানের ভেতরে-বাইরে পরিবর্তনের স্পন্দন জাগিয়ে যায়। মুসলিম নারী-পুরুষের মনে জাগে পুণ্যের প্রেরণা। ঘরে ঘরে হজ্ব ও কুরবানীর প্রস্তুতি। মসজিদে মসজিদে বয়ান ও আলোচনা। সব কিছু মিলে ব্যক্তি ও সমাজে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর এক পুণ্যময় স্পন্দন জেগে ওঠে। এটি খুবই ইতিবাচক ব্যাপার। এইটুকুর জন্যও আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারি করা কর্তব্য। আমাদের শত নাফরমানী সত্তে¡ও তিনি আমাদের তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর সাথে, তাঁর ফরমাবরদারির কিছু বিষয়ের সাথে যুক্ত করে রেখেছেন- এটি তাঁর কৃপা ও করুণা। কে না বোঝে যে, বান্দার ইবাদতে-ইতাআতে আল্লাহর কোনো স্বার্থ নেই। তিনি তো সম্পূর্ণ বেনিয়ায ও অমুখাপেক্ষী। তিনি সর্বাবস্থায় প্রশংসিত। আপন যাত ও ছিফাতের কারণেই প্রশংসিত। কাজেই বান্দার শত নাফরমানী সত্ত্বেও তিনি যখন তাকে ফরমাবরদারির সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করেন না, ইবাদত-বন্দেগীর সাথে, তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত রাখেন তখন সেটা তাঁর একান্ত দয়া ও পরম সহিষ্ণুতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
ইবাদতের বিভিন্ন মওসুমে আমাদের মাঝে কিছুটা স্পন্দন যে এখনো জাগছে আমাদের কি কর্তব্য নয়, এই নিআমতের কদর করা? এই স্পন্দন কি প্রমাণ করে না যে, আমাদের মাঝে এখনও কিছু প্রাণ রয়েছে? এখনো হৃদয়-জগৎ সম্পূর্ণ কালিমালিপ্ত হয়ে যায়নি? এই অশুভ পরিণাম থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হেফাযত করুন।
এই নিআমতের কদর কীভাবে হবে? এই নিআমতের কদর হবে এই ঈমানী কণিকাকে ঈমানী প্রদীপে পরিণত করার দ্বারা, যার জ্যোতির্ময়তায় আমাদের চেতনা ও বিশ্বাস, কর্ম ও আচরণ জ্যোতির্ময় হয়ে উঠবে।
হজ্ব ও কুরবানীতে আমাদের জন্য রয়েছে গভীর বার্তা। দুটোই আল্লাহর ইবাদত। তাওহীদ ও সুন্নাহ যার প্রাণ। হজ্ব ও কুরবানী তো একমাত্র আল্লাহর জন্য। এরপর মুমিনের মনে ও মুখে বারবার উচ্চারিত হয় তাওহীদের পয়গাম। হজ্বের তালবিয়া তো তাওহীদেরই স্মরণ ও স্বীকারোক্তি। কুরবানীর সময়ও মুমিনের মনে ও মুখে থাকে তাওহীদের বাণী। আর হজ্ব-কুরবানীসহ সকল ইবাদত তখনই ইবাদত হয় যখন তা আদায় করা হয় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক। আমরা ঐ নিয়মেই হজ্ব করি, যে নিয়ম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়ে গেছেন। ঐ নিয়মেই কুরবানী করি, যে নিয়ম তিনি দেখিয়ে গেছেন। হজ্ব ও কুরবানীর এই মৌলিক দুই শিক্ষা- তাওহীদ ও সুন্নাহ আমাদের গোটা জীবনেরও শিক্ষা। কালেমায়ে তাওহীদ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ পাঠ করে তাওহীদ ও সুন্নাহকে আমরা জীবনের আদর্শ হিসেবে শিরোধার্য করে নিয়েছি।
তাওহীদ-সুন্নাহর শিক্ষা আমাদের গোটা জীবনে কীভাবে পরিব্যাপ্ত? তাওহীদের শিক্ষায় এই কথা আছে যে, ইবাদত একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া আর কেউ, আর কোনো কিছুই ইবাদতের উপযুক্ত নয়। কাজেই ইবাদত একমাত্র আল্লাহরই করব। আল্লাহ ছাড়া আর কারো, আর কোনো কিছুর ইবাদত করব না। আমার সমাজে, চারপাশে উপাসনাধর্মী কোনো কাজ যদি গায়রুল্লাহর জন্য হয় আমি কোনোভাবেই তাতে শরীক হব না।
তাওহীদের শিক্ষায় একথাও আছে যে, চ‚ড়ান্ত আনুগত্য একমাত্র আল্লাহর। জগতে আর যত আনুগত্য আছে- মা-বাবার আনুগত্য, উস্তায-শিক্ষকের আনুগত্য, কর্তা-দায়িত্বশীলের আনুগত্য সবই আল্লাহর আনুগত্যের অধীন। অর্থাৎ আল্লাহপ্রদত্ত হুকুম-আহকামের সীমারেখার ভিতরে এইসব আনুগত্য অনুমোদিত, আল্লাহর নাফরমানী করে তা বৈধ নয়। কাজেই যেখানেই আল্লাহর হুকুমের সাথে অন্য কোনো হুকুমের সংঘর্ষ হবে সেখানে আল্লাহর হুকুমকেই অগ্রগণ্য বলে বিশ্বাস করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য করতে হবে। সকল হুকুমের উপর আল্লাহর হুকুমকে অগ্রগণ্য বলে বিশ্বাস করা তো ঈমানের অংশ। এটা ছাড়া তো মুমিনই হওয়া যায় না। আর কর্মক্ষেত্রেও আল্লাহর হুকুমকে অগ্রগণ্য করা, গুনাহ ও অবৈধ কাজে লিপ্ত না হওয়া পূর্ণাঙ্গ মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
তেমনিভাবে ‘সুন্নাহর’ শিক্ষাও আমাদের গোটা জীবনজুড়ে বিস্তৃত। ইবাদত-বন্দেগী যেমন সুন্নাহ- নির্দেশিত পন্থায় আদায় করতে হবে তেমনি জীবনযাত্রার সকল কাজ সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে। আয়-উপার্জন, খাওয়া-পরা, চলা-ফেরা, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র, চিন্তা-চেতনা, সামাজিকতা সবকিছুই হতে হবে সুন্নাহ অনুসারে। ইবাদত-বন্দেগীতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন আমাদের আদর্শ ও উসওয়া তেমনি জীবনের সকল ক্ষেত্রে তিনি উসওয়া ও আদর্শ। তাঁর জ্যোতির্ময় জীবনাদর্শের অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের জীবনেও আসতে পারে নূর ও আলো।
হজ্ব ও কুরবানী এই পবিত্র জীবন বোধের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যে, আমাদের এই জীবনটি আল্লাহপ্রদত্ত জীবন এবং এই জীবন সম্পর্কে আমাদের দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা আছে। আল্লাহ তাআলা এই জীবন আমাদের অনর্থক দেননি। তিনি এ জীবন এই জন্যই দিয়েছেন, যেন আমরা তাঁর ইবাদত ও আনুগত্য করি। এই জীবন তাই প্রবৃত্তির ইচ্ছা ও চাহিদা অনুসারে কাটিয়ে দেয়ার মতো বিষয় নয়, হিসেব করে ব্যবহার করার মতো বিষয়। কোথায় কীভাবে এই জীবনকে ব্যয় করতে হবে তা-ও জীবনদাতা আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন। মানুষের জন্য পরীক্ষা এটিই যে, সে এই পুঁজি কোথায় কীভাবে ব্যবহার করে।
হজ্ব ও কুরবানী বারবার আমাদের কাছে জীবনের এই অর্থ ও তাৎপর্যের পয়গাম নিয়ে আসে। আমরাও এই মওসুমে কিছু পরিমাণে হলেও স্পন্দিত ও আন্দোলিত হই। আমাদের মনের মাঝে সুপ্ত এই ঈমানী কণিকা প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠুক, আমাদের চিন্তা ও কর্মে আলো ছড়িয়ে দিক- এই প্রার্থনা।