পয়লা বৈশাখ : সুসংস্কৃতির চর্চা কাম্য
১৪২৪ বাংলা সাল সমাপ্তির পথে। আসছে ১৪২৫ বাংলা সন। জীবন থেকে যে মূল্যবান সময় চলে গেল তার হিসাব-নিকাশ প্রয়োজন। দুনিয়ার জীবনের সময়টুকুই মানুষের সম্পদ। তা কাজে লাগিয়েই অর্জন করতে হয় দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা। সময় আমাদের হাতে সীমাহীন নয়। সেই নির্ধারিত সময়ও অল্পে অল্পে নিঃশেষ হয়ে চলেছে। দিন-রাতের আগমন-নির্গমন, সপ্তাহ, মাস, বৎসরের বিদায় সেই বিন্দু বিন্দু ক্ষয়েরই স্মারক। এক কবি সময়কে তুলনা করেছেন বরফখণ্ডের সাথে।
ہو رہی ہے عمر مثل برف کم + رفتہ رفتہ چپکے چپکے دم بدم
জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে বরফখণ্ডের গলে যাওয়ার মতো, অল্প অল্প করে, নীরবে নিঃশব্দে, প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে।
তো জীবনের নিঃশেষ হওয়ার স্মারকগুলো যখন সামনে আসে তখন সচকিত হওয়া কাম্য। জীবন ও কর্মের তুলনা ও মুহাসাবা কাম্য। বিগত জীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতকে সুন্দর করার নবপ্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়া কাম্য। কাজেই বর্ষশেষ বা বর্ষশুরু আনন্দ-উৎসবের বিষয় নয়, চিন্তা-ভাবনা ও হিসাব-নিকাশের বিষয়। নতুন চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার বিষয়। কিন্তু এখন আত্মসমাহিত চিন্তা-ভাবনার চেয়ে উৎসবে মত্ত হয়ে পড়াই রেওয়াজ। কোনো একটা উপলক্ষ হলেই হল, উৎসবে মেতে উঠতে আর বাধা থাকে না। ফলে পয়লা বৈশাখ হোক বা থার্টিফার্স্ট নাইট, উৎসবে মেতে ওঠা একটা সাধারণ রেওয়াজ।
পয়লা বৈশাখের উৎসবের বিভিন্ন উপকরণ হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আর তরুণ-তরুণীদের অবাধ অসংযত মেলামেশা। আমাদের একশ্রেণির মিডিয়া এসবের পেছনে বাতাস দেয়Ñ ‘এ উৎসব বাঙালীর প্রাণের উৎসব’। আজকাল যেভাবে নববর্ষ উদ্যাপন করা হয় পঞ্চাশ বছর আগেও এসবের কোনো বালাই ছিল না। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কবি সাহিত্যিকদের রচনায় বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিষয়টি তেমন চোখে পড়ে না। না কবিতায়, না গল্পে-উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথ ষাট বছর বয়সে লিখলেনÑ ‘এসো হে বৈশাখ...’ এর আগ পর্যন্ত তিনিও এদিকে মনোযোগ দেওয়ার ফুরসত পাননি। সত্যিই, বাঙালীর বর্ষবরণ-উৎসব সেকালের কবি-সাহিত্যিকদের শুধু অবহেলাই পেয়েছে!
রমনার বটমূলে যে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তার সূচনা ১৯৬৪ সালে। অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ ১৩৭১। মঙ্গল শোভাযাত্রা যুক্ত হয়েছে আরও পরে, ১৯৮৬ সালে। যশোরের একটি সংগঠন প্রথম এটা শুরু করে। পরে এর দেখাদেখি ঢাকা ও অন্যান্য শহরেও তা ছড়িয়ে পড়ে।
পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনে বাঙালী-সংস্কৃতির কথা জোরেসোরে বলা হলেও এর অর্থ আসলে কী? এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম। ইসলামী সংস্কৃতিই মুসলমানদের সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতিতে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও অঞ্চলের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোÑ যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, ভাষা ইত্যাদিকে অনুমোদনের মতো প্রশস্ততা রয়েছে। একইসাথে রয়েছে অন্যায়-অনাচারকে প্রত্যাখ্যান করারও সৎসাহস। একারণে ইসলামী সংস্কৃতি ধারণ করেও বাঙালী মুসলিমের বাঙলা ভাষায় কথা বলতে, এদেশে উৎপাদিত ও প্রস্তুতকৃত পোষাক পরিধান করতে এবং এ ভূখণ্ডে আল্লাহ যে ফল-ফসল দান করেছেন তা ভোগ করতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে সংস্কৃতির নামে অনাচার, উচ্ছৃঙ্খলা ও লাম্পট্যের সুযোগ ইসলামে নেই। এ দেশের মুসলিম জনগণ তাই ইসলামী সংস্কৃতির পূর্ণ অনুসারী হয়েও দেশ, ভাষা ও দেশের জনগণের পূর্ণ কল্যাণকামী; বরং ইসলামী শিক্ষাই তাদের শেখায় নিজের প্রতি ও চারপাশের সকলের প্রতি দায়িত্বশীল হতে।
পক্ষান্তরে বাঙালী সংস্কৃতির নামে পয়লা বৈশাখে যেভাবে নানা অনাচারের চর্চা হচ্ছে তা যেকোনো খোদাভীরু মানুষকেই এই দেশ ও জাতির ভাগ্য সম্পর্কে শঙ্কিত করে তোলে। মাঝে মাঝেই এখন এসকল উদ্যাপনে শোনা যাচ্ছে মারাত্মক সব সংবাদ। নারী নির্যাতন এমনকি দলবেঁধে প্রকাশ্যে নারীর শ্লীলতাহানীর ঘটনাও কোনো কোনো সময় ঘটেছে।
যে কেউ নির্মোহভাবে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, পয়লা বৈশাখ বা থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্যাপনের মাহাত্ম্য আসলে কী? এর যতই মহিমা কীর্তন করা হোক এ যে পাপাচার ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার এক বড় উপলক্ষÑ তা বলাইবাহুল্য। এখন যারা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন তাদের অনেকেরই উদ্বেগের কারণ, বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এর চরিত্র বদলে যাওয়া। আগে যা ছিল দুপক্ষের সম্মতিতে বা দুর্ঘটনাবশত, এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকাশ্যে, জোরপূর্বক ও সদলবলে। কারণ একটি ‘শক্তিশালী’ ও ‘প্রাগ্রসর’ অংশ এখন আর বখাটেপনার সাথে ভদ্রতার খোলস বহন করতে রাজি নয়। এটা ভয়াবহ হলেও অভাবনীয় নয়, এ তো অনিবার্য পরিণতিমাত্র। সুতরাং এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে কিছু খণ্ডিত ও পরম্পরাহীন প্রতিক্রিয়া মোটেই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন এই অভিশপ্ত ধারা গোড়া থেকে বন্ধ করা। পাপের সব পথ খোলা রেখে শুধু তার বিবর্তন ও বংশবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখার দর্শন যে এক অবাস্তব দর্শনÑ এইসব ঘটনা তার প্রমাণ।
কয়েক দশক ধরে এ দেশের তরুণ ও যুবক শ্রেণিকে চরিত্রহীন করার যে নানামুখী আয়োজন, শিল্প-সংস্কৃতির নামে প্রবৃত্তিপরায়ণতার, বিনোদনের নামে অশ্লীলতা ও বল্গাহীনতার আর তথ্য-প্রযুক্তির নামে উঠতি বয়েসী ছেলে-মেয়ের হাতে নগ্নতার চাবিকাঠি সরবরাহের পরও সংযম-সুবুদ্ধির প্রত্যাশা অবাস্তব প্রত্যাশা নয় কি?
প্রসঙ্গত দোল বা হোলি উৎসব সম্পর্কেও দুটো কথা বলা প্রয়োজন। ফাল্গুনের মাঝামাঝিতে হোলি উৎসব শিরোনামে অনেক জায়গায় দৃষ্টিকটু পর্যায়ের মাতামাতি পরিলক্ষিত হয়েছে। আমাদের মনে হয়, জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবও এই মাতামাতির এক কারণ। প্রথমত বিষয়টি একান্তই হিন্দুধর্মের এক ধর্মীয় বিষয়। ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোতে এসংক্রান্ত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এবার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে কেন্দ্রীয়ভাবে এই উৎসবের আয়োজন করে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি। গতকাল সকালে মন্দিরের নিত্য পুরোহিত সবার মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেন। এরপরই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দিনব্যাপী এই আয়োজনে পুরো মন্দির এলাকা রঙে রাঙিয়ে যায়। দুপুর ১২টার দিকে মন্দির প্রাঙ্গণে ভজন-কীর্তন শুরু হয়। ... মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার অন্যতম উৎসব দোলযাত্রা। এই উৎসবে সর্বস্তরের মানুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্য পেতে চান। তাঁরা দেব-দেবীর পায়েও আবির প্রদান করেন।’
তো হিন্দু ধর্মের একান্ত উপাসনামূলক একটি বিষয়ে কোনো তাওহীদপন্থী মুসলিম কীভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে? মনে রাখতে হবে, শান্তিুপূর্ণ সহাবস্থান এক জিনিস, আদর্শ ত্যাগ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
হোলি বা দোল উৎসবের সূত্র নিয়ে নানা প্রকারের কাহিনী চালু আছে, যেগুলো সম্পূর্ণরূপে হিন্দু ধর্মীয় উপাখ্যাননির্ভর। সেইসব উপাখ্যান নিয়ে স্বয়ং হিন্দু ধর্মের গবেষকদের মধ্যেই রয়েছে প্রচুর বিতর্ক। সেসবে না গিয়ে এখানে ড. নীহার রঞ্জন রায়ের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়। হোলি বা হোলাক উৎসবের সূত্র বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এ তথ্য এখন অনেকটা পরিষ্কার যে, আদিতে হোলি ছিল কৃষি সমাজের পূজা। সুশস্য উৎপাদন কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাময় নৃত্যগীত উৎসব ছিল তার অঙ্গ। তার পরের স্তরে কোনও সময় নরবলির স্থান হইল পশুবলি এবং হোমযজ্ঞ ইহার অঙ্গীভূত হইল। বাঙালীর ইতিহাস (আদিপাঠ)Ñ সিন্ধু থেকে হিন্দু, ড. আর. এম দেবনাথ পৃ. ১৯৫
এই বক্তব্য অনুসারে ভেবে দেখা উচিত রং ছিটানোর এই প্রথা মূলত কিসের স্মারক!
ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বক্তব্যটিও এখানে প্রাসঙ্গিক। তিনি তার ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে লেখেন, যে সময়ে ইউরোপে নিউটন, লাইবনিৎজ, বেকন প্রভৃতি মানুষের প্রজ্ঞাশক্তি ও জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করিতেছিল সেই সময় বাঙালীর মনীষা নব্যনায়ের (ন্যায়শাস্ত্র) সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচারে, বাঙালীর প্রজ্ঞা কোন্ তিথিতে কোন্ দিকে যাত্রা শুভ বা অশুভ এবং ভোজ্য দ্রব্য বিধেয় বা নিষিদ্ধ তাহার নির্ণয়ে এবং বাঙালীর ধর্ম চিন্তা ও হৃদয়বৃত্তি স্বকীয় অপেক্ষা পরকীয়া প্রেমের আপেক্ষিক উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠার জন্য ছয় মাসব্যাপী তর্কযুদ্ধে নিয়োজিত ছিল।’ প্রাগুক্ত পৃ. ১৮৪
আমাদের কর্তব্য, মানবতা, স্বভাব-চরিত্রের নির্মলতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসরতার অনুষঙ্গগুলো লালন ও বিকাশে যত্নবান হওয়া।
এখানে জাতির প্রত্যেক শ্রেণির আলাদা দায়িত্ব আছে। ক্ষমতাশালীদের কর্তব্য, ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার, তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন। দুঃখজনকভাবে কোথাও যদি দুষ্টের লালনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তখন অনাচার-অবক্ষয় রোধ করার উপায় থাকে না। সমাজের যারা মস্তিষ্ক ও বিবেক তাদের কর্তব্য, সত্যপ্রিয় ও সত্যনিষ্ঠ হওয়া, হীনম্মন্যতা ও পরানুকরণ প্রবণতার ঊর্ধ্বে ওঠা। সমাজের যারা ‘কণ্ঠ’ তাদের দায়িত্ব, সত্য-ন্যায়ের প্রচারে অকুণ্ঠ হওয়া। এই দুই শ্রেণি বিপথগামী বা মিথ্যাশ্রয়ী হলে সমাজে মিথ্যা ও বিপথগামিতার ধারা চালু হয়ে যায়। তখন সত্যের নামে মিথ্যা, ভালোর নামে মন্দ আর শিল্প-সংস্কৃতির নামে অনাচার-অশ্লীলতার বিস্তার ঘটে। অভিভাবকদেরও কর্তব্য, অভিভাবকত্বের যোগ্যতা অর্জন করা এবং দায়িত্বসচেতন হওয়া। বাবা-মা, স্বামী-শিক্ষক নিজেরাই যদি সঠিক চিন্তার অধিকারী না হন তাহলে কীভাবে তারা সংশ্লিষ্টদের সঠিক পথে পরিচালিত করবেন?
সবশেষে ব্যক্তির কর্তব্য, নিজের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যে কাজ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যে সম্পর্ক চারিত্রিক পবিত্রতা বিনষ্ট করে কিংবা যে উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ লাঞ্ছনা-অবমাননার শিকার করে তা থেকে দূরে থাকা নিজের কল্যাণের স্বার্থেই প্রয়োজন।
আর কল্যাণ-অকল্যাণ শুধু পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবনের হিসাবেই বিবেচ্য নয়, আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের হিসাবেও বিবেচ্য; বরং সেই বিবেচনাই মুমিনের কাছে অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য। নিজের দেহ-প্রাণ, জীবন-যৌবন নিয়ে স্বেচ্ছাচারের সুযোগ নেই। এ জীবন অমূল্য, এ যৌবন মহামূল্য। এ পৃথিবীতে একবারই তা কাউকে দেওয়া হয়। সুতরাং একে ভুল পথে ভুলভাবে ব্যবহার নিজের প্রতি চরম অবিচার, যেজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। তেমনি যারা অন্যের ইজ্জত-আব্রু বিনষ্ট করে, দুনিয়ার আদালতে কখনো কোনো কারণে তারা বেঁচে গেলেও আল্লাহর আদালতে তাদের রেহাই নেই। ঐ আদালতের কাঠগড়ায় তাদেরও দাঁড়াতে হবে, যারা কোনো না কোনো পর্যায়ের দায়িত্বশীল হওয়া সত্ত্বেও সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।