যিলক্বদ ১৪৩৮   ||   আগস্ট ২০১৭

রাজধানী : মশকনিধন

হারীস তাবীল

কিছুদিন আগের কথা, সকালে পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখি প্রথম পাতায় বড় করে ছবি ছাপা হয়েছে- দু’ধারে সারি সারি ভবন, মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে চমৎকার এক খাল। জনগণ নৌকায় করে খাল পাড়ি দিচ্ছে। একটু খটকা লাগল, ইতালির ভেনিস নগরীর কোনো সংবাদ থাকলে তা আন্তর্জাতিক পাতায় আসার কথা, প্রথম পাতায় কেন? ছবিটা আরেকটু লক্ষ্য করার পর চক্ষু চড়কগাছ। খালে নৌকার সাথে সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলছে রিকশা, খাঁচামার্কা সিএনজি এবং ৬ নং মতিঝিল বনানী পরিবহন! ছবির ক্যাপশনের বর্ণনা মোতাবেক চিত্রটা ঢাকার ব্যস্ততম সড়ক কারওয়ান বাজারের। চার বছর আগের ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বিজ্ঞাপনের মাহাত্ম্য এখন বুঝে আসল। উন্নয়নের জোয়ার দেশের গ্রামগঞ্জের নদীনালায় সীমাবদ্ধ না থেকে আছড়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকায়। সেই জোয়ারে ভাসছে নৌকা, ভাসছে গাড়ি আর ভাসছে মানুষ। বিজ্ঞাপনের সাথে বাস্তবতার কী চমৎকার মিল! বিজ্ঞাপনে যা-ই থাকুক, আসলে রাজধানী ঢাকা হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিশ্বের অন্যতম ঘন জনবসতিপূর্ণ একটি শহর। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এখানকার নাগরিকদের দুর্ভোগ। আমরা নিত্যদিন সংগ্রাম করি লোডশেডিং, রাস্তার পাশে জমে থাকা ময়লার ভাগাড় এবং দূষিত বায়ুর সঙ্গে। আমরা লোকাল বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে গন্তব্যপানে ছুটি, যানজটে আটকে বাদুড়ঝোলার ব্যাপ্তি দাঁড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বহু ধরনের নাগরিক দুর্ভোগে নাকাল ঢাকাবাসীর জন্য সম্প্রতি নতুন বিপদ হয়ে এসেছে মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া। মড়ার ওপর এই খাঁড়ার ঘায়ে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারাত্নক জ্বর, মাথাব্যথা ও বাতরোগের সাথে লড়াই করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে হারে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে তাতে এটাকে মহামারী আখ্যা দেয়া যায়। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য এই রোগকে খাটো করে দেখানোর আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তা চালানো হোক, কিন্তু কথাবার্তার স্বাভাবিক সৌজন্যটুকু তো রক্ষা করা উচিত। এটুকুও যখন থাকে না তখন তা খুবই হতাশাজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন আয়োজিত চিকুনগুনিয়া সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে উত্তরের মেয়র বেশ বড় গলাতেই বলেছেন “মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা মারা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে সম্ভব না।” যদিও নির্বাচনের সময় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাওয়াটা কীভাবে সম্ভব হল সেই ব্যাখ্যা তিনি করেননি। এমনকি ঘরে ঘরে গিয়ে বিদ্যুতের মিটার চেক করা এবং ট্যাক্স আদায় করা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে সেটার সদুত্তরও পাওয়া যায়নি। তবু আমরা ধরে নিতে পারি দু’টোর মধ্যে বেশ তফাত আছে। মিটার ও ট্যাক্সের জন্য ঘরে ঘরে গেলে টাকা পাওয়া যায়, পক্ষান্তরে মশা মারতে গেলে টাকা খরচ হয়। সুতরাং ব্যয়ের চেয়ে আয়ের দিকেই তারা অধিক মনোযোগী হবেন এ-ই তো স্বাভাবিক! তবে কিনা মেয়র সাহেবকে মশা মারার জন্য কেউ ঘরে ঘরে যেতে বলেনি। তার প্রতিষ্ঠান যদি আরেকটু আন্তরিকতার সাথে কালো মাঠার মত হয়ে থাকা ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে, রাস্তার পাশে যত্রতত্র জমে থাকা ময়লার ভাগাড়গুলোর প্রতি নিয়মিত দৃষ্টি দেয় এবং মশক নিধনের জন্য বাজেট হওয়া ৩৪ কোটি টাকার সদ্ব্যবহার করে তাহলে ঘরে ঘরে গিয়ে মশা মারার মত প্রসঙ্গের অবতারণা তাকে করতে হবে বলে মনে হয় না। অনেকেরই হয়তো মনে আছে, ডিসিসি নির্বাচনের সময় একাধিকবার রাস্তা ঝাড়– দিয়ে তিনি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। নির্বাচিত হতে পারলে ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বানানোর ঘোষণাও দিয়েছিলেন। মেয়র নির্বাচিত হয়ে বলেছিলেন ঢাকার উন্নয়নের জন্য এক হাজার কোটি টাকা পেয়েছি, আগামী ছ’মাসে ঢাকাকে বিদেশী শহরের মত বানিয়ে ফেলব। এরপর সাড়ে তিন বছরে সাতটা ছ’মাস গিয়েছে, কোথায় ঢাকা, কোথায় সিঙ্গাপুর আর কোথায় সেই এক হাজার কোটি টাকা! পত্রিকায় খবর এসেছে নিউইয়র্কে ইঁদুরের উৎপাত মারাত্নক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেখানকার মেয়র বিল ডি ব্লাসিও আমাদের মাননীয় মেয়রের মত বলতে পারতেন, ঘরে ঘরে গিয়ে ইঁদুর মারা কর্পোরেশনের কাজ না। জনগণ পারলে হ্যামিলনের বাঁশিঅলাকে ভাড়া করে আনুক। তিনি বরং ৩২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ইঁদুর নিধনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছেন। এবং সেখানকার জনগণ নিশ্চিত তাদের ৩২ মিলিয়ন ডলারের পরিণতি ঢাকার মশক নিধনের ৩৪ কোটি টাকার মত হবে না। আমাদের মেয়র সাহেব যে ঢাকাকে বিদেশী শহরের মত বানাতে চেয়েছিলেন, তার উপায় এখন দু’টি- হয় নিউইয়র্কের মেয়র আমাদের মেয়রের মত ঘরে ঘরে ইঁদুর মারার অসম্ভাব্যতা বয়ান করে হাত গুটিয়ে বসে যান অথবা আমাদের মেয়র তার মত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুন। আপনিই এক আবেগী ভাষণে বলেছিলেন, মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। ঢাকাবাসীকে মশার কবল থেকে উদ্ধার করে সেটার বাস্তবতা আপনি দেখিয়ে দিন। একথাও নিশ্চয়ই আপনাকে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই যে, ঢাকা শুধু গুলশান-বনানীরই নাম নয়। চিকুনগুনিয়া মহামারীর দায়দায়িত্বের একটা অংশ যে জনগণের ওপরও বর্তায় তা স্বীকার না করে উপায় নেই। নিজেদের আশপাশ ময়লা রাখলে সেখান থেকে মশাসহ নানারকম ক্ষতিকর পোকামাকড় ও জীবাণু উৎপাদিত হয়। মজার ব্যাপার হল চিকুনগুনিয়াবাহী মশা জন্ম নেয় পরিষ্কার পানি থেকে। এরা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে এবং এক সপ্তাহ সময় পেলে ডিম থেকে হড়হড় করে বাচ্চা বেরিয়ে পড়ে। সুতরাং বালতি, ফুলের টব, খোলা বোতল, টায়ার, ভবনের চৌবাচ্চা, মাটির গর্ত ইত্যাদি জায়গায় পানি জমতে না দিলে চিকুনগুনিয়ার হুমকি বহুলাংশে কমে যাবে। সেইসাথে ঘুমের মধ্যে মশার কামড় থেকে বাঁচতে মশারিসহ প্রয়োজনীয় উপায় অবলম্বন করতে হবে। জনদুর্ভোগ ও নাগরিক সমস্যাবলীর ক্ষেত্রে নিজেদের করণীয় ভুলে কেবল অন্যকে দোষারোপ করাও ঠিক না। আমরা যারা লাইনে গ্যাস না থাকার অভিযোগ করি, তাদেরই অনেকে আবার ১০ পয়সার একটা ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য সারারাত চুলাটা জ্বালিয়ে রাখেন। অসময়ে কাপড় ধুয়ে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে তা শুকাতে দেন। অনেকে বাসার বারান্দা দিয়ে ময়লার পোটলাটা নির্বিকারভাবে রাস্তায় ফেলে দেন। কলার খোসাটা ডাস্টবিনের বদলে রাস্তায় ফেলতে অনেকে বিশেষ আনন্দ পান। পান চিবুতে চিবুতে ঠিক ‘এখানে পানের পিক ফেলবেন না’ লেখার ওপর পিকটা ফেলে পুলকিত বোধ করেন। কোথাও দেয়ালে পোস্টার লাগাতে নিষেধ করলে পোস্টার লাগিয়েই ঐ বাক্যটা ঢেকে দিয়ে বীরত্ব ফলান। এই রকমের অনেক দৃষ্টান্তই তুলে আনা যাবে। এখন করণীয় হচ্ছে নেতৃত্ব ও জনগণ উভয়কে ভালো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্বটা সবার উপরে থাকলেও দেশ ও দশের যারা নেতা তাদের দায়িত্বটা এক্ষেত্রে একটু বেশি। কথায় আছে- الناس على دين ملوكهم ‘নেতার ধর্মই অনুসারীর ধর্ম’। কাজেই নেতাগণ যদি ‘সুধার্মিক’ হন অনুসারীরাও সে পথে চলবে- এই প্রত্যাশা নিশ্চয় অন্যায় হবে না।

 

advertisement