Shawal 1439   ||   July 2018

এবারের রমযানে কি আমরা আসলেই একা হয়ে গেলাম?

Mawlana Muhammad Abdul Malek

(সা ক্ষা ৎ কা র : রমযান ১৪৩৯ হিজরী)

সায়ীদুল হক : আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক : ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

সায়ীদ : হেলাল প্রসঙ্গে তো হুযূর অনেক কিছু লিখলেন। আলকাউসারেও ছেপেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও সাড়ে ছয়শত পৃষ্ঠার দলীল জমা করলেন। তারপরেও দেখি মানুষের বিভিন্ন প্রশ্ন। অনুমতি হলে কিছু বিষয় হুযূরের সামনে পেশ করি।

আবদুল মালেক : জী, বলুন।

সায়ীদ : প্রথম কথা হল, এবার আমরা একেবারে একা পড়ে গেলাম। এমনকি হিন্দুস্তানে বৃহস্পতিবার (১৭ মে ২০১৮ তারিখে) পয়লা রোযা হল। শুধু আমরাই একা পড়ে গেলাম; আমাদের রোযা শুরু হল জুমাবার।

আবদুল মালেক : আমাদের আমল যদি হাদীস ও ফিক্হ অনুযায়ী হয়ে থাকে, শরীয়তের হুকুম মোতাবেক হয়ে থাকে তাহলে আমরা একা হওয়ায় অসুবিধার কী হল? আমরা তো-

فَإِنْ غُمّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا العِدّةَ ثَلاَثِينَ

-এই মুতাওয়াতির হাদীসের উপর আমল করেছি। আসলে কিন্তু আমরা একা হয়ে গিয়েছি এমন নয়। যদি এই অর্থে একা বলে থাকেন যে, আর কোনো দেশে জুমাবার রোযা শুরু হয়নি, সবার রোযা আগেই শুরু হয়েছে তাহলেও আমরা একা  নই। জুমাবার রোযা তো শ্রীলংকায়ও শুরু হয়েছে।

المشروع الإسلامي لرصد الأهلة

(ICOP)-এর সাইটে বিষয়টি উল্লেখ আছে। তাছাড়া আমরা একা এই জন্য নয় যে, অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলো যা করেছে আমরাও তাই করেছি। তারাও স্থানীয় হেলাল হিসেবে আমল করেছেন, আমরাও স্থানীয় হেলাল হিসেবে আমল করেছি। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে-

إِنّ اللّهَ جَعَلَ الْأَهِلّةَ مَوَاقِيتَ لِلنَاسِ، فَصُومُوا لِرُؤْيَتِهِ، وَأَفْطِرِوَا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنْ غُمّ عَلَيْكُمْ فَعُدّوَا لَهُ ثَلَاثِينَ يَوْمًا.

(মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীস ৭৩০৬, সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৯০৬, মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৫৩৯, সুনানে বাইহাকী ৪/২০৫)

অর্থাৎ, হেলাল না দেখে রোযা শুরু করবে না। হেলাল আড়ালে পড়ে গেলে ত্রিশের গণনা পূর্ণ করবে। আমরা সবাই কিন্তু এই হাদীসের উপরেই আমল করেছি। যে দেশগুলোতে বুধবারে সন্ধ্যায় হেলাল দেখা গিয়েছে তারা বৃহস্পতিবার রোযা শুরু করেছে। বুধবার সন্ধ্যায় যাদের হেলাল আড়ালে পড়ে গেছে তারা শাবান মাস ত্রিশ পুরা করে জুমাবার রোযা শুরু করেছে। তাহলে আমরা একা হলাম কোথায়। আমরাও অন্যদের মত স্থানীয় দেখা হিসেবে আমল করেছি এবং সবাই এই হাদীসের উপর আমল করেছে।

আপনি বিভিন্ন দেশের হেলালের ফায়সালাগুলো পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে কিন্তু বলা আছে, মঙ্গলবার তাদের স্থান হিসেবে ২৯ শাবান সন্ধ্যায় তাদের সেখানে হেলাল দেখা প্রমাণিত হয়নি। তাই শাবান ত্রিশদিন পূর্ণ করে বৃহস্পতিবার রোযা শুরু হবে। এ ধরনের বিবরণ দেখতে পারেন সৌদির সুপ্রীম কোর্টের ঘোষণায় এবং মিশরের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার ঘোষণায়। মরক্কো এবং পাকিস্তানে আমাদের মত বুধবারেই ছিল ২৯ শাবান। তাদের ঘোষণায় এসেছে আমাদের এখানে বুধবার সন্ধ্যায় হেলাল দেখা প্রমাণিত হয়েছে। তাই  বৃহস্পতিবার প্রথম রোযা হবে। বুঝা গেল সবাই কিন্তু স্থানীয় হেলাল হিসেবেই আমল করেছে। আমরাও তাই করেছি।

বুধবার ২৯ শাবান সন্ধ্যায় আমাদের এখানে হেলাল দেখা প্রমাণিত হয়নি। তাই শাবান-এর ৩০ দিন পুরা করে জুমাবার আমরা রোযা শুরু করেছি। তাহলে আমরা একা হলাম কীভাবে?

সবাই যেই নীতি এবং মাসআলার উপর আমল করেছেন আমরাও তাই করেছি।

সায়ীদ : তারপরও তো মনে মানার একটা বিষয় আছে না? সবাই বলে ৩২টির মতো দেশে বৃহস্পতিবার রোযা শুরু হল আমরা ঐ দিন শুরু করতে পারলাম না। একদিন পিছিয়ে পড়লাম!

আবদুল মালেক : আসলে মনকে শরীয়তের বিধানের অনুগামী বানাতে হবে। এ নীতি অবলম্বন করলেই মন না মানতে চাইলেও ইনশাআল্লাহ মেনে যাবে। দেখার বিষয় হল, আমাদের এ কাজ শরীয়তের মাসআলা হিসেবে সঠিক হয়েছে কি না। হয়ে থাকলে আপত্তির কোনো সুযোগ নেই।

আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন :

যারা বৃহস্পতিবার রোযা শুরু করেছেন তারা কি পিছে পড়েননি? আপনার কি জানা আছে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়ও আমেরিকা ও আফ্রিকার কিছু জায়গায় হেলাল দেখা গিয়েছে এবং পৃথিবীর ৭টি দেশে বুধবার প্রথম রোযা হয়েছে। এখান থেকে আমাদের ছবক হাছিল করা উচিত। আমাদের অনেকেই যে সারা বিশ্বে একই দিনে রোযা ও ঈদের স্বপ্ন দেখে থাকেন তাদের এ চিন্তা কত বাস্তববিরোধী এবং যারা আপত্তি করে থাকে যে, বাংলাদেশ সব সময় সৌদি থেকে পিছে থাকে তাদেরও বুঝা দরকার যে, খোদ সৌদিও অনেক সময় অন্য এলাকা থেকে পিছিয়ে থাকে।

এবার সৌদিতে প্রথম রোযা হল বৃহস্পতিবার। অথচ বিভিন্ন দেশে বুধবারেই প্রথম রোযা হয়েছে। আর এটা কিন্তু স্বাভাবিক একটি বিষয়। কারণ হেলালের সর্বপ্রথম দেখা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যে নয় বরং তা বেশিরভাগ হয়ে থাকে একেবারে পশ্চিম প্রান্তে।

সায়ীদ : মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কোথায় হেলাল দেখা গিয়েছে?

আবদুল মালেক : এ প্রশ্নের জবাবে আমি কিছু না বলে দুটি ডকুমেন্ট দিয়ে দিচ্ছি। আপনি দেখে নিন। প্রথমটি হল-

Islamic jurisprudence council of Minnesota-এর, যার বক্তব্য হুবহু হল-

تحديث بخصوص بداية شهر رمضان ১৪৩৯ هـ في ولاية مينيسوتا و عموم أمريكا.

الحمد لله، والصلاة والسلام على رسول الله وبعد :

وصلتنا أخبار قبل قليل أن الهلال رؤي في كاليفورنيا ووردت ثلاث شهادات أحدها من دكتور في علم الفلك، اسمه أحمد سلامة، رآه بالمنظار ورآه معه فضيلة الشيخ محمد فقيه، إمام مسجد مقاطعة أورنج كاونتي بكاليفورنيا وشخص ثالث.

وفي نفس الوقت وصلت أخبار من دولتى ساحل العاج ومالي أن الهلال رؤي فيهما، وبناء عليه فإن أول أيام شهر رمضان المبارك هو يوم الأربعاء ১৬ مايو ২০১৮، وقد عدل المجلس الفقهي لولاية مينيسوتا بيانه السابق وأعلن أن الأربعاء هو أول رمضان بناء على الرؤية الشرعية، كذلك أعلن مجمع فقهاء الشريعة أن الأربعاء هو أول رمضان، وبالله التوفيق.

Update concerning the beginning of Ramadan, Praise be to Allah and peace and blessings upon the prophet Pbuh. We just got the news a little while ago, that the crescent moon was sighted in california, three witnesses have seen it. Among them Dr ahmed salam, a professor of Astronomy And Sheikh Mohamed al Fakih Imam of Masjid Orange County. In the same time news has been reported that the crescent moon was also sighted in Mali and Cote.d’ivoire.

Base on these news the first day of Ramadan is wednesday May 16th 2018. The IJCM rectifies its earlier announcement to confirm that the 1st day of Ramadan is wednesday May 16th 2018. Also the AMJA (The Assembly of Muslim jurist of America) based in Houston Texas, has announced that the first day of Ramadan is Wednesday May 16th 2018. And with Allah swt AtTawfeeq.

এতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ক্যালিফোর্নিয়াতে হেলাল দেখা গিয়েছে। তিনজন ব্যক্তি হেলাল দেখার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যাদের মধ্যে একজন জ্যোতির্বিদ ও একজন ইমামও রয়েছেন।

এ সন্ধ্যায় আইভরিকোস্ট ও মালিতেও হেলাল দেখার সংবাদ পাওয়া গিয়েছে।

শরয়ী নীতিমালা অনুযায়ী হেলাল দেখা প্রমাণিত হওয়ায় IJCM (Islamic jurisprudence council of Minnesota) এবং AMJA (The Assembly of Muslim jurist of America)  বুধবার ১৬ মে ২০১৮ প্রথম রোযা হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

দ্বিতীয় ডকুমেন্টটি হলো ‘ইত্তেহাদে ওলামায়ে আফ্রিকা’র, যার হুবহু বক্তব্য এই-

الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على خاتم الأنبياء والمرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين،أما بعد:

فقد اطلعت لجنة الفتوى والإرشاد على الأخبار الواردة عن أعضاء الاتحاد بثبوت رؤية هلال شهر رمضان مساء الثلاثاء التاسع والعشرين من شعبان في كل من جمهورية كوت ديفوار (ساحل العاج) وجمهورية مالي.

وعليه يكون يوم الأربعاء أول رمضان لعام ১৪৩৯ هـ ولجنة الفتوى والإرشاد تهنئ المسلمين في أفريقيا وفي ربوع العالم بحلول الشهر الكريم، ونسأل الله جل وعلا أن يتقبل من الجميع صالح الأعمال، وصلى الله على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.

رئيس لجنة الفتوى والإرشاد

الدكتور محمد أحمد لوح

এতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আইভরিকোস্ট ও মালিতে হেলাল দেখা প্রমাণিত হওয়ায় ‘লাজনাতুল ফাতওয়া ওয়াল ইরশাদ’ বুধবার প্রথম রমযান হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

সায়ীদ :  বুধবার কোন্ কোন্ দেশে প্রথম রোযা হয়েছিল?

আবদুল মালেক : ICOP-এর সাইটে তো ৭টি দেশের নাম লেখা আছে। বসনিয়া হার্জেগোভিনা, নাইজার, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, আইভরিকোস্ট, মালি, ম্যাকডোনিয়া। আমেরিকার অনেক জায়গাতে বুধবার রোযা শুরু হয়েছে তা কিন্তু এ তালিকাতে উল্লেখ করা হয়নি। অথচ আমেরিকা প্রবাসী আমাদের বন্ধুদের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, সেখানে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হেলাল দেখার যে ডকুমেন্ট পেশ করা হল, তার ভিত্তিতেই তারা বুধবার প্রথম রোযা রাখে।

মুনসাইটিং ডট কম -এর মধ্যেও বলা হয়েছে যে, আমেরিকায় ক্যালিফোর্নিয়াতে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা গিয়েছে। (Moonsighting.com)  

সায়ীদ : হুযূরের আলোচনায় আলহামদু লিল্লাহ অনেক কিছুই স্পষ্ট হল। জাযাকুমুল্লাহ খাইরান। কিন্তু আমরা না বলি মাতলা‘ (উদয়স্থল) এক হলে এক জায়গার হেলাল দেখা অন্য জায়গার জন্য প্রযোজ্য। তাহলে দেওবন্দের সাথে আমাদের মাতলা‘ -এর কি মিল নেই? আমরা তো জানতে পারলাম, সেখানে নাকি বুধাবার চাঁদ দেখা গিয়েছে এবং বৃহস্পতিবার রোযা শুরু হয়েছে। মাতলা‘ এক হয়ে থাকলে সে দেখার ভিত্তিতেই তো আমরা বৃহস্পতিবার রোযা শুরু করতে পারতাম।

আবদুল মালেক : বুধবার সন্ধ্যায় দেওবন্দে হেলাল দেখা গিয়েছে এ কথা কে বলল? শুধু দেওবন্দ নয় হিন্দুস্তানের অধিকাংশ জায়গায় হেলাল দেখা যায়নি। হিন্দুস্তানের একেবারেই উপকূলীয় অঞ্চলে- কোথাও কোথাও হেলাল দেখা গিয়েছে। সে ভিত্তিতে হিন্দুস্তানের হেলাল বিষয়ক আঞ্চলিক জিম্মাদারদের অনেকে বৃহস্পতিবার রোযা শুরু হওয়ার ফায়সালা করেছেন।

একে তো আমরা ঐ জিম্মাদারদের ফয়সালার অধীনে নই। দ্বিতীয়ত যে হেলালের ভিত্তিতে তারা ফয়সালা করেছেন সেই হেলালের মাতলা‘ অধিকাংশ সময়ে আমাদের মাতলা‘ থেকে আলাদা হয়ে থাকে।

তাহলে একই মাতলা‘ -এর হেলাল, তাও আমরা সে অনুযায়ী আমল করিনি- এমন ধারণা ঠিক নয়।

তাছাড়া হেলালের মাতলা‘ এক হওয়াই তো যথেষ্ট নয়। বরং তার খবর/শাহাদাত (যে ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য) যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সামনে উপস্থাপিত ও প্রমাণিত হওয়া জরুরি।

সায়ীদ : হেলাল বিষয়ক হুযূরের লেখাগুলোতে যে কথাটি বারবার এসেছে সেটা হল, হানাফী মাযহাবের রাযেহ এবং মামূল বিহী মাছলাক হল, اختلاف مطالع -এর এ‘তেবার আছে। অর্থাৎ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য। তাই অনেক দূরের কোনো জায়গার হেলাল দেখার ভিত্তিতে রোযা-ঈদ করা যায় না। শুনেছি অনুসৃত পদ্ধতির সমর্থক আহলে হক ওলামার পক্ষ থেকে যে দলিল পেশ করা হয়েছে তাতে তিনশরও অধিক হাওয়ালা  (রেফারেন্স) পেশ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বহিঃর্বিশ্বে আপনার কিছু সফরও হয়েছে। এক্ষেত্রে এ বিষয়ক নতুন কোনো কিতাবের কোনো হাওয়ালা পেয়েছেন কি না?

আবদুল মালেক : এত বড় আজীব সুওয়াল! এর মানে কি সফরের আগে যতগুলো হাওয়ালা পেয়েছি সব দলীলে লিখে দিয়েছি? কত হাওয়ালা আমাদের কাছে রয়েছে, যা উপস্থাপিত সে কিতাবে উল্লেখ করা হয়নি। সফরের আগে পরে বা সফরের সময় পুরনো পুরনো অনেক হাওয়ালাই সামনে আসছে। এ-ই তো কিছুদিন আগে আমাদের ছাত্ররা পাঠালেন- জামালুদ্দীন হাসীরী রাহ.-এর কিতাব خير مطلوب في العلم المرغوب (খাইরু মাতলূব ফিল ইলমিল মারগূব)-এর পাণ্ডুলিপির পিডিএফ, যার মূল নূসখা কায়রোর দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যা’য় রয়েছে। হাসীরী রাহ. আল্লামা কাযীখান রাহ.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ। তিনি তার কাছ থেকে জাহেরে রেওয়ায়েতের কিতাবগুলো খুব যতেœর সাথে পাঠ গ্রহণ করেছেন। পাঠ শেষে কাযীখান রাহ. তাকে যে সনদ প্রদান করেছেন তাতে তাকে “আল ইমামুল জালিলুয যাহিদু যাইনুল আনাম”-এর মত বড় বড় খেতাবে ভূষিত করেছেন।

সায়ীদ : জামালুদ্দীন হাসীরী রাহ.-এর জন্য আল্লামা কাযীখান রাহ. লেখা সেই সনদটি কোথায় পাব?

আবদুল মালেক : এটা তো الطبقات السنية তেই আছে। সেই সনদের পূর্ণ বিবরণ কাযীখান-এর কিতাব শরহুয যিয়াদাত-এর  মুকাদ্দিমাতুত তাহকীক-এও (পৃ. ৮০-৮১) আছে ।

সায়ীদ : কী জানি বলতে চেয়েছিলেন হাসীরী রাহ.-এর কিতাব থেকে?

আবদুল মালেক : হাঁ, ইমাম জামালুদ্দীন হাসীরী রাহ.-এর কিতাব خير مطلوب -এর পাণ্ডুলিপি (পাতা ২৭)-এ রয়েছে-

صام أهل بلدة ثلاثين للرؤية، و أهل مصر تسعة وعشرين، صاموا يوما، إذا لم يختلف المطالع.

দেখেন, ইমাম হাসীরী রাহ. কত শক্তিশালীভাবে মাতলা‘-এর ভিন্নতা ধর্তব্য হওয়ার বিষয়টি বললেন।

সায়ীদ : এত কিছুর পরও আমাদের দেশে দেখি অনেকেই একদিন আগেই রোযা শুরু করে দেন। তারা আসলে কী বলতে চান?

আবদুল মালেক : তারা যে কী বলতে চান এটা হয়ত তারাও জানেন না। সেজন্য দেখা যায় তারা  কখনো বলেন- সর্বপ্রথম দেখা অনুযায়ী রোযা-ঈদ করতে।

কখনো বলেন, সৌদি আরবকে অনুসরণ করতে। কখনো বলেন, দেখার ঝামেলা বাদ দিয়ে লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুসারে রোযা-ঈদ করতে।

তাদের একজন তো এই কথাও লিখেছেন- আলোকিত হেলাল নয়; বরং  অমাবস্যার চাঁদ দিয়ে শুরু হবে চান্দ্রমাস এবং সে অনুযায়ী হবে রোযা-ঈদ। সে হিসেবে এবার মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে অবশ্য রোযা শুরু করা উচিত ছিল। অবশ্য তিনি তা করেননি।

সায়ীদ : তাহলে কি খোঁজ পাওয়া গিয়েছে তারা এবার কবে থেকে রোযা শুরু করলেন?

আবদুল মালেক : হাঁ, এবার তো বেশ মজার ঘটনা ঘটেছে। আমাকে জনাব আবু শাব্বীর সাহেব (মুহতারাম আবদুস সুবহান শেখ, লেখক: বিশ^ব্যাপী রমাদান ও ঈদ একই দিনে না ভিন্ন) জানালেন, তিনি ড. মাহবুব সাহেবের সাথে কথা বলেছেন। তিনি বললেন, বুধবারেই তিনি রোযা। সাদ্রাতেও (হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর) রোযা শুরু হয়েছে বুধবার। এরপর তিনি ফোন করলেন ড. আবদুল্লাহ মারূফকে। তিনি বললেন, না, আমি তো আজকে (বুধবার) রোযা ছিলাম না। আমি রোযা শুরু করব আগামীকাল (বৃহস্পতিবার)। আবু শাব্বীর সাহেব তাকে জানালেন- ড. মাহবুব তো আজকে রোযা। এরপর তিনি মারূফ সাহেবকে বললেন, আপনাদেরই লোক মাহবুব সাহেব রোযা শুরু করলেন বুধবার। আপনি বললেন, শুরু করবেন বৃহস্পতিবার। আজ সন্ধ্যায় যেহেতু আমাদের এখানে হেলাল হয়নি আমরা রোযা শুরু করছি জুমাবার। তাহলে আপনাদের প্রশ্নটিই আমি আপনাকে করতে চাচ্ছি। বলুন, এবার লাইলাতুল কদর কয়টি বা কোন্টি? মারূফ সাহেব খামুশ!

আবু শাব্বীর সাহেব বললেন, এরচে’ ভালো হত না, যদি সবাই একসঙ্গে স্থানীয় হেলাল কমিটির ফয়সালা অনুসরণ করতাম?

আসলে এই বন্ধুরা খেয়ালই করেন না- এ বিষয়ে সকল ফকীহ-এর ইজমা রয়েছে যে, হেলালের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্র্র্র্তৃপক্ষের ফয়সালার বিরুদ্ধে যাওয়া নাজায়েয। যে ফকীহগণ উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় বলেন তাদেরও ফায়সালা এটাই যে, হেলালের ক্ষেত্রে যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের ফয়সালার খেলাফ করা জায়েয নেই।

বন্ধুরা যদি এই ইজমাসম্পন্ন বিধানটি মেনে নিতেন কত ভালো হত!

হাঁ, কর্তৃপক্ষ যদি শরীয়তবিরোধী কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চায় তা অবশ্যই বর্জন করতে হবে। এখানে তো বিষয়টি এমন নয়; বরং যারা বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করছেন তারাই শরীয়ত পরিপন্থী কাজ করছেন।

সায়ীদ : কেউ কেউ তো এমন প্রশ্নও করে থাকেন, বাংলাদেশ যে ঠিক সময়ে চান্দ্রমাস শুরু করে না এর একটি প্রমাণ এও যে, আমরা যেটিকে পহেলা চাঁদ বলে থাকি অনেক সময় দেখা যায় তা আকারে খুব বড় হয়। অথচ পহেলা চাঁদ হল অত্যন্ত সরু ও ক্ষণস্থায়ী।

আবদুল মালেক : এর উত্তর হাদীস শরীফেই রয়েছে। সহীহ মুসলিম শরীফে তাবেয়ী যুগের একটি ঘটনা উদ্ধৃত হয়েছে।

উমরার সফরে রওয়ানা হয়ে রাস্তায় তারা রমযানের প্রথম হেলাল দেখলেন। হেলালের আকার দেখে কেউ বললেন, এটি দু’দিনের চাঁদ। কেউ বললেন, তিন দিনের। মক্কা গিয়ে তারা পেলেন  আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে। তাঁকে ঘটনা বললে তিনি বললেন, না, এটি যে সন্ধ্যায় তোমরা হেলাল দেখেছ সে রাতেরই চাঁদ। (সহীহ মুসলীম, হাদীস ১০৮৮ কিতাবুস সিয়াম, হেলাল আকারে ছোট বড় হওয়া বিবেচ্য নয়- সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ)

অর্থাৎ হেলালের আকার দিয়ে বা জ্যোতি দিয়ে তার তারিখ ঠিক করা যায় না; বরং অমাবস্যার পরে যে স্থানে যে হেলাল দেখা যাবে সেটিই তাদের নতুন চাঁদ।

সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগে হাদীস যে কথা বলেছে আজ বিজ্ঞানও তাই বলে। এ প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানী শওকত আওদাহ (ওদা)-এর দু’টি প্রবন্ধ দেখা যেতে পারে। এক. ‘আত তাকভীমুল হিজরী আল আলামী’ অক্টোবর ২০০১-এ প্রস্তুতকৃত, ২০১০-এ নযরে ছানী কৃত, পৃ. ৫-৬

দুই. ‘আল হিলালু বায়নাল হিসাবাতিল ফালাকিয়্যাহ ওয়ার রুয়াহ’ (ডিসেম্বর ২০০৬ সালে প্রস্তুতকৃত) পৃ. ১২-১৩। সেখানে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন যে, হেলালের আকার বড় হওয়ার কারণে এটিকে দ্বিতীয় চাঁদ বলা বা আকার ছোট দেখেই এটিকে প্রথম চাঁদ বলা কোনোটাই ঠিক নয়।

সায়ীদ : একজন বললেন, নয়াদিগন্তে নাকি একটি লেখা ছেপেছে। তাতে লুনার ক্যালেন্ডারকে ঘড়ির সাথে তুলনা করা হয়েছে। এবং আরাফা দিবস হিসেবে ৯ই যিলহজে¦র রোযা ও কুরবানী করতে বলা হয়েছে।

আবদুল মালেক : ভাই! এসব তো তাদের পুরনো কথা; কত উত্তর দেওয়া যায় এসব জাহেলী কথার। কতবার লেখা হয়েছে এসব বিষয়ে। কিন্তু কারো যদি হক বুঝার বা মানার যোগ্যতাই না থাকে তাহলে করার কী আছে?

আরাফার প্রসঙ্গটি তো গত সংখ্যার প্রবন্ধটিতে আলোচনায় এসেছে। লুনার ক্যালেন্ডারের তুলনা যে ঘড়ির সাথে চলে না তা তো মুফতী শফী রাহ. তাঁর কিতাব رؤيت هلال-এ বিস্তারিত লিখেছেন, যার বাংলা অনুবাদও হয়েছে। আলকাউসারেও সফর ১৪৩৪, জানুয়ারি ২০১৩ সংখ্যায় ‘দুটি প্রশ্ন ও তার উত্তর : ইয়াওমে আরাফার রোযা ও কোরবানীর সাথে আকীকা’ শিরোনামে এ বিষয়ে লেখা হয়েছে।

ফাউন্ডেশনে আমরা যে কিতাব পেশ করেছি তাতে এ বিষয়গুলো সবিস্তারে দলীলসহ আলোচনা করা হয়েছে।

সায়ীদ : আপাতত আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দেখছি না। সময় দেয়ার জন্য ‘জাযাকুমুল্লাহু খাইরান’।

আবদুল মালেক : ওয়া ইয়্যাকা।

سُبْحَانَكَ اللّهُمّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلّا أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ.

 

advertisement