তরুণদের প্রতি : নামাযের পাবন্দী
[বিগত ১৫ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৯ হিজরী/৪ মার্চ ২০১৮ ঈসায়ী তারিখে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মিরপুরের ভবনে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্নকারীদের নিয়ে দিনব্যাপী একটি দ্বীনশিক্ষা মজলিস। এই মজলিসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া। তাঁর মূল্যবান বয়ান আলকাউসারের পাঠকবৃন্দের জন্য উপস্থাপিত হল। -সম্পাদক]
আমাদের উস্তায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম তাঁর সংক্ষিপ্ত কথার মধ্যে এক মূল্যবান কথা বলে গেছেন; আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়- আমরা মুমিন, আমরা মুসলিম। আমরা জন্মের প্রথম দিন থেকে যে পরিচয় বহন করি তা হল, আমরা মুসলিম। তারপর জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে জীবনের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পরিচয় এসে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়; কেউ ডাক্তার হয়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়, কিন্তু তখনও আমাদের আসল পরিচয় থাকে- আমরা মুসলিম। এ পরিচয়েই আমাদের মর্যাদা, আমাদের সম্মান।
যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার সব পরিচয় মুছে যায়। মৃত্যু মানুষের সব পরিচয় মুছে দেয়। তখন শুধু ঈমান ও আমলে ছালেহ-এর পরিচয়টাই বাকি থাকে। আখেরাতে অন্য কোনো পরিচয় কাজে আসবে না। একমাত্র এই পরিচয়ই কাজে আসবে যে, সে মুসলমান, সে ঈমানদার।
সুতরাং মুসলমান পরিচয়টা যেহেতু আমাদের সবসময় কাজে আসবে সেহেতু এ পরিচয় আমাদের থেকে কখনো যেন ছুটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আর দুনিয়াতেও যদি কেউ বাস্তব অর্থে সুখী হতে চায়, তাহলে তার জন্য এ পরিচয় অপরিহার্য।
দেখ, পড়াশোনার লাইন ভিন্ন হলেও আমরা সকলেই কিন্তু এক। আমরা সকলেই মুসলমান। সারা বিশ্বের যেখানে যত মুসলমান আছে, আমরা সকলেই ভাই ভাই। আমাদের দেশ ও ভাষা ভিন্ন হতে পারে, শিক্ষাঙ্গন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মুসলিম পরিচয়ের সূত্রে আমরা এক, আমরা ভাই ভাই। মুসলিম পরিচয় সূত্রের এই যে বন্ধন এটা কিন্তু আমাদের থেকে কিংবা আমাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে শুরু হয়নি। এটা এসেছে সাহাবাদের যুগ থেকে। তাঁরা পেয়েছেন নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। তিনি পেয়েছেন আল্লাহ তাআলা থেকে। তার আগে আরো অনেক নবী অতিবাহিত হয়েছেন। হযরত আদম আ., হযরত নূহ আ., হযরত ইবরাহীম আ., হযরত ইদরীস আ., হযরত ইসহাক আ., হযরত ইয়াকুব আ. ...তাঁরা সকলেই মুমিন ছিলেন এবং এ পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন। দুনিয়ায় মানবকুলের মধ্যে সবচেয়ে সেরা হলেন নবীগণ। এই সেরা গোষ্ঠীর সাথে যদি আমাদের মিল থাকে তাহলে আমরাও সেরা হয়ে যাব। সেই মিল হল, তাঁরা মুমিন ছিলেন, তাঁরাও আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করতেন, আমরাও মুমিন, আমরাও আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করি। এই ঈমানের বাঁধনের মাধ্যমে আমরা তাঁদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। যদি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা এই পরিচয়টুকু ধরে রাখতে পারি তাহলে এর মাধ্যমে মানবকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ গোষ্ঠীর সাথে আমাদের একটা সম্পর্ক হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে আমাদের দুনিয়ার জীবনও শ্রেষ্ঠ হবে এবং মৃত্যুর পরও ইনশাআল্লাহ এর মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ জীবন লাভ করব।
এটা হল এক দিকের কথা। আরেক দিক থেকে দেখ, আমাদের কাছে বাবা-মায়ের পরিচয় সবচেয়ে বড়। আমরা কোন্ বংশের, আমার বাবা, আমার দাদা, আমার নানা কোন্ বংশের, তাদের পরিচয়েই আমরা পরিচিত হই। একজন মানুষ যত বড় শিক্ষিতই হোক, সে তার বাবার পরিচয়েই বড় হয়, চাই তার বাবা কৃষকই হোক না। কোনো সন্তান যদি তার বাবার পরিচয়কে অস্বীকার করে তাহলে সে যত বড় শিক্ষিতই হোক না কেন সে কোনো আদর্শ সন্তান হতে পারে না। তো আমাদের আসল বাবা কে?
আমরা হলাম বনী আদম, আদম সন্তান। আমাদের আদি পিতা হলেন হযরত আদম আলাইহিস সালাম। সকল মানবকুলের সূচনা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে দিয়ে। সুতরাং আমাদের আদি পিতা যেমন ছিলেন আমাদের তেমনি থাকা উচিত। তিনি তো এক আল্লাহ্র উপর বিশ্বাসী ছিলেন। জীবনভর তাঁর ইবাদত করে গেছেন। এবং এই পরিচয় নিয়েই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তো আদর্শ সন্তান হল সেই, যে বাবার এই পরিচয়টাকে ইয়াদ রাখে, স্মরণ রাখে। দুনিয়াতে এমন অনেক মানুষ আছে, যে এই পরিচয় বহন করেনি, সে হয়ত খ্রিস্টান, ইহুদী বা অন্য ধর্মাবলম্বী। তারা বাবার ঐ পরিচয়টাকে ধরে রাখেনি। তারা আদম আ.-এর সন্তান, কিন্তু আদম আ.-এর এই বৈশিষ্ট্য তারা ধরে রাখেনি। তাই তারা বলতে পারবে না- তারা বাবার আদর্শ সন্তান। আদমের সন্তান বলতে হলে আদমের বৈশিষ্ট্যাবলি তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এক আল্লাহ্র উপর বিশ্বাসী হতে হবে, যেভাবে হযরত আদম আ. এক আল্লাহ্র উপর বিশ্বাসী ছিলেন। সারা জীবন তাঁরই ইবাদত করে গেছেন। যদি আমরা প্রকৃত আদম সন্তান হতে চাই তাহলে আদম আ., নূহ আ., হযরত ইবরাহীম আ., সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- তাঁদের পরিচয়টা আমাদের ভেতর রাখতে হবে।
আমাদের সম্পর্ক শুধু বাংলাদেশের এই কয়েক কোটি মানুষের সাথেই না। আমাদের সম্পর্ক আরো আগ থেকে শুরু হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবীর সাথে আমাদের এই রিলেশন, এই ঈমানী সম্পর্ক। এই ঈমানী কালিমা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এই ঈমানী কালিমার মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক তাদের সাথে হচ্ছে, যারা মানবকূলের মধ্যে সবার চেয়ে সেরা।
আমরা যে কোনো শিক্ষায় শিক্ষিত হই না কেন আমাদের এই পরিচয়টা সবচেয়ে বড়। এই পরিচয়টা যদি আমরা ধারণ করতে পারি, তাহলে দুনিয়ার জীবনের যখন অবসান ঘটবে তখন আখেরাতের জীবনে অনন্তকাল পর্যন্ত আমরাও ঐ শ্রেষ্ঠদের সাথে মিলিত হয়ে যাব, আমাদের ওই ঈমানী পরিচয়ের কারণে এবং ঈমানী পরিচয়ের হক আদায় করার কারণে।
এই হল এক কথা। যে কোনো পরিচয়ের একটা বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাদের পরিচয় আমরা মুসলমান, আমরা মুমিন। এই পরিচয়েরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, কিছু দাবি আছে। একটা কাজ তো হল আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করব। অন্য কাউকে সিজদা করব না। অন্য কারো ইবাদত করব না। আল্লাহ্রই ইবাদত করব। আমাদের এই সিজদা এটা আল্লাহ্র জন্য সুনির্ধিারিত। সারা জীবন এই শিক্ষা মনে রাখব। যে কেউ বোঝাক আমাকে; যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি আমাকে শ্রেষ্ঠ মাখলুক বানিয়েছেন, যিনি আমাকে সুন্দর করে বানিয়েছেন, আমার সিজদার হক একমাত্র তাঁর। আল্লাহ্ তাআলার প্রতি আমাদের এই বিশ্বাস, আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার এই হক।
তোমাদের সকলেরই তো এখন ১৫ বছর বয়স হয়ে গেছে। মাশাআল্লাহু তাআলা কত সুন্দর শাবাব!
এই যে আমাদেরকে ইহ-জীবনে এবং পরজীবনে শ্রেষ্ঠদের সাথে মিলিত হতে হবে; সেই মিলার জন্য আমাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল নামায। এই সামান্য একটা কাজ এটা আমাদেরকে একেবারে সেরাদের সাথে মিলিয়ে দেয়। আখেরাতে সর্বপ্রথম হিসাব হবে নামাযের। এখন তো তোমাদের জীবনটা মাত্র শুরু। এখন থেকে যদি তুমি নামায ধরে নাও তাহলে তুমি একটা সময় বলতে পারবে- আলহামদু লিল্লাহ, আমার জীবনে কোনো নামায কাযা নেই। যদি এখন থেকে ত্রিশ বছর পর তুমি নামায ধর তাহলে ত্রিশ বছরের কাযা নামায আমাকে পরে পড়তে হবে। এক বছরের কাযা নামায পড়াই তো মুশকিল। হিসাব তো আমাকে দিতেই হবে। তো এই হিসাবের বোঝাটাকে বড় করে কী লাভ? ঈমান নিয়ে যাব। ঈমান একটা গাছ। এই গাছের ফল হল, আমলে ছালেহ- নেক আমল। এর ফুল হল, নামায। অনেক কাজ করলাম জীবনে, কিন্তু ফল হল না। আমার ঈমানের বৃক্ষ কোনো ফল দিল না। আমি ঈমানদার এটা তো আমাকে প্রমাণ দিতে হবে। যদি আমি নামায না পড়ি তাহলে কিন্তু সেটা প্রমাণ হল না। পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিক মত পড়ো। নামায পড়তে কতক্ষণ সময় লাগে? এত প্রস্তুতিও লাগে না। নামায হল সবচেয়ে সহজ।
আমার কোচিং আছে, ক্লাস আছে, আমি স্কুলে যাচ্ছি, আমার পড়াশুনা আছে, সব ঠিক আছে, কিন্তু নামায যেন যথা সময়ে হয়ে যায় এটা খেয়াল রাখতে হবে। এখন থেকে এই মজলিস থেকে যদি তোমরা নামাযের বিষয়ে যত্নবান হয়ে যাও, যদি তোমাদের জীবনের একটা অভ্যাস গড়ে নাও যে জীবনে কোনো নামায কাযা করবে না। নামাযের সময় হলে আমি যেখানেই থাকি নামায পড়ে নেব। বাসায় আছি নামায পড়ে নেব। স্কুলে আছি, কলেজে আছি ওখানেই নামায পড়ে নিব। নামায ছাড়ব না। নামায কাযা হবে না। তাহলে জীবনে একটা সময় বলতে পারবে, আমার ষাট সত্তর বছর বয়স। কিন্তু আলহামদু লিল্লাহ, আমার নামায কাযা হয়নি।
এখন নামাযের কথা যখন মসজিদে বলি বয়স্ক লোকেরা হা হুতাশ করে, কাঁদে- নামাযের কারণে আল্লাহ্র কাছে হিসাব দিতে হবে। এখন কেন কাঁদে? কারণ তোমাদের মত থাকা অবস্থায় তারা নামাযের প্রতি মনোযোগী হয়নি। এখন একেকজনের অনেক বছরের নামায কাযা। কারো পাঁচ বছর, কারো দশ বছর। কারো আরো বেশি। হিসাব করো তো, পাঁচ বছরে মোট কত ওয়াক্ত নামায কাযা হয়। এত ওয়াক্ত নামায কীভাবে পড়বে? এখন তোমাদের জন্য সহজ। যখনকার কাজ তখন সেরে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। এর মাধ্যমে আল্লাহ্র কাছে তোমাদের অনেক মূল্য হবে। জীবনভর আল্লাহ্কে স্মরণ করেছ বলে গণ্য হবে। এভাবে আল্লাহ তাআলার সাথে তোমাদের একটা সম্পর্ক হবে, বন্ধুত্ব হবে।
আল্লাহ তাআলার সাথে বন্ধুত্ব বিষয়টি চিন্তা করেছ। তোমাদের তো অনেক বন্ধু আছে। এখন মোবাইল, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের মাধ্যমে তো বন্ধুর শেষ নেই। বন্ধুত্ব যদি আল্লাহ্র সাথে হয় তাহলে সেটা সবচেয়ে সেরা বন্ধুত্ব নয় কি? আল্লাহ তাআলার সাথে বন্ধুত্ব হয় নামাযের মাধ্যমে। তুমি যদি সময়মত যথাযথভাবে নামায পড় তাহলে আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব হবে। আমি তোমাদেরকে এটা বলছি না যে, নামায পড়তে হলে তোমাদেরকে মসজিদে যেতেই হবে, না হয় নামায সহীহ হবে না- এমন নয়। হাঁ, যদি তুমি চাও তোমার নামাযটা সুন্দর হোক তাহলে তোমাকে মসজিদেই যেতে হবে। মসজিদে গিয়ে এক ওয়াক্ত নামায পড়লে দিল ঠা-া হয়ে যায়। মনটা ভালো লাগে। ওখানে গিয়ে দুআ কর, হে আল্লাহ আমার ব্রেইনটা খুলে দেন। আমার রেজাল্ট ভাল করেন। ফরয নামাযের পর দুআ কবুল হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! কোন সময় দুআ বেশি কবুল হয়? তিনি বললেন, ফরয নামাযের পরের দুআ।
যখন কারো সাথে বন্ধুত্ব হয় তখন তার কাছে কিছু বলা যায়। ফরয নামায হল আল্লাহর বন্ধুত্ব লাভের সবচেয়ে বড় একটি মাধ্যম। প্রথম বন্ধন হল ঈমান। এরপর ঘনিষ্ঠতম বন্ধন হল নমায। তাহলে নামাযের পর আমাদের জীবনে যা যা দরকার তা চেয়ে নিব।
দেখ, উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে পাশ করার পরও কর্মক্ষেত্রে আরেকটা পরীক্ষা থাকে। ফার্স্ট ক্লাসে পাশ করার পরও সকলে কিন্তু এক ধরনের চাকরি পায় না। আমাদের গ্রামে এক লোক ছিলেন, প্রখর মেধাবী, তুখোড় ইংরেজি জানেন। ম্যাথমেটিকে অনেক পাকা ছিলেন। কিন্তু জীবনভর চাকরি করেছেন গ্রামের একটা প্রাইমারি স্কুলে। অথচ তার ব্যাচের যারা মধ্যম মেধার তারা ছিল বড় বড় অফিসার। তাহলে জীবনের সফলতা আল্লাহ তাআলার হাতে। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ব আর নামাযের পর আমাদের যা প্রয়োজন তা আল্লাহ্র কাছে চাইব। তাহলে দেখবে জীবনটা একসময় অনেক দামী হবে। এগুলো মনে রেখ। এগুলো হল জীবন দামী করার পদ্ধতি। জীবনে সফলতা অর্জনের পদ্ধতি।
বছর তিনেক আগের কথা। পরীক্ষার আগে এক ছেলে নিয়মিত মসজিদে আসত এবং সামনের কাতারে নামায পড়ত। পরীক্ষার পর দেখা গেল সে আর আসে না। রাস্তায় আমার সাথে দেখা হলে সালাম মুসাফাহা হয়। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার তুমি মসজিদে আস না কেন? বলে, হুযূর মন খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বলল, পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হয়নি, তাই মসজিদে আসি না।
একবার যদি রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায় তাহলে তার কাছে আমাদের চাওয়া পাওয়া শেষ হয়ে গেল? পরীক্ষা কি শুধু একটাই না আরো আছে? পরবর্তী পরীক্ষাগুলোর রেজাল্ট ভাল করার জন্য তাঁকে বলতে হবে না? সেগুলোতে সফলতা কে দেবেন? তাঁর দান আর আমার চেষ্টা মিলেই তো হবে। তাঁর দান ব্যতীত, শত চেষ্টা করেও সফলতা পাবে না। আমাকে সেরাদের কাতারে শামিল হতে হবে। শ্রেষ্ঠদের সাথে মিলতে হবে। শ্রেষ্ঠ কাজের মাধ্যমে। শ্রেষ্ঠ কাজ হল- নামায।
নামাযের ক্ষেত্রে আমরা কিছু জটিলতায় পড়ি। নামাযের সময় সম্পর্কে ভালোভাবে না জানার কারণে। যেমন মাগরিবের সময়। যদি মাগরিবের পর সাথে সাথে নামায পড়তে না পারি তাহলে মনে করি, নামাযের সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। নামাযের সময় ভালোভাবে জানি না, বিধায় আমরা ঠিকমত নামায পড়তে পারি না।
দ্বিতীয় একটা কারণ হল, তোমরা অনেক সময় বলে থাক কাপড় পাক নেই। আমি প্যান্ট পরেছি, কাপড় পাক নেই। এটা কেমন সমস্যা। কখনো বলে, গোসল করিনি। অথচ নামায একেবারে সহজ।
গত শুক্রবারে এক ভাই মাসআলা জিজ্ঞেস করলেন, পেশাবের লাইনে সমস্যা থাকার কারণে কারো ক্যাথেটার লাগানো। ওটার ভেতরে পেশাব সবসময় জমা থাকে। এই অবস্থায় তার নামায পড়ার হুকুম কী। তার নামায হয়ে যাবে কি না। নামায তো সর্বক্ষণ আদায় করার বিষয়।
যে হালতেই থাক নামায তোমাকে পড়তে হবে। নামাযের সময় জানা অনেক বেশি জরুরি। মোবাইলে নামাযের সময়ের বিভিন্ন অ্যাপ আছে এগুলোকে তুমি কাজে লাগাতে পার। একটা অ্যাপ আছে ‘সালাতুক’। এটা একটা বিশ্বব্যাপী অ্যাপ। যেমন ধর ফযরের নামায। এখানে দেখাচ্ছে, ৩০ নভেম্বর ৫টা ৩ থেকে ফজরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়েছে। ৬টা ২৩ সূর্যোদয়। সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত নামায পড়া যায়। পড়া যায় মানে নামাযটাও সহীহ হবে। সাধারণত মসজিদে ফজরের নামায শেষ হয় ৬টার দিকে। এরপরও আরো প্রায় বিশ মিনিটের মত ফজরের সময় থাকে। জোহরের সময় দেখাচ্ছে ১২ টা ১০ মিনিট থেকে শুরু হয়েছে। এবং শেষ ৪ টা ২০ মিনিট।
অনেকে মনে করে, আজানের আগে নামায পড়া যায় না। এটা ঠিক না। বরং নামাযের সময় হলেই নামায পড়া যায়। ধর তোমার ক্লাস আছে পৌনে একটায়। পৌনে একটায় আজান হয়। তুমি ভাবতে পার আজানের আগে ফরয নামায পড়া যায় না। তাহলে নামাযের বিষয়টা অনর্থক তোমার জন্য কষ্টকর হয়ে গেল। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, ১২ টা ১০ থেকেই তুমি নামায পড়তে পার। আজানের আগেও নামায পড়া যায়। আজান হয় মূলত জামাতের জন্য। কিন্তু তুমি একা একা নামাযটা পড়ে নিলেও নামাযটা হয়ে যায়। তবে মসজিদের জামাতের নামাযে বেশি সওয়াব। তুমি ক্লাস ইত্যাদির কারণে জামাত পাচ্ছ না, কিন্তু নামায যেন কাযা না হয়। তাই ওয়াক্তের শুরুতেও পড়ে নিতে পারো।
তো দেখতে পেলে জোহরের সময় কত দীর্ঘ। চার রাকাত নামায পড়তে কতক্ষণ লাগে? ওযু করলাম দুই মিনিটে; এরপর চার রাকাত নামায আরো চার-পাঁচ মিনিটে। সব মিলে ছয়-সাত মিনিটের কাজ। এই পাঁচ ছয় মিনিট ব্যয় করে তোমার সম্পর্ক হয়ে গেল ঐ সাহাবা তাবেয়ীদের সাথে, যারা কখনো নামায ছাড়তেন না। এ সামান্য ছয় মিনিটের একটা আমল করে তুমি সে সকল সেরা লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলে। আর ঐ নামাযের পরই তুমি হাত তুলে দুআ করলে আল্লাহ তুমি আমার রেজাল্ট ভালো করে দাও। আমার জীবনটা সুন্দর করে দাও। যদি এটা বলতেই থাক তাহলে কি তোমার জীবনটা সুন্দর হবে না?
দেখ জোহরের সময় থাকে চার ঘণ্টা। অবশ্য সব সিজনে এই পরিমাণ সময় থাকে না। কিছু আগ পর হয়।
সত্যি কথা হল, যার নামায নেই তার মুসলমান হওয়ার পরিচয়পত্রই নেই। আমরা যতই পরিচয়পত্র সাথে রাখি না কেন! মূলত সে মুসলমানিত্বের পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলেছে।
দেখ, কোনো মুসলমানেরই এই খেয়াল থাকে না যে, নামায একেবারেই পড়বে না। সবার খেয়াল থাকে একটা সময় গিয়ে অবশ্যই নামায পড়বে। কিন্তু তখন আফসোস হবে- আহারে আগে কেন আলেমগণ আমাদেরকে বোঝাননি! আগে থেকে যদি আমি নামায পড়তাম তাহলে তো আমার নামায এমন কাযা হয়ে যেত না।
এই মজলিস থেকেই তোমরা প্রতিজ্ঞা করে, জীবনে কখনো নামায কাযা করব না। যদি কখনো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায় এবং ফজরের নামাযের সময় শেষ হয়ে যায়, তাহলে ঘুম থেকে ওঠার সাথেসাথেই ফজরের নামায পড়ে নিবে এবং এরপর আল্লাহর কাছে বল, আল্লাহ! সময়মত নামায পড়তে পারলাম না, তুমি মাফ করে দাও। যখন কোনো নামায ছুটে যাবে সেটা সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথে আদায় করে নিবে। এতে তোমার কাযা জমবে না। এখন থেকে যদি তোমরা সবগুলো নামায সময়মত পড়ে নাও তাহলে কাযার বোঝা জমবে না। এই পরামর্শটা অনেক উপকারী। বয়স্ক লোকেরা যখন নামায শুরু করে তখন তারা অনেক আফসোস করে, আগে কেন নামায শুরু করলাম না।
তোমাদের কেউ কেউ জানতে চেয়েছে- যে নামায কাযা হয়ে গেছে সেটার জন্য কী করবে?
এখন থেকে তোমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে, সামনে আর এক ওয়াক্ত নামাযও কাযা হতে না দেওয়া। পেছনের কাযা মাঝেমধ্যে পড়বে, সময় সুযোগ মত।
অনেক সময় বলা হয়, টি শার্ট পরেছি। পেছনে ছবি আছে। এজন্য মসজিদে যেতে পারছি না। বা প্যান্ট পরেছি। প্যান্ট পাক না। এজন্য নামায পড়ি না।
না, এটার জন্য তুমি নামায ছেড়ে দিও না। মসজিদে যাও। পারলে ছবিযুক্ত পোশাক ত্যাগ করো (এবং ত্যাগ করাই উচিত)। তা না করতে পারলে মসজিদ ত্যাগ করো না। তোমাদের জন্য এটা জরুরি না যে, নামাযের জন্য ভিন্ন পোশাক পরতে হবে। স্কুলে যাচ্ছ, কলেজে যাচ্ছ, কোচিং-এ যাচ্ছ, যখন যে পোশাকেই থাক, ওটা নিয়েই নামাযে চলে যাও।
অনেকের মনে সন্দেহ হয়, কাপড়ে হয়ত নাপাক থাকতে পারে। এই হয়ত থাকতে পারে এটা কিন্তু ঠিক না। এটা শয়তানের একটা ধোঁকা- ওয়াসওয়াসা। এটা শয়তানের একটা ফাঁদ। সে এর মাধ্যমে তোমাদেরকে নামায থেকে দূরে রাখতে চায়। এখানে সন্দেহের কিছু নেই। তুমি ধোয়া কাপড় পরেছ। এখন খামোখা সন্দেহ করবে কেন? পকেটে টিস্যু রাখবে। এটা তো পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা। যারা নামাযী মুসলমান তাদের বৈশিষ্ট্য তারা সবসময় পরিচ্ছন্ন থাকে। এটা কেমন লাগে যে, পেশাবের ফোঁটা আমার কাপড়ে পড়ে গেছে। এটা তো কাপড়ে জীবানু ছড়াতে পারে। একজন ভদ্র মানুষ হিসাবেও তো এটা খেয়াল রাখা দরকার।
আর একথাও জানা থাকা দরকার, এক ফোঁটা পেশাব লাগলেই কাপড় নামাযের অযোগ্য হয়ে যায় না। প্রথম কথা তো হল, শুধু ঐ জায়গাটুকু ধুয়ে নিলেই তো হয়। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে ঠেকার সময় কিন্তু এই ধরনের কাপড় নিয়েও নামায পড়া যায়। নামায সহীহ হয়ে যাবে। এত সামান্য পরিমাণ নাপাকী এমন নয় যে, তার কারণে একেবারে নামাযই সহীহ হবে না। পাক-নাপাকীর মাসআলাগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া দরকার। শয়তান নামায না পড়ার আরো অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করে। গোসল করা হয়নি। নামাযের জন্য তো গোসল জরুরি নয়। গোসল যখন ফরয হয় তখনই গোসল করা জরুরি। স্বপ্নদোষ হলে গোসল ফরয হয়। সুতরাং কয়েকদিন ধরে গোসল করি না- এই অজুহাতে নামায ছাড়া যায় না। যেখানেই থাক, একাকী থাক বা একত্রে সেখানেই নামায পড়ে নিবে।
মোটকথা তোমাদের নিকট আমার আবেদন, তোমরা স্কুলে-কলেজে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবে। তোমরা নামাযী হবে। নামাযের সময় হলে নামায পড়ে নিবে। যে মুসলমান নামায পড়ে না- সে ভালো, না যে নামায পড়ে সে ভালো? যে পড়ে সে ভালো। তাহলে তোমরা ভালো হতে চেষ্টা কর। তোমাদের জীবনের সফলতার জন্যে এটা জরুরি। এটা এখন থেকে যদি ধর তাহলে তোমাদের জীবন আলোকিত হবে, দামী হবে, সুন্দর হবে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন- আমীন। হ
পত্রস্থকরণ : এনামুল হাসান