Shaban-Ramadan 1439   ||   May-June 2018

মাওলানা হাফেজ শামসুল আলম চাটগামী হুযুর রাহ.

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

তিনি চিটাগাংয়ের হুযুর; চাটগামী হুযুর নামেই বিখ্যাত ছিলেন। শেষের কয়েকটি বছর বাদ দিলে প্রায় পুরো জীবনই তিনি ইলমে নববীর আলো ছড়িয়ে গেছেন নিজ জেলার বাহিরে এবং প্রধানত রাজধানী ঢাকার তৎকালীন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগে।

গত শতাব্দীর আশির দশকে লালবাগ মাদরাসায় হিদায়া জামাতে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমবার বাড়ী গিয়েই আমার আব্বাজান মাওলানা শামসুল হক দামাত বারাকাতুহুম থেকে শুনতে পেলাম লালবাগে তাঁর একজন সঙ্গী আছেন। চাটগামী হুযুরকে সে পরিচয় দেয়ার পর হুযুর বললেন, তোর বাবা দরবেশ ছিল, বেশি লেখাপড়া করত, বুড়ো হয়ে পড়াশুনা শুরু করেছে, বয়সে আমার অনেক বড় ইত্যাদি। সেই থেকে হুযুরের কাছ থেকে উস্তায ও পিতৃস্নেহ দুটিই পেয়ে এসেছি আক্ষরিক অর্থে।

দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর একজন নামকরা উস্তায ছিলেন মাওলানা নাদেরুযযামান রাহ.। তাঁর ঘরেই জন্মগ্রহণ করেন পরবর্তী যুগের চাটগামী হুযুর হযরত মাওলানা শামসুল আলম রাহ.। হাটহাজারী এলাকাতেই তাঁদের পৈত্রিক নিবাস।

শামসুল আলম অর্থ পৃথিবীর সূর্য, তিনিও জন্মেছিলেন সু-দর্শন আলোকিত হয়ে। অল্প বয়সেই নিজ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছেন; এক বছরেরও কম সময়ে কুরআনে কারীমের হিফয সম্পন্ন করেছেন। সে থেকেই হাটহাজারীতে তিনি হাফেয শামসুল আলম নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছেন। অসাধারণ মেধার অধিকারী এই তালিবে ইল্ম দরসে নেযামীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করেন মাদারে ইলমী দারুল উলূম হাটহাজারীতেই। এখানে স্বীয় পিতা ছাড়াও তিনি উস্তায হিসেবে পেয়েছেন মুফতী আযম ফয়জুল্লাহ রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল ওয়াহ্হাব (মুহতামিম) রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল কাইয়ূম রাহ., খতীবে আজম মাওলানা সিদ্দীক আহমদ রাহ., হযরত মাওলানা আবদুল আযীয রাহ., হযরত মাওলানা আবুল হাসান রাহ., হযরত মাওলানা হাফেযুর রহমান রাহ. এর মত দেশবরেণ্য শ্রেষ্ঠ উলামা-মাশায়েখকে।

দারুল উলূম হাটহাজারীতে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করার পর তিনি চলে যান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত জামেয়া আশরাফিয়া করাচীতে। সে আমলে এটি ছিল পুরো পাকিস্তানের ইলমে ওহীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মারকায। এখানে তখন দরসে হাদীস ও তাফসীর অলংকৃত করতেন মাওলানা ইদ্রীস কান্ধলভী রাহ., মাওলানা রাসূল খান রাহ.-এর মত ব্যক্তিত্বগণ। ভারত ভাগ হওয়ার পর দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে এ ব্যক্তিত্বগণ লাহোরে একত্রিত হন। মাওলানা শামসুল আলম  তাঁদের নিকট হাদীস ও তাফসীর অধ্যয়ন করেন।

লাহোরের অধ্যয়ন শেষে দেশে ফিরেই লেগে পড়েন ইলমে ওহীর মহান খেদমতে। বেশ কয়েকটি বড় বড় মাদরাসায় হাদীস-তাফসীর ও অন্যান্য বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো অত্যন্ত সুনামের সাথে পড়িয়েছেন তিনি। শুরু জীবনে বেশি দিন তাদরীসী খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন পোরশা দারুল হিদায়া মাদরাসায়। এখানে তিনি শাইখুল হাদীসের দায়িত্বও পালন করেছেন। প্রায়  ১৫ বছরের শিক্ষকতা কালে উত্তরবঙ্গের এ জেলায় তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপকভাবে। সে সূত্রেই লালবাগের মুরুব্বীগণ তাঁর খোঁজ পান। এবং একসময় দরজায়ে উল্ইয়ার উস্তায হিসাবে তাঁকে নিয়ে আসেন। আগেই বলা হয়েছে, সে সময়ের লালবাগ মাদরাসা ছিল অন্যতম দেশশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ., হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ (মুহাদ্দিস হুযুর), হযরত মাওলানা আজীজুল হক (শাইখুল হাদীস), হযরত মাওলানা মুফতী আবদুল মুইয (খতীব বায়তুল মুকাররম), হযরত মাওলানা  আবদুল মজীদ ঢাকুবী হুযুর, হযরত মাওলানা সালাউদ্দীন (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বগণের সমাবেশ ছিল এখানে। চাটগামী হুযুর এখানে এসেও তাঁর যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। উপরোক্ত মহান ব্যক্তিত্বদের মাঝেও তাঁর নিজস্ব পরিচিতি ও পড়াবার আপন বৈশিষ্ট্য ছিল। জামিআর প্রিন্সিপাল মুহাদ্দিস সাহেব হুযুর রাহ.-সহ সকল আকাবির উস্তাযের তিনি আস্থাভাজন ছিলেন।

লালবাগ জামেয়ায় তাঁর দরস থাকত প্রধানত উপরের চার জামাত- হেদায়া, জালালাইন, মিশকাত ও দাওরায়। তাফসীরের কিতাব পড়াতেন খুবই যওক-শওকের সাথে। প্রায়ই প্রসঙ্গ টেনে আনতেন স্বীয় উস্তায শাইখুত তাফসীর মাওলানা ইদ্রীস কান্ধলভী রাহ.-এর।

একসময় লালবাগে কিছু বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে। দুই ধাপে মুরুব্বী উস্তাযগণের অনেকেই ভিন্ন জায়গায় চলে যান। তখন চাটগামী  হুযুরেরও মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তিনি লালবাগেই থেকে যান। প্রায় তিন দশক ঢাকায় খেদমত আঞ্জাম দেয়ার পর তাঁকে হাটহাজারী মাদরাসার মুরুব্বীগণ সেখানে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানান। ২০০৪ সনে সেখানে হাদীসের উচ্চস্তরের উস্তায হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকে ইন্তিকাল পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। যদিও অসুস্থতাজনিত কারণে শেষ বছরগুলোতে আর দরস দিতে পারেননি। দারুল উলূম হাটহাজারীতে বুখারী, তিরমিযী, বাইযাবী ইত্যাদি কিতাব পড়িয়েছেন। এখানে তিনি মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।

চাটগামী হুযুর তাঁর পুরো জীবন ইলমে দ্বীনের পেছনে ব্যয় করেছেন। মাঝেমাঝে ইদরীস কান্ধলভী রাহ.-এর একটি পংক্তি বেশ জযবার সাথে পড়তেন।

روح پدرم شاد كہ گفت باستاد + فرزند مرا عشق بياموز دیگر ہيچ

অর্থাৎ, আমার পিতার রূহ যেন থাকে চির শান্তির ছায়ায়, উস্তাযকে তিনি এই নিবেদন করেছিলেন যে, বাছাকে আমার দিয়েন ইশকের পাঠ (ইশকে ইলাহী, ঈমানী ও দ্বীনী জযবা) আর সবই তো তুচ্ছ।

ইলমে ওহীর খেদমতে নিয়োজিত থেকে নিজেই শুধু সন্তুষ্ট ছিলেন না; বরং পাঁচ ছেলের সকলকেই দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিয়েছেন। তাদের একজন মাওলানা মাহমুদুল আনোয়ার তাঁর জীবদ্দশাতেই ইন্তিকাল করেন। দ্বিতীয় ছেলে হাফেয মাওলানা শহীদুল আনোয়ার ঢাকার বড় কাটারা মাদরাসায় তাদরীসী খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন।

অসাধারণ সচ্চরিত্র ও দুনিয়াবিমুখ তবীয়তের অধিকারী ছিলেন চাটগামী হুযুর। সকলের সাথে নরম ও নীচু স্বরে কথা বলা, হাসিমুখে মিলিত হওয়া ছিল তাঁর স্বভাবের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

দুনিয়ার মোহ তাঁর মধ্যে ছিল না। কিছু টাকা-পয়সা হাতে আসলে খরচ করে ফেলতেন। বেশি খরচ হত মেহমানদারির পেছনে। এত অতিথিপরায়ণ লোক কমই দেখা যায়।

ঢাকার খান মুহাম্মাদ মসজিদে বহু বছর ইমামতি ও খেতাবত করেছেন। তাঁর সুমধুর কণ্ঠের তিলাওয়াতে মুগ্ধ হতেন সকলে। মুসল্লীগণের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি।

আমার আসাতিযায়ে কেরামের মধ্যে খাস মুশফিক উস্তায ছিলেন চাটগামী হুযুর। আব্বাজানের সহপাঠী হওয়ায় হুযুর নিজ সন্তানদের মত ¯েœহ করতেন। কর্মজীবনের প্রথম কয়েক বছর প্রায় প্রতিদিন বিকেলে মোলাকাতের জন্য যাওয়া হত। শেষের দিকে দূরত্ব ও ব্যস্ততা এবং গাফলত ও দুর্বলতা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে।

হুযুর ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। আমিও আটকে গেছি কাজের  বেড়াজালে। অনেকদিন দেখা না হওয়ায় মন কাঁদছিল। পরে ২০১৪ ডিসেম্বরে নিজ দুই ছেলে মুহিব্বুল্লাহ হাসান ও নূরুল্লাহ হোসাইনকে সঙ্গে নিয়ে হুযুরকে দেখতে যাই চট্টগ্রামে। তখন তিনি অসুস্থ। দেখে আবেগাপ্লুত হন। দুআ করেন। মেহমানদারির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যদিও তখন তাঁর মানসিক অবস্থা দরস দেওয়ার উপযোগী ছিল না, তথাপি বারবার বলছিলেন আমি মাদরাসায় যাব, আমি মাদরাসায় যাব। ছেলেরা বুঝিয়ে ফেরাচ্ছিলেন।

চাচী আম্মা (হুযুরের আগেই ইন্তিকাল করেছেন) অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ ছিলেন। হুযুর স্মৃতিচারণ করলেন- ‘পঞ্চাশ বছরের অধিককালের দাম্পত্য জীবনে একবারও ঝগড়া-বিবাদ হয়নি।’ তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে, নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সান্ত¡না দেয়ার ভাষা নেই। আমার মনে পড়ে গেল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস-

خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ

‘তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে বেশি ভালো বলে বিবেচিত’। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮৯৫

কাছের লোকেরা জানতো- তাঁদের দু’জনের সম্পর্ক এমনই ছিল।

দারুল উলূম হাটহাজারীর অদূরে অবস্থিত আমাদের চাটগামী হুযুরের এই পৈত্রিক নিবাসে আসা হয়েছে আরো অনেকবার। থাকা হয়েছে। হুযুরের সাথে খোশ-গল্প হয়েছে; কিন্তু আজ হুযুরের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখে বেশি সময় অবস্থান করা কঠিন ছিল। তাঁর বড় দুই ছেলে হাফেয মাওলানা হাবীবুল আনোয়ার (আলমগীর) ও মাওলানা তাওহীদুল আনোয়ার আন্তরিকতার সাথে মেহমানদারি করলেন। আমরা বিদায় নিয়ে বের হলাম। কে জানত, এটিই ছিল চাটগামী হুযুরের সাথে শেষ সাক্ষাৎ!

গত ১৮ রবিউস সানী ১৪৩৯ হিজরী মোতাবেক ৬ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রায় ৮৫ বছর বয়সে তিনি এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। দারুল উলূম হাটহাজারীর কবরস্থানেই তাঁর দাফন হয়েছে।

চাটগামী হুযুর চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন অর্ধশতাব্দীরও বেশিকাল যাবৎ তৈরি করে যাওয়া অসংখ্য আলেমেদ্বীন, যারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের সুমহান খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন। সদাকায়ে জারিয়ার এ ধারা কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে ইনশাআল্লাহ।

জীবনী লিখে আমি অভ্যস্ত নই। চাটগামী হুযুরের কথা লিখতে গিয়ে তাঁর সাথে ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে। আর লম্বা করতে পারলাম না। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন! তাঁর কবরকে ‘রওজাতুম মিন রিয়াযিল জান্নাহ্’ বানিয়ে দিন। আমাদের চাচীআম্মাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। তাঁর পরিবার-পরিজনদের সিহ্হাত ও আফিয়াতের সাথে সীরাতে মুস্তাকীমের উপর কায়েম রাখুন- আমীন।

আলকাউসারের পাঠকদের কাছেও একই দুআর আরজ করছি।

 

advertisement