(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কিন' কী ঘটেছে? মানুষ যখন এই সুযোগ পেল যে, ইবাদত তো পাঁচ ওয়াক্ত করতে হবে আর বাকি সময় ব্যবসা করা যাবে, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে, স্ত্রী-সন-ানের হক আদায় করা যাবে তখন তারা এতেই মগ্ন হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা এই অভিযোগই করেছেন সূরা তাকাছূর-এ যা আমি আপনাদের সামনে তেলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) চিন-া তোমাদেরকে (আখিরাতের বিষয়ে) উদাসীন করে দিয়েছে।
অর্থাৎ আমি তো তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম আমার ইবাদতের জন্য। আর তোমাদের সহজতার লক্ষ্যে ব্যবসা, উপার্জন ইত্যাদি বৈধ করেছিলাম। কিন' তোমরা এই প্রতিযোগিতা শুরু করেছ যে, আমার কাছে অন্যের চেয়ে বেশি সম্পদ থাকুক, অন্যের চেয়ে বেশি টাকা-পয়সা আসুক, আমার বাড়ি অন্যের চেয়ে উন্নত হোক, গাড়িটা সবার চেয়ে ভালো হোক, আমার অলংকার, কাপড়-চোপড় অন্যের চেয়ে উত্তম হোক। আর এতেই তোমরা সকল সামর্থ্য ব্যয় করছ। এই প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে জীবনের মূল লক্ষ্য, যার জন্য তোমরা দুনিয়ায় এসেছ।
তাকাছুর অর্থ ধন-সম্পদ ও দুনিয়ার উপায়-উপকরণের প্রতিযোগিতায় একে অন্যের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করা। অমুকের বাংলো এত ভালো, আমারটা তার চেয়েও ভালো হওয়া চাই। অমুকের গাড়ি এরকম তো আমারটা তার চেয়ে উন্নত হওয়া চাই। অমুকের অলংকার, কাপড় এত ভালো তো আমার অলংকার, কাপড় তার চেয়েও ভালো হওয়া চাই। দিনরাত তোমরা এই চিন-াতেই ব্যস-, এ নিয়েই তোমাদের সকল ভাবনা।
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তোমরা দুনিয়ার জীবন, যা ছিল ইবাদতের তা কী করে ফেলেছ? যে উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছিল তা তোমরা ভুলে গিয়েছ। তোমাদের কাছে দুনিয়াবী জীবন হচ্ছে খেলাধুলা, সাজসজ্জা, পরস্পর গর্ব-অহংকার এবং সন-ান ও সম্পদে পরস্পর প্রতিযোগিতা।’ অর্থাৎ জীবনের শুরু হয় খেলাধুলা দিয়ে। বাল্যকালে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ খেলাধুলার প্রতিই থাকে। তাই খেলাধুলা নিয়েই পড়ে থাকলে। তাতেই সকল আগ্রহ ও সকল উৎসাহ, সর্বক্ষণ এক চিন-া খেলায় কিভাবে বিজয়ী হব। এরপর যৌবনে উপনীত হলে আগ্রহ জাগল জাঁকজমকের। এখন শখ শুধু এই যে, আমার কাপড় সুন্দর হওয়া চাই, অলংকার সুন্দর হওয়া চাই। তারপর কী হল? এখন অন্যের উপর গর্ব করব যে, আমার এত টাকা-পয়সা আছে, আমার এত ব্যাংক-ব্যালেন্স আছে। আমার সন-ান এতজন, আমার এত আয়-উপার্জন। আমার এত সেট কাপড়, এত সেট অলংকার এভাবে একে অন্যের উপর গর্ব করা। এরপর ধন-সম্পদ ও সন-ান-সন-তির প্রতিযোগিতায় একে অন্যের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চিন-া।
আল্লাহ তাআলা শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন- গোটা জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। আর তা এমন চিত্র যে, পরবর্তী স-রে পৌঁছে মানুষ পূর্বের স-রকে বোকামি মনে করে এবং ভাবতে থাকে যে, কী বোকাই না ছিলাম তখন! সারাক্ষণ ওই কাজ নিয়েই পড়ে থাকতাম। আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন কী করতাম? খেলাধুলা। আগ্রহ ও চেষ্টা থাকত শুধু এক বিষয়ে। তা এই যে, ভালো একটা খেলা হয়ে যাক, খেলায় যেন জয় লাভ করি! এখন যখন বড় হয়ে পিছনের কথা মনে করি যে, শৈশবে যখন খেলাধুলা করতাম এবং জয়-পরাজয়কেই জীবনের বড় বিষয় মনে করতাম তখন কি আমাদের হাসি পায় না? আমাদের কি মনে হয় না যে, তখন কেমন বোকার রাজ্যে বাস করছিলাম!
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা তাঁর শৈশবের ঘটনা বলতেন যে, ছোটকালে দেওবন্দে এক ধরনের খেলা ছিল ‘সারকান্ডা’। সারকাণ্ডা হচ্ছে, তুলার একটি ছোট চারাগাছ, যাতে একটি ডাল হত। সে সময় খেলাধুলাও এমন হত যে, তাতে অর্থ খরচ হত না। আজকাল তো খেলাধুলার জন্যও হাজার হাজার টাকা প্রয়োজন। আগেকার দিনে খেলাধুলার পিছনে টাকা-পয়সা খরচ হত না। সাধারণ জিনিস নিয়েই শিশুরা খেলাধুলা করত। সারকাণ্ডা খেলার নিয়ম এই ছিল যে, সকলেই তা উপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করত। যার সারকাণ্ডা আগে পৌঁছে যেত সে জয়ী হত আর যারটা পিছনে রয়ে যেত সে পরাজিত হত।
তিনি বলেন, আমার মনে আছে, আমি আমার কাজিনের সঙ্গে সারকাণ্ডা খেলছিলাম। খেলায় যে জয়ী হত সে অন্যজনের চারাগুলো নিয়ে যেত। আব্বাজান বলেন, আমি খেলাধুলায় সব সময় পিছনে থাকতাম। খেলাধুলার অভিজ্ঞতা আমার কখনো হয়নি।
আমার কাজিন ছিল খুবই চৌকস।সারকাণ্ডা নিক্ষেপ করা হলে তার সারকাণ্ডা আগে পৌঁছে যেত আর আমার গুলো পিছনে থেকে যেত। ফলে আমার কাছে যত সারকাণ্ডা ছিল সবগুলোই সে জিতে নিল। একটিও অবশিষ্ট থাকল না। এতে আমার এত দুঃখ হল এবং এত বেশি ক্রন্দন করলাম, যেন দুনিয়ার সব কিছুই আমি হারিয়ে ফেলেছি। আজও শৈশবের সে কান্নার কথা ভাবলে খুব হাসি পায় যে, কীসের জন্য এত কেঁদেছিলাম? তা তো ছিল সামান্য কয়েকটি চারা। অথচ এর কারণে আমি মনে করতাম যে, আমার সারা দুনিয়া লুট হয়ে গেছে।
মোটকথা পরবর্তী স-রে উপনীত হয়ে পূর্বের স-রের অজ্ঞতাগুলো বোঝা যায়। যৌবনে পৌঁছে শৈশবের খেলাধুলাকে অজ্ঞতা মনে করে। বার্ধক্যে এসে যৌবনের সাজসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ইত্যাদি সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। যুবকদের চালচলন, সাজসজ্জা দেখে হাসি পায়। মনে হয় তারা কত বোকামীতে লিপ্ত রয়েছে। এ সময়ের একমাত্র ভাবনা, ব্যাংক-ব্যালেন্স কত বেশি করা যায়, কত বেশি সুনাম-সুখ্যাতি লাভ করা যায়, সম্পদ কত বৃদ্ধি করা যায় ইত্যাদি। কোনো ভাবে কাপড় নষ্ট হয়ে গেলে, ময়লা হয়ে গেলে সে দিকে ভ্রুক্ষেপও করা হয় না। সাজসজ্জা না হলেও অসুবিধা নেই তবে সম্পদ বৃদ্ধি হওয়া চাই।
সকল মানুষই পরের স-রে পৌঁছে পূর্বের স-রকে বেওকুফী মনে করে এবং তা মনে করে হাসে। কিন' এতটুকুই। এটুকু ভেবেই শেষ। আর এটাই হল মন্দ অভ্যাস।
আব্বাজান বলেন, মৃত্যুর পর যখন এর পরের স-র আসবে, মানুষ আখেরাতে পৌঁছবে তখন সম্পদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদের উপরও তেমনি হাসি আসবে যেমন আজ সারকাণ্ডা খেলার জন্য হাসি পায়। আখিরাতে পৌছে বুঝে আসবে যে, দুনিয়ার সহায়-সম্পদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করা ছিল কত বড় অজ্ঞতা। কেননা সেখানে গিয়ে বুঝতে পারব যে, এসব জিনিসের কোনো মূল্যই নেই। এসব ছিল শুধুমাত্র ধোঁকা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুনিয়ার জীবন কেবল ধোঁকার উপকরণ।’
কুরআন মজীদে এ কথা ঘোষণা করা হয়েছে যে, ধন-সম্পদের প্রাচুর্য অর্জনের চেষ্টা তোমাদেরকে জীবনের মূল লক্ষ্য ভুলিয়ে দিয়েছে। এমনকি তোমরা কবরস-ান পর্যন- পৌঁছে গেছ। অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন- তোমাদের ভাবনা ও প্রচেষ্টা সবকিছুই অধিক সম্পদ উপার্জন নিয়ে। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, কখনোই এমন হওয়া উচিত নয়। অচিরেই তোমরা বুঝতে সক্ষম হবে। কুরআন মজীদের বাক্যগুলো লক্ষ করুন, তোমরা অচিরেই বুঝতে পারবে যে, যেসব বস' তোমরা অধিকতর অর্জন করার পিছনে পড়ে ছিলে তার কোনো মূল্যই নেই। পুনরায় কুরআন মজীদ বলছে, তোমাদের কখনো এমন করা উচিত নয়। অচিরেই তোমরা বুঝতে সক্ষম হবে।
যতক্ষণ এই চোখ দুটি খোলা আছে ততক্ষণ পর্যন- এই সব পার্থিব ধন-সম্পদ তোমাদের ধোঁকা দিতে থাকবে। যেদিন চোখ বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন বাস-বতা প্রকাশিত হবে। সেদিন দুনিয়ার সাজসজ্জা, ধন-সম্পদের প্রকৃত অবস'া বুঝে আসবে। এরপর বলা হয়েছে, ‘তোমাদের কখনো এমন করা উচিত নয়। আহা! যদি তোমাদের ইলমে ইয়াকীন হাসিল হয়ে যেত তাহলে তোমরা বুঝতে পারতে। তোমরা স্বচক্ষে দেখবে প্রজ্বলিত অগ্নির দোযখকে। তোমরা অবশ্যই দেখবে জাহান্নামকে।’ কিভাবে দেখবে? বলা হয়েছে, ইকায়ীনের চোখে দেখবে। অর্থাৎ চোখে দেখে তোমাদের ইয়াকীন হাসিল হয়ে যাবে। আজ শুধু বিশ্বাসে আছে, কিন' সেদিন চোখে দেখে ইয়াকীন হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহ তাআলা বলেন, সেদিন তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, দুনিয়ায় আমি তোমাদেরকে যে নেয়ামতসমূহ দান করেছিলাম তার কী হক আদায় করেছ? ওই নেয়ামতসমূহের কীরূপ ব্যবহার করেছ?
(চলবে ইনশাআল্লাহ)