Zilqad 1439   ||   August 2018

‘দান করেছি লুকমানকে হিকমাহ...’ : পুত্রের উদ্দেশে পিতার উপদেশ

Mawlana Muhammad Zakaria Abdullah

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

وَ اِذْ قَالَ لُقْمٰنُ لِابْنِهٖ وَ هُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشْرِكْ بِاللهِ  اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِیْم.

আর স্মরণ কর (ঐ সময়কে) যখন লুকমান তার ছেলেকে বলল -তখন সে তাকে উপদেশ দিচ্ছিল- হে আমার প্রিয় পুত্র! আল্লাহ্র সাথে শিরক করো না, নিঃসন্দেহে শিরক অতি বড় জুলুম।’ -সূরা লুকমান (৩১) : ১৩

এখানে প্রথম বিষয় হল, কুরআন মাজীদে হযরত লুকমান আ.-এর এই কথাটি বিশেষভাবে স্মরণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। পুত্রকে উপদেশ দেওয়া এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকার উপদেশ দেওয়া এই আয়াতের মূল বিষয়।

 

সন্তানকে পিতার উপদেশ

কুরআন মাজীদে হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত ইয়াকুব আ.-এর কথা উল্লেখিত হয়েছে।

সূরাতুল বাকারায় আছে-

وَ مَنْ یَّرْغَبُ عَنْ مِّلَّةِ اِبْرٰهٖمَ اِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهٗ  وَ لَقَدِ اصْطَفَیْنٰهُ فِی الدُّنْیَا  وَ اِنَّهٗ فِی الْاٰخِرَةِ لَمِنَ الصّٰلِحِیْنَ، اِذْ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗۤ اَسْلِمْ   قَالَ اَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ،  وَ وَصّٰی بِهَاۤ اِبْرٰهٖمُ بَنِیْهِ وَ یَعْقُوْبُ  یٰبَنِیَّ اِنَّ اللهَ اصْطَفٰی لَكُمُ الدِّیْنَ فَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَ اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ.

যে নিজেকে নির্বোধ করেছে সে ছাড়া ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ থেকে আর কে বিমুখ হবে? পৃথিবীতে আমি তাকে মনোনীত করেছি আর আখিরাতেও সে অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। 

তাঁর রব যখন তাকে বলেছিলেন, সমর্পিত হও সে বলেছিল, আমি রাব্বুল আলামীনের সকাশে সমর্পিত হলাম। এবং ইবরাহীম ও ইয়াকুব এর সম্বন্ধে তাদের পুত্রদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, হে পুত্রগণ! আল্লাহ্ই তোমাদের জন্য এই দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমাদের মৃত্যু যেন এমন অবস্থাতেই হয় যখন তোমরা মুসলিম। -সূরা বাকারা (২) : ১৩০-১৩২

ইবরাহীম আ.-এর বাবা মুসলিম ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুশরিক। মুশরিক পিতার ঘরে জন্মলাভকারী ইবরাহীম আ.-কে আল্লাহ তাআলা ঈমান ও ইসলামের হেদায়েত দান করেন এবং নবুওত ও রিসালাতের মহা মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। আল্লাহ্র মহান নবী হযরত ইবরাহীম আ. তাঁর পুত্রদের যে অসীয়ত করেছেন তা উপরোক্ত আয়াতসমূহে বর্ণিত হয়েছে। তিনি তাদের সেই মিল্লাত ও ধর্মাদর্শের অনুসরণ করার অসীয়ত করেছেন, যা তিনি আল্লাহ্র পক্ষ হতে প্রাপ্ত হয়েছেন।

উপরের আয়াতগুলোতে আমরা দেখছি, ইবরাহীম আ.-কে তাঁর রব ‘ইসলাম কবুলে’র আদেশ করেছেন আর তিনিও তাঁর সন্তানদের এই অসীয়তই করেছেন। প্রত্যেক মুসলিম বাবার জন্য এখানে আছে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত।

 

সন্তানদের ইসলামের উপর রাখার প্রয়াস নবীগণের বৈশিষ্ট্য

উপরের আয়াতগুলোতে শুধু ইবরাহীম আ.-এর অবস্থাই নয়, তাঁর পৌত্র ইয়াকুব আ.-এর অবস্থাও উল্লেখিত হয়েছে-

وَ وَصّٰی بِهَاۤ اِبْرٰهٖمُ بَنِیْهِ وَ یَعْقُوْبُ  یٰبَنِیَّ اِنَّ اللهَ اصْطَفٰی لَكُمُ الدِّیْنَ فَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَ اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ،

এবং ইবরাহীম ও ইয়াকুব এর সম্বন্ধে তাদের পুত্রদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, হে পুত্রগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এই দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমাদের মৃত্যু যেন এমন অবস্থাতেই হয় যে, তোমরা মুসলিম। -সূরা বাকারা (২) : ১৩২

এরপর মৃত্যুশয্যায় পুত্রদের প্রতি ইয়াকুব আ.-এর অসিয়ত কী দৃঢ় ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

اَمْ كُنْتُمْ شُهَدَآءَ اِذْ حَضَرَ یَعْقُوْبَ الْمَوْتُ اِذْ قَالَ لِبَنِیْهِ مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْۢ بَعْدِیْ  قَالُوْا نَعْبُدُ اِلٰهَكَ وَ اِلٰهَ اٰبَآىِٕكَ اِبْرٰهٖمَ وَ اِسْمٰعِیْلَ وَ اِسْحٰقَ اِلٰهًا وَّاحِدًا  وَّ نَحْنُ لَهٗ مُسْلِمُوْنَ.

 ইয়াকুবের নিকট যখন মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছিল তখন কি তোমরা উপস্থিত ছিলে? সে যখন পুত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার পরে তোমরা কীসের ইবাদত করবে? তারা তখন বলেছিল, আমরা আপনার ইলাহের এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের ইলাহের ইবাদত করব। তিনিই একমাত্র ইলাহ। আর আমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণকারী। -সূরা বাকারা (২) : ১৩৩

এখানেও ঐ বিষয়। সন্তানের দ্বীন-ঈমানের ব্যাপারে চিন্তা ও ব্যাকুলতা। সন্তান যেন ঈমানের উপর থাকে- তাওহীদের উপর থাকে- এই ফিকির ও প্রত্যাশা। হযরত ইয়াকুব আ.-এর সন্তানেরাও তাদের মহান পিতার এই ব্যাকুলতা ও কল্যাণচিন্তার কদরদানী করেছেন এবং পিতাকে আস্বস্ত করেছেন।

একজন দায়ীর জন্য আনন্দের ও প্রত্যাশার বিষয় হচ্ছে, তাওহীদ ও ঈমানের চেতনা মানুষের স্বভাবজাত। আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টি বান্দাদের স্বভাবের মাঝে রেখে দিয়েছেন। কাজেই দায়ী যখন সেই চেতনার দিকে উত্তম উপায়ে আহ্বান জানায় তখন তা গ্রহণের জন্য মাদউ তার ভেতর থেকেই তাড়না বোধ করে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فَاَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّیْنِ حَنِیْفًا،  فِطْرَتَ اللهِ الَّتِیْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیْهَا.

সুতরাং তুমি নিজকে এই দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত কর একনিষ্ঠভাবে। আল্লাহর সেই ফিতরত (অনুযায়ী চল), যে ফিতরতের উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। -সূরা রূম (৩০) : ৩০

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মনীষীগণ আলোচনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা মানবশিশুকে সত্য দ্বীন অর্থাৎ তাওহীদ ও ইসলাম কবুলের যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। পরবর্তীতে পারিপাশির্^ক বিভিন্ন কারণে সে সত্য দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়। (দ্র. তাফসীরে কুরতুবী ১৪/২৯)

হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلّا يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ وَيُنَصِّرَانِهِ وَيُمَجِّسَانِهِ، كَمَا تُنْتَجُ الْبَهِيمَةُ بَهِيمَةً جَمْعَاءَ، هَلْ تُحِسّونَ فِيهَا مِنْ جَدْعَاءَ؟

 প্রত্যেক মানবশিশু ফিতরাতের উপর (অর্থাৎ সত্যদ্বীন গ্রহণের যোগ্যতা নিয়েই) জন্ম লাভ করে। এরপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদী বানায় কিংবা নাসরানী বানায় কিংবা অগ্নিপুজারী বানায়। যেমন পশু নিখুঁত শাবক জন্ম দেয়। ওদের মধ্যে তোমরা কি কোনো কান-কাটা শাবক দেখতে পাও?

হযরত আবু হুরায়রা রা. এই হাদীস বয়ান করার পর বলতেন ইচ্ছে হলে তোম্রা (কুরআনের এই আয়াত) পড়তে পার-

فِطْرَتَ اللهِ الَّتِیْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَیْهَا  لَا تَبْدِیْلَ لِخَلْقِ اللهِ.

 অর্থাৎ এই আয়াতেও একথা আছে।

-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৫৮

মানুষের স্বভাবের মাঝেই যেহেতু সত্যগ্রহণের যোগ্যতা রয়েছে তাই দায়ীদের কর্তব্য সেই যোগ্যতাকে জাগ্রত ও বিকশিত করার চেষ্টা করা। বাবা-মায়ের কর্তব্য, সন্তানের দ্বীন ও ঈমান কবুল করার যোগ্যতাকে জাগিয়ে তোলা এবং তাকে দ্বীন ও ঈমানের পথে পরিচালিত করা।

বাবা হিসাবে আমরা সাধারণত যে দায়িত্বটুকু পালনের চেষ্টা করে থাকি সেটা হল সন্তানের জাগতিক উন্নতির চেষ্টা। সন্তান যেন শিক্ষা-দীক্ষা অর্জন করে, আয়-উপার্জন করে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়, জীবনটা সুখে-স্বাচ্ছন্দে কাটাতে পারে, সন্তানের জন্য এসব চিন্তা আমরা করি। এই চিন্তার সবটা দোষের নয়, চিন্তাটা যদি এভাবে হয় যে, আমার সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হোক, তার চরিত্র ও মানবিকতা বিকশিত হোক, হালাল উপার্জনের যোগ্যতা অর্জন করুক তাহলে সেটাই হয় মুসলিম সুলভ চিন্তা।

আমাদের শুধু বাবা হলে চলবে না, মুসলিম বাবা হতে হবে। এখানেই সাধারণত বড় ভুলটি হয়ে যাচ্ছে। সন্তানের উন্নতির চিন্তা করা হয়, কিন্তু কোন্ উন্নতি? শুধু বৈষয়িক উন্নতি? না চিন্তা-চেতনা ও মানবিকতারও উন্নতি, আয়-উপার্জনের চিন্তা করা হয়, কিন্তু কোন্ আয়-উপার্জন? হালাল আয়-উপার্জন, না যে কোনো প্রকারের আয়-উপার্জন? সন্তান খেয়ে-পরে বেঁচে থাকুক। কিন্তু কী খেয়ে? কী পরে? হালাল খেয়ে-পরে, না হারাম খেয়ে-পরে? এই বিষয়টাও একজন বাবাকে চিন্তা করতে হবে। তার বড় চিন্তা সন্তানের দ্বীনদারি, ঈমানদারিকে কেন্দ্র করে  আবর্তিত হতে হবে। আল্লাহর নবী হযরত ইয়াকুব আ.-এর জীবনে আমরা এই নমুনা পাচ্ছি যে, কেমন হবে একজন ঈমানদার বাবার চিন্তা। এতে কিয়ামত পর্যন্ত সকল বাবার জন্য শিক্ষা ও আদর্শ রয়েছে।

সূরা লুকমানে হযরত লুকমান আ.-এর যে বক্তব্য উল্লেখিত হয়েছে, সেটিও একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত। এখানে লুকমান আ. তাঁর সন্তানকে শিরক থেকে বেঁচে থাকার উপদেশ দিচ্ছেন।

یٰبُنَیَّ  لَا تُشْرِكْ بِاللهِ اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِیْم.

তো প্রত্যেক বাবা ও অভিভাবকের কর্তব্য, সন্তানকে ঈমান শেখানো এবং দ্বীন ও ঈমানের উপর পরিচালিত করা।

 

সন্তানকে উপদেশ দিন

আমরা অনেকেই অন্য মানুষকে উপদেশ দেই। সন্তানকে উপদেশ দেই না। বাইরে কত নসীহত-উপদেশ চলতে থাকে, কিন্তু ঘরে এই বিষয়টাকে গৌণ মনে করা হয়। মনে করা হয়, এরা তো আমারই আপনজন, এদেরকে ওয়ায করি কীভাবে? অনেকের তো ঘরে সালাম দিতেও লজ্জা লাগে। স্ত্রীকে, ছেলে-মেয়েকে সালাম দেয় কীভাবে? কিন্তু সালাম তো দুআ, শুভকামনা।

السلام عليكم ورحمة الله وبركاته

তোমাদের উপর শান্তি ও নিরাপত্তা, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।

সালাম যখন শুভকামনা, তো শুভকামনার বেশি হকদার কে? শুভকামনার বেশি হকদার  তো তারাই, যারা বেশি আপন। কাজেই ঘরেও সালামের রীতি গড়ে তুলতে হবে।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আনাস ইবনে মালেক রা.-কে বলেছেন, বেটা, তুমি যখন ঘরে যাবে, তখন ঘরের লোকদের সালাম দিবে।

يكن بركة عليك وعلى أهل بيتك

এটা তোমার জন্য এবং তোমার পরিবারে জন্য বরকতের ব্যাপার হবে।

তো সালাম-কালাম, নসীহত-উপদেশ, আমর বিলমা‘রূফ, নাহি আনিল মুনকার ইত্যাদির সবচেয়ে বেশি হকদার আমার পরিবার, আমার স্ত্রী-কন্যা, পুত্র-পরিজন। কারণ এগুলো হচ্ছে শুভকামনা ও কল্যাণকামিতা। আর শুভকামনা ও কল্যাণকামিতার বেশি হকদার তো সেই, যে আমার বেশি নিকটের, বেশি আপনার।

তো وَ هُوَ یَعِظُهٗ লুকমান হাকীম তার সন্তানকে উপদেশ দিচ্ছেন। বাবা সন্তানকে উপদেশ দিতে হবে। স্বামী স্ত্রীকে উপদেশ দিতে হবে। বড় ভাই ছোট ভাইকে দিতে হবে। পরিবারে উপদেশ দেওয়ার ধারা অব্যাহত থাকতে হবে। উপদেশ, ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজ থেকে নিষেধ এইসব বিষয়ের চর্চা যদি পরিবারে থাকে, তাহলে পরিবারে খায়র ও বরকত হবে।

 

উপদেশের ভাষা ও পদ্ধতি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আদেশ-উপদেশের ভাষা কী হবে, পন্থা ও পদ্ধতি কী হবে?

এখানে দেখুন, লুকমান হাকীম তার পুত্রকে কোন ভাষায় উপদেশ দিচ্ছেন? তিনি সন্তানকে সম্বোধন করছেন- یٰبُنَیَّ বলে। আরবী ভাষায় َّ يابُنَی শব্দের অর্থ, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র’, ‘আমার আদরের সন্তান’। তাহলে উপদেশের সময় সুন্দর  ও কোমল ভাষা ব্যবহার করা উপদেশের একটি আদব, যা কুরআন মাজীদে বর্ণিত হয়েছে।

বাবা যখন সন্তানকে উপদেশ দিচ্ছেন, ঐ সময় বাবার ভাষাটা কোমল হতে হবে, সম্বোধনটা মধুর হতে হবে। তদ্রƒপ সন্তান যখন বাবাকে দ্বীনী বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তখন সন্তানের ভাব ও ভাষা হতে হবে সম্মানপূর্ণ, সম্বোধনটা হতে হবে আদবপূর্ণ। হযরত ইবরাহীম আ. যখন তার বাবাকে তাওহীদের কথা বলেছেন তখন তাঁকে সম্বোধন করছেন- يا أبت বলে। يا أبت সম্বোধনটা আদবপূর্ণ, তাজিমপূর্ণ। أب মানে বাবা, يا أبي হে আমার বাবা। কুরআন বলছে- يا أبت । আরবী ভাষায় يا أبت সম্বোধনটা তাযিমপূর্ণ সম্বোধন। ‘আব্বাজান’, ‘হে আমার সম্মানিত পিতা’।

ইবরাহীম আ. যখন তার বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, তখন বলছেন, يا أبت। লুকমান আ. যখন তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছেন তখন বলছেন- يا بني। এখান থেকে সাধারণ যে নিয়মটি বের হয়ে আসে তা হচ্ছে, উপদেশ দেওয়ার সময়, বিশেষত আপনজন প্রিয়জনদের কাউকে উপদেশ দেওয়ার সময় ভাষা খুব কোমল ও মসৃণ হওয়া উচিত। স্নেহের পাত্র হলে সম্বোধনে স্নেহ থাকা চাই। মর্যাদার পাত্র হলে সম্বোধনে আদব-তাযিম থাকা চাই। এটা ইসলামী দাওয়াতের আদব।

অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারে এই ইসলামী আদবগুলো রক্ষা করতে আমাদের সংকোচ হয়। বাইরে অন্যান্য মানুষের সাথে ভালো আচরণ করি,  সৌজন্য-শিষ্টাচার রক্ষা করি, কিন্তু পরিবারে তা রক্ষা করার তাগিদ বোধ করা হয় না।

এই রকম ব্যাপার অনেক পরিবারেই শোনা যায়। অন্যের ছেলেকে পড়ানোর সময় একরকমের আচরণ হয়, নিজের ছেলেকে পড়ানোর সময় অন্য রকম আচরণ হয়। অন্যের ছেলেকে পড়ানোর সময় কত সোহাগভরা শব্দ ব্যবহার করা হয়, একবার বুঝছে না, কয়েকবার বুঝানো হয়, আদর করে শেখানো হয়, কিন্তু নিজের ছেলেমেয়েকে শেখানোর সময় একবার-দু’বার, এরপরই মেযাজ গরম হয়ে যায়। এইটুকু হলেও তো একটা কথা ছিল; বরং  এই গরমটা তো কথা ও কাজের মধ্যে দিয়েও বইতে শুরু করে। এটা কেন হয়? হয়ত বা এইজন্য হয় যে, নিজের সন্তানকে একেবারে নিজের সাথে বাঁধা মনে করা হয়। ওর সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করলেও জিজ্ঞাসা করার কেউ নেই- এমনটা ভাবা হয়। কিন্তু অন্যের ছেলে তো অন্যের ছেলে। তার সাথে উল্টো আচরণ করা হলে প্রশ্ন করার লোক আছে। তার অভিভাবক এসে প্রশ্ন করবে। কিন্তু নিজের ছেলের সঙ্গে মন্দ আচরণ করলে তো জিজ্ঞাসা করার কেউ নেই। তারও যাওয়ার জায়গা নেই। হয়ত এইজন্য হয় কিংবা অন্য কোনো কারণে হয়। হাঁ, বিপরীতও আছে। নিজের সন্তানের ব্যাপারে অন্যায় পক্ষপাতেরও একটা ব্যাপার আছে। সেটা অন্য ক্ষেত্রে হয়। দেখুন, আমাদের আচরণগুলো কত অগোছালো।

তো দাওয়াতের সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, আপনজনকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার সময় কথা ও আচরণ বেশি কোমল হতে হবে। কারণ, আপনার কাছে আপনার আপনজনের দাবিটা একটু বেশি। এই দাবির লেহাজ করতে হবে। তাছাড়া সন্তানের হকও তো বেশি। ছাত্রের চেয়ে সন্তানের হক বেশি না? আপনি যখন আপনার সন্তানকে পড়াচ্ছেন, দ্বীন শেখাচ্ছেন তখন আপনার কাছে তার ছাত্র হিসাবে এক হক, সন্তান হিসেবে আরেক হক। সাধারণ ছাত্রের যদি এক হক থাকে, সন্তান ছাত্রের দুই হক। কাজেই ছাত্রের সাথে যদি কোমল ব্যবহার কাম্য হয়, সন্তানের সাথে তা দ্বিগুণ কাম্য। একজন সাধারণ মুসলিমকে দাওয়াত দেওয়ার সময় যদি কোমল আচরণ জরুরি হয়, তাহলে  স্ত্রীকে দাওয়াত দেওয়ার সময় কোমল আচরণ দ্বিগুণ জরুরি। কারণ স্ত্রী হিসেবে তার বাড়তি হক রয়েছে। অথচ বিপরীতটাই বেশি হয়। সামাজিক ক্ষেত্রেও দেখা যায়, অন্যের সাথে আচরণ এক রকম, আর আত্মীয় হয়ে গেলেই, অধীনস্ত বা সংশ্লিষ্ট হয়ে গেলেই যেন অপরাধ হয়ে গেল! এখন তার যোগ্যতা, সীমাবদ্ধতা, তার দোষ-গুণ ও দুর্বলতাগুলোর লেহাজ করার যেন কোনো প্রয়োজনই নেই!

لاحول ولا قوة إلا بالله

আরেকটা ব্যাপারও হয়, দেখা যায় যে, সাধারণ আচরণের সময় কোমল আচরণ হচ্ছে, কিন্তু শেখাবার সময় আচরণটা কঠোর হয়ে যায়। অথচ সাধারণ অবস্থায় আচরণ যদ্দুর কোমল হবে শেখাবার সময়, দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার সময় আচরণটা আরো বেশি কোমল হওয়া উচিত। যেন সন্তান এই অনুভূতি লাভ করে যে, শেখাবার সময়টাই হচ্ছে বাবার শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময়ই তিনি সবচেয়ে আনন্দিত থাকেন। ফলে শেখাবার প্রসঙ্গ যখন আসবে তখন সে আনন্দিত হয়ে উঠবে। আপনার কাছ থেকে গ্রহণ করতে আরো বেশি উৎসাহিত হবে।

একটা অভিযোগ প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায় যে, ‘ছেলেকে দ্বীনের কথা বলি, ছেলে তো শোনে না।’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার না শোনার দায় কিছুটা আমার উপরও আসে বৈকি? আমি যদি তাকে সুন্দর করে না বলি, অধীনস্ত মনে করে খালি দোষ দিয়ে দিয়ে বলি, তাহলে সে শুনবে কীভাবে? দোষ দিয়ে দিয়ে বললে কার শুনতে ইচ্ছে করে? তো নিয়ম হল দাওয়াতের সময়, তা‘লীমের সময় সন্তানের প্রতি আপনার আদর সোহাগ, বাৎসল্য বেশি প্রকাশ পেতে হবে।

সন্তানের প্রতি আপনার আদরটা শুধু মনের মধ্যেই পুষে রাখবেন না, কিছু কিছু প্রকাশও করবেন। বিশেষত দাওয়াতের ক্ষেত্রে, তা‘লীমের ক্ষেত্রে। কুরআন মাজীদ কিন্তু আমাদের তা শেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা এই আদবগুলো রক্ষা করি না বলে এর সুফলও পাই না।

 

সন্তানকে যুক্তি দিয়ে বোঝান

লুকমান হাকীম আদর-স্নেহের সাথে কী বলেছেন-

لَا تُشْرِكْ بِاللهِ اِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِیْم.

‘আল্লাহর সাথে শিরক করো না। শিরক তো বড় অবিচার।’

অনেক অবিচার মানুষ উপলব্ধি করে, কিন্তু শিরক যে মহা অবিচার, এটা অনেকেরই উপলব্ধিতে জাগে না। অবিচার কী? একজনের হক আরেকজনকে দেওয়া অবিচার। যে যার সমকক্ষ নয় তাকে তার সমকক্ষ বানানো অবিচার। যে যেই স্থানের নয় তাকে ঐ স্থানে উঠানো অবিচার। যে যেই স্থানের তাকে ঐ স্থান থেকে নামানো অবিচার। যে বিষয়টাকে যে পর্যায়ে রাখা উচিত, ঐ বিষয়টাকে ঐ পর্যায়ে না রাখা অবিচার।

তো ইবাদত-বন্দেগী  কার হক? আল্লাহ্র হক। বন্দেগী ও উপাসনার একমাত্র হকদার আল্লাহ তাআলা। তিনিই একমাত্র সত্য মা‘বুদ, সত্যিকারের উপাস্য। এই জগৎ-মহাজগৎ তিনিই সৃষ্টি করেছেন। তাঁর আদেশেই সব কিছু হয়। কাজেই মানুষের সর্বোচ্চ সম্মান, সর্বোচ্চ তাযিম পাওয়ার হকদার একমাত্র আল্লাহ।

উপাসনা তো চূড়ান্ত তাযিম। এর উপরে আর কোনো তাযিম নেই। সালাম, মুসাহাফা, আদব-লেহাজ এগুলো বিভিন্ন পর্যায়ের তাযিম, যা এক মানুষ আরেক মানুষের জন্য করতে পারে। কিন্তু ইবাদত ও উপাসনা এটা শুধু আল্লাহ্র জন্য, কোনো মাখলুকের জন্য তা হতে পারে না। আল্লাহ তাআলাই খালিক ও ¯্রষ্টা। তিনিই রাযযাক ও রিযিকদাতা। তিনিই কাদীর, আলীম-সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী। তিনিই সব গুণে গুণান্বিত। বান্দার প্রতি তাঁর অনুগ্রহই প্রকৃত ও নিরঙ্কুশ। কাজেই সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত তাযিম, ইবাদত ও উপাসনার তিনিই হকদার। তিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদত-উপাসনার হকদার নয়। কাজেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা হলে সেটা হবে অবিচার। বড় অবিচার।

কুরআন মাজীদ মূল কথাটি বলে দিয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত যুক্তি, বুদ্ধি এবং প্রগতি ও প্রযুক্তির যতই উন্নতি হোক এর চেয়ে বড় কথা আর কিছুই হবে না। ইবাদত ও উপাসনা একমাত্র আল্লাহ্র হক। এই হক যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে দেওয়া হয়, সেটা হবে অবিচার।

লুকমান হাকীম তাঁর সন্তানকে উপদেশ দিয়েছেন যুক্তির সাথে। যে যুক্তি কোনো বিবেকমান মানুষই রদ করতে পারে না।

 

উপদেশের বিষয়বস্তু

লুকমান আ.-এর উপদেশ থেকে উপদেশের বিষয়বস্তু সম্পর্কেও নির্দেশনা গ্রহণ করা যায়। তিনি সন্তানকে সবার আগে উপদেশ দিয়েছেন ঈমানের, তাওহীদের। শিরক থেকে বেঁচে থাকার। এটাই তার প্রথম উপদেশ। এখান থেকে বোঝা যায়, সন্তানকে কোন্ বিষয়টা আগে শেখাবেন। সবার আগে ঈমান শেখাতে হবে। তাওহীদ ও শিরকের পরিচয় দিতে হবে। তাওহীদকে ধারণ করার ও শিরক থেকে বেঁচে থাকার উপদেশ দিতে হবে। কারণ ঈমানই সবার আগে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement