হযরত ছুমামাহ রা.-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা : ঈমানের নূরে আলোকিত হৃদয়
কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَقَدْ كَانَ فِیْ قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّاُولِی الْاَلْبَابِ.
তাদের ঘটনাবলিতে জ্ঞানীদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। -সূরা ইউসূফ (১২) : ১১১
আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যাতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, নবী-রাসূল ও পূর্বসূরীদের ঘটনায় তোমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষার উপাদান। ঘটনা ও ইতিহাস সংরক্ষণ করাই হয় তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য। নিছক জ্ঞানলাভ বা আনন্দ-বেদনার কাহিনী শুনে সাময়িক তৃপ্তি অর্জনের জন্য নয়। ইতিহাস থেকে মানুষ যেমন জানতে পারে কোনো জাতির উত্থান-পতনের কাহিনী তেমনি জানতে পারে, ব্যক্তিগত জীবনে কারো সফল বা ব্যর্থ হওয়ার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা।
ঘটনা বা কাহিনী খুব সহজে হৃদয়ঙ্গম হয় এবং শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ সহজ হয়। তাই কুরআন-হাদীসে নবী-রাসূল ও পূর্বসূরীদের বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত এ ধরনেরই একটি ঘটনা ও তার শিক্ষা নিয়েই আজকের এ লেখা।
ঘটনাটি ইয়ামামার অধিপতি ছুমামাহ্ ইবনুল উছালের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল অশ্বারোহী নজদ অভিমুখে প্রেরণ করলেন। তাঁরা ইয়ামামাবাসীদের সরদার ছুমামাহ বিন উছালকে বন্দি করে আনলেন।
তিনদিন পর্যন্ত মসজিদের এক খুঁটির সাথে তাকে বেঁধে রাখা হল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তার পাশ দিলে যেতেন তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, ছুমামাহ! তোমার কী ধারণা- আমি তোমার সাথে কেমন আচরণ করব? জবাবে তিনি বলতেন, মুহাম্মাদ! আমি আপনার কাছে উত্তম আচরণেরই প্রত্যাশা করি। আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন, একজন হত্যাযোগ্য ব্যক্তিকেই হত্যা করবেন। আর আমার উপর অনুগ্রহ করলে একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তির উপর অনুগ্রহ করা হবে। আর আপনার যদি সম্পদের কামনা থাকে, খুলে বলুন, আপনি যা চাইবেন তাই আপনাকে দেয়া হবে। এভাবে একাধিকবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার মাঝে কথোপকথন হল।
একপর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যখন মনে হল, তাকে মুক্ত করে দেয়াই ভালো। তাকে মুক্ত করে দিলেন। আল্লাহ পাক ছুমামাহ্র অন্তরে ঈমানের নূর ঢেলে দিলেন।
ছাড়া পেয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাকে ইসতেকবাল করে নিকটবর্তী একটি কূপের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি গোসল করে পবিত্র হলেন এবং কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বললেন, হে মুহাম্মাদ! ইতিপূর্বে আমার কাছে আপনার চেহারাই ছিল সবচে’ অপ্রিয়। আর আজ আমার নিকট আপনার চেহারাই সবচে’ প্রিয়। পূর্বে আমার কাছে আপনার শহর ছিল সবচে’ অপছন্দনীয় আর আজ আমার নিকট আপনার শহরই সবচে’ পছন্দনীয়। পূর্বে আমার নিকট আপনার ধর্ম ছিল সবচে’ ঘৃণিত আর আজ আপনার ধর্মই আমার সবচে’ কাক্সিক্ষত ধর্ম।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহুকে ক্ষমার সুসংবাদ দিলেন। সেখানে হযরত উমর রাযিআল্লাহু আনহু উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহ্র কসম, ছুমামাহ আমার চোখে শূকরের চেয়েও হীন ছিল কিন্তু এখন আমার কাছে তার মর্যাদা আসমানসম।
অতপর হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু নবীজীকে সম্বোধন করে বললেন, আল্লাহ্র রাসূল! আপনার উপর আল্লাহ্র রহমত বর্ষিত হোক, আমি মুশরিক থাকা অবস্থায় উমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেছিলাম, পথিমধ্যে আপনার অশ্বারোহী মুজাহিদ বাহিনী আমাকে বন্দি করে আনে। সুতরাং আমার উমরাটা পুরা করার সুযোগ করে দিন। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে উমরার বিধান শিক্ষা দিলেন এবং উমরা আদায়ের ব্যবস্থা করে দিলেন।
হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু উমরার উদ্দেশ্যে যখন মক্কায় পৌঁছলেন এবং কুরাইশরা শুনল যে, তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম নিয়ে কথা বলছেন তখন তারা তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে লাগল এবং বলতে লাগল ছুমামাহ কাফের হয়ে গেছে। জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি কাফের হয়নি; বরং মুসলমান হয়েছি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বাস করেছি। তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি। সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, ইয়ামামা থেকে একটি শস্যদানাও তোমাদের কাছে আসবে না। কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেই আমি তোমাদেরকে শস্য দিব।
হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু নিজ শহরে ফিরে গেলেন এবং মক্কায় শস্য রফতানি বন্ধ করে দিলেন। মক্কার সকল খাদ্যশস্যের যোগান হত ইয়ামামা থেকে। ফলে কুরাইশরা দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হল। তখন তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চিঠি লিখল। তারা নবীজীর সাথে তাদের আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে বলল, নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার আদেশ করেন। আমরা আপনার আত্মীয়। ছুমামাহ খাদ্যশস্য রফতানি বন্ধ করে দিয়ে আমাদেরকে এবং আমাদের নারী-শিশুদেরকে মৃত্যুমুখে পতিত করেছে। আপনি আমাদের রক্ষা করুন এবং ছুমামাহকে চিঠি লিখুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুমামাহ্কে চিঠি লিখলেন, তিনি যেন আল্লাহ্র হেরেমের এই বয়কট এবং খাদ্যশস্য রফতানি জারি করে হেরেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে কুরাইশদের উপর থেকে অবরোধ উঠিয়ে নিলেন।
[দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৭২ (বিস্তারিত), ২৪২২-২৪২৩, ৪৬৯, ৪৬২ (সংক্ষিপ্ত); সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭৬৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৬৭৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১৮৯, ৭১২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৩৬১; সুনানে সাঈদ ইবনে মানসূর, হাদীস ২৬১৩, দালাইলুন নুবুওয়াহ, বায়হাকী ৭/৭৯-৮০; সীরাতে ইবনে হিশাম ৪/২৮৪-২৮৫; আলইসতিআব ১/২১৪-২১৫ ইত্যাদি।]
হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহণের ঘটনায় রয়েছে অনেক শিক্ষা ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত-
১. ইসলাম গ্রহণের ব্যাপার কারো ওপর জোরজবরদস্তি না করা; বরং তার অন্তরকে জয় করার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় ইসলাম কবুল করার পথ সুগম করা।
২. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতার কথা মুসলিম-অমুসলিম সবার মাঝেই প্রসিদ্ধ ছিল। এজন্যই ইয়ামামার এই ইসলাম বিদ্বেষী গোত্রপতি ও নবীজীর কাছে উত্তম আচরণেরই আশা করেছেন।
৩. হযরত ছুমামাহ রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং স্বেচ্ছায় মুক্তিপণ দিতে রাজি ছিলেন। এরপরও নবীজী তার উপর মৃত্যুদ- বা মুক্তিপণ কোনোটাই আরোপ করেননি; বরং শর্তহীনভাবে তাকে মুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন- ছুমামাহ্র সামনে ইসলামের বাস্তব রূপ তুলে ধরতে, যাতে ছুমামাহ্র অন্তর থেকে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর হয় এবং ইসলামকে উপলব্ধি করে মুসলমান হয়ে যেতে পারে।
আর এটা তার গোত্রের সকল মানুষের ইসলাম গ্রহণের পথ সুগম করবে। কারণ, তিনি গোত্রপ্রধান। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই গোত্রের মাঝে ইসলামের দাওয়াত প্রসারিত করার লক্ষ্যে দাওয়াতের এই সুবর্ণ সুযোগটি অতি উত্তমভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
হযরত ছুমামাহ্র উপর চাপ প্রয়োগ তো দূরের কথা তার কাছে সরাসরি ইসলামের দাওয়াতও পেশ করা হয়নি। বরং তিনি বন্দি অবস্থায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক, মুসলমানদের কাজকর্ম, আচর-আচরণ খুব কাছে থেকে দেখেছেন। অতপর মুক্তি পাওয়ার পর স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়েছেন। মূলত মুসলমানদের উত্তম কর্ম ও আচরণ, তাদের কুশলী দাওয়াত ও আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আল্লাহ পাক চারিদিকে ইসলামকে প্রসারিত করেছেন।
৪. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুমামা রা.-এর ব্যাপারে খুব ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যার নির্দেশ দেননি। বরং বারবার তার মতামত জানতে চেয়েছেন এবং চিন্তা-ভাবনার সুযোগ দিয়েছেন। নবীজী শুরুতেই তাকে ছেড়ে দিলে হয়তো তার ইসলামের সত্যতা ও সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তা করারই সুযোগ হত না; ফলে তিনি কাফেরই থেকে যেতেন। অপরদিকে তাকে হত্যা করা হলে হয়তো মুসলমান ও ইয়ামামাবাসীদের মাঝে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হত। অতএব এখানে সবচে’ উত্তম সিদ্ধান্ত ছিল সেটাই, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করেছেন।
৫. আমরা লক্ষ্য করেছি, হযরত ছুমামাহ রাযিআল্লাহু আনহুর ইসলাম গ্রহণের পূর্বের অবস্থা হল- মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্তা, তাঁর ধর্ম, তাঁর শহর, এককথায় তাঁর সবকিছু ছুমামাহ্র নিকট সবচে' ঘৃণিত ও অপছন্দনীয় ছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের সান্নিধ্যে মাত্র তিন দিন সময় কাটানোর পরই তার মাঝে আমূল পরিবর্তন সাধিত হল। এখন তার কাছে সবচে’ প্রিয় ব্যক্তি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সবচে’ কাক্সিক্ষত শহর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শহর। সবচে’ পছন্দের ধর্ম নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্ম। এককথায়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্বন্ধিত সকল কিছু এখন হযরত ছুমামাহ রা.-এর নিকট পৃথিবীর যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি প্রিয় ও প্রত্যাশিত। এটাই প্রকৃত ঈমানের আলামত এবং ঈমানদার এমনই হয়, এমনই হওয়া উচিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যবানেই ঈমানের এই আলামত ও শর্ত আমাদের কাছে পৌঁছেছে-
لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنّاسِ أَجْمَعِينَ.
কেউ মুমিন হতে পারবে না; যতক্ষণ না আমি তার কাছে প্রিয় হব- তার পিতা থেকে, তার সন্তান থেকে, এমনকি পৃথিবীর সকল মানুষ থেকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫
এটিই ঈমান ও ঈমানের আলামত। ছুমামাহ্ রা. ঈমান এনেছেন। দিল থেকে ঈমান এনেছেন। তাঁর সাচ্চা ঈমানই তাকে এই শর্তের উপর এনে দিয়েছে। নবীজীর প্রতি এই ভালোবাসা মুমিনের স্বভাবজাত; যে স্বভাব সাচ্চা ঈমান থেকে উৎসারিত। একজন খাঁটি মুমিনকে এ বিষয়টি আলাদাভাবে শিখিয়ে দিতে হয় না। তার ঈমানই তাকে এরূপ আচরণ প্রকাশ করতে বাধ্য করে। হযরত ছুমামাহ রা.-কেও তা কেউ শিখিয়ে দেয়নি, পড়িয়ে দেয়নি।
৬. হযরত উমর রাযিআল্লাহু আনহুর বক্তব্য- ‘ছুমামাহ আমার চোখে শূকরের চেয়েও হীন ছিল। কিন্তু এখন আমার কাছে তার মর্যাদা আসমানসম।’
কুফর ও কুফর সংশ্লিষ্ট সবকিছু সাহাবায়ে কেরামের কাছে ছিল সবচেয়ে ঘৃণার; পক্ষান্তরে ঈমান ও ঈমান সংশ্লিষ্ট সবকিছু তাঁদের কাছে ছিল সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে প্রত্যাশিত। এ বিষয়টি আল্লাহ তাআলা কুরআনে বর্ণনা করেছেন এ ভাষায়-
وَ لٰكِنَّ اللهَ حَبَّبَ اِلَیْكُمُ الْاِیْمَانَ وَ زَیَّنَهٗ فِیْ قُلُوْبِكُمْ وَ كَرَّهَ اِلَیْكُمُ الْكُفْرَ وَ الْفُسُوْقَ وَ الْعِصْیَانَ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الرّٰشِدُوْنَ.
...কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং একে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন; আর কুফর, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন । এরাই সৎপথ অবলম্বনকারী। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ৭
কুফরের প্রতি ঘৃণার কারণেই কাফেরের প্রতি এ ঘৃণা। এ থেকে আমরা শিখে নিতে পারি একজন কাফের ও একজন মুমিনের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে। দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্য শুধু ঈমান ও কুফরের কারণে। ব্যক্তি-বিদ্বেষ বা অন্য কোনো কারণে নয়। নতুবা একই ব্যক্তির ব্যাপারে উমর রাযিআল্লাহু আনহুর দৃষ্টিভঙ্গির এই আকাশ-পাতাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হত না। ছুমামাহ্র সাথে হযরত উমর রা.-এর কোনো বিদ্বেষ ছিল না। আবার তার প্রতি এত সন্তুষ্টি প্রকাশের পার্থিব কোনো স্বার্থও ছিল না। এখানে একমাত্র বিষয়টি ছিল- হযরত ছুমামাহ্-এর ঈমান গ্রহণ।
৭. এই ঘটনায় আমরা লক্ষ করেছি, হযরত ছুমামাহ রা. ঈমান গ্রহণের সাথে সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তার ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আদব বহুগুণে বেড়ে গেছে। তিনি শুরুতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করেছিলেন তাঁর নাম ধরে ‘হে মুহাম্মাদ!’ বলে। কিন্তু মুসলমান হওয়ার পর সম্বোধন করলেন ‘ হে আল্লাহ্র রাসূল!’ বলে। সাথে তাঁর উপর দরূদও পাঠ করলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করা, তাঁর সাথে আদব রক্ষা করা, তাঁর উপর দরূদ পাঠ করা- এগুলো সব মুমিনের বৈশিষ্ট্য। সত্যিই যদি কারো অন্তরে নবীর প্রতি ঈমান ও ভক্তি থাকে তাহলে এ আচরণগুলো তার থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পাবে। যেমন হযরত ছুমামাহ্ রা. থেকে প্রকাশ পেয়েছে। এগুলো তাঁকে শিখিয়ে দিতে হয়নি। ঈমান গ্রহণের সাথে সাথে স্বভাবজাতভাবে এগুলো তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
৮. কাফেররা ছুমামাহ রা.-কে উত্তেজিত করার জন্য বলল, ছুমামাহ কাফের হয়ে গেছে। জবাবে তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি কাফের হইনি বরং মুসলমান হয়েছি (আমি বর্জন করেছি, মূর্তিপূজা ও কুসংস্কার)। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বাস করেছি। তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।
এ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এ প্রত্যয় গ্রহণ করতে পারি- দ্বীন ও ঈমানের পথে সকল বাধা-বিপত্তি, শত ধিক্কার আমরা উপেক্ষা করব। সকল গোমরাহী ও মিথ্যার মোকাবেলায় আমরা সত্যের বাণী স্পষ্টবাক্যে তুলে ধরব, সত্যের পথে অটল-অবিচল থাকব, সত্য-গ্রহণকে গর্বের সাথে উচ্চারণ করব। যেমনটি হযরত ছুমামাহ রা. করেছেন।
৯. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের ব্যাপারে মক্কার কাফেরদের বিদ্বেষ দেখে হযরত ছুমামাহ রা.-এর ঈমানী গায়রত (চেতনা) উদ্দীপ্ত হল। তিনি তাঁর ক্ষমতা ও সম্পদ ইসলামের স্বার্থে কাজে লাগালেন। মক্কার কাফেরদের সাফ জানিয়ে দিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি ব্যতীত একটি শস্যদানাও ইয়ামামা থেকে মক্কায় আসবে না।
মুসলিম শাসকগণ এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন যারা বা যেসকল রাষ্ট্র ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি জুলুম অত্যাচার করে তাদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে এই ঘটনায় শিক্ষা রয়েছে। আমরা সাধারণ মুসলিম জনতাও প্রত্যেকে যার যার অবস্থানে থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের শত্রুদের ব্যাপারে আমাদের ঈমানী গায়রতকে এই শান্তিপূর্ণ উপায়ে কাজে লাগাতে পারি।
১০. ইতিহাস ও বাস্তব অভিজ্ঞতা সাক্ষী, ঈমান-কুফরের লড়াইয়ে সংকটময় অবস্থায় কাফেরদের থেকে মুসলমানগন কক্ষনো ক্ষমা বা সাহায্যের আশা করতে পারেনি। কিন্তু কাফেররা ঠিকই যুগে যুগে মুসলমানদের থেকে এই প্রত্যাশা করেছে এবং তা পেয়েছেও। আলোচ্য ঘটনাতেই আমরা তার দুটি উজ্জ¦ল উদাহরণ লক্ষ করেছি। এক হলো কাফের থাকা অবস্থায় হযরত ছুমামাহ্র উত্তম আচরণের প্রত্যাশা। দ্বিতীয়টি কুরাইশ কাফেরদের সাহায্য প্রার্থনা। অথচ হযরত ছুমামাহ রা. কর্তৃক সংঘটিত কুরাইশ কাফেরদের উক্ত সংকটটি তৈরি হয়েছিল তাদেরই ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বষের কারণে।
১১. এখানে কুরাইশ কাফের সম্প্রদায় কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের উপর নির্বিচার যুলুম-অত্যাচার এবং শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করার বিষয়টি সামনে ছিল। এরপরেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশোধের কথা ভাবেননি; বরং তাদেরকে নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিয়েছেন। ভোলেননি আল্লাহ্র হরমের কথা, তার পবিত্রতা ও নিরাপত্তার কথা। সুতরাং আমাদেরও উচিত বিজয় ও সাফল্যের অবস্থায় প্রতিশোধ নয় বরং ক্ষমা ও অনুগ্রহের মাধ্যমে শত্রুর হৃদয় জয় করা এবং সর্বাবস্থায় ইসলামের নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের বিষয়ে সজাগ থাকা; যেমন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র হরমের ব্যাপারে সতর্ক থেকেছেন এবং হযরত ছুমামাহ রা.-কে হরম শরীফের উপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আর অবরোধ তুলে নেয়ার কারণ হিসাবে হরম শরীফের পবিত্রতা রক্ষার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
এ ঘটনা আমাদের জন্য রেখে গেছে বহু শিক্ষা। তার কিছু দিক এখানে তুলে ধরা হল।
সাহাবায়ে কেরামের ঈমানই আমাদের জন্য ঈমানের মাপকাঠি ও নমুনা। তাঁরাই ঈমানের বাতিঘর। তাইতো ইরশাদ হয়েছে-
اٰمِنُوْا كَمَاۤ اٰمَنَ النَّاسُ
তোমরা ঈমান আনো যেরূপ লোকেরা (সাহাবীগণ) ঈমান এনেছে। -সূরা বাকারা (২) : ১৩
তাঁরা ঈমান এনেছেন। আল্লাহ তাঁদের ঈমানের পরীক্ষা নিয়েছেন। তাঁরা সে পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছেন। আল্লাহ তাঁদের ঈমানের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং পুরস্কার ঘোষণা করেছেন-
اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ امْتَحَنَ اللهُ قُلُوْبَهُمْ لِلتَّقْوٰی لَهُمْ مَّغْفِرَةٌ وَّ اَجْرٌ عَظِیْمٌ.
আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ৩