Jumadal Akhirah 1431   ||   June 2010

জীবন-নদীর বাঁকে বাঁকে-৪

Mawlana Abdullah Bin Sayeed Jalalabadi

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ-ফরাসী-ইটালি মিত্রশক্তি যখন মুসলিমজাহানের কেন্দ্রীয় শক্তি তুরস্ককে খণ্ড বিখণ্ড করে ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছিল তখন বৃটিশ ভারতে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে থাকে। বিশেষত আমাদের সিলেট জেলায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। মাওলানা আবদুল হক মুখতারপুরী (১৮৯৮-১৯৪২)-এর নাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি কোলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯১৭ সালে ‘ফখরুল মুহাদ্দিসীন’ ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ যখন ‘তরকে মুয়ালাত’ বা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং একই সাথে হিন্দু-ভারতের জাতির জনক মোহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধীও এই আহ্বান জানান তখন সংবাদপত্রে, সভাসমিতিতে, মসজিদের খুতবায় সর্বত্র অসহযোগের আহ্বান ঘোষিত হতে থাকে। তখন মাওলানা মুখতারপুরী ১৯১৮ সালের ১৮ নভেম্বর চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে সিলেট এসে খিলাফত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ও তার সম্বন্ধী ডা. মুর্তজা চৌধুরী (১৮৯৬-১৯৭১ ঈ.) ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে করণসী কালীগ্রামে একটি মাদরাসা স্থাপন করেন। ঐ বছর শীতের শেষে বালাগঞ্জের আওরঙ্গপুরে তাঁদেরই উদ্যোগে এবং আওরঙ্গপুরের জমিদার ভ্রাতৃদ্বয় আফরোজ বখত চৌধুরী ও ইয়াত্তর বখত চৌধুরীর অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় সিলেটে ওলামা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা সহূল উছমানী ভাগলপুরী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন সিরাজগঞ্জের অনলবর্ষী বক্তা মাওলানা কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী। ভাটিপাড়ার মাওলানা আবদুল মুকীত চৌধুরী ও ফুলবাড়ির মাওলানা আবদুল বারীর ভাষণেও উপস্থিত জনতা অত্যন্ত উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। মাওলানা আবদুল মুকীতও সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসায় অধ্যাপনার সরকারী চাকুরি ত্যাগ করে আন্দোলনে নেমেছিলেন। ১৯২০ সালের জুলাই মাসে সিলেটে যথারীতি সিলেট জেলা খেলাফত কমিটি গঠিত হয় এবং হাওয়া পাড়ায় মৌলবী আবদুল্লাহ বিএল-এর বাসভবনে এর অস্থায়ী অফিসও প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে তা স্থানান্তরিত হয় নয়া সড়কস্থ মানিক পীরের টিলা সংলগ্ন খেলাফত বিল্ডিং-এ। মাওলানা মাদানী এখানে সরকারী মাদরাসার ত্যাগী ছাত্রদের হাদীসের দরস দিতেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসানের কাছে পত্র লিখে অনুরোধ করে মাওলানা মাদানীকে এ উদ্দেশ্যে প্রথমে আনিয়েছিলেন কোলকাতায়। তারপর তিনি সিলেটে আসেন। ডা. মুর্তজা চৌধুরী ছিলেন এর সার্বক্ষণিক দফতর সম্পাদক। ১৯২০ সালের ৩০ আগস্ট সিলেট টাউন হলে সুরমাভেলী রাষ্ট্রীয় সম্মেলনের পঞ্চম অধিবেশন এবং সুরমাভেলী মুসলিম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে সর্বভারতীয় কংগ্রেসনেতা সিলেটের পৈলনিবাসী বাগ্মী বিপিন পাল এবং মাওলানা আকরাম খাঁর সভাপতিত্বে। সুরমাভেলী বলতে সম্মিলিতভাবে সিলেট ও কাছাড় জেলা (বর্তমান আসাম)কে বোঝানো হত। ১৯২১ সালে মৌলবী বাজার মহকুমার (বর্তমানে জেলা) যোগীডহরে রীতিমতো ‘খেলাফত নগর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ উপলক্ষে ডা. মুর্তজা চৌধুরী আহুত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সর্বভারতীয় নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। দেওবন্দের মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানীর আগমনে খেলাফত নগর আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। গঠিত হয় আসাম প্রাদেশিক খেলাফত কমিটি। অনেক টাকা চাঁদা উঠানোর পরও ব্যয় সংকুলান না হওয়ায় ডা. মুর্তজা চৌধুরী নিজের জমি বিক্রি করে ব্যয় সঙ্কুলান করেন। দেশপ্রেম, স্বাধীনতার স্পৃহা ও জাতীয় চেতনা তখন কত তুঙ্গে ছিল এ থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সময় এক ঝাঁক দেশপ্রেমিক কর্মী ময়দানে অবতীর্ণ হন। এদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা সাখাওয়াতুল আম্বিয়া (১৮৯৪-১৯৬৯ ঈ.) মাওলানা ইবরাহীম চতুলী (১৮৯৪-১৯৫৯ ঈ.) মাওলানা আবদুর রহমান সিংকাপনী (১৮৮৯-১৯৬১ ঈ.) ভাদেশ্বরের আবদুল মতিন চৌধুরী (১৮৯৫-১৯৪৮ ঈ.), মাওলানা আবদুল মুসাব্বির (১৮৮৯-১৯৪০ ঈ.), ফজলুল হক সেলবর্ষী (১৮৯৩-১৯৬৮ ঈ.), উকীল আবদুল্লাহ বিএল, মকবুল হোসেন চৌধুরী (১৮৯৮-১৯৫৭ ঈ.), মাওলানা নাযীর উদ্দীন, বালিকান্দি (মৌলভী বাজারের লেখক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ শামসুল ইসলামের পিতা), দুহালিয়ার মর্দে মুজাহিদ আহবাব চৌধুরী (১৮৯১-১৯৭১ ঈ.) পাঠানটুলার মৌলভী আবদুল হামীদ (১৮৮৬-১৯৬০ ঈ.), মৌলভী আবদুল্লাহ বানিয়াচঙ্গী (১৯০১-১৯৭৩ ঈ.) এবং আরো অনেকে। বৃটিশ বিরোধী এ স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রচণ্ডতা ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। আমার মাতৃভূমিতে জন্মগ্রহণকারী কয়েকজন কৃতি পুরুষ, গোটা ভারতে, এমনকি কেউ কেউ গোটা পৃথিবীতে খ্যাতি লাভ করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন, বিখ্যাত শিক্ষাবিদ পাঠানটুলার মৌলভী আবদুল করীম (১৮৬৩-১৯৪৩ ঈ.), নেদারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম (ইসলামী বিশ্বকোষ)-এ তার জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। তার লিখিত ইসলামিক কনট্রিবিউশন টু সাইন্স এন্ড সিভিলাইজেশন গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার ভারতের ইতিহাস বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লিখিত হয়ে গোটা ভারতবর্ষে পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়েছিল। পূর্বোল্লোখিত মাওলানা আবদুল কাদির (জিতু মিয়ার পিতা) এর আরবী-উর্দু-ফার্সী ভাষায় লিখিত পুস-কগুলিও আন-র্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। দার্শনিক হিসাবে অধ্যক্ষ দেওয়ান মুহাম্মাদ আজরফ, শিক্ষাবিদ আলিম হিসাবে শামসুল উলামা আবু নসর ওহীদ (১৮৭২-১৯৫৩ ঈ.), আন্তর্জাতিক শ্রম আন্দোলন (এলএলও) নেতারূপে বালাগঞ্জের আফতাব আলী (১৯০৬-১৯৭১ ঈ.) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতিরূপে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, লেখকরূপে সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪ ঈ.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতিরূপে জেনারেল আতাউল গণী উছমানী (১৯১৮-১৯৮৪ ঈ.), প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলররূপে ড. এম এ রশীদ (১৯১৯-১৯৮১ ঈ.) বিশ্বমানের ইংরেজি পত্রিকা দৈনিক দ্যা ডন এর সুদীর্ঘ কুড়ি বছরের সম্পাদক (প্রথমে দিল্লী ও পরে করাচি থেকে প্রকাশিত) এবং পরবর্তীতে আইয়ুব খানের মন্ত্রীসভার সদস্য আলতাফ হোসেন (১৯০০-১৯৬৮ ঈ.), বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিরূপে বিচারপতি মাহমুদ হোসেন (১৯১৬-১৯৮২ ঈ.) চৌধুরী গোলাম আকবর (১৯২১-১৯৮৪ ঈ.), বাংলাদেশের সাবেক দুই অর্থমন্ত্রী মুহাম্মাদ সাইফুর রহমান এবং এইচ এম এস কিবরিয়া দু’জনই সিলেটের অধিবাসী ছিলেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তারাও সুপরিচিত। আলেম সমাজের মধ্যে ফখরুল মুহাদ্দিসীন মাওলানা রমীজউদ্দীন সিদ্দীকী (১৮৭৯-১৯৭৯ ঈ.), বাহরুল উলূম মুহাম্মাদ হোসেন (১৮৯০-১৯৭২ ঈ.), শায়খে বাঘা মাওলানা বশীর উদ্দীন ও নাবাপিং মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা রিয়াসত আলী, শায়খে বর্ণভী মাওলানা লুৎফুর রহমান ও মাওলানা আবদুল লতীফ ফুলতলীর অবদানও উল্লেখের দাবি রাখে।

 

advertisement