যিলহজ্ব ১৪৩৮   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিবাহ-বিচ্ছেদ নয়

Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah

ইচ্ছা ছিল ব্যাংকিংয়ের একটি বিষয়ের উপর লেখার। কিন্তু হঠাৎ নজরে পড়ল একটি শিরোনাম- ‘তালাকের হিড়িক, ঢাকায় দিনে ৫০-৬০ দম্পতির বিচ্ছেদের আবেদন।’ খুবই উদ্বেগ ও বেদনার বিষয়। শিরোনামটি দেখার পরে মনে হয়েছে, এ বিষয়েই কিছু বলি।

ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ ও উত্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১০-২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে তালাকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় বায়ান্ন হাজার। প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০টির মত বিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে।

কী ভয়াবহ অবস্থা! যদিও সংবাদে যা এসেছে তা দাপ্তরিক হিসাব। বাস্তবে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। এটা আমরা বলতে পারি ফতোয়া বিভাগের অভিজ্ঞতা থেকে। নানা পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান, যা একটি সমাজের জন্য, বিশেষত মুসলিম সমাজের জন্য খুবই দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক। কারণ, বিবাহ-বিচ্ছেদের কুফল অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সমাজে বিচ্ছেদ প্রবণতার এই ক্রমবর্ধমান বিস্তার কেন। সমাজবিজ্ঞানীরা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নানা কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে যে কথাটি প্রায় সবাই বলছেন তা হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব। বাস্তবেই এটা অনেক বড় কারণ।

ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়টি অনেক বিস্তৃত। বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, জীবন-দর্শন ও জীবনধারা, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, একে অপরের হক সম্পর্কে সচেতনতা, বিনয় ও ছাড়ের মানসিকতা- এই সবই ধর্মীয় অনুশাসনের অন্তর্র্ভুক্ত। এরপর পর্দা-পুশিদা রক্ষা, পরপুরুষ বা পরনারীর সাথে সম্পর্ক ও মেলামেশা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদিও বিশেষ ধর্মীয় অনুশাসন, যা পালন না করাও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি ও বিবাহ বিচ্ছেদের  কারণ। পরিসংখ্যানও বিষয়টিকে সমর্থন করে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের গবেষণা-পরিসংখ্যান বলছে, বিচ্ছেদের যেসব আবেদন ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে তার মধ্যে ৮৭ শতাংশ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে পরকীয়ার জের ধরে। কোনো ক্ষেত্রে স্বামীর পরকীয়া, কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রীর।

কাজেই সমাজবিজ্ঞানীদের কর্তব্য, এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা। কেন এই সমাজে পরকীয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর প্রতিকারের উপায় কী- তা নিয়ে নির্মোহ চিন্তা-ভাবনার এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন আছে।

পরিসংখ্যানের আরেকটি দিক হচ্ছে, বিবাহ-বিচ্ছেদে পুরুষের চেয়ে নারীরাই এগিয়ে। এক জরিপে দেখা গেছে, ৭০.৮৫ ভাগ তালাক গ্রহণ করছেন নারী আর ২৯.১৫ ভাগ তালাক দিচ্ছেন পুরুষ।

এর কারণ হয়তো অনেক ক্ষেত্রে এই যে, সাধারণত নারীরা নির্যাতিত হওয়ায় তারাই বিচ্ছেদের পদক্ষেপ বেশি নিচ্ছে তবে এর সাথে অনেকেই আরো যা বলছেন তা হচ্ছে-

‘মেয়েরা এখন অনেক অধিকার পেয়েছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুই দিক থেকেই বেশি অধিকার পেয়ে স্বামীকে তালাক দিতে আগের চেয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। আগেকার দিনের মায়েরা সংসার ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। এখন একক পরিবার হওয়ায় এবং বাইরে চাকরি-বাকরির ও সার্বিক স্বাধীনতার বিস্তার ঘটায় বাইরের মানুষের সাথে তাদের মেলামেশা বেড়েছে এবং স্বামীদের চেয়ে বাইরের বন্ধু-বান্ধবদের দিকে বেশি ঝুকছে। তাই পারিবারিক অবস্থা একটু খারাপ হলেই তালাকের চিন্তা করছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা খুব বেশি অত্যাচারী হয়ে থাকে। এছাড়া তথ্য-প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম ও আধুনিক সংস্কৃতির কারণে সংসার ভাঙছে। বর্তমানের মেয়েরা বিদেশী টেলিভিশন, স্টার জলসা, জি-বাংলাসহ বিভিন্ন ধরনের সিরিয়াল দেখে সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রভাবিত হচ্ছে।’

এই কথাগুলো কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নয়। এদেশের আধুনিক চিন্তাধারার সমাজ-চিন্তকেরাই এই কারণগুলো নির্দেশ করছেন। এখান থেকে বেশ কিছু বিষয় বুঝে আসে।

প্রথমত, ইসলামে যে সুসংহত জীবন-ব্যবস্থা রয়েছে, তার প্রতিটি অংশই অতি প্রয়োজনীয়। যে অংশই বাদ দেয়া হবে তার কুফল ভুগতে হবে। ইসলামে আয়-উপার্জন, জীবনমান ও জীবনধারার ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির শিক্ষা দেয়া হয়েছে। জীবনের বাস্তব প্রয়োজন আর অবাস্তব প্রয়োজনের মাঝেও রেখা টেনে দেয়া হয়েছে। অল্পেতুষ্টির পরিবর্তে যদি সম্পদ ও প্রাচুর্যের মোহ তৈরি হয়, বাস্তব প্রয়োজন ছাড়াও নানা অবাস্তব প্রয়োজনের ভার কাঁধে তুলে নেওয়া হয় তখন অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তদ্রূপ ইসলামী শিক্ষায় পারস্পরিক হক রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরকে কোনোভাবে-ই কষ্ট না দেওয়া, প্রত্যেকে অন্যের হক রক্ষায় সচেষ্ট থাকা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলাম শুধু অধিকারের কথা বলে না, কর্তব্যের কথাও বলে। স্বামী ও স্ত্রী প্রত্যেকেরই রয়েছে কর্তব্য এবং অধিকার। নিজের কর্তব্য পালন আর অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হলেই সবার শান্তি আসতে পারে।

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَهُنَّ مِثْلُ الَّذِیْ عَلَیْهِنَّ بِالْمَعْرُوْف.

আর স্ত্রীদেরও ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন তাদের প্রতি (স্বামীদের) অধিকার রয়েছে। -সূরা বাকারা (২) : ২২৮

কাজেই দেখা যাচ্ছে, নারীর যেমন কর্তব্য আছে তেমনি অধিকারও আছে। একই কথা পুরুষের ক্ষেত্রেও। তাই পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়কে নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং একে অপরের হক ও অধিকারের বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

পারিবারিক শান্তির জন্য শুধু পরিবারকেন্দ্রিক ইসলামী অনুশাসনগুলোই নয়, সাধারণ অনুশাসনগুলো মেনে চলারও গুরুত্ব আছে। যেমন ধরুন, মাদকাসক্তিও অনেক পরিবারের ভাঙ্গনের কারণ। মাদক ইসলামী বিধানে হারাম। এটি দাম্পত্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়, সাধারণ বিষয়। কিন্তু এর প্রভাব পারিবারিক জীবনেও পড়ে এবং প্রকটভাবেই পড়ে।

দ্বিতীয়ত পরিবারের ভরণ-পোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পুরুষের। কাজেই পুরুষ বাইরে উপার্জন করবে আর নারী ঘরে সংসার ও সন্তানদের আদব-তরবিয়ত ও প্রাথমিক লেখা পড়ায় সময়  দেবে- মৌলিকভাবে এটাই স্বাভাবিক পদ্ধতি। এর বিপরীতে নারী-স্বাধীনতা বা নারীর স্বাবলম্বিতার নামে নারীকে উপার্জনে বের করার যে সংস্কৃতি এর কুফল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। খোদ সমাজ-চিন্তকেরাই এখন স্বীকার করছেন যে, বিবাহ-বিচ্ছেদের এক বড় কারণ, নারী বাইরে বের হওয়া এবং পর-পুরুষের সাথে মেলামেশা। অথচ অন্য ক্ষেত্রে নারীর স্বাবলম্বিতার তথা বাইরের জগতে বিচরণের বর্তমান ধারার পক্ষে নারী-নির্যাতনের বিষয়টিকে কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এর দ্বারা নারী নির্যাতন তো কমছেই না, বরং বাড়ছে, একইসাথে সংসারও ভাঙছে। কাজেই গোড়া থেকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। একান্ত আর্থিক সমস্যা ছাড়া নারীদেরকে রোজগারের জন্য ঘরের বাইরে বের করবে না, বরং স্বামীরাই স্ত্রী-সন্তানের খরচাদির ব্যবস্থা করবে।

তৃতীয়ত তালাকের অধিকার  পুরুষের হাতে ন্যস্ত করার যথার্থতাও স্পষ্ট হচ্ছে। ইসলামী বিধানে তালাকের অধিকার পুরুষের হাতে ন্যস্ত করার পাশাপাশি পুরুষকে যে সকল গুণের অধিকারী হওয়ার এবং স্ত্রী ও পরিবার পরিচালনায় যে নীতি ও বিধান অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা পালনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া সম্ভব। ইসলাম স্ত্রীদেরকে ‘খোলা‘আ’র অধিকার দিয়েছে এবং স্বামী থেকে পাওয়া অধিকার বলে তালাকেরও ক্ষমতা দিয়েছে, যা আমাদের দেশের কাবিননামার ১৮ নং ধারায় উল্লেখ থাকে। সে ধারার গলদ ব্যবহার করেই নারীগণ পুরুষের চেয়ে ৩ গুণ বেশি তালাকের পথে হাঁটছে। এর থেকেই অনুমান করা যায় যে, যদি তারা সরাসরি তালাকের ক্ষমতা পেত তবে পরিস্থিতি আরো কত ভয়াবহ হত। 

এখানে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া চাই যে, ইসলামী শরীয়তে অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তালাকের অবকাশ রয়েছে, কিন্তু বিষয়টি পছন্দনীয় নয়। সুনানে ইবনে মাজাহ্য় আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী বর্ণিত হয়েছে যে-

أَبْغَضُ الْحَلَالِ إِلَى اللّهِ الطّلَاقُ.

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় হালাল হচ্ছে তালাক। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২০১৮

সুনানে আবু দাউদে মুহারিব ইবনে দিছার রা.-এর সূত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ বর্ণিত হয়েছে-

مَا أَحَلّ اللّهُ شَيْئًا أَبْغَضَ إِلَيْهِ مِنَ الطّلَاقِ.

আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে তালাকের চেয়ে অপ্রিয় কোনো কিছু হালাল করেননি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৭৭

কাজেই তালাকের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নারী-পুরুষ উভয়ের কর্তব্য তালাক থেকে দূরে থাকা। তালাক দেয়ার ক্ষমতা যেহেতু পুরুষের তাই পুরুষকে এই ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সংযমী হতে হবে। অন্যদিকে নারীর ব্যাপারে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে-

أَيّمَا امْرَأَةٍ سَأَلَتْ زَوْجَهَا الطّلَاقَ فِي غَيْرِ مَا بَأْسٍ فَحَرَامٌ عَلَيْهَا رَائِحَةُ الْجَنّةِ.

যে নারী তার স্বামীর কাছে বিনাকারণে তালাক প্রার্থনা করে তার জন্য জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২০৫৫

সম্প্রতি পরকীয়ার যে বিস্তার এতে যেমন পুরুষের অপরাধ আছে তেমনি আছে নারীরও। দেখা যাচ্ছে যে, এক নারীর দ্বারাই অন্য নারীর সংসার ভাঙছে। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী খুবই প্রাসঙ্গিক। জামে তিরমিযীতে হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لاَ تَسْأَلِ الْمَرْأَةُ طَلاَقَ أُخْتِهَا لِتَكْفِئَ مَا فِي إِنَائِهَا.

কোনো নারী যেন তার বোনের (অপর নারীর) হিস্যা নিজের পাত্রে উপুড় করে নেয়ার জন্য তালাকের ফরমায়েশ না করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৯০

প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজের পাতে যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। অন্যের পাতে যা আছে তা-ও নিজের পাতে নিয়ে নেওয়ার মতো লোভী মানসিকতা কোনো ভদ্র মানুষের হতে পারে না। উপরন্তু যখন ঐ নারীটিও একজন নারী, একজন মুসলিম, দ্বীনী বোন।

তো এই সকল ঈমানী ও মানবীয় চেতনার বিস্তার এখন খুবই জরুরি। তাহলে অন্যায় অযৌক্তিক কারণে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার অনেক হ্রাস পাবে। নারী-পুরুষ উভয়ে যদি পর্দার বিধান মেনে চলে তবে পরকীয়া জাতীয় কিছু ঘটার কোনই আশংকা থাকবে না। যারা শরীয়তের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটি নিয়ে কটাক্ষ করে অথবা একে জটিল মনে করে তা পালনে বিরত থাকে, তাদের বিষয়টি ভাবা উচিত।

উল্লেখ্য যে, পর্দা বলতে শুধু সামনের মানুষটির সাথেই পর্দা নয়; বরং এ ডিজিটাল যুগে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদির মাধ্যমেও ব্যাপকভাবে পর্দা লংঘিত হয় এবং তাও এক সময় সংসার ভাঙার কারণ হয়ে থাকে। বিশেষতঃ ফেসবুক ইত্যাদির মত তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যে, বিশ্বব্যাপী কত সংসার ভাঙার কারণ ঘটেছে, কত শিশুকে তাদের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে তার সঠিক হিসাব হয়ত কোনো দিনই প্রকাশিত হবে না। মুসলমানরা এসব বিজাতীয় পথে হেঁটে আর কত নিজেদেরকে ধ্বংস করবে? মনে রাখা দরকার, সমাজের আগে পরিবারের স্থান, তাই তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটিয়ে পারিবারিক বন্ধনকে ঝুঁকিতে ফেলা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।

শরীয়তের নির্দেশনা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত বৈবাহিক সম্পর্ক রক্ষায় প্রয়াসী হওয়ার। তালাক ও বিবাহ-বিচ্ছেদের পর্যায়টি হচ্ছে সর্বশেষ পর্যায়, যা একান্ত অনিবার্য প্রয়োজনের স্বার্থেই বৈধ করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য হতে পারে, ঝগড়া-বিবাদ হতে পারে, তা নিজেরাই মিটমাট করে নেয়া চাই, যদি তা বড় আকার ধারণ করার আশংঙ্কা হয় তখন দুই পরিবার আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَیْنِهِمَا فَابْعَثُوْا حَكَمًا مِّنْ اَهْلِهٖ وَ حَكَمًا مِّنْ اَهْلِهَا  اِنْ یُّرِیْدَاۤ اِصْلَاحًا یُّوَفِّقِ اللهُ بَیْنَهُمَا  اِنَّ اللهَ كَانَ عَلِیْمًا خَبِیْرًا.

তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তার (স্বামীর) পরিবার থেকে একজন ও তার (স্ত্রী)পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তিচাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংশার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত। -সূরা নিসা (৪) : ৩৫

 

অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক জিদ ও বিদ্বেষের কারণে যখন আশংঙ্কা হয় যে, তারা নিজেরা বিবাদ মিমাংসা করতে পারবে না তখন দুই পক্ষের আত্মীয়দের মধ্য থেকে একজন একজন করে সালিশ নিযুক্ত করে দেওয়া হবে এবং মীমাংসার জন্য তাদেরকে স্বামী-স্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। আত্মীয়রাই তো তাদের অবস্থা ভালো জানবে এবং এদের কল্যাণকামিতার প্রত্যাশাও তাদের কাছে বেশি করা যায়। এই দু’জন গিয়ে খোঁজ খবর নিবে এবং যার যে পরিমাণ অন্যায় সে অনুযায়ী বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদেরকে মিলিয়ে দিবে।

আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, উভয় সালিশ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করে দেয়ার সদুদ্দেশ্য রাখলে আল্লাহ তাআলা তাদের নেক নিয়ত ও সঠিক চেষ্টার বদৌলতে বনিবনা করে দিবেন। কাজেই বিবাহ-বিচ্ছেদের আগে এই কুরআনী শিক্ষা অনুসরণ করা কাম্য।

বর্তমানে এই কুরআনী শিক্ষাটি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়। দেখা যায় ঝগড়া-বিবাদ বা মনোমালিন্য সৃষ্টি হলেই স্বামী বা স্ত্রী-পক্ষ অথবা উভয় পক্ষের মধ্যে মিথ্যা আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত হয় এবং কোনো এক পক্ষ তাড়াহুড়া করে তালাকের পদক্ষেপ নিয়ে বসে। এরপর স্থানীয় সরকারের শালিশী কাউন্সিল তাদের মধ্যে মিমাংসা করতে বসে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো কাজে আসে না।

এখানে উল্লেখ্য যে, এই যে শালিশী কাউন্সিল এটি কিন্তু একটি শরীয়ত-বিরোধী আইনের ফসল, যা ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন নামে প্রসিদ্ধ। স্বাধীনতার ৪ দশক পার হয়ে যাওয়ার পরও পাকিস্তানী সামরিক শাসক আইউব খানের জারী করা কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী আইন আমাদের দেশে এখনো চালু রয়েছে। জানি না ইসলাম-বিরোধী হওয়ার কারণেই কি না? যদিও পাকিস্তানে এটি সংশোধিত হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। যা হোক, ঐ ১৯৬১ সালের আইনটির বহুবিধ ত্রুটির মধ্যে এটিও একটি যে, এতে তালাকনামা লিখে নোটিশ পাঠাবার পর শালিসের কথা বলা হয়েছে। অথচ শরীয়া অনুযায়ী তালাকনামা লিখে দস্তখত করার পরই তালাক হয়ে যায়। তাহলে আর শালিস কিসের জন্য? আসলে শালিস হওয়া দরকার তালাকের পূর্বেই এবং তা হওয়া দরকার পারিবারিক ও সামাজিকভাবে। আইনের লোকদের দিয়ে নয়। এ সহজ কথাগুলো সংশ্লিষ্ট লোকজন যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই জাতির মঙ্গল হবে।

আমরা মুসলিম নর-নারীদের অনুরোধ করব, তারা যেন তালাকের আগে অন্ততঃ দশবার ভেবে নেন। শালিশ-সমঝোতাসহ যাবতীয় পূর্ব-পদক্ষেপ বিফল হয়ে গেলে যদি তালাকের পথে যেতেই হয় তবে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমের পরামর্শ নিয়ে তা করবে এবং কোনোক্রমেই এক তালাকে বায়েনের বেশি দিবে না; যেন পরে সংসার পুনর্বহালের সুযোগ থাকে।

পারিবারিক মর্যাদা, মূল্যবোধ, সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের দ্বীন ও ঈমানের হেফাজতের জন্য তালাকের বিষয়ে সংযমী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মসজিদের সম্মানিত খতীবগণ, ওয়ায়েযগণ এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞ লোকজন গণ-মানুষকে এসব বিষয়ে বোঝাতে এগিয়ে আসলে তা অধিক কার্যকরি হবে বলে আশা করা যায়।

 

 

advertisement