Zilqad 1439   ||   August 2018

অশ্লীলতার ভয়াবহ বিস্তার : কী হবে পরিণাম?

মাওলানা আবদুর রহমান

এমন দিন সম্ভবত কমই আছে, যেদিন পত্র-পত্রিকায় ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয় না। উদ্বেগজনকহারে তা বেড়ে চলেছে। কিছু ঘটনা আছে, যা রীতিমতো  রোমহর্ষক। ঘর-বাড়ি, পথ-ঘাট এমনকি শিক্ষাঙ্গনে পর্যন্ত এই জাহেলিয়াত থাবা বিস্তার করেছে। শিশু-বৃদ্ধা কেউই এই পাশবিকতার হাত থেকে নিরাপদ নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৭ আসক-এর পর্যবেক্ষণ বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় সংস্থাটি।

মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, এ বছর ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি এর ধরনে নিষ্ঠুরতা ও ভয়াবহতা লক্ষ করা গেছে। শিশু কিংবা বৃদ্ধা কেউ রেহাই পায়নি এই পাশবিকতার হাত থেকে। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছে ৪৭ জন নারী এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ১১ জন নারী। [দৈনিক ইনকিলাব (অনলাইন), ১ জানুয়ারি ২০১৮]

মহিলা পরিষদ বলছে, ২০১৬ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৭০৫টি। ২০১৭ সালে ১০ মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩৪টিতে। একইভাবে গণধর্ষণ ১৩৯ থেকে ১৯৩ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৩১ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২টি। [প্রথম আলো (অনলাইন), ২৬ নভেম্বর ২০১৭]

আসলে এর সংখ্যা আরো বেশি হবে। বহু ঘটনা আছে, যা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তিরা নানা কারণে তা প্রকাশ করে না বা করতে পারে না।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, দেশে যে হারে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটছে তাতে আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন ও দুঃখিত। [প্রথম আলো (অনলাইন), ২৯ মার্চ ২০১৬]

এ হচ্ছে বাংলাদেশে ধর্ষণের কাগজ-কলমের পরিসংখ্যান, যেখানে সবেমাত্র ‘আধুনিকতা’ ও ‘উন্নয়নশীলতা’র তেলেসমাতি শুরু হয়েছে।

এবার বিশে^র আরো কিছু দেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক, যেগুলো বহু আগেই ‘উন্নতি’ ও ‘আধুনিকতা’র উচ্চ শিখরে আসন পেতেছে।

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত এক সংবাদ অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আমেরিকায়। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশটিতে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিসংখ্যান ৯১% এবং ৮% পুরুষ। অপর একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, এ দেশে ছয়জন নারীর মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার। পুরুষদের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটা ৩৩ জনে ১ জন। এখানে ১৪ বছর বয়স থেকেই ধর্ষণের মত অপরাধের প্রবণতা তৈরি হয় শিশুর মনে।

চার নম্বরে আছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো অনুযায়ী ২০১২ সালে ভারতে ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়ে ২৪ হাজার ৯২৩টি। দেশটিতে ধর্ষণের শিকার ১০০ জন নারীর মধ্যে ৯৮ জনই আত্মহত্যা করে। প্রতি ২২ মিনিটে ভারতে একটি করে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়।

তালিকায় পাঁচ নম্বরে আছে ব্রিটেন। দেশটিতে প্রতিবছর চার লাখ মানুষ ধর্ষণের শিকার হয়। প্রতি পাঁচজন মহিলার মধ্যে একজন করে ধর্ষণের শিকার হয়।

তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে থাকা জার্মানিতে এখন পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়ে দুই লাখ ৪০ হাজার নারীর মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতে প্রতিবছর ৬৫ লাখ ৭ হাজার ৩৯৪টি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়।

সপ্তম স্থানে আছে ফ্রান্স। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ধর্ষণের মত ঘটনা ফ্রান্সে অপরাধ বলেই মানা হত না। সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, এই দেশে প্রতিবছর ধর্ষণের শিকার হয় অন্তত ৭৫ হাজার নারী।

তালিকায় অষ্টম স্থানে থাকা কানাডায় এখন পর্যন্ত লিখিত অভিযোগের সংখ্যা ২৫ লাখ ১৬ হাজার ৯১৮টি। প্রতি ১৭ জনের মধ্যে একজন নারী এই দেশে ধর্ষণের শিকার হয়। [বাংলাদেশ প্রতিদিন (অনলাইন), ২৬ অক্টোবর ২০১৬]

আরো দ্রষ্টব্য : যুগান্তর (অনলাইন), ২৬ অক্টোবর ২০১৬; আমাদের সময় (অনলাইন), ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

এ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের হালচাল। আচ্ছা, এই দেশগুলোতে কিসের অভাব? অর্থকড়ি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি সবদিক থেকেই তো তারা ‘পরিপূর্ণ’। আমাদের দেশও দিন-দিন উন্নতি লাভ করছে। শিক্ষার হার যথেষ্ট বেড়েছে। তারপরও কেন ধর্ষণের এই ভয়াবহ রূপ?

যখন একটা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায় তখন কয়েকদিন কিছু হইচই হয়। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় তুমুল আলোচনা হয়। প্রতিবাদ ও মানববন্ধন হয়। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। তারপর একসময় সবকিছু থেমে যায়। এ সময়ের মধ্যে আরেকটা ঘটনা যোগ হয়।

কিন্তু এই অনাচার কেন হয়, দিন-দিন তা কেন বেড়ে চলেছে, ভুক্তভোগী মা-বোনদের জীবন কত দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, বৃহত্তর সমাজে এর কী কুপ্রভাব পড়ে- এসব বিষয়ে আমাদের কতটুকু চিন্তা করার সুযোগ হয়? প্রত্যেকে নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী কতটুকু সচেতন হই?

বাস্তবতা হল, কিছু হইচই, কাদা ছোড়াছুড়ি আর বিচারের দাবি জানানোর মধ্যেই সব শেষ। না তার সঠিক কারণ চিহ্নিত করার আন্তরিক প্রয়াস লক্ষ করা যায়, না সে অনুযায়ী সচেতন হওয়ার।

উল্টো কেউ সত্য কথা বললে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা সেকেলে কিংবা গোঁড়া আখ্যা দেওয়া হয়।

অথচ এই ব্যাধির প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে যথাব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এর রাশ টেনে ধরা কঠিন হবে। তাই চিন্তাশীলদের উচিত এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদা শারমীন বেনু বলেন, নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সমবেত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আইন দিয়ে কখনোই এমন বর্বর ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না। দেশে নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বহু আইন রয়েছে। তারপরও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ...নির্যাতন প্রতিরোধে বা বন্ধে সামাজিক আন্দোলন আরও জোরদার করতে হবে। [যুগান্তর (অনলাইন), ২১ মার্চ ২০১৭]

এই আন্দোলনের লক্ষ হওয়া উচিত, সর্বস্তরে ঈমান ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তার করা, জবাবদিহি ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। একইসাথে অশ্লীলতা, নগ্নতা, বিচারহীনতা, ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা। ধর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য ইসলামী শিক্ষার অভাব, জবাবদিহি ও নৈতিক মূল্যবোধের শূন্যতা এবং অশ্লীলতা, বিচার-ব্যবস্থার দুর্বলতা, ক্ষমতার অপব্যবহারই দায়ী। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র সর্বত্র একই অবস্থা বিরাজমান।

***

অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান, তার কল্যাণ-কামনা করা, সৎকাজে সাহায্য করা, বিশেষত তাকে কোনো ধরনের কষ্ট না দেওয়া সকলের ক্ষেত্রে কাম্য। নারীর ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে কাম্য। নারী মানবজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ; বরং এছাড়া মানবজীবন অপূর্ণ। একই সাথে সে দুর্বল ও সংবেদনশীলও বটে। কাজেই তার সম্ভ্রমহানি করা, ইজ্জত-সম্মান লুণ্ঠন করা কত বড় অবিচার?

সায়্যিদুল মুরসালীন, রাহমাতুল লিল আলামীনের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাছে তো শুধু সৎকাজেরই অনুমতি চাওয়া যায়। অসৎকাজের অনুমতি চাওয়ার কল্পনাও করা সম্ভব নয়। কিন্তু এক যুবক তাই করল। সরাসরি নবীজীর কাছে এসে ব্যভিচারের মত জঘন্য অপরাধের অনুমতি চেয়ে বসল। দেখুন, নবীজী তাকে কীভাবে সংশোধন করলেন। তার অন্তর থেকে কীভাবে ব্যভিচারের মূলোৎপাটন করলেন।

যুবক এসে বলল, আমাকে যিনার অনুমতি দিন। অন্যরা ধমকাতে লাগল- এই তুমি কার সামনে কী বলছ? চুপ কর!

নবীজী ধমক দিলেন না। কাছে ডেকে নিলেন। বললেন-

-তোমার মায়ের সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ কর?

-আল্লাহ্র কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কক্ষনো  আমি এটা পছন্দ করব না, এটা হতে দিব না।

-কোনো মানুষই তার মায়ের সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।

তোমার মেয়ের সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ কর?

-আল্লাহ্র কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কক্ষনো  আমি এটা পছন্দ করব না, এটা হতে দিব না।

-কোনো মানুষই তার মেয়ের সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।

তোমার বোনের সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ কর?

-আল্লাহ্র কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কক্ষনো  আমি এটা পছন্দ করব না, এটা হতে দিব না।

-কোনো মানুষই তার বোনের সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।

-তোমার ফুফুর সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ কর?

-আল্লাহ্র কসম, আপনার উপর আমার জান কোরবান হোক! কক্ষনো  আমি এটা পছন্দ করব না, এটা হতে দিব না।

-কোনো মানুষই তার ফুফুর সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।

-তোমার খালার সাথে কারো ব্যভিচার করা কি তুমি পছন্দ কর?

-আল্লাহ্র কসম, আপনার উপর জান কোরবান হোক! কক্ষনো  আমি এটা পছন্দ করব না, এটা হতে দিব না।

-কোনো মানুষই তার খালার সাথে কারো ব্যভিচার করাকে পছন্দ করবে না।

নবীজী তাকে আরো কাছে টানলেন। তার গায়ে হাত রেখে দুআ করে দিলেন-

اللهُمّ اغْفِرْ ذَنْبَهُ وَطَهِّرْ قَلْبَهُ، وَحَصِّنْ فَرْجَهُ.

আল্লাহ! আপনি তার গুনাহ ক্ষমা করে দিন। হৃদয়টা পবিত্র করে দিন। লজ্জাস্থানকে (অন্যায় কাজ থেকে) হেফাজতে রাখুন।

বর্ণনাকারী আবু উমামা রা. বলেন, এরপর সে আর কোনোদিন ব্যভিচারের দিকে ফিরেও তাকায়নি। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২২১১

অর্থাৎ, নবীজী তার মানসিকতার পরিশোধন করলেন- নিজের মা-বোন, মেয়ে, খালা-ফুফুর জন্য যা তোমার পছন্দ নয়, অন্যের মা-বোন, মেয়ে, খালা-ফুফুর সাথে তা কীভাবে করবে?

এই অনুভূতি যদি অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়, তাহলে কি কোনো নারী যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের শিকার হতে পারে?

উপরোক্ত হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকের মানসিকতার পরিবর্তন করলেন নিজের রক্ত-সম্পর্কের নারীদের উদাহরণ টেনে, যাদের সামান্য ক্ষতিও কেউ চায় না। তার দৃষ্টি খুলে দিলেন- তোমার আপনজনদের যে ক্ষতি তুমি চাও না; সকলেই নিজ নিজ আপনজনের এ ক্ষতি চায় না; নিজ মা-মেয়ে-বোন-খালা-ফুফুর সামান্য ক্ষতি চায় না। আর প্রতিটি নারীই কারো না কারো মা-মেয়ে-বোন-খালা-ফুফু।

যিনা-ধর্ষণের উল্লেখযোগ্য একটি ক্ষেত্র হল, প্রতিবেশী নারী। এ অপরাধের পাপবোধ ও ভয়াবহতা যেন পুরুষের অন্তরে থাকে তাই একটি হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবেশীর সাথে ব্যভিচারকে জঘন্য অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন।

এক সাহাবী নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে বড় গোনাহ কোনটা? তিনি বললেন, আল্লাহ্র কোনো সমকক্ষ সাব্যস্ত করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটা? বললেন, সন্তান তোমার খাবারে ভাগ বসাবে এই ভয়ে তাকে হত্যা করা। জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটা? বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে  ব্যভিচার করা।  -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪২

তো ইসলাম নারীর ব্যাপারে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার সংশোধন করে, নারীকে সম্মান ও সহানুভূতির স্থানে অধিষ্ঠিত করে। পুরুষের মনে আল্লাহ্র ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহির কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। নারীর প্রতি যে কোনো ধরনের অন্যায় আচরণের ক্ষতি ও ভয়াবহতা তুলে ধরে পুরুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে। পুরুষের অন্তরে একথা বদ্ধমূল করে- নারীর সাথে আচরণ হতে হবে তার সম্মান ও মর্যাদা বিবেচনায় রেখেই। তার প্রতি মানসিকতা থাকবে সম্মান ও সহানুভূতির। আর এর অনুকূল সকল ব্যবস্থা-ই ইসলাম গ্রহণ করেছে।

কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতা? যাকে নারী নিজের মুক্তির পথ ভাবছে সে সভ্যতায় নারীকে কোন্ চোখে দেখা হয়? তাকে কিসে পরিণত করা হয়েছে? সে সভ্যতায় নারীর ব্যাপারে পুরুষের মানসিকতা কী?

পশ্চিমা সভ্যতায় নারীর পরিচয় হচ্ছে, সে একটি ভোগ্যপণ্য। টিভি বিজ্ঞাপন, পত্রিকা বিজ্ঞাপন, অনলাইন বিজ্ঞাপন- সবকিছুতে নারীকে পণ্যায়িত করা হচ্ছে। নারী ছাড়া যেন বিজ্ঞাপন হয় না। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর জিনিসে নারী শোভা পাচ্ছে। মোবাইল কোম্পানির সিম বিক্রি থেকে শুরু করে জুস, আচার, কোল্ড ড্রিঙ্কস, পেস্ট, সাবান, চেয়ার, টেবিল, গাড়ি সব বিজ্ঞাপনে নারীকে উপস্থাপন করা হয়। পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য সুন্দরী মডেলের ছবি প্রচারিত হয়। নৌকায় দেওয়ার জন্য আলকাতরা কিনলেও তাতে একটি নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে।

শিল্পের নামে নারীকে পরিণত করা হচ্ছে ¯্রফে ‘আইটেম গার্ল’-এ। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা চলছে নারীর ‘উন্মুক্ত প্রদর্শনী’। উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীর দেহকে প্রদর্শন করে পণ্যটির দিকে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা।

আর এ অসম্মানের পথকেই তারা নারীর সামনে উপস্থাপন করছে নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার, নারী উন্নয়ন, সাবলম্বিতা নামে! এসব সস্তা শ্লোগানের ট্র্যাপে পড়ে কর্পোরেট হাউজের শো-পিস হওয়া মাজলুম নারীদের খবর কি কেউ নিয়েছে কখনো?

দুঃখজনক হল নারী এটাকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে এবং একে সম্মানের প্রতীক মনে করছে।

ধর্ষণ-প্রবণতার জন্য কি এই দৃষ্টিভঙ্গির কোনো দায় নেই? নারীর বাণিজ্যিকীকরণ, বিজ্ঞাপন ও ইভেন্টে নারীকে ক্রমাগত দেহসর্বস্ব যৌন লালসার ভোগ্য-পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা কি পুরুষকে ধর্ষণের প্রতি প্ররোচিত করে না?

পুরুষের মানসিক বিকৃতির একটা বড় কারণ হচ্ছে নারীকে ভোগ্য-পণ্য হিসেবে দেখার সংস্কৃতি এবং এটা একটা ধর্ষণ মনস্তত্ত্ব তৈরিকারী।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক জনাব তপন মাহমুদ বলেন, এসবের ফল হচ্ছে বিষম। এসবের কোনো কিছুই ধর্ষণকে বৈধ করবে না সত্য; কিন্তু পুরুষের ধর্ষণ মনস্তত্ত্ব তৈরিতে এসবের ভূমিকা আছে বটে।

***

যিনা (ব্যভিচার) একটা চরম অপরাধ। অনেক অপরাধের সমষ্টি। মানবসভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি। নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনার চূড়ান্ত রূপ। এতে আত্মিক, মানসিক, শারীরিক, চারিত্রিক, সামাজিক বহু রকমের বিপর্যয় ঘটে। এর কুফল কখনো কখনো গোটা সমাজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

ইসলাম যিনার কাছে যেতেও নিষেধ করে-

وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً ؕ وَ سَآءَ سَبِیْلًا.

তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয় তা অশ্লীলতা ও বিপথগামিতা। -সূরা বনী ইসরাইল (১৭) : ৩২

যিনা কত নিকৃষ্ট তা বোঝার জন্য এই একটি আয়াতই যথেষ্ট। এখানে ‘যিনা করো না’ এ কথা বলা হয়নি; বরং এর কাছে যেতেও নিষেধ করা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, এটা কত জঘন্য অপরাধ।

অথচ সমাজ বিয়ে বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক- যিনায় ছেয়ে গেছে। নানা স্থানে পতিতালয় গড়ে উঠছে। কিন্তু এর কোনো বিরোধিতা নেই। ধর্ষণকে (বলপূর্বক যিনা) অন্যায় মনে করা হলেও যিনাকে (উভয়ের সম্মতির ব্যভিচার দোষের মনে করা হয় না। যদিও কখনো ক্ষতির শিকার হওয়ার পর এরও নাম হয়- ধর্ষণ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মানববন্ধন হলেও ব্যভিচারের বেলায় কিছুই নেই। বরং একে প্রগতি, স্বাধীনতা ও আধুনিকতা সাব্যস্ত করা হয়।

ধর্ষণ কেন নিন্দনীয়? এর কারণ কি শুধু এটা যে, এতে নারীর সন্তুষ্টি বিদ্যমান থাকে না, নাকি এর কারণ এই যে, এতে মানসিক, শারীরিক, সামাজিক ইত্যাদি বিপর্যয় ঘটে? সর্বোপরি তা সুস্পষ্ট কবীরা গুনাহ। আমরা মনে করি, এগুলোই ধর্ষণ অন্যায় হওয়ার মূল কারণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ বিষয়গুলো যিনা, স্বেচ্ছা ধর্ষণ ও ট্র্যাপে পড়া ধর্ষণে আরো প্রকটভাবে বিদ্যমান। তো একে কেন অন্যায় মনে করা হয় না?

ব্যভিচার কি ধর্ষণকে উসকে দেয় না? চারদিকে যে যিনার প্রতিযোগিতা চলছে, ধর্ষণের পেছনে কি তার মোটেই ভূমিকা নেই?

ইসলামে শুধু অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের চূড়ান্ত রূপটাই যিনা নয়। বরং যেসব কাজ যিনার প্ররোচনা দেয় সেগুলোও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং তাও যিনা বলে গণ্য।

এক হাদীসে আছে-

الْعَيْنَانِ زِنَاهُمَا النّظَرُ، وَالْأُذُنَانِ زِنَاهُمَا الِاسْتِمَاعُ، وَاللِّسَانُ زِنَاهُ الْكَلَامُ، وَالْيَدُ زِنَاهَا الْبَطْشُ، وَالرِّجْلُ زِنَاهَا الْخُطَا، وَالْقَلْبُ يَهْوَى وَيَتَمَنّى، وَيُصَدِّقُ ذَلِكَ الْفَرْجُ وَيُكَذِّبُهُ.

চোখের ব্যভিচার হল দেখা। কানের ব্যভিচার শোনা। জিহ্বার ব্যভিচার বলা। হাতের ব্যভিচার ধরা। পায়ের ব্যভিচার হাঁটা। মন কামনা করে আর লজ্জাস্থান  তা সত্য বা মিথ্যায় পরিণত করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৫৭

অর্থাৎ চোখ-কান-হাত-পা-জিহ্বা সবই যিনা করে- যিনার প্ররোচনা দেয়, যা পূর্ণতা পায় লজ্জাস্থানের মাধ্যমে। সুতরাং এসব অঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

বিশেষত চোখের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা চাই। যেসব জিনিস দেখা নাজায়েয সেগুলো থেকে দৃষ্টিকে হেফাজত করতে হবে (যেমন বেগানা নারী, পর-পুরুষ, অশ্লীল ছবি ইত্যাদি)। অবৈধ জিনিস দেখা অবৈধ কাজের প্ররোচণা দেয়, মনে কুচিন্তা আনে। পর্নোগ্রাফীতে আসক্তির কারণে বিকৃত যৌনইচ্ছা জন্মাতে পারে, যা ধর্ষণের মানসিকতাকে উসকে দেয়। বস্তুত কু-নজর হচ্ছে অনৈতিক কাজের ‘ভূমিকা’। এজন্য হাদীসে একে ব্যভিচার গণ্য করা হয়েছে।

জিহ্বার যিনা দ্বারা উদ্দেশ্য হল মুখে এমন কিছু বলা, যার ফলে অন্তরে যিনার চিন্তা আসে। এজাতীয় জিনিস সেবন করা ও ভক্ষণ করাও এতে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্যের কথা উল্লেখ করা যায়। মাদকাসক্তি মানবসভ্যতার জন্য বিরাট হুমকি। মাদকদ্রব্যের নেশার ছোবল অত্যন্ত ভয়াবহ। এতে ব্যক্তি শুধু পরিবার ও সমাজ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয় না; তার গোটা জীবন ধ্বংস হয়। মাদক কেবল সমাজ ও জাতির জন্যই ক্ষতিকর নয়; সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেও বিপন্ন করে। মদ্যপান সকল অশ্লীলতার মূল এবং অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত করে। এতে মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য বুদ্ধি-বিবেচনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যার ফলে সে অতি সহজেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ নানা রকম অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়।

মদকে কুরআনে শয়তানের ‘গান্দা কর্ম’ আর হাদীসে সকল অশ্লীলতার মূল আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

অথচ সমাজের সর্বস্তরে জীবনবিনাশী মাদকের অভয়ারণ্য। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এখন হাত বাড়ালেই গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, সিসা, বাংলা মদ, হেরোইন সহজে পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নেশা প্রতিরোধ নিরোধ সংস্থার (মানস) ভাষ্যমতে, দেশে বর্তমানে মাদক সেবনের সাথে ৭০ লাখ মানুষ জড়িত। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। মাদক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে অন্তত কোটি লোক নেশায় আসক্ত হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে প্রতিবছর শুধু নেশার পেছনে খরচ হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ৮ মে ২০১৮)

কানের যিনা প্রসঙ্গে গানবাদ্যের কথা আলোচনা করা যায়। গানবাদ্য বহু অন্যায়ের সমষ্টি। এতে অন্তরে কপটতা,  ব্যভিচারের প্রেরণা, কুরআনের প্রতি অনীহা সৃষ্টি এবং অন্তর থেকে আখেরাতের চিন্তা নির্মূল হয়। আর বর্তমানের গান তো অশ্লীলতা ও যৌনতার আকর্ষণে ঠাসা, যা মানুষকে অবৈধ সম্পর্কের প্ররোচনা দেয় এবং অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও বুযুর্গ ইমাম ফুযায়েল ইবনে ইয়ায রাহ. যথার্থই বলেছেন, الغناء رقية الزنا ‘গান ব্যভিচারের মন্ত্র।’

অথচ গানের ঐকতানে সমাজ ভেসে যাচ্ছে। গাড়িতে-বাড়িতে, পথে-ঘাটে সবখানে গান, গানের উপদ্রব।

***

নারীর কর্তব্য হচ্ছে নিজ গৃহে অবস্থান করা, স্বামী ও সন্তানকে সঙ্গ দেওয়া। তার সংস্পর্শে স্বামীর দেহ-মন প্রশান্তি লাভ করবে। সে ঘরকে সুকূনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করবে।

মা হচ্ছে সন্তানের প্রথম ও হৃদয়গ্রাহী পাঠশালা। এ পাঠশালায় সে শারীরিক, মানসিক, চারিত্রিক সবদিক থেকে পরিপুষ্ট হবে। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মায়ের চেয়ে উপযুক্ত কিছু নেই। শিশুর সঠিক শিক্ষা ও দীক্ষা তখনই সম্ভব যদি শিক্ষক দয়াপরবশ হয়। ছাত্রের মন-মেযাজ সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়। তার দুষ্টুমিগুলো সবরের সাথে সংশোধন করতে পারে।

তার চেয়ে বড় বিষয় হল খোদ শিশুও তাকে অপার মহব্বত করে। তার শাসন নিজের জন্য উপকারী মনে করে। কঠোরতাকে হাসিমুখে মেনে নেয়। এ বিষয়গুলো মা আর সন্তানের মাঝে যেভাবে পাওয়া যাওয়া সম্ভব অন্য কারো মধ্যে সেভাবে সম্ভব নয়।

শৈশব তো পুরোটাই কাটবে মায়ের ¯েœহ-আঁচলে। তারপর যখন বিদ্যালয়ে যাবে তখনও বিদ্যালয়ের বাইরের সময়টা তার সংস্পর্শে অতিবাহিত হবে। এভাবে মা-নারীর সার্বিক তরবিয়ত ও তত্ত্বাবধানে রচিত হতে পারে আদর্শ সন্তান, উৎকৃষ্ট পরিবার ও টেকসই সংসার। সুতরাং নারীর গৃহে অবস্থানই অধিকতর প্রাসঙ্গিক।

প্রয়োজনে বাইরে গেলে শরীর ঢেকে যাওয়া। আপন রূপ ও সৌন্দর্য পর-পুরুষের সামনে প্রকাশ না করা, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, চলাফেরায় ভদ্রতা ও শালীনতা বজায় রাখা, অবাধ মেলামেশা ও বেহায়াপনা থেকে বিরত থাকা এবং সতর্কতা অবলম্বন করা। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কে যেতে বলেছে, কেন বলেছে, তার কু-উদ্দেশ্য আছে কি না এসব বিষয় ভাবা চাই। ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবককে সঙ্গে নিতে হবে।

কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ لَسْتُنَّ كَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَیْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَیَطْمَعَ الَّذِیْ فِیْ قَلْبِهٖ مَرَضٌ وَّ قُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوْفًا وَ قَرْنَ فِیْ بُیُوْتِكُنَّ وَ لَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِیَّةِ الْاُوْلٰی.

হে নবী পত্নীগণ! তোমরা সাধারণ কোনো নারীর মত নও, যদি তাকওয়া অবলম্বন কর। সুতরাং তোমরা (পর-পুরুষের সাথে) কোমলভাবে কথা বলো না। অন্যথায় যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে লালায়িত হয়ে পড়বে। আর তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলো। তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করো এবং আগের জাহেলিয়াতের মত নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িও না। -সূরা আহ্যাব (৩৩) : ৩২-৩৩

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ.

তোমরা যখন নবীর স্ত্রীদের কাছে কিছু চাও তখন পর্দার আড়াল থেকে চাও। এটা অধিক পরিচ্ছন্ন- তোমাদের অন্তর ও তাদের অন্তরের জন্য। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৩

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَ لْیَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوْبِهِنَّ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا لِبُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اٰبَآىِٕهِنَّ اَوْ اٰبَآءِ بُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اَبْنَآىِٕهِنَّ اَوْ اَبْنَآءِ بُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اِخْوَانِهِنَّ اَوْ بَنِیْۤ اِخْوَانِهِنَّ اَوْ بَنِیْۤ اَخَوٰتِهِنَّ اَوْ نِسَآىِٕهِنَّ اَوْ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُهُنَّ اَوِ التّٰبِعِیْنَ غَیْرِ اُولِی الْاِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفْلِ الَّذِیْنَ لَمْ یَظْهَرُوْا عَلٰی عَوْرٰتِ النِّسَآءِ  وَ لَا یَضْرِبْنَ بِاَرْجُلِهِنَّ لِیُعْلَمَ مَا یُخْفِیْنَ مِنْ زِیْنَتِهِنَّ .

(মুমিন নারীদের বল) তারা যেন নিজেদের সৌন্দর্য অন্যদের কাছে প্রকাশ না করে, তবে তার মধ্যে যা (সাধারণত) প্রকাশ পেয়ে যায় (তার কথা ভিন্ন)। এবং তারা যেন তাদের ওড়না নিজ বক্ষদেশে নামিয়ে দেয় এবং নিজেদের সৌন্দর্য যেন স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নে, আপন স্ত্রী লোক, যারা তাদের মালিকানাধীন, এমন পুরুষ সেবক, যাদের (নারীদের বিষয়ে) কোনো আগ্রহ নেই এবং নারীদের গোপন বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো সামনে প্রকাশ না করে। আর তারা যেন এমনভাবে পা না ফেলে, যার ফলে তাদের গোপন সৌন্দর্য জানা হয়ে যায়। -সূরা নূর (২৪) : ৩১

হাদীসে আছে-

المرأة عورة، فإذا خرجت استشرفها الشيطان.

নারী হল গোপনযোগ্য। যখন সে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে দৃষ্টি উঁচু করে তাকাতে থাকে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৭৩

অপর এক হাদীসে আছে-

لا يخلون أحدكم بامرأة، فإن الشيطان ثالثهما.

তোমাদের কেউ যেন (বেগানা) নারীর সাথে একান্তে মিলিত না হয়। কেননা তখন শয়তান তাদের তৃতীয়জন হিসেবে উপস্থিত হয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৪

এ আয়াত ও হাদীসসমূহে যে বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে, নারী যেন নিজ গৃহে অবস্থান করে, পর্দা রক্ষা করে এবং তার পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তা, চালচলনে যেন শালীন, মার্জিত ও সংযত হয়, যাতে শয়তান তার রূপ-লাবণ্যের প্রতি পুরুষদের প্রলুব্ধ করতে না পারে। তাদের মনে কুচিন্তা সৃষ্টি করতে না পারে।

কিন্তু বর্তমান সমাজে কী সংস্কৃতি চলছে? পর্দাহীনতা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা। বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ডের নব্য সংস্কৃতি। ভেতরের নিরাপদ ভুবনের চেয়ে বাইরের অনিরাপদ জগতকেই ঢের পছন্দ করা হয়। সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক মনে করা হয়। নারীর কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন সর্বত্রই অশালীনতা। এত পাতলা, সূক্ষ্ম ও আঁটসাঁট পোশাক পরিধান করা হয়, যা দ্বারা কাপড়ের উপর থেকেই শরীরের গঠনপ্রণালী দৃশ্যমান হয়। সর্বত্রই চলছে ব্যভিচারের আয়োজন ও প্রতিযোগিতা।

একশ্রেণির নারী নিজের ক্যারিয়ার, প্রমোশনের প্রলোভনে অপরের ‘শয্যাসঙ্গী’ হচ্ছে। আরেক শ্রেণির নারী তো শোভা পাচ্ছে বড়-ছোট পর্দায়। বিনোদনের নামে যেখানে চলছে যৌনতার উন্মুক্ত চর্চা। তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে সবই এখন সহজলভ্য। ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে সবখানে সবার কাছে।

ধর্ষণের প্রবণতা বৃদ্ধির পেছনে এসব নগ্নতার কি কোনো ভূমিকা নেই? তা কি নারীর প্রতি অনৈতিক চিন্তা ও কাজে প্রলুব্ধ করে না?

২০১৫ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। এর কারণ কী, এক্ষেত্রে কি বলিউডের রূপালি পর্দার কোনো দায় নেই? ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ নানা চরিত্রের সঙ্গে কথা বলে বিবিসির চলচ্চিত্র সমালোচক টম ব্রুকস একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। প্রতিবেদনটির একটি অংশ এরকম :

একের পর এক এমন সব বর্বর ধর্ষণের ঘটনার সামাজিক কারণ খুঁজতে গিয়ে এই প্রশ্নটাও সামনে চলে এসেছে যে, ভারতে নারীর প্রতি এই যৌন সহিংসতা উসকে দেওয়ার পেছনে কি বলিউড আংশিকভাবে দায়ী? বিশেষত চলচ্চিত্রের পর্দায় নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং যেসব চিত্রকল্প আর আখ্যান তুলে ধরা হয় সেসব কি যৌন সহিংসতা উসকে দিচ্ছে?

(প্রথম আলো, ১৪ জুলাই ২০১৫)

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী ধর্ষণের ঘটনার পেছনের কারণ সম্পর্কে বলেন, ...সবকিছুর মূলে আছে মূল্যবোধের অভাব। অবাধ পর্নোগ্রাফির বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্বল্প পরিচয়ের পর ওই ছেলের সঙ্গে বাছবিচার না করে মেলামেশা, বিভিন্ন চ্যানেল, বিশেষ করে পাশের দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে যা দেখানো হয়, তাও ধর্ষণের মত অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। বিজ্ঞাপন দেখে একটি ছোট ছেলেও জানতে পারছে, শরীরকে উত্তেজিত করতে হলে কী খেতে হবে। ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেটে কোন্ সাইট দেখছে, তাও অভিভাবকেরা কখনো নজরে আনছেন না। (প্রথম আলো, ২৪ মে ২০১৭)

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. খুরশিদ আলম ধর্ষণ প্রতিরোধে বহুমুখী পদক্ষেপের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,

তৃতীয়ত, যেখানে যতটা সম্ভব নারীদের ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পরিচয় কিংবা নম্বর আদান-প্রদান এধরনের ঝুঁকি বাড়াতে সহায়তা করে। তাই এই নম্বর আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। [সমকাল  (অনলাইন), ৫ জুন ২০১৭]

ধর্ষণের বিরুদ্ধে বেশি সরব হয়ত নারী সমাজই (এবং এমনটাই হওয়া উচিত)। কিন্তু তাদের পোশাক-আশাক, কথাবার্তা ও চালচলনে কি শালীনতা, ভদ্রতা ও সচেতনতার ছাপ লক্ষ করা যায়?

মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে, এখন বলিউড, হলিউডের তারকারাও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। কিন্তু তারা কি এই বেশ্যাবৃত্তিটা বর্জন করেছেন?

সারকথা হল ধর্ষণ একটি ভয়াবহ ব্যাধি। এ কেবল যৌন নির্যাতনই নয়; বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের বহিঃপ্রকাশ। দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্ক। অনৈতিকতা ও পাশবিকতার চূড়ান্ত পর্যায়। এ থেকে আমাদের রক্ষা পেতেই হবে। তবে তা যেন শুধু মুখ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং কর্ম ও আচরণেও প্রকাশ পায়। যেসব জিনিস ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব তৈরি করে, একে উসকে দেয় এবং যে পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অবস্থানের সমন্বয়ে মানুষ এর প্রতি প্রলুব্ধ হয়, সেগুলো থেকে প্রত্যেককে নিজ নিজ শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী বেঁচে থাকতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা বন্ধের জন্য দায়িত্বশীলদের কাছে দাবি জানাতে হবে। সুস্থ ও সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। সর্বোপরি ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত হতে হবে; আল্লাহ্র ভয় ও আখেরাতের জবাবদিহির কথা অন্তরে সদা জাগরুক রাখতে হবে।  সবারই জানা, ভেতরের চিকিৎসা না করে উপরে যতই মলম লাগানো হোক, রোগ নিরাময় সম্ভব নয়। হ

 

advertisement