Jumadal Akhirah 1439   ||   March 2018

অবক্ষয় : কৈশোর

আব্দুল্লাহ নাসীব

শিশু-কিশোররা আমাদের আশার প্রদীপ, উম্মাহ্র ভবিষ্যত। তাদের উন্নত জীবন গঠনের ব্যাপারে অবহেলা ও উদাসীনতার যেমন সুযোগ নেই তেমনি এক্ষেত্রে ভুল পথে যাওয়ারও অবকাশ নেই।  আজ তাদের মানসপটে জীবনের যে ছবি অংকিত হবে ধীরে ধীরে তা-ই তাদের কর্ম-চরিত্রে প্রতিফলিত হবে। প্রযুক্তির কল্যাণে পশ্চিমা হিংস্রতা ও ভোগবাদে আমাদের শিশু-কিশোরেরাও মর্মান্তিকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। হিংস্রতাকেই তারা মনে করছে বীরত্ব, জুলুম-অত্যাচারকেই মর্যাদা ও নেতৃত্ব। সম্প্রতি রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় সহপাঠীদের দ্বারা এক স্কুলছাত্রের ছুরিকাহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির সংবাদ পত্র-পত্রিকায় এসেছে। কয়েক মাস আগে একই এলাকার নবম শ্রেণির এক ছাত্র তার সহপাঠীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে পুলিশি অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছিল গ্যাং কালচারের ভয়াবহ সব তথ্য। সে সময় বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় বেশ লেখালেখিও হয়েছিল।

এই হিংস্রতা ও জুলুম তো আমাদের পরিচয় ছিল না। আমাদের পরিচয় ছিল মমতা ও মানবসেবা। আমাদের শিশু-কিশোররাও বেড়ে উঠছিল সেই পরিবেশে। আমাদের যারা উত্তরসূরি, তাঁদের জীবন তো আলোকিত ছিল সেবা ও সদাচারে। শৈশব থেকেই তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। শায়েখ আলাউদ্দীন আলাউল হক্ব (১৩৯৮ হি.) রাহ.-এর সন্তান শায়েখ নূরুল হক্ব রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি তার ওয়ালিদ ছাহেবের খানকাহ্র সকল মেহমানের খিদমত নিজের যিম্মায় নিয়েছিলেন। তাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিতেন, পানি গরম করতেন, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত-দিন তার শুশ্রƒষায় মশগুল থাকতেন।

একদিন ওয়ালিদ ছাহেব বললেন,  নূরুল হক্ব! গাঁয়ের কুয়ায় যেখানে মহিলারা পানি নিতে আসে সেই জায়গাটা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। মহিলারা পানি আনতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে ব্যথা পায়। কলস ভেঙে যায়। তুমি যদি কুয়া থেকে পানি তোলার কাজটা করে দাও তাহলে ভালো হয়। ইতিহাসে আছে, চার বছর পর্যন্ত তিনি এই খেদমত করেন। নিজে কুয়া থেকে পানি তুলে চৌবাচ্চায় ভরে রাখতেন, এখান থেকে যার প্রয়োজন পানি নিয়ে যেত।

শৈশব থেকেই যিনি মানবসেবার শিক্ষা পেয়েছেন তার আগামী জীবন কেমন হবে তা তো বলাই বাহুল্য।

উর্দু ভাষায় ‘বাড়োঁ কে বাচপান’ একটি সুন্দর গ্রন্থ। তাতে আছে যে, তাবলীগের মারকায নিজামুদ্দীনে মেহমানদের ভিড় থাকত। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. সবসময় মেহমানদের সাথেই খানা খেতেন। মাওলানা ইউসুফ রাহ. (যিনি পরে তাবলীগের আমীর হয়েছিলেন)-এর বয়স তখন ছিল ১২-১৩ বছর। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. আগত মেহমানদের নাস্তা-খাবার ও আনুষঙ্গিক সকল কাজের দায়িত্ব তাঁর ওপর দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি সবার জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। খাবারের পর খালি বরতন নিয়ে যেতেন।

মারকায সংলগ্ন মাদরাসায় ছাত্রদের খাবার-দাবারের সুব্যবস্থাপনা তখনও গড়ে ওঠেনি। ছাত্ররাই খাবার রান্না ও পরিবেশনের দায়িত্ব পালন করত। মাওলানা ইউসুফ রাহ.-ও এইসকল কাজে শরীক থাকতেন।

একবারের ঘটনা, রান্নার জন্য তিনি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনেছেন। কিন্তু তা ভালো শুকনা না হওয়ায় আগুন জ¦ালাতে পারছিলেন না। শুধু ধোঁয়া হচ্ছিল এবং চোখের পানি পড়ছিল। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিলেন। একপর্যায়ে নিজে এগিয়ে এসে একটি কাগজে আগুন ধরিয়ে দিলে আগুন জ¦লে উঠল। এরপর পুত্রকে বললেন, ‘সব কাজই শিখতে হয়।’

এরকমের ঘটনা অনেক বলা যাবে। আমাদের ধারাই তো ছিল সভ্যতা-ভদ্রতার, দয়া-মহানুভবতার, সদাচার ও মানবসেবার। আমাদের শিশুরাও এভাবেই গড়ে উঠত। কিন্তু পশ্চিমা জীবনবোধ ও জীবনব্যবস্থার আগ্রাসনে এখন সবকিছুই তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এখন বড়দের জীবন থেকে যেমন উন্নত ও সদ্গুণাবলি হারিয়ে যাচ্ছে তেমনি শিশু-কিশোরেরাও হারিয়ে ফেলছে তাদের নির্মল শৈশব, দুরন্ত কৈশোর। এর পরিবর্তে তাদের হাতেখড়ি হচ্ছে, নেশা, সন্ত্রাস ও খুনোখুনির মত জঘন্য বিষয়াদিতে।

আমাদের ফিরে যেতে হবে আমাদের মহান ঐতিহ্যের দিকে। পরিবার ও সমাজ সকল ক্ষেত্রে সুস্থ জীবনবোধ ও সদ্গুণাবলির চর্চা বাড়াতে হবে। আমাদের শিশু-কিশোরদের সামনে আমাদেরকে উপস্থাপন করতে হবে ‘বড়’র আদর্শ-রূপ। শিশুরা স্বভাবতই ‘বড়’ হতে চায়। কিন্তু সেই ‘বড়’র রূপটি এখন তাদের সামনে কী? নেশা ও সন্ত্রাস নয় কি? বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে ‘ছোট’দের উপর জুলুম চালানো নয় কি? রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এহসান রফিকদের রাতভর নির্যাতন করে চোখ নষ্ট করে দেওয়া নয় কি? এই ধারা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পশ্চিমা জীবনবোধ ও জীবনযাত্রার মোহ থেকে এখনি যদি আমরা বেরিয়ে আসতে না পারি তাহলে শুধু নিজেদের উপরই জুলুম করব না, ভবিষ্যত প্রজন্মের উপরও নির্মম জুলুম করে যাব।

 

advertisement