Shaban-Ramadan 1439   ||   May-June 2018

মালালা, শার্লি এবদো ও কুন্দুযের শহীদান : মিডিয়ার ভিন্ন চিত্র

মুনশী মুহাম্মাদ মহিউদ্দিন

অক্টোবর ২০১২ সালে স্কুলবাসে বন্দুকধারী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয় মালালা ইউসুফজাই। হামলায় গুলিবিদ্ধ হয় মালালা। এ হামলা সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে বিশ্ব মিডিয়ায় হামলার ব্যাপক নিন্দা হয়।

হামলার প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এই ঘটনাকে একটি জঘণ্য ও কাপুরুষোচিত পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা এই ঘটনাকে ঘৃণ্য ও দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ বিদেশসচিব উইলিয়াম হেগ এই ঘটনাকে বর্বরোচিত বলে উল্লেখ করেন।

২০১৫ জানুয়ারিতে ফান্স্রের একটি ব্যঙ্গ সাময়িকী শার্লি এবদোর কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা হয়। ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের কারণে প্রসিদ্ধ ছিল পত্রিকাটি। এ হামলায় আট সাংবাদিকসহ ১২ জন নিহত হয়। বিশ্ব মিডিয়া এ ঘটনাকে এমনভাবে প্রচার করে যে, গোটা বিশ্ব এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।

এ ঘটনার পর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এক সংহতি পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। প্যারিসের ‘প্লেস দ্য লা রিপাবলিক’-এ আয়োজিত ওই সমাবেশে ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা নানা ধর্ম ও বর্ণের ১০ লাখেরও বেশি সাধারণ মানুষ এবং ৪০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান অংশগ্রহণ করেন। নানা  প্ল্যাকার্ড ও প্রতীক হাতে এই সমাবেশে একাধিক মুসলিম দেশের সরকারপ্রধানও যোগ দেন। আগত বিশ্বনেতারা একে অন্যের হাত ধরে সমাবেশের সূচনা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল, ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজি, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনসহ আরো অনেকে। এর আগে ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনী প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে একই কাতারে দেখা যায়নি বহু বছর।

এছাড়াও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া এ ঘটনাকে ব্যাপকভাবে ফোকাস করে। এমনকি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ কয়েকদিন `I am Charlie Hebdo’ আমি শার্লি এবদো’ তো ভাইরাল ছিল।

গত ৩ এপ্রিল আফগানিস্তানের কুন্দুয এলাকার একটি মাদরাসায় বিমান হামলা চালানো হয়। এতে নিহতের সংখ্যা ছিল দেড়শ’রও অধিক। যার মধ্যে প্রায় ১০০ জন শিশু-কিশোর হাফেজে কুরআন ছিল।

প্রথম প্রথম এ হামলাকে সন্ত্রাসীদের উপর চালানো বলে প্রচার করা হলেও যখন বাস্তবতা সামনে আসে তখন দেখা যায় সেখানে ছিল অনেক নিষ্পাপ শিশু, যারা কুরআনে পাকের হিফজ শেষ করে পাগড়ি নেওয়ার জন্য সেখানে একত্রিত হয়েছিল। এরপর থেকেই বিশ্বমিডিয়া নীরব।  শহীদ হওয়া হাফেজ শিশুদের ছবি যখন স্যোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ পায় তখন আফসোস হচ্ছিল, এত কঠিন বর্বরতা এবং এত বড় জুলুম আর অপরদিকে মিডিয়ার নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত অবস্থান। পশ্চিমা মিডিয়া থেকে তো কিছু আশা করাই বেকার। কিন্তু মুসলিম দেশের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মিডিয়াও এত বড় জুলুম ও বর্বরতাকে কোনো গুরুত্বই দিল না- যেন কিছুই হয়নি।

মানবাধিকার কর্মীরা এখন কোথায়? জাতিসংঘের মহাসচিব এখন নিশ্চুপ কেন? এর জন্য তো কোন সংহতি পদযাত্রা বা সমাবেশ হল না। বিশ্ব নেতারা কোনো নিন্দা জ্ঞাপন করল না। এ কোন্ ধরনের মানবাধিকার! কোন্ ধরনের ইনসাফ!!

কুন্দুযের শহীদানদের সাথে সারা দুনিয়ার মিডিয়া ও নেতাদের এ কেমন ভিন্ন আচরণ। অর্থাৎ সন্ত্রাসী হামলা যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে হয় তখন এর ব্যাপক নিন্দা করা হয়। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হয়। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলা যখন কোনো রাষ্ট্রকর্তৃক পরিচালিত হয় এবং তাতে হতাহতের সংখ্যা শত শত হলেও এর জন্য না আছে নিন্দা প্রস্তাব, না কোনো সংহতি পদযাত্রা; না কোনো শোক প্রস্তাব, আর না আছে হতাহতের জন্য কোনো সহমর্মিতা। যেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বর্তমান বিশে^ এক স্বীকৃত বিষয়! আজ আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, কাশ্মির, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন ও মায়ানমারে এ চিত্রই দেখা যাচ্ছে। ইনসাফ বলতে কোনো কিছুই যেন আর নেই। মানবতা এখন মৃতপ্রায়।

নাইন ইলেভেনের পর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তবে হাঁ, শর্ত শুধু একটাই- হামলার লক্ষ্যবস্তু মুসলিম হতে হবে।

কিন্তু আফসোসের বিষয় হল মুসলমানদের মিডিয়া ও মুসলিম দেশগুলোও তাই করছে, যা আমেরিকা চাচ্ছে। আমাদের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোর কথাই ধরুন! ভারতীয় চিত্র নায়িকা শ্রীদেবীর মৃত্যুতে রাত-দিন কভারেজ করে শোক পালন করা হল।  কিন্তু কুন্দুযে শাহাদাত বরণ করা নিষ্পাপ শিশুদের রক্তমাখা শরীর ঐ মিডিয়াগুলোর চোখে পড়ল না, শহীদানদের পিতা-মাতার আহাজারি নজরে আসল না।

আফগানিস্তানের পাশের মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। মালালা বন্দুকধারীদের গুলিতে আহত হওয়ার পর পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ঐ হামলাকে সভ্য মানুষের ওপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু কুন্দুযের শহীদানদের ব্যাপারে সবাই নিশ্চুপ।  প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই চুপটি মেরে বসে থাকা। কেন কুন্দুযের মাদরাসার হাফেজ শিশুগুলোর জন্য মুসলিম রাষ্ট্রের নেতৃবর্গের কোনো বিবৃতি এল না? কেন কেউ এর প্রতিবাদে মুখটুকুও খুলল না?

যারা মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত এবং শার্লি এবদোর ঘটনার ব্যাপারে সোশ্যাল মিডিয়াতে কয়েকদিন আফসোস প্রকাশ করেছিলেন, তাদের অনেকের কাছেই শতাধিক হাফেজের শাহাদাতের ব্যাপারে আফসোস প্রকাশ করা ও মার্কিনীদের  জুলুমের নিন্দা করার  জন্য একটু সময়ও নেই। কেউ তো এ প্রশ্নটুকুও তুলল না যে, তাদের অপরাধ কী ছিল? তারা তো হাফেজে কুরআন ছিল। তারা তো মুসলমানদের নেক সন্তান ছিল। এটাই কি তাদের অপরাধ। যে যেখানেই এ ধরনের হামলার শিকার হোক- এ এক মহা জুলুম! কুন্দুযের ঘটনা সন্ত্রাসবাদের একটি নির্মম চিত্র।

এ ঘটনাকে সকলের সামনে নিয়ে আসার দায়িত্ব ছিল মিডিয়ার। কিন্তু মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ যে ওদের হাতেই। তাই এ মিডিয়াই আমাদেরকে কাঁদায় আবার হাসায়। এখন তো মিডিয়ার ক্ষমতা ও প্রভাব এ পরিমাণ হয়েছে যে, কে জালিম আর কে মাজলূম এর ফায়সালা মিডিয়া করে। আফগানিস্তানে হামলা করা দরকার ছিল, মিডিয়া পথ প্রস্তুত করে দিয়েছে। ইরাককে ধ্বংস করা দরকার ছিল, আত্মবিধ্বংসী অস্ত্রের মিথ্যা অজুহাত মিডিয়ার মাধ্যমেই দাঁড় করানো হয়েছে। লিবিয়াতে হামলা করা দরকার ছিল, তো কর্নেল গাদ্দাফিকে দুঃশাসক হিসেবে এই মিডিয়াই প্রকাশ করেছে।

তাই মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মিডিয়ার প্রতি অনুরোধ, একটু  ভেবে দেখবেন কি, পশ্চিমা বিশ্ব ও পশ্চিমা মিডিয়ার ছায়া হয়ে আমরাও নিরপরাধ মুসলমানদের রক্ত নিয়ে খেলা করছি না তো?

 

advertisement