আসছে রমাযানুল মুবারক : আমাদের জীবন ও কর্ম আলোকিত হোক মাহে রমযানের শিক্ষায়
বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আসছে শা‘বান ও রমযান। বর্তমান সংখ্যাটি শা‘বান-রমযান যৌথ সংখ্যা। রমাযানুল মুবারকের নাম আমাদের মন-মানসে এক নতুন অনুভূতি জাগ্রত করে। স্নিগ্ধতা ও পবিত্রতার অনুভূতি। এই মাসটি একটি মহিমান্বিত মাস, যার ফযীলত ও মর্যাদা কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে। এই মাস মুমিনের নব চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার মাস। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অন্বেষণে অগ্রণী হওয়ার মাস। স্বয়ং আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মাসে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হতেন। তাঁর সাহাবীগণকেও ইবাদত-বন্দেগীতে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাই মুমিনের কাছে এই মাস আলাদা মহিমা ও তাৎপর্য নিয়ে আগমন করে। মুমিনের কর্তব্য, ইবাদত-বন্দেগীতে অগ্রসর হওয়ার পাশাপাশি চাল-চলন, আচার-আচরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি সবক্ষেত্রে একটি আদর্শিক ছাপ রাখার চেষ্টা করা।
প্রতি রমযানেই নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটি আমাদের জন্য লজ্জার। যদিও অনেক বিত্তশালী মুসলিম এ মাসে প্রচুর দান করে থাকেন, অনেকে যাকাত দিয়ে থাকেন, দুস্থ-অসহায়ের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন, রোযাদারদের ইফতার করিয়ে থাকেন, কিন্তু এইসব নেক আমল ও জনকল্যাণমূলক কাজ চাপা পড়ে যায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কাছে। একারণে মুসলিম ব্যবসায়ীদের কর্তব্য, কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করে হলেও রমাযানুল মুবারকে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা। এতে যেমন মুসলমানদের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হবে তেমনি মানবসেবারও ছওয়াব পাওয়া যাবে।
রমাযানুল মুবারককে উপলক্ষ করে আমাদের সমাজে যদি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে সেটি হবে অতি সুখের ব্যাপার। ইসলামে নিষিদ্ধ বিষয়াদি- সুদ, ঘুষ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, ইভটিজিং, মাদকের ব্যবহার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়া উচিত। রমাযানুল মুবারকের ভাবমর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলো যদি এইসব অনাচার নির্মূলে সংকল্পবদ্ধ হয় তাহলে সুফল আসতে পারে। এই ইতিবাচক ও জাতিগঠনমূলক কর্মকা-ের পরিবর্তে গোটা রমযান মাস জুড়েই অব্যাহত থাকে অশ্লীল বিনোদনমূলক প্রচার ও সম্প্রচার । বিশেষত ঈদ-বিনোদনের নামে নাটক-সিনেমার যে সয়লাব এদেশের মিডিয়াগুলোতে বয়ে যায় তাতে যেকোনো সচেতন মুসলিমেরই মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার কথা। সস্তা বিনোদনের স্থলে মিডিয়াকে জাতি ও চরিত্রগঠনে কাজে লাগানো আমাদের কর্তব্য। মাহে রমযানের ভাবমর্যাদা ও মুসলিমমানসে এর প্রভাবকে সফলভাবে কাজে লাগানো গেলে এপথে অনেকদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব।
এই পবিত্র মাসের বিশেষ ফরয ইবাদত হচ্ছে সওম। ঈমানের পর যে চারটি বিষয়কে ইসলামের রোকন বলা হয়েছে সওম তার অন্যতম। কাজেই যার উপর সওম ফরয এমন প্রত্যেকের কর্তব্য, যতেœর সাথে এই ফরয ইবাদতটি আদায় করা। ইসলামে ফরয ইবাদত-আমলের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি, এর মাধ্যমেই অর্জিত হয় আল্লাহ্র সবচেয়ে বেশি নৈকট্য। কাজেই নফল ইবাদত-আমলে কিছু ত্রুটি হলেও ফরয-ওয়াজিবে ত্রুটি হওয়া উচিত নয়; বরং গুরুত্বের সাথে তা পালন করা উচিত। একইসাথে কর্তা ব্যক্তিদের দায়িত্ব রোযাদার কর্মীর কাজের ভার কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করা। এটি যেমন এক রোযাদার বান্দার উপর অনুগ্রহ তেমনি একটি ফরয ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতা। পাশাপাশি তা ফরয আদায়ে উৎসাহিত করারও একটি উপায়।
যারা রোযা রাখেন তাদের জন্যেও রয়েছে উন্নতির সুযোগ। কারণ পানাহার ও স্ত্রী-মিলন থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি রোযাদারের কর্তব্য, সব রকমের অন্যায়-অনাচার থেকেও বেঁচে থাকা। কটূক্তি-ঝগড়া-বিবাদ ও অশোভন উচ্চারণ থেকেও বেঁচে থাকা। হাদীস শরীফে আছে, ‘যখন তোমাদের রোযার দিন আসে তখন তোমরা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে বিরত থাকবে। কেউ যদি ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হয় তাহলে বলবে, আমি রোযাদার।’ কাজেই রোযাদারের রোযার পূর্ণতা সাধনের জন্য সবরকমের অন্যায়-অশোভন কাজ থেকে বিরত থাকাও কর্তব্য। বলা বাহুল্য, মুমিন যদি একমাস এভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখার চেষ্টা করে, ইনশাআল্লাহ তার স্বভাব-চরিত্রে, কথা ও কাজে পরিবর্তন সাধিত হবে। এভাবেই রোযা মানবজীবনে শুদ্ধি ও পরিশুদ্ধির বার্তা নিয়ে আসে।
মাহে রমযানের আরেক বিশেষ ইবাদত তারাবী। গোটা মুসলিম জাহানে তারাবীর নামায অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে আদায় হয়ে থাকে। তারাবী অতি বরকতময় সুন্নত। আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুবারক যামানা থেকেই তারাবী মাহে রমযানের অতি ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। ঐকান্তিকতা ও একনিষ্ঠতার সাথে এই ইবাদতে মশগুল থাকা কাম্য। কোনো কোনো জায়গায় তারাবীর রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক হতে শোনা যায়। কোনো কোনো মহল থেকে নানা প্রকারের লিফলেট ইত্যাদিও বিতরণ হয়। এই সকল কর্মকা- খুবই অশোভন ও অনুচিত। এ সংক্রান্ত বিচ্ছিন্ন মতামতের অসারতা প্রমাণ করে গবেষক আলেমগণ দলীলভিত্তিক পর্যাপ্ত আলোচনা করেছেন। কাজেই সাধারণ মুসলমানের কর্তব্য, কল্যাণ-অন্বেষার এই মাসে অর্থহীন বিবাদ-বিতর্কে না জড়ানো। আলিমগণের নির্দেশনা অনুসারে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা। কেউ বিতর্ক করতে এলে তাকে বলে দেওয়া যে, বিষয়টি আলিমদের সাথে আলোচনা করুন।
তারাবীর নামাযের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ের রেওয়াজও ক্রমবর্ধমান। আর তা হচ্ছে মেয়েদের মসজিদের জামাতে শামিল হওয়া। এই প্রবণতাকে উৎসাহিত করার উপায় নেই। কারণ একে তো মেয়েদের জন্য নিজ ঘরে নামায পড়াই কাম্য, যা সহীহ হাদীস-আছার দ্বারা প্রমাণিত, তাছাড়া নারী-পুরুষ উভয় শ্রেণির মাঝেই প্রকৃত দ্বীনদারীর ক্রমাবনতি বিষয়টিকে আরো নাযুক করে দিয়েছে। একারণে উম্মাহ্র ফকীহ-মুজতাহিদগণের কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত অনুসারে মেয়েরা যদি নিজ গৃহে নামায আদায়ে সম্মত হন তাহলে সেটিই তাদের জন্য অধিকতর পুণ্য ও কল্যাণের বিষয় হতে পারে।
মাহে রমযান ঈমান ও ইহতিসাবের ক্ষেত্রে অগ্রসরতার মাস। ঈমান মানে বিশ্বাস, আর ইহতিসাবের মর্মার্থ প্রত্যাশা। এই মাসের সকল ইবাদত-আমলে ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস ও প্রত্যাশার প্রেরণা জাগরূক রাখা কর্তব্য। হাদীস শরীফে এ মাসের সিয়াম-কিয়ামে ঈমান ও ইহতিসাবের চেতনা জাগ্রত রাখার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে রমযানের রোযা রাখে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে রমযানের রাতে আল্লাহ্র ইবাদতে দাঁড়ায় তারও পেছনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। তাই রমযান মাস ঈমানী চেতনায় অগ্রগামী হওয়ার মাস। আল্লাহ তাআলা যা যা সংবাদ দিয়েছেন সকল সংবাদে দৃঢ় বিশ্বাস, যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার গভীর প্রত্যাশা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশাই আল্লাহ্র ইচ্ছায় মুমিনকে পরিচালিত করে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির পথে। আমল ও ইবাদতকে করে তোলে সার্থক ও প্রাণবন্ত। অধিকারী করে দুনিয়া-আখেরাতের সৌভাগ্য ও প্রাপ্তির। এই একমাসের অনুশীলনের মাধ্যমে মুমিনের গোটা জীবনটি হয়ে উঠতে পারে ঈমান ও ইহতিসাবের জীবন; বিশ্বাস ও প্রত্যাশায় আলোকিত জীবন।
রমাযানুল মুবারকের শেষ দশ দিন আরও বরকতময়। এই দশকের যে কোনো বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভাবনা। তাই এসময়টা সর্বোচ্চ আগ্রহ নিয়ে ইবাদতে মশগুল থাকা কাম্য ছিল। অথচ এখন আমাদের সমাজে চালু হয়েছে ঈদশপিংয়ের সংস্কৃতি, যার চক্করে পড়ে অনেক দ্বীনদার মানুষেরও দশকের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। অন্তত দ্বীনদার মানুষের এই ক্ষতিকর রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসা কর্তব্য।
এই মহিমাপূর্ণ মাসের জন্য আমাদের আরো কর্তব্য একটু আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া। এই প্রস্তুতি চেতনাগত, বিশ্বাসগত ও ব্যবস্থাপনাগত। মুমিন যখন ভালো কাজের সংকল্প করে এবং আল্লাহ্র উপর ভরসা করে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাআলা তার জন্য পথ খুলে দেন। শা‘বান থেকেই ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে থাকা যায়। আর ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান’ অর্থাৎ চৌদ্দ শা‘বান দিবাগত রাতে (শবে বরাতে) সুন্নাহসম্মত পন্থায় ইবাদত-বন্দেগীও আল্লাহ্র নৈকট্য ও ক্ষমার এক বড় উপায়। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির প্রতি বিশেষ রহমতের দৃষ্টি দান করেন এবং মুশরিক ও শত্রুতা পোষণকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন। কাজেই এ রাতের কদরদানী কর্তব্য।
এ রাতকে ঘিরেও আমাদের সমাজে রয়েছে নানা প্রান্তিকতা। কেউ এ রাতকে শবে কদরের চেয়েও বেশি ফযীলতের মনে করে। এটা ভুল। কেউ নানা রকমের রসম-রেওয়াজে লিপ্ত হয়। এটাও বর্জনীয়। অন্যদিকে কেউ কেউ এ রাতের আলাদা গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। এটাও প্রান্তিকতা। এই সকল প্রকারের প্রান্তিকতা থেকে বেঁচে এই রাতে সাধ্যমত ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা ভালো ও কাম্য।
মাহে রমযান আমাদের সবার জীবনে মোবারক হোক। ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসুক। আমাদের ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন থেকে সকল আবিলতা দূর হয়ে যাক। আমাদের চিন্তা-ভাবনা মন-মানস, কর্ম ও আচরণ উজ্জ্বল হয়ে উঠুক মাহে রমযানের শিক্ষায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করুন ও কবুল করুন- আমীন।