Rajab 1439   ||   April 2018

অনিচ্ছার যত অনর্থ

Mawlana Abul Bashar Md Saiful Islam

ইচ্ছাশক্তি মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলার এক অমূল্য দান। এর মাধ্যমে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভূত কল্যাণ সাধিত করতে পারে। তাই প্রত্যেকের উচিত এ শক্তির মর্যাদা দেওয়া, যেমন নিজ ইচ্ছার, তেমনি অন্যের ইচ্ছারও। নিজ ইচ্ছার মর্যাদা দেওয়ার অর্থ ইচ্ছার সদ্ব্যবহার করা। যে-কোনও বিষয়ের সদ্ব্যবহারের মানদ- শরী‘আত। শরী‘আত মোতাবেক ব্যবহার করলেই তার সদ্ব্যবহার হয়। সুতরাং ইচ্ছাশক্তির সদ্ব্যবহারও কেবল শরী‘আত মোতাবেক ব্যবহার দ্বারাই হতে পারে। যেকোনও কাজের ইচ্ছা জাগলে শরী‘আতের মানদণ্ডে যাচাই করে দেখতে হবে সে কাজটি শরী‘আত অনুমোদন করে কি না। অনুমোদন না করলে সে কাজের ইচ্ছা দমন করতে হবে। আর যদি অনুমোদন করে, তবে তা যেভাবে করার অনুমোদন করে, ঠিক সেভাবেই করার চেষ্টা করতে হবে, নিজ খেয়াল-খুশিমত নয়। এটাই ইচ্ছার সদ্ব্যবহার এবং এর দ্বারা ইচ্ছাশক্তির যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হয়।

কখনও কোনও ভালো কাজের ইচ্ছা জাগলে অবহেলা না করে তা করে ফেলা উচিত। এটাও ইচ্ছার একপ্রকার মূল্যায়ন ও নি‘আমতের শুকরিয়া। এর একটা নগদ সুফল হল এতে করে অন্তরে সদিচ্ছার ক্রমবৃদ্ধি হয়। বেশি বেশি ভালো কাজ করার ইচ্ছা জাগে। ইচ্ছাশক্তি যখন আল্লাহর দান ও নি‘আমত, তখন কুরআন মাজীদের ঘোষণা মোতাবেক শুক্র ও সদ্ব্যবহার দ্বারা এর বৃদ্ধি ঘটাই স্বাভাবিক।

কর্তব্য অন্যের ইচ্ছাকে মর্যাদা দেওয়াও। এক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা বড় বেশি। আমরা সাধারণত আপন ইচ্ছা নিয়েই মেতে থাকি। অন্যের ইচ্ছার বিশেষ ধার ধারি না। এর ক্ষতি বহুমাত্রিক। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক বহু সম্ভাবনার প্রতিফলন এর ফলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার কারণে অনেক সম্ভাবনার বিকাশে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। অনেক ভালো কাজই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, যখন একের ইচ্ছা অন্যের দ্বারা মূল্যায়িত না হয়। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য কাউকে কোনও ভালো কাজে ইচ্ছুক দেখলে তাকে সে কাজে উৎসাহ যোগানো ও যতদূর সম্ভব তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-

وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی

তোমরা সৎকাজে ও তাকওয়ায় একে অন্যকে সাহায্য কর। -সূরা মায়িদা (৫) : ২

যে কাজে নিজের ইচ্ছা নেই, সে কাজে অন্যের আকাক্সক্ষা পূরণ করা কঠিন বটে। তা যতই কঠিন হোক, নিজের দ্বীন-দুনিয়ার কোনও ক্ষতি না হলে সাহায্যের হাত বাড়াতেই হবে। তা না বাড়ালে অনেক সময় নিজের ইচ্ছাপূরণও অসম্ভব হয়ে যাবে। বাস্তবিকপক্ষে অসম্ভব হয়েও যায়। পারস্পরিক সহযোগিতা না থাকার কারণে আজ পারিবারিক ও সামাজিক বহু কাজ অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। সেই অপূর্ণতা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে আত্মকলহেরও। একজনের একটা কাজ করার ইচ্ছা। সে মনেপ্রাণে চায় কাজটি হোক। কিন্তু তা হতে হলে আরেকজনের সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু তার সেটি করার ইচ্ছা নেই। সে চায় না কাজটি হোক। তাই সে তাতে সাহায্য করতে প্রস্তুত নয়। তার অসহযোগিতার দরুণ কাজটি করা সম্ভব হল না। যে ব্যক্তি মনেপ্রাণে তা চাচ্ছিল, এতে সে আহত হল। সে আঘাত থেকে ক্ষোভেরও সঞ্চার হল। অতঃপর এই একই কাজ সেও করল। সেও অপরজনের কাক্সিক্ষত কাজে অনিচ্ছা দেখাল। তার অসহযোগিতার দরুন ওই ব্যক্তির ইচ্ছাও অপূর্ণ থেকে গেল। সেও অন্তরে আঘাত পেল। এভাবে একের পর এক পারস্পরিক অসহযোগিতার ফলে উভয়ের মনে প্রতিশোধস্পৃহা দানা বাঁধতে থাকল। এখন আর কেউ কারও মুখ দেখতে রাজি নয়। প্রস্তুত নয় কোনওরকম ছাড় দিতে। দিন-রাত কাটে আত্মকলহে। প্রত্যেকের ধান্ধা অন্যজনকে কিভাবে ঠেকাবে এবং তাকে ব্যর্থ ও বাধাগ্রস্ত করবে। এই অশুভ তৎপরতা লক্ষ করা যায় ঘরে ঘরে। সমাজের সর্বস্তরে।

অন্যের শুভ ইচ্ছায় অসহযোগিতা কেবল অশান্তিই ডেকে আনে না, এটা পারিবারিক ও সামাজিক বহুমুখী অনর্থের কারণ হয়ে থাকে। এমনকি এর ফলে পর্যায়ক্রমে অনেক ভালো রেওয়াজ-প্রথাও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ ধারায় ইতোমধ্যে আমাদের সমাজ থেকে কোনও ভালো রেওয়াজ পূর্ণ বিলুপ্ত না হলেও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এর উদাহরণ আছে অনেক।

আতিথেয়তার বিষয়টাই ধরা যাক। প্রাণবন্ত আতিথেয়তা মুসলিম সমাজের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। ইসলামী শিক্ষায় এর গুরুত্ব অনেক। এর আছে অনেক ফযীলত। এক হাদীছে আছে-

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَ الْيَوْمِ الْاٰخِرِفَلْيُكْرِمْ ضَيْفَه

যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার অতিথিকে সম্মান করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮; সুনানে আবূ দাঊদ, হাদীস ৩৭৪৬; মুআত্তা মালিক, হাদীস ৯৫৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৬৪৩

অতিথির সেবা করা নবী-রাসূলগণের সুন্নত ও আদর্শ। এ আদর্শ মুসলিম উম্মাহ যুগ-যুগব্যাপী অনুসরণ করে এসেছে। যথারীতি এক ইসলামী প্রথারূপেই মুসলিম সমাজে এ আদর্শ প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুসলিম উম্মাহ’র দেখাদেখি অন্যরাও এর চর্চা করত। আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগেও দেখা গেছে মেহমান আসাকে বরকতের বিষয় মনে করা হত। গরীব মানুষও অতিথির কদর করত। অতিথির সেবা করতে পারাকে নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করত। তখন অতিথি বলতে আত্মীয় বোঝাত না। আত্মীয়ের বাড়ি আত্মীয়ের যাতায়াত তো ছিল সাধারণ ব্যাপার। আত্মীয়ের সেবা করাতে বাড়তি কোনও মহত্ত্ব ছিল না। তা স্বাভাবিক দায়িত্ব ছিল। না করাটা ছিল অপরাধ। অতিথি হত পথিকজন। চলতি পথের মানুষ দুপুরবেলা কোথায় খাবে? রাত হয়ে গেছে। সে কোথায় রাত যাপন করবে? সামনে যার বাড়ি পড়ত, পথিকের জন্য তার দরজা খোলা থাকত। সে তাকে সাদর সম্ভাষণ জানাত। তাকে দুপুরের আতিথেয়তা গ্রহণের অনুরোধ জানাত। উপস্থিত যা আছে, তা দিয়েই তার আপ্যায়ন করত। তা করতে পারাকে সৌভাগ্য গণ্য করত। সান্ধ্য-পথিককে নিজ বাড়িতে ডেকে নিয়ে আসত। পথিকও নির্ভয়ে নিশ্চিন্তমনে সেখানে রাত কাটিয়ে দিত। লোকে অতিথির অপেক্ষায় থাকত। বাড়ির দরজায় যাকেই পাওয়া যায় ডেকে নিয়ে আসত। শত্রু-মিত্র পার্থক্য করত না। শত্রুকে অতিথি করে নেওয়ার কত বিস্ময়কর ঘটনা আমাদের ইতিহাসগ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায়- অতীতে প্রত্যেক মুসলিমগৃহ ছিল একেকটি মেহমানখানা। এ জাতি আবাসিক হোটেলের সাথে পরিচিত ছিল না। মুসলিম সমাজে এ ধারায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে অন্যদের থেকে। আখিরাতবিমুখ জাতি আতিথেয়তাকে ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। মুসলিম মানসে এটা ছিল পুণ্যার্জনের উপায়। মেহমানের সেবা যতবেশি করা যাবে, আখিরাতের খাতায় ততবেশি পুণ্য জমা হবে। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল মুসলিম এ চেতনা লালন করত। আজ সে ঐতিহ্য কোথায়? আজ পথিক তো দূরের কথা, আত্মীয়ের আগমনকেও উটকো ঝামেলা মনে করা হয়। দুপুর বা রাতের খাবারকালে আকস্মিক কেউ এসে পড়লে তার কা-জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

আমরা অতিথির সমাদর ভুলে গেছি। শত শত বছরের ঐতিহ্য কিভাবে ভুলে গেলাম? হঠাৎ করে ভুলিনি। ভুলেছি পারস্পরিক অসহযোগিতার ধারায়। গৃহকর্তা হয়তো অতিথিপরায়ণ। তার ইচ্ছা ঘরে অতিথির পদধূলি পড়ুক। কিন্তু গৃহকর্ত্রীর সম্মতি নেই। তার কাছে এটা বাড়তি ঝামেলা। তার সহযোগিতা ছাড়া তো অতিথির সেবা সম্ভব নয়। জোর করে করতে গেলে অশান্তি হবে। অগত্যা গৃহকর্তা হাল ছেড়ে দেয়। মনের ইচ্ছা মনের ভেতর চেপে কেবল গুমরে মরে।

এর বিপরীতও আছে। স্ত্রীর বড় ইচ্ছা মেহমান আসুক। নিজ হাতে রেঁধে তাকে খাওয়াবে। কিন্তু স্বামী মহাকৃপণ। মেহমান খাওয়ালে বাড়তি খরচ হবে। বাড়তি খরচ সে মানতে রাজি নয়। তাই স্ত্রীর ইচ্ছা আর পূরণ হয় না। কোনও পরিবারে কেবল স্বামী বা কেবল স্ত্রীর ইচ্ছায় অতিথি সেবা সম্ভব হয় না। একের ইচ্ছায় চাই অন্যের সমর্থন ও সহযোগিতা। তা না থাকায় ওই পরিবার থেকে অতিথি সেবার রেওয়াজ লুপ্ত।

মুসলিম সমাজে আজ এরকম পরিবার বড় কম, যেখানে অতিথি সেবায় একের ইচ্ছায় অন্যের সমর্থন আছে। তা না থাকার দরুন অধিকাংশ পরিবার থেকে ইসলামের এ মহান ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। আজ পথিকজনের কারও বাড়িতে খাদ্যগ্রহণ ও রাত্রিযাপন বলতে গেলে কল্পনার অতীত।

এখন তো এক আত্মীয়কেও বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে যেতে অনেকবার ভাবতে হয়। কারণ জানা আছে, তার যাওয়াকে খুশিমনে গ্রহণ করা হবে না, যেমন সে নিজেও খুশিমনে গ্রহণ করে না। তাই এখন আত্মীয়বর্গের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ হয় কেবল ঈদ মওসুমে, মৃত্যুদিবস ও জন্মদিন পালনে এবং এরকম আরও বিভিন্ন পালা-পার্বণে। কারও বাড়িতে কেবলই বেড়াতে যাওয়ার মধুর যাত্রা এখন শুধু শিশুমনই কল্পনা করতে পারে। বড়দের মনে সে কল্পনা বারণ। কারণ নিজ বাড়িতে যে জিনিসের স্বতঃস্ফূর্ত চর্চা নেই, অন্যের বাড়িতে তা আশা করা যায় কিভাবে? সুতরাং এখন বেড়াতে চাও, তো কোথাও গিয়ে হোটেলে ওঠ। তাতেই স্বস্তি। আহা! মুসলিম মন কিভাবে এমন শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হল? আতিথ্যের মাধুর্য আজ কেন হিসাব-নিকাশের তিক্ততায় পর্যবসিত? এর একটা নিকট কারণ এইও যে, আমরা অন্যের ইচ্ছাকে সম্মান দেখাতে পারি না। নিজ অনিচ্ছাই শেষকথা। অনিচ্ছার শাসনে অন্যের শুভ ইচ্ছা দমন করে রাখি।

উদাহরণ দেওয়া যায় মা-বাবার সেবা দ্বারাও। দিন দিন বৃদ্ধাশ্রমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। মুসলিম সমাজে এ অশুভ প্রবণতার জায়গা কিভাবে হতে পারছে? পারছে এ কারণেও যে, অনেক বাড়িতে পুত্রের একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও বৃদ্ধ মা-বাবার ঠাঁই হচ্ছে না। স্ত্রীর সমর্থন ছাড়া পুত্রের পক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব হয় না। এককালে এ নিয়ে কোনও টানাপোড়েন ছিল না। মা-বাবার সেবাকে পুত্র ও পুত্রবধূ উভয়ে নিজেদের জন্য সৌভাগ্য মনে করত। তখন পুত্র-কন্যারা দ্বীনের শিক্ষায় উজ্জীবিত ছিল। তারা মনে করত দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি পিতামাতার সেবার মধ্যে নিহিত। তাই সেবা করত মনের মাধুর্য দিয়ে। পুত্রবধূও শ্বশুর-শাশুড়িকে পিতা-মাতার মতই ভক্তি-শ্রদ্ধা করত এবং সেই শ্রদ্ধার সাথেই তাদের সেবা করত। তখন বৃদ্ধ পিতামাতাকে কেউ বোঝা মনে করত না। বোঝা মনে করার কল্পনাকেও ভাবা হত কঠিন পাপ। ফলে বৃদ্ধ বাবা-মা পুত্রের সংসারে পরম সমাদরে দিন কাটাত। কিন্তু ইদানীং আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক সংসারে তো পুত্র ও পুত্রবধূ উভয়ের কাছে পিতামাতা বাড়তি বোঝা। এ বোঝা তারা খামোখা টানতে রাজি নয়। হ্যাঁ, খামোখা টানাই বটে! জড়বাদী সভ্যতার ছোবলে যাদের চিন্তা-ভাবনা পুরোপুরি নষ্ট-ভ্রষ্ট হয়ে গেছে, পিতামাতার সেবা তাদের কাছে বেগার খাটুনি ছাড়া কিছুই নয়। হাসিমুখে বেগার মেহনত কে-ই বা করতে চায়? সবাই এর থেকে মুক্তি চায়। সেই মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে পশ্চিমা সভ্যতা। মা-বাবার সেবা থেকে আধুনিক দম্পতির দায়মুক্তির ব্যবস্থা। ভূগর্ভে যাওয়ার আগেই জ্যান্ত দাফনের বৃদ্ধাশ্রম। আধুনিক দম্পতিরা বৃদ্ধ পিতামাতাকে ¯েœহ-মমতা বর্জিত সেই ভূপৃষ্ঠের কবরে চালান করে বাড়তি ভার লাঘবের সুযোগ গ্রহণ করছে। আর ধীরে ধীরে সেই অভিশপ্ত বার্ধক্যযাপনের জন্য নিজেদেরও প্রস্তুত করছে।

একথা ঠিক যে, এ অভিশাপ এখনও পর্যন্ত মুসলিম সমাজকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিতে পারেনি। কিন্তু যেভাবে এর পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং পিতামাতার সেবাযত্ন থেকে আধুনিক মনমানস যে হারে বিমুখ হচ্ছে, তাতে অসম্ভব নয় যে, মুসলিম সমাজও এই লা‘নতী ব্যবস্থার দিকে সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়বে। তখন ছেলেমেয়েরা তাদের পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমের নির্বাসনে পাঠিয়ে নিজেদের জাহান্নামী বানানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলবে! সেই দিন আসার আগে এখনই সকলের হুঁশিয়ার হয়ে যাওয়া উচিত। সচেতন মহলের উচিত দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা নিয়ে মাঠে নেমে পড়া। সর্বস্তরের মানুষকে ইসলামের কল্যাণময় শিক্ষা সম্পর্কে উজ্জীবিত করা না গেলে বেদ্বীনী সভ্যতা-সংস্কৃতির সয়লাবে তাদের দ্বীন-দুনিয়া সব ভেসে যাবে।

যাহোক বলছিলাম পুত্রসংসারে পিতামাতার সেবাযত্নের কথা। এক শ্রেণীর আধুনিক দম্পতি তো এ ব্যাপারে বৃদ্ধাশ্রমের শরণাপন্ন হয়েছে। আরেক শ্রেণী চলছে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে। অনেক পুত্রের ইচ্ছা বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের সংগেই থাকুক। কিন্তু সেই ইচ্ছাপূরণে তার স্ত্রীর সায় নেই। তা তার সায়-সম্মতি না থাকলেও পুত্র নিজ ইচ্ছায় অটল। অগত্যা স্ত্রীকে রাজি হতেই হয়। কিন্তু প্রাণের সাড়া না থাকায় শ্বশুর-শাশুড়ির সেবায় তার আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে না। শ্বশুর-শাশুড়িও তা ঢের বুঝতে পারে। ফলে এ সংসারে তাদের নিজেদের অবাঞ্ছিত মনে হয়। তারা হয়তো নিরুপায়। তাই নীরবে সব অপমান মেনে নেয়। অপেক্ষায় থাকে কবে মৃত্যু আসবে আর এ অবমাননাকর বেঁচে থাকা থেকে মিলবে চিরমুক্তি।

পুত্র চায় পিতামাতা সম্মানজনকভাবেই থাকুক এবং বেঁচে থাকুক অনেকদিন। তাঁদের ছায়া তার সংসারে একান্ত দরকার। তাঁরা তার পক্ষে আল্লাহর রহমত। এ রহমত তাঁরা যতদিন বেঁচে আছেন টের পাওয়া যাবে না। বেঁচে থাকা অবস্থায় টের পাওয়া যায় না। কিন্তু চলে যাওয়ার পর উপলব্ধি করা যায় মর্মে মর্মে। নেক সন্তান দ্বীনের চেতনায় উজ্জীবিত। সে বুঝতে পারে এ রহমতের কত মূল্য। তাই যথাযথ মর্যাদার সংগেই তাঁদের রাখতে চায়। কিন্তু স্ত্রী তো চায় না। এ নিয়ে ঘরে অশান্তি। সুখের দাম্পত্য জীবন অশান্তির ভেতর কাটে। টের পায় বাচ্চারাও। পিতামাতার অসদ্ভাবের প্রভাব তাদের উপরও পড়ে। হয়তো তাদের মধ্যেও পক্ষপাত দেখা দেয়। এভাবে পিতামাতা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, নাতি-নাতনি সব মিলিয়ে গোটা পরিবার গভীর জটিলতার আবর্তে পড়ে যায়। পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে যায় বিষাদময়। কেন এতসব অনর্থ? কেবল এ কারণে যে, স্বামীর ইচ্ছায় স্ত্রী সহযোগিতা করছে না। সে আপন অনিচ্ছা থেকে একচুল সরতে রাজি নয়। যদি অনিচ্ছার কুরবানী দিত, পারিবারিক শান্তির জন্য নিজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বামীর ইচ্ছা মেনে নিত, তবে এই জটিলতার সৃষ্টি হত না।

পারিবারিক জীবনের মাধুর্য রক্ষার জন্য অন্যের বৈধ ও শুভ ইচ্ছার সামনে নিজ অনিচ্ছা অনেক সময় ত্যাগ করতে হয়। ত্যাগের মাহাত্ম্যও বোঝা দরকার। একের ত্যাগ দ্বারা যদি অন্যে আনন্দ পায়, সে ত্যাগ স্বীকার করা একটা মহত্ত্ব। যদি একজনের ত্যাগ গোটা পরিবারের পক্ষে আনন্দদায়ক হয়, তবে সেই একজন কেন ত্যাগ স্বীকারের আনন্দ বোধ করবে না?

যে উদাহরণদু’টি দেওয়া হল, সত্যিকার অর্থে তা ত্যাগের বিষয়ও নয়। কেননা এক্ষত্রে অনিচ্ছা প্রশংসণীয় কিছু নয়। সৎ ও ভালো কাজে অনিচ্ছা নিঃসন্দেহে দূষণীয়। নিজেকে দোষ থেকে রক্ষা করার জন্য হলেও ওই অনিচ্ছা ত্যাগ করা উচিত। একজন মু’মিনের অতিথিসেবায় অনিচ্ছা হবে কেন? কেন একজন মুসলিমনারী স্বামীর পিতামাতাকে নিজের পিতামাতাস্বরূপ গণ্য করবে না? তাদের সেবাযত্নে কেন সে অনিচ্ছুক থাকবে? হাঁ, অনেক নেককার নারী এখনও আছে, যারা শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করতে পারাকে নিজের পক্ষে সৌভাগ্য মনে করে। এরূপ নেককার পুত্রবধূর সেবাযত্নে বহু বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি পুত্রের সংসারে ইজ্জতের সাথে দিন কাটাচ্ছে। নিঃসন্দেহে সেসব নারী দুনিয়ার জীবনেও ইজ্জত পাচ্ছে এবং পরকালেও তাদের এ সেবা নাজাত লাভের একটা বড় কারণ হবে- ইনশাআল্লাহ।

ব্যক্তিবিশেষের অনিচ্ছা অনেক সময়ই সমষ্টির আনন্দ নষ্ট ও আশাভঙ্গের কারণ হয়ে থাকে। হয়তো সকলে মিলে কোথাও বৈধ আনন্দযাত্রার উদ্যোগ নিল। কিন্তু একজনের তাতে অংশগ্রহণের ইচ্ছা নেই। আবার সেই একজনের অংশগ্রহণ ছাড়া অন্যরা যেতেও রাজি নয়। কিংবা তার অংশগ্রহণ ছাড়া তাদের আনন্দ উপভোগ পূর্ণ হওয়ার নয়। তাই তাদের একান্ত ইচ্ছা সে তাদের সংগে থাকুক। তাদের ইচ্ছা থাকলে হবে কি, সে তার অনিচ্ছায় অনড় পাহাড়। যদি তার বিশেষ সমস্যা না থাকে, তবে তাদের আনন্দদানের লক্ষ্যে সে কি পারে না নিজ অনিচ্ছার সংগে লড়তে? তারা আনন্দ পাবে এ দৃষ্টিতে নিজ অনিচ্ছাকে ইচ্ছাতে রূপান্তরিত করা খুব কি কঠিন কাজ, বিশেষত যখন অন্যকে আনন্দদানও একটি ছওয়াবের কাজ? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যকে আনন্দদানের জন্য এমন অনেক কাজ করেছেন, এমনিতে যা তাঁর করার কথা নয়। তিনি সাহাবায়ে কিরামের সংগে রসিকতা করেছেন। নিজে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-এর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে সৈন্যদের সামরিক কসরত দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর সংগে দৌড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত দিয়েছেন। কেন তিনি এসব করেছিলেন? আনন্দ দানের জন্যই কি নয়? অন্যের মুখে হাসি ফোটানো ইসলামের এক মহান শিক্ষা। এতে পুণ্য লাভ হয়। সে পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে নিজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্যদের আনন্দভ্রমণে কিংবা অন্য কোনও বৈধ বিনোদনে অংশগ্রহণ করাই উচিত, যদি না তার বিশেষ ওজর থাকে। প্রকৃত মু’মিন যখন কোনও কাজে ছওয়াবের আশ্বাস পাবে, তখন যদি অনিচ্ছার অবসান না ঘটে বা অবসান ঘটানোর চেষ্টা সে না চালায়, তবে তার পক্ষে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বুঝতে হবে তার দ্বীনী মানসিকতা এখনও ভালোভাবে গড়ে উঠেনি।

অনেক শুভ উদ্যোগ অঙ্কুরেই নষ্ট হতে দেখা গেছে, যার একমাত্র কারণ ব্যক্তিবিশেষের তাতে ইচ্ছা ছিল না। ব্যক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাবশালী হলে এরকম হয়ে থাকে। কেননা এরকম ব্যক্তির সমর্থন ছাড়া সমষ্টির উদ্যোগ সামনে এগোতে পারে না। এমনকি জনস্বার্থমূলক কাজও ব্যক্তিবিশেষের অনিচ্ছার কারণে পণ্ড হয়ে যায়। কয়েক তরুণ মিলে একটি রাস্তা বাঁধা বা সেতু নির্মাণের আগ্রহ ব্যক্ত করল। তারা স্বেচ্ছাশ্রমে সেটি করতে চায়। প্রভাবশালী লোকটির কাছে যখন কথাটি তুলল, সে মুখে কিছুই বলল না। তরুণরা বুঝল এতে তার ইচ্ছা নেই। তার ইচ্ছার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কাজটি করে ফেলবে এমন সাহস তারা করতে পারল না। হয়তো অতীত অভিজ্ঞতা সে সাহস তাদের করতে দেয়নি। অতএব তারা থেমে যেতে বাধ্য হল। অনিচ্ছার জগদ্দল পাথর মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নস্যাৎ করেছে এরকম ঘটনাও বিরল নয়।

বস্তুত ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক উৎকর্ষের পথে অনিচ্ছাও একটি বাধা। এ বাধা অবশ্যই দূর করা উচিত। দূর করা উচিত নিজ সম্ভাবনা বিকাশের স্বার্থেই। একজন ব্যক্তির দ্বারা অনেক কিছু হওয়া সম্ভব। সম্ভব অনেক কিছু করা। সে পারে নিজেকে বহুদূর নিয়ে যেতে। পারে তার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, বিশেষত যারা তার পরিবারের সদস্য, তাদের সুখী করতে। সামাজিক উন্নয়নেও সে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। আর প্রকৃতপক্ষে অন্যদের কল্যাণে ভূমিকা রাখার দ্বারা নিজেরই উন্নতি সাধিত হয়। তো যেসকল কাজ দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজের উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধিত হয়, তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করা উচিত।

অনেক সময় অন্তরে সেই স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না। কেন থাকে না? থাকে না এ কারণে যে, জীবনের আছে নানা পারিপাশির্^কতা। তাতে কখনও উদ্যম হারিয়ে যায়। কখনও বিষণœতা দেখা দেয়। স্বাস্থ্যগত কারণেও শরীর-মন নির্জীব হয়ে পড়ে। ইহজীবনে এ সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা থাকবেই। এসব নিয়েই মানুষ চলে এবং চলতে হয়। বস্তুগত বা জৈবিক দিক থেকে যে সকল কাজ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, তাতে মানুষ পারিপার্শ্বিকতা উপেক্ষা করে। গুরুত্ব বিবেচনায় মনের ইচ্ছা না থাকলেও সেসব কাজ করেই ফেলে।

তো মানুষ যখন জীবমাত্র নয়, সে এক সম্ভাবনাময় সৃষ্টি, অনেকদূর যাওয়ার মত ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সৃষ্টি করেছেন, তখন সে সম্ভাবনার বাস্তবায়ন ও ক্ষমতার প্রতিফলনকেও তার গুরুত্বপূর্ণ মনে করা উচিত। সেক্ষেত্রে তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মানবিকতার বিকাশ সাধন, যা কেবল ইসলামী শিক্ষার অনুসরণ দ্বারাই সম্ভব। ইসলাম যেসকল কাজ করার হুকুম দিয়েছে ও যেসকল কাজের প্রতি উৎসাহ যুগিয়েছে, তা করার দ্বারাই মানবজীবনের প্রকৃত উৎকর্ষ সাধিত হয়। তা দ্বারা মানবিকতার বিকাশ হয়। তা দ্বারা মানবাত্মা এতটা উচ্চতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়, যেখানে পৌঁছা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সেই উচ্চতায় পৌঁছতে হলে নিজ ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত রাখতেই হবে।

কতই না মহান আমাদের ইসলাম! সে ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত রাখার ব্যবস্থাও দান করেছে। সকল ভালো কাজের জন্যই আছে তার পুরস্কারের ঘোষণা। অন্যের সংগে হাসি দিয়ে কথা বললেও ছওয়াব পাওয়া যায়। এমনকি পুণ্য লাভ হয় রসিকতা করলেও। কিন্তু ইচ্ছার অভাবে এসব কাজ করা হয় না। ইচ্ছা হয় না বলে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা হয় না। ইচ্ছা হয় না বলে দ্বীনী বই-পুস্তক পড়া হয় না। ইচ্ছা হয় না বলে দ্বীনী আলোচনার মজলিসে বসা হয় না। ইচ্ছা জাগে না বলে রোগী দেখতে যাই না। ইচ্ছা হয় না বলে আত্মীয়ের খোঁজ নেই না। ইচ্ছা হয় না বলে একজনের মাথার বোঝা নামিয়ে দেই না। ইচ্ছা হয় না বলে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করি না, তুমি কেমন আছ। ইচ্ছার অভাবে একটা গাছ লাগাই না। ইচ্ছা হয় না বলে একজন পথহারাকে পথ দেখিয়ে দেই না। ইচ্ছা হয় না বলে শেষরাতে জাগাও হয় না।

ইচ্ছার অভাবে এভাবে কতশত নেককাজ করা হয় না। পিছিয়ে থাকি হাজারও শুভ উদ্যোগ থেকে। পিছিয়ে থাকি অজস্র পুণ্যার্জন থেকে। পিছিয়ে থাকি জ্ঞানের বিকাশে। আরও পিছিয়ে থাকি জীবনকে কর্মময় করে তোলার অঙ্গনে। অথচ হাদীছ ভাণ্ডারসমূহে আছে ফাযাইলের এক বিস্তৃত অধ্যায়। তা তো এজন্যই যে, মানুষ সৎকাজে উৎসাহ পাবে। নেককাজ করার ইচ্ছা জাগবে।

সুতরাং মু’মিন মুসলিম কেন নির্জীব হয়ে থাকবে? ভালো কাজের ইচ্ছা তার মনে কেন জাগবে না? নিজের থেকে যদি বিশেষ কোনও ভালো কাজের ধারণা মাথায় না আসে, তবে অন্যের দেখাদেখিও সে কাজে তার ইচ্ছা জাগার কথা। তার তো দরকার পুণ্যার্জন। পুণ্যার্জনের জন্য নির্জীব মনকেও অনুপ্রাণিত করবে। অনিচ্ছাকে ইচ্ছায় রূপান্তরিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। আসুন আমরা আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে জাগ্রত ও শাণিত করে তোলার চেষ্টা করি, অন্যের ইচ্ছাকে সম্মান জানানোর মানসিকতা অর্জন করি, অনিচ্ছার জগদ্দল পাথর সরিয়ে পুণ্যার্জনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হই এবং নিজ ইচ্ছাকে পবিত্র শরী‘আতের অনুগামী বানানোর সাধনায় লেগে পড়ি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

 

advertisement